সোমবার, ২৭ জুন, ২০১৬

মাওলানা মুহিউদ্দীন খানঃ যেমন দেখেছি


আবুল হুসাইন আলেগাজী
২৬. ০৬. ২০১৬, রোববার



০১. বাংলা ইসলামী সাহিত্য ও সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃৎ Pioneer رائد, সাহসী লেখক, অনুবাদক ও প্রকাশক মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে আমার দুইবার দেখা হয়েছে। প্রথমবার ১৪১৮ (১৯৯৮) হিজরীর রমজানের শেষের দিকে আমার নিজের আগ্রহে বাংলা বাজারের মাসিক মদীনার কার্যালয়ে এবং দ্বিতীয়বার ২০০৭ এর শুরুর দিকে শ্রদ্ধেয় মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী সাহেবের আগ্রহে গেন্ডারিয়াস্থ তাঁর বাড়িতে। 

০২. আজ থেকে ১৯ বছর অগে যখন মাসিক মদীনার কার্যালয়ে মাওলানা খান সাহেবের সাথে অমার দেখা হয়, তখন বর্তমানে স্থগিত সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের (প্রতিষ্ঠাকাল ১৯৯০) স্বর্ণযুগ ছিল। আমি ১৯৯৪ এর প্রথম দিক থেকে এটির পাঠক ছিলাম। এটির প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি ছিলেন খান সাহেব নিজে। সম্পাদক ছিলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ ছেলে মোস্তফা মইনুদ্দীন খান। নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী। প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন ময়মনসিংহের মাওলানা শহীদুল ইসলাম। সেরা কলাম লেখক ছিলেন মরহুম সালেহ উদ্দীন আহমদ। তিনি 'আদব আলীর বেয়াদবি মাফ করবেন' শিরোণামে লিখতেন। তাছাড়া ঝিনাইদহের কবিতা সুলতানাও ভালো লিখতেন। 'সরল সত্য' শিরোণামের মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী সাহেবের লেখাগুলো ছিল অতুলনীয়।

০৩. তখন জিহাদ-কিতালের চিন্থায় মনটা অস্থির-বিক্ষুব্ধ থাকলেও বয়স ও জীবনচিন্তার ভার ছিল অনেক হাল্কা। হাটাচলা ও সফরে কষ্ট হতো না। মীরপুর থেকে রমজানের শেষের দিকে চট্রগ্রাম যাওয়ার পথে চিন্তা করলাম দাওরায়ে হাদীছে আমার ক্লাস ও রুম মেট মাওলানা বদরুল আলম হামিদীর (হাটহাজারীতে মাদরাসা সংলগ্ন একটি ভাড়া বাসায় আমরা দুইজন এক সাথে থাকতাম ও খেতাম) সাথে দেখা করবো। কারণ, তিনি বলেছিলেন তাঁর দাদা (শায়খে বরুনী) একজন বড় বুজর্গ ব্যক্তিত্ব ছিলেন এবং বরুনায় (শ্রীমঙ্গল) তাদের একটি বড় মাদরাসা রয়েছে। আছরের সময় মীরপুর থেকে বের হওয়ার সময় ঠিক করেছিলাম মৌলভী বাজারের গাড়িতে ওঠার আগে বাংলা বাজারস্থ মাসিক মদীনা, সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান ও মদীনা পাবলিকেশন্স কার্যালয় দেখে যাবো। বাংলা বাজারে পৌঁছুতেই ইফতারের সময় হয়ে গেল। একটি ছোট ছোলা-পিয়াজির দোকানে ইফতার করলাম। মাগরিব নামাজ শেষে মদীনার কার্যালয় খুঁজে বের করি। ওই কার্যালয়ে তখন মাসিক মদীনার চেয়ে সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের কাজই বেশি হতো। ওখানে ঢুকে দেখা হল মাওলানা উবাইদুর রহমান খান নদভী, পশ্চিমবঙ্গের জালাল উদ্দীন বিশ্বাস (তখন তিনি মুসলিম জাহানে কর্মরত ছিলেন) মাওলানা শহীদুল ইসলাম ও কবি আবদুল কুদ্দুস ফরিদীর সাথে। দাঁড়িয়ে ওলামায়ে দেওবন্দের কি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলতে দেখলাম আহমদ বদরুদ্দীন খানকেও। নদভী সাহেব তখন মাসিক জাগো মুজাহিদের উপদেষ্টা সম্পাদক ছিলেন। জানালেন, তিনি এটির সম্পাদকীয় লিখে দেন। কথা প্রসঙ্গে বললাম, আমি মাওলানা মুহিউদ্দীন খানকে দেখতে চাই। বললেন, ওই কক্ষে যান। গিয়ে সালাম দিলাম। তিনি তখন সম্ভবত মাসিক মদীনার প্রশ্নের উত্তর লেখায় ব্যস্ত ছিলেন। তারপরও আমার সালামের উত্তর দিয়ে বসতে বললেন। পিয়নকে চা আনার নির্দেশ দিলেন। চা খেলাম। পরে তিনি আমাকে কাছে রক্ষিত তাঁরই সঙ্কলিত 'হাদীসে রসূল' নামের একটি বই হাদিয়া দিলেন। এটি খান সাহেবের বড় আর্থিক মুহসিন মরহুম শিল্পপতি জহুরুল ইসলামের ভাই কামাল সাহেব তার ভাইয়ের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করছিলেন মাওলানা খানের মাধ্যমে। কোনো দোয়া বা নছীহত চাইতে নয়; শুধুমাত্র তাঁকে দেখতেই গিয়েছিলাম। তাই দেরি না করে বিদায় নিয়ে চলে এলাম। তবে প্রথম সাক্ষাতেই তাঁকে আমার একজন কর্মট ও ভালো মনের মানুষ বলে মনে হয়েছিল। হ্যা! আমি তখন জিহাদ-কিতালের চিন্তায় অনেকটক অস্থিরমনা হওয়ায় আমাদের আলেম সমাজসহ কারো রাজনৈতিক তৎপরতা অমার ভালো লাগতো না। এতে রিয়া ও হীনমন্যতার গন্ধ অনুভব করতাম । অবশ্য এখনো নিজে কোনো বিকল্প দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে না পারায় বর্তমানে নির্বোধ ও নিষ্ঠুর সালাফী খারেজী ছাড়া অন্য কারো সমালোচনা করতে উৎসাহ পাই না। তবে আমি বিক্ষুব্ধ জিহাদ-কিতাল প্রেমী তরুণদের খারাপ দৃষ্টিতে দেখি না। ওদের যে মাইন্ড ঘড়ে উঠছে, তা এ অস্থির ও জাহেলী সমাজের অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। ওরা মসজিদ-মাদরাসাসহ কোনো জায়গায় উপযুক্ত গাইড বা দিকনির্দেশনা না পাওয়ায় এরকম ক্ষুব্ধ ও সমালোচক হয়ে উঠছে।

০৪. মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের সাথে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছে ২০০৭ এর শুরুর দিকে গেন্ডারিয়াস্থ তাঁর মালিকানাধীন বাড়িতে। তখন আমি ফরিদাবাদ মাদরাসার মালিকানাধীন গেন্ডারিয়াস্থ ভবনটির লাইনে একটি বাসায় থাকতাম। পথে দেখা পেয়ে একদিন ওখানে সাদা মনের মানুষ চট্রগ্রামের প্রবীন লেখক ও গবেষক মাওলানা আবদুর রহীম ইসলামাবাদী সাহেবকে নিয়ে গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। ঢাকায় থাকাকালে তিনি খান সাহেবের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। ওই সময় ওখানে আসা-যাওয়ার পথে তিনি মাঝেমধ্যে আমার বাসায়ও যেতেন। একদিন সন্ধ্যায় তিনি আমাকে বললেন, 'চলো তোমাকে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই। তোমার অনুবাদ করা বই তাঁকে হাদিয়া দাও। তোমারই উপকার হবে।' আমি বললাম, আমিতো অন্য চিন্তার মানুষ। তিনি বললেন, 'তারপরও চলো।' মহানুভব মুরুব্বী মানুষের কথা শোনে আমার অনুবাদ করা শহীদ ডঃ আবদুল্লাহ আযযামের 'পাশ্চাত্য ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্র' বইটি নিয়ে গেলাম। খান সাহেবকে হাদিয়া দিলাম। তিনি তখন পড়াতে ব্যস্ত ছিলেন। জিহাদ-কিতাল ও তাগুতবিরোধী চিন্তায় আসক্ত ও অস্থির থাকায় এবারও তার কাছে কোনো ব্যাপারে প্রশ্ন করতে উৎসাহবোধ করিনি। চা খেয়ে বাসায় চলে এলাম।

০৫. পুরানা পল্টনের নোয়াখালী টাওয়ারের দ্বিতীয় তলায় খান সাহেবের একটি অফিস ছিল। সাথে মদীনা পাবলিকেশন্সের বিক্রয় কেন্দ্র ও মদীনা গ্রাফিক্সের অফিসও। এতে তাঁর ছোট ছেলে আহমদ বদরুদ্দীন খানও বসতেন। আমি খুব কম সময়ই ওই টাওয়ারে যেতাম। একদিন আছরের সময় গিয়ে মাওলানা খান সাহেবকে তাঁর কার্যালয়ের সাদা কাপড় বিছানো ফ্লোরে কাঁত হয়ে শোয়া অবস্থায় দেখলাম। দৃশ্যটি আমার খুব ভালো লাগলো। কারণ, মহান ব্যক্তিরা এরকম সহজ-সরলই হয়ে থাকেন। তাদের মাঝে থাকে না কৃত্রিমতা ও গৌরব-অহঙ্কার। ২০০৯ সালে খান সাহেবের ওই কার্যালয়ে তাঁরই নামে আমার দুইটি বই (কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট করা) পাঠিয়েছিলাম। খান সাহেবের সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে ১৯৯৯ ও ২০০০ সালে আমার কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। একই ভাবে মাসিক মদীনার ২০০০ সালের বড় আকারের সীরাত সংখ্যাটিতেও আমার প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এরপর সেটির ২০০৬ সালের জুলাই সংখ্যায় জিকিরের গুরুত্ব ও ফজিলতের উপর লেখা আরেকটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। 

০৬. মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সারাদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিত হয়েছিলেন ১৯৯৪ সালের নাস্তিক বিরোধী আন্দোলনের সময়। তখন তিনি সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের শীর্ষ নেতাদের একজন ছিলেন। এটি তখন ২০১৩ এর হেফাজতে ইসলামের ভূমিকায় ছিল। মাওলানা মুহিউদ্দীন খান মোল্লা ওমরের তালেবানেরও সমর্থক ছিলেন। ১৯৯৬ এর ২৭ সেপ্টেম্বর তালেবান কাবুল দখল করার পর সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানে তাদের সমর্থনে সম্পাদকীয়সহ একাধিক লেখা প্রকাশ করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে মুসলিম জাহানে প্রকাশিত মাওলানা মুহিউদ্দীন খানের 'ওসামা বিন লাদেনঃ একজন অকুতোভয় মুজাহিদের আলেখ্য' শীর্ষক লেখাটি পড়েই আমি সৌদি জিহাদী মার্চেন্ট শায়খ ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে সর্বপ্রথম ধারণা লাভ করেছিলাম। দেওবন্দী আলেম না হয়েও আকাবিরে দেওবন্দের প্রতি ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং দেশের কওমী আলেমদের সাথে উত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে তাদের মন জয় করে নিয়েছিলেন মাওলানা মুহিউদ্দীন খান। তাঁর কর্মদক্ষতা ও সাহস দ্বারা লাখো-কোটি মুসলমান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে উপকৃত হয়েছে। সীরত সাহিত্যসহ ইসলামের বিভিন্ন দিককে কলমের মাধ্যমে উপস্থাপনের কঠিন কাজে তাঁর কীর্তি অতুলনীয়। মাসিক মদীনা ও সাপ্তাহিক মুসলিম জাহানের পাশাপাশি মদীনা পাবলিকেশন্সের মাধ্যমেও তিনি মানুষের সামনে ইসলামের বাণী তুলে ধরতে বিশাল যোগ্যতার স্বাক্ষর রেখেছেন। বাংলার ইসলামী ব্যক্তিত্বদের ইতিহাসের পাতায় তাঁর নামটি অনেক উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত তাঁর অন্যতম সেরা কীর্তি মাসিক মদীনা দীর্ঘজীবি হোক। আল্লাহ তাঁকে স্বীয় রহমত ও মাগফিরাতের চাদরে আবৃত করে রাখুন। 


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন