লিখেছেন সাফওয়ানা জেরিন
কিছুদিন আগে একটা ছবি দেখেছিলাম। “Not without my daughter” নামক একটি ছবি। অনেকেই হয়তো বিখ্যাত এই ছবিটির নাম শুনে থাকবেন। ইরানের ইসলামী বিপ্লব অবলম্বনে নির্মিত এই ছবিটি। বেটি নামক একজন আমেরিকান মহিলা এই ছবিতে নায়িকা, ছবিতে দেখা যায় বেটির বিয়ে হয় এক ইরানি ছেলের সাথে যার নাম মাহমুদী । মাহমুদী অনেক ভুলিয়ে বেটিকে ইরানে নিয়ে আসে। সেই সময় ইরানে বাধ্যতামূলক সবাইকে হিজাব পরতে হতো এবং একই ধারাবাহিকতায় বেটিকেও হিজাব ধারণ করতে হয়। একজন খ্রিস্টান মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও ইরানে থাকাকালীন পুরো সময়টাই তাকে বড় আবায়া পরে থাকতে হয়, যা তার জন্য একটা বন্দিত্ব বটে। শুধু তার জন্যই না, তৎকালীন সময়ের আলোচিত সেকুলার ইরানি নারী শিরিন এবাদির বই- Iran awaking এও রাষ্ট্রীয়ভাবে চাপিয়ে দেওয়া এই পোশাককে বোঝা হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
সে যাই হোক! মূল কথা এই যে, পোশাক বিশ্বাসের শক্তি বহন করে। আপনি কি বিশ্বাস করেন? মুসলিম হিসেবে ধর্মকে কতোটুকু মানেন সেটা আপনার পোশাকেই প্রকাশ পায়। কিন্তু আলোচিত উদাহরণে বেটি কিংবা শিরিন এবাদিরাও তো হিজাব পরেছেন, তবে সেটা কোন বিশ্বাসের ধারক হিসেবে নয়। পরতে হবে তাই পরেছে। তাই বলে নিশ্চয়ই আপনি বলবেন না, বেটি মাহমুদী হিজাব পরেই মুসলিম হয়ে গেছেন! কারণ, মুসলিম মাত্রই আমরা জানি, শুধু মাত্র আচার নিষ্ঠায় নয়, মনে প্রাণে তার বিশ্বাসকে ধারণ করা এবং তা কাজে পরিণত করা।
তাই তো বলা হয়- “Change first happens in mind, then reflect in action” সুতরাং, যে পরিবর্তন মন থেকে শুরু হয় না, সে পরিবর্তনে বাহ্যিকতার প্রকাশ শুধুমাত্র বস্তুবাদিতার লোক দেখানো রূপ ছাড়া আর কিছুই না। ইদানিং হিজাবের প্রকৃতরূপ থেকে বিচ্যুতি, বিকৃতি নিয়ে অনেক লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত সমস্যার সমাধান আসলে কেউই বলতে পারছেন না। উল্টো সমাধানের চেয়ে বিশেদ্গার করে পর্দা সম্পর্কে নেতিবাচক জনসমর্থন গড়ে তোলার অপচেষ্টা চলছে মাত্র।
প্রথমতঃ এই দেশে প্রকৃত পর্দা থেকে বিচ্যুতির যে কারণ ঘটেছে তার পেছনে পুরো সমাজই কিছুটা হলেও দায়ী। একটা সময় কলসি বোরখা, গোল বোরখা পড়া হতো, এখন সেগুলোর চল নেই বললেই চলে। কিংবা আমি এও বলবো না যে সেগুলোই যথার্থ পর্দার রূপ ছিল। কিন্তু, আমরা কি দেখেছি? পর্দানশীল মেয়েদের পদে পদে শুধু বাঁধাই সৃষ্টি করেছে সমাজ। ভাইভা বোর্ড থেকে শুরু করে ইউনিভার্সিটির প্রবেশপথ, মেধা তালিকায় প্রথম হওয়া সত্ত্বেও টিচার না হতে পারা, কর্পোরেট লাইফে ঠাই না পাওয়া। প্রতিযোগিতায় পর্দানশীলরা কেন পেরে উঠবে লাস্যময়ী ললনাদের সাথে? বসের মনোরঞ্জনে তো তাদের সঙ্কীর্ণ হবার কথা কারো অজানা নয়! তাই না?
যেখানে নারী সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন , যেখানে নারীর চাকুরী মানেই বসের টোপ গেলা মাছ, সেখানে পর্দানশীল মেয়েদের জন্য সমাজের গঠনমূলক জায়গাগুলোতে অবস্থান বানিয়ে নেওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা কারা? কই! যখন মেয়েদের স্কুলে ফুল হাতা জামা কেঁচি দিয়ে কাঁটা হয়, যখন ইউনিভার্সিটিতে হিজাব নিয়ে ঢুকতে দেওয়া হয় না, যখন ভাইভা বোর্ডে, ক্লাসের ডায়াসে ডাকিয়ে শুধুমাত্র প্রকৃত পর্দা করার অপরাধে অপমানিত করা হয়, তখন তো কাউকে দেখা যায় না তাদের পাশে দাড়াতে!!! প্রকৃত পর্দার জন্য মায়াকান্না করতে! তখন বরং কোমর বেঁধে নেমে পড়ে কেউ কেউ, বোরখা কীভাবে নারীকে বন্দী করেছে? কীভাবে স্বাধীনতা হরণ করেছে?
অথচ, আজ এই নারী স্বাধীনতার যুগে হিজাব পরে এমন একটি মেয়েকে জিজ্ঞেস করে দেখুনতো – তাকে কে জোর করে হিজাব পরতে বাধ্য করেছে? এমনই যখন সমাজের প্রতিকূল চালচিত্র, তখন পর্দাপ্রিয় হিজাবীরা ধীরে ধীরে পর্দার ধরণে পরিবর্তন আনতে শুরু করলো। আর এই পরিবর্তনে আমরা হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম, হিজাব অনেক ব্যাপকতা পেলো। কারণ মেয়েদের মধ্যে একটা নিরাপত্তার আনন্দ তৈরি করে দিয়েছিল এই হিজাব। আর যখন কোন কিছু সমাজে হুট করেই খুব বেশী ব্যাপকতা পায়, তখন অনেক মানুষ ধারণ করার কারণে কিছুটা বিকৃতি দেখা দেয় তাতে। আর সঠিক প্রচার এবং শিক্ষার অভাবে এই বিকৃতি একটা সময় মহামারী আকার ধারণ করে। সে ক্ষেত্রে বিকৃতিকে শুধরানোর জন্য সঠিক ধারণার চর্চার বিকল্প নেই। কিন্তু তথাকথিত সুশীলদের বক্তব্য হল- মাথা ব্যাথা তো মাথাই কেটে ফেলি ।
“Not without my daughter” ছবিটির কথা বলছিলাম। ওখানে ইরানেই বেটির সাথে এক আমেরিকান কনভার্টেড মুসলিম মেয়ের দেখা হয়। বাসায় যাওয়ার পরে সেই মহিলা রান্না ঘরে গিয়ে হিজাব খুলে ফেলে। দৃশ্যটাকে হলিউডের এই ছবিটাতে এমনভাবে দেখানো হল- যেন সে কি একটা আজাব থেকে মুক্তি পেলো! অথচ- সে কিন্তু জেনে বুঝে কুরআন মেনে মুসলিম হয়েছে! এই যে দেখার কিংবা দেখানোর দৃষ্টিভঙ্গি! এতেই কিন্তু বোঝা যায় ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির প্রতি আপনি কতোটুকু বায়াস।
কিন্তু কেউ যদি প্রকৃত মুসলিম হিসেবে এই সব হিজাবীদের দেখে লজ্জাই পান, তাহলে তার উচিৎ ছিল প্রকৃত পর্দা কি বা তা কতোটা সুন্দর তা আগে তুলে ধরা, সেই সাথে তুলে ধরা এর বিকৃতিতে তাদের কষ্টের মায়াকান্নার স্বরূপও। শুধু বিশেদ্গার করেই ক্ষান্ত হলে কিভাবে হয়?।
অথচ সুন্দরী প্রতিযোগিতায় আপনাদেরই সামনে কেউ বিচারক হয়ে যখন একটা মেয়ের শরীরের ইঞ্চি ইঞ্চি মাপে তার মানুষ হবার শ্রেষ্ঠত্বকে পরিমাপ করে ফেলে, যখন এই আপনাদেরই সামনে শুধুমাত্র রূপের প্রচারণার মাধ্যমে নারীকে পণ্য বানানোর মানসিকতা হাজার হাজার কালো মেয়ের জীবনে অভিশাপ হয়ে নেমে আসে, যখন এই আপনাদেরই সামনে উন্মুক্ত রূপ প্রদর্শনের কারণে আরেক মেয়ের ঘর ভাঙ্গে তখন কোথায় থাকে আপনাদের এইসব মায়াকান্না??? তখন যতো দোষ নন্দ ঘোষ সব পুরুষের।
হিজাব ব্যাপকতা পেয়েছে এটা অবশ্যই একটি ইতিবাচক ব্যাপার। প্রত্যেক ইতিবাচক পরিবর্তন কিছু বিচ্যুতি, বিকৃতিও সাথে করে নিয়ে আসে। যেমন তথ্য প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে অনেক সহজ করেছে, আবার নৈতিক বিকৃতিরও দুয়ার খুলে দিয়েছে। কিন্তু তাই বলে আমরা প্রযুক্তিকে পরিত্যাগ করি না। ঠিক তেমনি হিজাবের এই ইতিবাচক বিকাশে বিকৃতির জন্য হিজাবের প্রয়োজনীয়তাকেও অস্বীকার করতে পারবো না। বরং হিজাবের প্রকৃত তাৎপর্য আর বিশ্বাসের আধেয় তুলে ধরার এখনই সময়। ফ্যাশন হাউজগুলো ঠিক করে দেয় আপনি কি পরবেন? কি করবেন?
প্রকৃত হিজাবের ফ্যাশন ট্রেন্ড তৈরি, কিংবা বিশ্বাসের সাথে যায় এমন যুগোপযোগী পর্দার পোশাক কিংবা রোল মডেল মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য আপনি আমি কি করেছি? কিংবা শুধু যে টাইট ফিট জিন্স আর মুখে দস্তুরমতো মেকআপ লাগালেই ফ্যাশনেবল হওয়া যায় না, তার কি বিকল্প আমরা তুলে দিয়েছি নারী সমাজের হাতে। ঢিলেঢালা মার্জিত বোরখা হিজাব এখন সময়ের চাহিদা। যা সতর ঢেকে, বিশ্বাস সংরক্ষণ করে, পর্দার উদ্দেশ্য পূরণের সাথে সাথে সময়, পেশাগত ও আভিজাত্যের ধারা ও অক্ষুণ্ণ রাখতে পারে। এখনই সময় এমন বিকল্প তৈরি করার, এমন হিজাব নিয়ে ভুল মতবাদের প্রচারণা তুঙ্গে ওঠার আগেই।
লেখকঃ কবি ও সাহিত্যিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন