শুক্রবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

শুদ্ধ ভাষার আন্দোলন

আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টি করে তাকে যে সব অমূল্য নেয়ামত দান করেছেন তার অন্যতম হল ভাষা। ভাষার মাধ্যমে মানুষ নিজের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশ করতে পারে। সাহিত্য সৃষ্টি, মানব-সভ্যতার বিকাশ, ও সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের জন্য ভাষাই প্রধান অবলম্বন। পৃথিবীর সব জ্ঞান-বিজ্ঞান, সভ্যতা-সংস্কৃতি, ধর্ম-ইতিহাস ধারণ করে আছে ভাষা। তাই ভাষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। কোরআনে কারিমে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, তিনি সৃষ্টি করেূেছন মানুষ এবং তাদেরকে দিয়েছেন ভাব প্রকাশের জন্য ভাষা। (সুরা আর রহমান,আায়াত-২-৩) ভাষা আল্লাহ তায়ালার বিশেষ নেয়ামত। এই নেয়ামত আল্লাহ তায়ালা বিশুদ্ধভাবে আমাদেরকে দান করেছেন । কোরআনসহ পৃথিবীর সব ধর্মগ্রন্থ বিশুদ্ধ ভাষায় নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর কাছে রাসুল বা বার্তা বাহক পাঠিয়েছেন। তারা বিশুদ্ধ ভাষায় আর্বিভূত হয়েছেন । বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলেছেন। বিশুদ্ধ ভাষায় আল্লাহর বিধান বা দ্বীন প্রচার করেছেন। পৃথিবীর এমন কোনো জনপদ বা জনগোষ্ঠী নেই যেখানে আল্লাহ তায়ালা তার বাণী বাহক এবং আসমানি কিতাব বা সহিফা অবতীর্ণ করেননি। তবে সব বার্তা বাহক ছিলেন বিশুদ্ধভাষী। সব আসমানি কিতাব ছিল সংশ্লিষ্ট জাতির বিশুদ্ধতম ভাষায়। তাই বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা ইসলামেরই দাবী, এবং নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একটি দায়েমী সুন্নত। নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বদা বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলতেন। সাহাবায়ে কেরাম অশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করলে তিনি তা শুধরে দিতেন। একবার এক সাহাবি রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে ‘আ-আলিজু?’ বলে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইলেন। শব্দটির অপপ্রয়োগ হওয়ায় রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা শুদ্ধ করে দিয়ে বললেন তুমি ‘আ-আলিজু?’ এর স্থলে ‘আ-আদখুলু?’ বল। মুসলিম শরিফের একটি হাদিসে আছে , সাহাবায়ে কেরাম আঙ্গুরকে ‘করম’বলতেন। রাসুলে করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লম তা ঠিক করে দিয়ে ‘করম’ এর স্থলে ‘ইনাব’ বলার নির্দেশ দিয়েছেন। হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আঙ্গুরকে ‘ইনাব’ বল না’। (মুসলিম শরিফ, হাদিস নং ৬০০৫)। অনুরূপ ইশা নামাজকে ‘আতামা’ না বলে ‘ইশা’ বলার নির্দেশ দিয়েছেন। মসান্নাফে ইবনে আবি শায়বায় বর্ণিত আছে, হযরত সা’রা (রাঃ) বলেন, আমি সালিম (রাঃ)কে বলতে শুনেছি, তোমরা ইশাকে ‘আতামা’ বল না। এ ছাড়া ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে শব্দের সুপ্রয়োগ-অপপ্রয়োগ ও শব্দ প্রয়োগের কুশলতা সম্পর্কে শিক্ষা দান করেছেন।
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন আরবদের মাঝে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী। তিনি ঘোষণা করেছেন ‘আমি আরবদের মধ্যে সবচেয়ে বিশুদ্ধভাষী’। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুখ নিসৃত বাণীই হল হাদিস। আরবি সাহিত্য ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছে এই হাদিস। কোরআনের পর আরবি সাহিত্যে হাদিসের অবস্থান। কোরআন ও হাদিসের মত সাহিত্য এখনো সৃষ্টি করতে পারেনি আরবরা। ভবিষ্যতে ও পারবেনা। আল কোরআন চ্যলেঞ্জ করেছে, কোরআনের মত একটি সুরা ও কেউ সৃষ্টি করতে পাারবেনা। আরবরা সেই চ্যলেঞ্জ গ্রহণ করেছে। এটা সেটা তৈরি করেছে। কিন্তু সেগুলো কোরআনের সাহিত্যে মানুত্তীর্ণ হয়নি ।
ভাষার বিশুদ্ধতা দাওয়াতি কাজে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে ভাষার বিশাল দখল রয়েছে। যে কোনো দেশে ও সমাজে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সে দেশের মানুষের ভাষা ও সাহিত্যে র্পূণ পারদর্শিতা পূর্বশর্ত। বলা যায় যে, দাওয়াতি কার্যক্রমকে আবেদনময়ী ও মর্মস্পর্শী করে তোলে ভাষা। এইজন্যই মহান আল্লাহ তায়ালা দাওয়াতি কার্যক্রমকে বেগবান, প্রানবন্ত ও সচল করার জন্য আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামকে স্বজাতির ভাষায় ব্যুৎপত্তি ও পূর্ণ দক্ষতা দিয়ে পাঠিয়েছেন। সমস্ত আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের ন্যায় আমাদের নবী হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দাওয়াতি কার্যক্রম করত গিয়ে বহু বিদগ্ধ ভাষাজ্ঞ ব্যক্তিদের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনো অশুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করেননি; বরং তিনি প্রতিপক্ষকে হৃদয়ষ্পর্শী আবেদনময়ী বর্ণনাশৈলীর মাধ্যমে কপোকাত করেছেন। ভাষায় যদি বিশুদ্ধতা ও আবেদনময়তা না থাকে তবে সম্বোধিত ব্যক্তির মন-মননে ও মেজাজে দাগ কাটতে সক্ষম হয় না। মনে কোনো ধরণের রেখাপাত করে না। সে হিসেবে বিশুদ্ধ ভাষার শক্তি বহুগুণে বেশি। পারমাণবিক অস্ত্র দ্বারা দেশ ধ্বংস করা যায়, দেশ দখল করা যায় তবে মানুষের মন-মনন দখল করা যায় না। ভাষায় যদি থাকে বিশুদ্ধতা ও আবেদনময়তার গুণ তবে সে ভাষা দ্বারা মানুষের মন জয় করা অতি সহজ। ভাষা মানুষের মনের ওপর কর্তৃত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম। এই জন্যই হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, ‘কিছু কিছু কথায় জাদু আছে।’ হজরত মুসা (আঃ) এর মুখে জড়তা ছিল তাই তিনি তার ভাইকে সহযোগী হিসেবে তার সঙ্গে পাঠানোর জন্য আবেদন করলেন। কারণ তিনি ছিলেন সাবলীলভাষী। সুতরাং বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলা ও সম্বোধন করার গুরুত্ব বুঝানোর জন্য এর বাইরে আর কিছু বলার প্রয়োজন হয় না।
আমরা সর্বক্ষেত্রে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণ করি। কিন্তু ভাষার প্রশ্ন এলে আমরা তার অনুসরণ করতে রাজি নই। এমনকি রাজি নই বিশুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ করতেও। বিজ্ঞ আলেমদেরকে বিশুব্ধ ভাষায় কথা বলতে দেখা যায় না। অশুদ্ধ-বিশুদ্ধ মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মতো কথা বলেন তারা। ভাষা দিয়ে তাদেরকে সাধারণ মানুষ থেকে পৃথক করা যায় না। অপর দিকে আমাদের সমাজের এক শ্রেণীর আলেমদের ধারণা , বাংলার পরিবর্তে আমাদের উর্দু চর্চা করা উচিত। কেননা বাংলার চেয়ে উর্দু সমৃদ্ধ ভাষা। তাছাড়া আরবির পর উর্দুই ইসলামের ও ইলমে নববির সবচেয়ে নিকটের ভাষা। এই শ্রেণীর আলেমদের জানা উচিত যে, মুসলমানদের ধর্মীয় ভাষা আরবির পর পৃথিবীর যে কোনো ভাষার মর্যাদা সমান। কোনো জনপদ বা জনগোষ্ঠী হিসেবে কোনো ভাষার বিশেষ মার্যাদা নেই। বরং চর্চার মাধ্যমে যে ভাষা যত উৎকর্ষতা অর্জন করতে পারে, সে ভাষার মার্যাদা তত বেশি। পৃথিবীর অনেক ভাষা চর্চার অভাবে মৃত ভাষায় পরিণত হয়েছে। উর্দু ভাষাভাষীগণ চর্চার মাধ্যমে তাদের ভাষাকে উৎকর্ষতা দান করেছে ও ইসলামের কাছে নিয়ে গেছে, তাই উর্দু আমাদের ভাষার তুলনায় সমৃদ্ধ ও ইসলামের কাছের ভাষা। অপর দিকে আমরা আমাদের ভাষাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করতে পারিনি, হিন্দুদের ভাষা বলে তার সঙ্গে শুধু বিমাতাসূলভ আচরণ করেছি, তাই আমাদের ভাষা তাদের মত সমৃদ্ধ হয়নি। আমরা আমাদের ভাষাকে ইসলামের ও ইলমের ভাষা বানাতে পারিনি। এটা আমাদেরই ব্যর্থতা। আমরা বিশুদ্ধ বাংলা বলতে বা লেখতে ততটুকু আগ্রহী নই যতটুকু আগ্রহী বিদেশী ভাষার শুদ্ধতার প্রতি। আমাদের চারপাশে প্রতিদিন যে সব বাংলা বলা বা লেখা হয়, তার বড় একটি অংশ অশুদ্ধ। সাইনবোর্ড লেখা হয় অশুদ্ধ বানানে। পত্রিকা লেখা হয় অর্ধশুদ্ধ বাংলায়। বিজ্ঞজনদের কথাবার্তায় অশুদ্ধতার ছড়াছড়ি। রক্ত দিয়ে আমরা ভাষা অর্জন করলেও ভাষার যথাযথ মর্যাদা আমরা দিতে পারিনি। ভাষা আন্দোলনের দাবী ছিল সর্বত্র বাংলার প্রচলন ঘটানো। কিন্তু ৬১ বছর পরও তা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত শ্রেণী এখনো বাংলা বলতে স¦চ্ছন্দ বোধ করেন না। তারা বরং ইংরেজী বা অর্ধ বাংলা বলেই আনন্দ বোধ করেন। উচ্চবিত্তের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে গর্ব বোধ করে। যে দেশের মানুষ বাংলার জন্য রক্ত দিয়েছে সে দেশেই বাংলা উপেক্ষিত। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আরো একটি আন্দোলন দরকার। তবে সেটার নাম হবে শুদ্ধ ভাষার আন্দোলন। আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সেরকম একটি আন্দোলন করার তাওফিক দিন। আমীন।
-মুফতি মুহাম্মাদ শোয়াইব

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন