পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সাহিত্য সংস্কৃতি তমুদ্দুন মজলিস ছিল একটি বিপ্লবী নাম। ভাষা আন্দোলনে মজলিসের মুখপত্র ‘সৈনিক’ পত্রিকার এক গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রথম প্রস্তাবক।
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯১১ সালে রংপুরে মুসলিম প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে তখনকার রক্ষণশীল পরিবেশেও বাংলাভাষার পক্ষে বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখেন। তিনি যুক্তি সহকারে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার জোর সুপারিশ করেন।
(তথ্য : সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, ডক্টর আলী নওয়াজ, অগ্রপথিক, ১২ মার্চ, ১৯৮৭।)
‘বিশ্বভারতীয়’ অনুষ্ঠিত এক সভায় রবীন্দ্রনাথের হিন্দি ভাষার পক্ষে এবং ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাভাষার দাবি পেশ করেন।
১৯১৮ সালে ‘বিশ্বভারতীয়’ অনুষ্ঠিত এক সভায় ভারতের সাধারণ ভাষা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের হিন্দি সম্পর্কিত প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধের মাধ্যমে বাংলাভাষার দাবি পেশ করেন। সে সভায় সভাপতিত্ব করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ।
সুত্র - ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর প্রবন্ধটি সমকালীন ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। (১ম বর্ষ, ১ম খণ্ড, বৈশাখ-১৩২৭/১৯২০ খ্রি.)।
১৯২১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের কাছে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লিখিতভাবে দাবি উত্থাপন করেন সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী। দাবিনামায় তিনি লেখেন, ভারতের রাষ্ট্রভাষা যাই হোক, বাংলার রাষ্ট্রভাষা করতে হবে বাংলাকে। ১৯৩৭ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন, ‘সাহিত্যের মধ্যে বাংলা সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ। বাংলাভাষায় বিবিধ ভাব প্রকাশের উপযোগী শব্দের সংখ্যাই বেশি। অতএব বাংলাভাষা সব দিক দিয়েই ভারতের রাষ্ট্রভাষা হইবার দাবি করিতে পারে। মহাত্মাগান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করিবার প্রস্তাব করিয়াছে বটে, কিন্তু এ বিষয়ে বাংলাভাষার চেয়ে হিন্দীর যোগ্যতা কোনদিক দিয়াই বেশি নেই।’
(তথ্য : সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, ডক্টর আলী নওয়াজ, অগ্রপথিক, ১২ মার্চ, ১৯৮৭।)
সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ১৯১১ সালে রংপুরে মুসলিম প্রাদেশিক শিক্ষা সম্মেলনে তখনকার রক্ষণশীল পরিবেশেও বাংলাভাষার পক্ষে বলিষ্ঠ বক্তব্য রাখেন।
১৯৩৭ সালে মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, দৈনিক আজাদ-এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলেন, ‘সাহিত্যের মধ্যে বাংলা সমস্ত প্রাদেশিক ভাষার মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে তমুদ্দুন মজলিসের মাধ্যমে।
১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের উদ্যোগে এবং নেতৃত্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষকের সহযোগিতায় ভাষা আন্দোলনের এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক।
(তথ্য : ভাষা আন্দোলনের ডায়েরী, মোস্তফা কামাল, পৃ-১৩)
১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার দু’বছরের মধ্যেই কলকাতা ও ঢাকায় যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি ও পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নামে দুটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান দুটির বিভিন্ন সভায়ও বহুবার বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার কথা আলোচিত হয়।
ভাষা আন্দোলনে অধ্যাপক গোলাম আজম
১৯৪৭ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পূর্ব পাকস্তিান সফরে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়াম মাঠে এক ছাত্রসভায় অংশগ্রহণ করেন। তখন ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য দাবি সম্বলিত এক ঐতিহাসিক স্মারকলিপি প্রদান করা হয়। ডাকসুর তৎকালীন জি এস অধ্যাপক গোলাম আযম স্মারকলিপিটি পাঠ করেন এবং হস্তান্তর করেন।
তমুদ্দুন মজলিস-এর উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত
১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবুল কাসেমের সম্পাদনায় তমুদ্দুন মজলিস-এর উদ্যোগে পাকিস্তানের ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু শিরোনামে একটি পুস্তিকা বের হয়। তখন তমুদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদও গঠিত হয়। এ পরিষদ নানা সভা-সমাবেশের মাধ্যমে বাংলাভাষার দাবি তুলে ধরার চেষ্টা করে।
কবি ফররুখ আহমদ বাংলার সমর্থনে ব্যঙ্গ সনেট রচনা করেন।
রেনেসাঁ সোসাইটির উৎসাহী সমর্থক কবি ফররুখ আহমদ বাংলার সমর্থনে এবং এক শ্রেণীর উর্দু প্রেমিক বঙ্গ সন্তানদের তীব্র সমালোচনা করে ‘উর্দু বনাম বাংলাভাষা’ শীর্ষক ব্যঙ্গ সনেট রচনা করেন। এই সনেটটি ১৩৫২ বাংলা সনের জ্যৈষ্ঠ মাসের সংখ্যায় মাসিক মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হয়।
১৯৪৩ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদের সম্মেলনে সংসদের সভাপতি সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যের বাহন হবে বাংলাভাষা এ প্রশ্ন বহু পূর্বেই চূড়ান্তভাবে মীমাংসিত হয়ে গেছে।’
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মজলিসের উদ্যোগে ঢাকায় পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট এবং প্রদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১১ মার্চ একটি মাইলফলক। এ ধর্মঘটের কারণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন এগিয়ে আসেন এবং রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৭ দফা চুক্তিতে আবদ্ধ হন। এ চুক্তিতে উর্দুর সাথে সাথে বাংলাভাষাকেও সমান মর্যাদা প্রদান এবং পূর্ববাংলার সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে চালু করার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।
১১ মার্চ থেকে ২১ মার্চের মধ্যেই পাল্টে গেল দৃশ্যপট। ২১ মার্চ পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে এলেন। তখন তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের কার্জন হলে আয়োজিত বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। কায়েদে আযমের এ ঘোষণা ছিল এ তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মাতৃ ভাষার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আঘাত। তাই ঘোষণার বিরুদ্ধে গর্জে উঠল দেশ। ফের শুরু হলো ভাষার আন্দোলন।
এরই মধ্যে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হলো নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ঢাকা অধিবেশন। এখানে বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন পুনরায় ঘোষণা করলেন : উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। দেশের মানুষ আরেকবার হতাশ হলো। তারা আর স্থির থাকতে পারল না। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার প্রতিবাদে আবার জেগে উঠল দেশ। ৩০ জানুয়ারি ঢাকায় পালিত হলো প্রতিবাদ দিবস।
৩১ জানুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ এবার জাতীয় পর্যায়ে গিয়ে গঠিত হলো সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ নামে। শুরু হলো নতুন উদ্যমে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ প্রদেশব্যাপী ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করল। অথচ সরকার জনগণের এ দাবিকে নস্যাত করার জন্য একই দিন ঢাকা শহরে, শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ ঘোষণা করল এবং জারি করল ১৪৪ ধারা। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বাধা আসে পুলিশের।
পুলিশী আক্রমনে এতে ৩ জন ছাত্রসহ ৪ ব্যক্তি নিহত হন এবং গ্রেফতার হন ৬২ জন। পুলিশের গুলিতে যারা শহীদ হন তারা হলেন, রফিক উদ্দিন আহমদ (মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র), আবদুল জব্বার (গ্রামীণ কর্মচারী), আবুল বরকত (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এম এ কাসের ছাত্র) এবং আবদুস সালাম (শুল্ক বিভাগের পিওন, আহত অবস্থায় ৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন)। ২২ তারিখ নিহতদের গায়েবানা জানাজা ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার পর লক্ষাধিক মানুষের এক বিশাল শোভাযাত্রা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। এ ঘটনার পর ক্ষমতাসীন সরকারের ক্ষমতার ভিত নড়ে ওঠে। আমরা পেয়ে গেলাম বাংলা ভাষার সম্মান।
বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে মর্যাদার ইতিহাস।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর জাতিসংঘের ইউনিসেফের এক বৈঠক বসে প্যারিসে। সভার ১৮৮ জন সদস্যের সমর্থনে আমাদের ভাষা সেদিন অমর মর্যাদা লাভ করে। এর আগে বিশ্বের ২৮টি দেশ বাংলাভাষাকে সাতিসংঘে উত্থাপনের সমর্থন জানায়। বাংলাভাষা আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন