যুগে যুগে মহামনিষীগনই ইসলামের জন্য অনেক ত্যাগ দিয়েছেন। যাঁর সম্পর্কে পূর্ব বক্তাগণ আলোচনা করেছেন, কুতুব যামান আলহাজ শাহ মুহাম্মদ ইউনুস (রহ.)। তিনি এ জামিয়া পটিয়ার দ্বিতীয় মুহতামিম। তাঁকে ছাত্র অবস্থায় তার মুরশিদ মাওলানা জমির উদ্দিন (রহ.) খিলাফত দান করেছেন। হযরত মুফতী আজিজুল হক (রহ.) ১৯৬০ সালে ইন্তিকাল করেন। ইন্তিকালের চার বছর আগে হাজী ইউনুস (রহ.)-কে মুহতামিম নিযুক্ত করেন। পটিয়া মাদরাসার বার্ষিক সভায় মুফতী সাহেব হুযুর (রহ.) হাজী সাহেব হুযুর (রহ.)-কে সকলের সামনে দাঁড় করিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং বললেন, ‘আপনারা এই মাদরাসা ব্যাপারে তাঁর সাথে যোগাযোগ করবেন। এখন থেকে তিনিই মুহতামিম।’ ১৯৬০ সালে হুযুর ইন্তিকাল করলেন। এর চার বছর আগে যদি হয়, তাহলে ১৯৫৬ সালে তিনি মুহতামিম হন। ১৯৫৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত একাধারে তিনি জামিয়া পটিয়ার মুহতামিম ছিলেন। এ সকল বুযুর্গানে দীন আজকে নেই। আমাদেরকে তাঁদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে হবে।
হিন্দুস্থানে এক হাজী সাহেব ছিলেন; হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)। তিনি হযরত হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রহ.) ও ইমামে রব্বানী হযরত রশীদ আহমদ গঙ্গুহী (রহ.)-এর পীর ছিলেন। ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন করে ছিলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেফতার করার জন্য তালাশ করছিল। তিনি তাঁর এক মুরিদের বাসায় আশ্রয় নিলেন। শত্রুদের কাছ থেকে আত্মগোপন করে থাকা এটাও একটা সুন্নত।
রাসুলে আকরাম (সা.) যখন মদীনায় হিজরতের উদ্দেশ্যে বের হলেন, গারে সূর নামক গুহায় রসুল (সা.) কয়েকদিন আত্মগোপনে ছিলেন। আমাদের মুরুব্বিরা এই সুন্নতও পালন করে গেছেন। জেলখানায় থাকাও সুন্নত। আমাদের মুরুব্বিরা সে সুন্নতও পালন করেছেন।
হাজী ইউনুস সাহেব (রহ.) বাংলাদেশ স্বাধীনতা উত্তর একাধারে দু’বছর আত্মগোপনে ছিলেন। কিন্তু মাদরাসা তাঁকে ছাড়েনি। এই আত্মগোপন অবস্থায় হুযুরের বাড়ির সামনে বর্তমানে ইসাপুর মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) আত্মগোপন করলেন তাঁর এক মুরিদের বাসায়। মুরিদ ছিলেন বড় শিল্পপতি। ইংরেজ অফিসারের সাথে তার যোগাযোগ ছিল। ইংরেজ অফিসারও মাঝেমধ্যে তাঁর মুরিদের বাসায় আসত। মুরিদ বললেন, হুযুর! আমার বাসায় তো ইংরেজ অফিসাররা আসেন। এখন হঠাৎ যদি আপনাকে দেখে ফেলে তবে তো গ্রেফতার করে ফেলবে। হুযুর! বেয়াদবি মাফ করবেন। আমি ঘোড়ার ব্যবসা করি। বাড়ির পেছনে ঘোড়া রাখার এককটি ঘর আছে। ওই ঘরেই আপনার জন্য স্থান করে দেওয়া হবে। ইংরেজ অফিসার আসলে তারা তো আর সেখানে যাবে না; আপনার নিরাপত্তার জন্য! ব্রিটিশের গোয়েন্দা বিভাগ স্ট্রং ছিল, তারা খবর পেল, হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) অমুখ ব্যক্তির বাসায় ঘোড়া ঘরে অবস্থান করছেন। এখন ইংরেজ অফিসার আসল ওই ব্যক্তির কাছে। বলল, ভাই! আমার একটা ঘোড়া দরকার। আপনার নাকি ভালো ঘোড়া আছে? তাহলে যেখানে ঘোড়া রাখেন, সেখানে একটু গিয়ে দেখব; কোন ঘোড়াটা ভালো? আসলে সে ঘোড়া দেখতে আসেনি। তার মূল টার্গেট হল হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)।
এখন ঘোড়া দেখার জন্য গেল। এ দিকে মুরিদ থরথর কাঁপছিল; তিনি মনে করছেন, হুযুর তো এখনই ধরা পড়বেন! এখন আমার ঘোড়ার কামরায় যাচ্ছে অফিসার। অফিসার সেখানে পৌঁছার আগে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) নামায পড়ার জন্য অযু করেছিলেন। জায়নামায বিছানো ছিল, অফিসার ও মুরিদ রুমে গিয়ে দেখেন, জায়নামায বিছানো আছে, অযুর পানি দেখা যায়, কিন্তু মানুষ নেই। সুবহানাল্লাহ। হুযুরকে পাননি তারা। অফিসার চলে যাওয়ার পর মুরিদ চিন্তা করলেন, আমার হুযুর আবার কোথায় চলে গেলেন? তিনি তো এখানে ছিলেন। কোথায় গেলেন? রুমে এসে দেখেন হুযুর সাজদায় আছেন। ইতঃপূর্বে কিন্তু আল্লাহপাক তাঁকে গায়েব করে রেখেছিলেন। আল্লাহ যদি হেফাযত করেন, তবে কেউ কি কিছু করতে পারে?
فَاللّٰهُ خَيْرٌ حٰفِظًا١۪ وَّهُوَ اَرْحَمُ الرّٰحِمِيْنَ۰۰۶۴ {يوسف}
হযরত মুহাম্মদ (সা.)-কে সেই আল্লাহ পাকই হেফাযত করেছেন। তিনি এই মাত্র প্রবেশ করেছেন। সাথে সাথে কবুতর বাসা বাঁধল, মাকড়সার বাসাও দেখা দেখ। শত্রুরা এসে এদিক সেদিক তালাশ করে। কিন্তু সেই গুহায় তাকায় না। বলতে লাগল, যদি এখানে প্রবেশ করতো তবে কবুতরের বাসা ভেঙে যেত। হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাযি.) বললেন, হুযুর! শত্রুরা তো গুহার মুখে এসে পৌঁছেছে। এখন তো আমরা ধরা পড়ব। হুযুর আকরাম (সা.) ইরশাদ করেন,
اِذْ يَقُوْلُ لِصَاحِبِهٖ لَا تَحْزَنْ اِنَّ اللّٰهَ مَعَنَاۚ ۰۰۴۰ {التوبة}
আবু বকর! চিন্তার কোনো কারণ নেই। আল্লাহ সাথে আছেন। রাখেন আল্লাহ মারে কে? শত্রুরা গর্তের পাশেই এসেছিল। কিন্তু ওদিকে নযর দিতে পারেনি। আল্লাহ হেফাযত করেছেন।
এবার আসেন, বাংলাদেশের হাজী সহেব। হাজী ইউনুস (রহ.) যখন আত্মগোপনে ছিলেন। শহরে একটি দু’তলা বাসায় হুযুর অবস্থানগ্রহণ করেছিলেন। পুলিশ খবর পেল। হুযুরকে গ্রেফতার করার জন্য তারা ওই বাসাটা চতুর্দিকে ঘেরাও করে ফেলল। তারপর উপরে উঠে গ্রেফতার করবে। হুযুরের সাথীরা ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন। এখন কী হবে? পুলিশ তো ঘেরাও করে রেখেছে। পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের সামনে হুযুর বের হয়ে চলে গেলেন। তারা হুযুরকে দেখতে পায়নি। আল্লাহু আকবর।
নফসের জিহাদই সবচেয়ে বড় জিহাদ
এ সকল বুযুর্গানে দীন আল্লাহর কাছে এমন মর্যাদা কীভাবে পেলেন? তারা নফসে আম্মারার সাথে জিহাদ করেছেন। নফস তিন প্রকার। যথা- ১. নফসে আম্মারা, ২. নফসে লওয়ামা ও ৩. নফসে মুতমায়িন্না। এসব কথা কুআন শরীফে আছে, ইরশাদ হচ্ছে,
وَمَاۤ اُبَرِّئُ نَفْسِيْ١ۚ اِنَّ النَّفْسَ لَاَمَّارَةٌۢ بِالسُّوْٓءِ اِلَّا مَا رَحِمَ رَبِّيْ١ؕ اِنَّ رَبِّيْ غَفُوْرٌ رَّحِيْمٌ۰۰۵۳ {يوسف}
আম্মারা মানে, বেশি বেশি আদেশ করে, খারাপ কাজের দিকে বেশি বেশি আদেশ করে। নফসে আম্মারার সাথে যখন জিহাদ করবে নামায-রোযা ও যিকরের মাধ্যমে তখন এই নফসে আম্মারার চিকিৎসা হবে। বুযুর্গানে দীন বলছেন, নফসে আম্মারাকে যদি দুর্বল করতে না পার। তোমার জন্য জাহান্নাম অবধারিত।
কীভাবে দুর্বল করবে তাকে? নফস বিশেষজ্ঞের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে। গলা বিশেষজ্ঞ নয়। নাক বিশেষজ্ঞ নয়। হাত-পা বিশেষজ্ঞ নয়। এই নফস বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চারটা কাজ কর। যথা-
১. قِلَّةُ الطَّعَامِ| খাওয়া-দাওয়া কমিয়ে ফেল। খাবার পেটের তিন ভাগের এক ভাগ গ্রহণ করা সুন্নত। খাবার কমিয়ে ফেললে দুনিয়ারও লাভ, আখেরাতেরও লাভ। খাবার যখন কম খাবে অলসতা আসবে না, ইবাদত সহজ হবে, বিভিন্ন রোগও থেকে মুক্ত থাকবে। বেশি খেলে রোগ হয়? না কম খেলে রোগ হয়? যত রকমের রোগ আছে, সবই বেশি খাওয়ার কারণে। কলেরা বেশি খাওয়ার কারণে। ডায়বেটিস বেশি খাওয়ার কারণে। গ্যাস্টিক বেশি খাওয়ার কারণে। যদি খাবার কম খান যাবতীয় রোগ হতে মুক্ত থাকবেন। এতে নফসও দমন হবে।
২. قِلَّةُ الْـمَنَامِ ঘুম কম যাও। ইশারের পরে শুয়ে যাওয়া এবং শেষরাত্রে উঠে যাওয়া। ঘুম বেশি গেলে মানুষ অসুস্থ হয়ে যায়। ব্লাড সারকোলেশন ঠিক থাকে না। ঠিক পরিমাণ ঘুম গেলে ব্লাড সারকোলেশন ঠিক থাকে শরীরে। আমাদের বাংলাদেশিরা অনেকে সকালে আটটা পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকে।
দৈনিক কতক্ষণ ঘুমাবে? ডাক্তাররা বলছেন, ছয় ঘণ্টা ঘুম যথেষ্ট। ইশার নামাযের পর শুয়ে যাবেন। শেষরাত্রে উঠে যাবেন। ছয় ঘণ্টা ঘুম হয়ে যাবে। দুনিয়া তো জাগ্রত থাকার জায়গা। ঘুমের তো স্পেশাল জায়গা আছে কবর, কিয়ামত পর্যন্ত। এত ঘুমানোর ব্যবস্থা সেখানে। আবার সেখানে মশা নেই। আল্লাহঅলাদের জন্য বেহেস্তী বিছানা থাকবে, বেহেস্তী পোষাক থাকবে, বেহেস্তের দিকে দরজা খোলে দেওয়া হবে আল-হামদু লিল্লাহ। যারা আল্লাহঅলা নয়, তাদের জন্য কবরে সাপ থাকবে।
৩. قِلَّةُ الْكَلَامِ কথা কমান। জরুরি কথা বলবেন। বেহুদা কথা বলবেন না। এখন অনেকে বসে বসে গল্প করে। আমেরিকার এই অবস্থা, ওবামার এই অবস্থা, সরকারি দলের এই অবস্থা, বিরোধী দলের এই অবস্থা। নিজের অবস্থার খবর নেই। নিজের কী অবস্থা? আমি যে, কিয়ামতের ময়দানে উপস্থিত হব। আমি ঈমানদার হিসেবে যাব? না বেঈমান হিসেবে যাব? খবর নেই। কথা কমান।
৪. قِلَّةُ اخْتِلَاطِ مَعَ الْأَنَامِ মানুষের সাথে মেলা-মেশা কমিয়ে ফেলুন। জরুরত হলে মেলা-মেশা করবেন।
এই চারটা কাজ দ্বারা নফসে আম্মারা দুর্বল হয়। নফসে আম্মারার যখন চিকিৎসা হবে, তখন নফসে আম্মারার নাম বদলে যাবে। তখন হবে নফসে লওয়ামা। লওয়ামা মানে হল, গালিদাতা নফস। তখন নফস বলবে, নামায কেন পড়নি? রোযা কেন রাখনি? সবসময় গালি দেয়। নফসে আম্মারার সাথে জিহাদ করতে হয়।
أَشَدُّ الْـجِهَادِ جِهَادُ الْـهَوَىٰ … وَمَا كَرَمُ الْـمَرْءِ إلَّا التُّقَىٰ
সবচেয়ে বড় জিহাদ হল, নফসের সাথে জিহাদ করা।
হাজী ইউনুস (রহ.)-এর একটি ঘটনা
হাজী ইউনুস সাহেব (রহ.)-এর সাথে আমি সফর করতাম। তিনি দীর্ঘদিন সফরের পর একদিন আমাকে বলেছেন, ‘আমি নফসের সাথে অনেক লড়াই করেছি।’ আমি বললাম, হুযুর! কী রকম লড়াই? হুযুর বললেন, ‘আমি স্ট্যান্ডার করে পান খেতাম। এত বড় মুরাদাবাদী পানের বাটা ছিল। সেখানে জর্দা রখার ঘর আছে তিনটা। তিন রকমের জর্দা থাকবে। পান বানিয়ে সবখান থেকে একটু একটু দিয়ে খাব। পান খাওয়ার পর খুশব বের হবে। কিছু দিন খাওয়ার পর নফসকে বললাম, হে নফস! তোমার বিলাসিতা বেড়ে গেছে। জর্দা খাওয়া দূরের কথা। তোমাকে আর পানও খাওয়াব না। জর্দা, পান-সুপারি, চুনা সবগুলো একত্রে নিয়ে পিতলের মুরাদাবাদী বাট্টা একটা বড় দিঘির মাঝে ছুড়ে মেরেছি। এরপর থেকে কেউ দিলে খাই। না পেলে কোনো অসুবিধা হয় না।’ হুযুর যা বলছেন তা বলছি, আমার পক্ষ থেকে নয়।
হুযুরের সাথে সৌদি আরবের এক শহরে গিয়েছিলাম। ভক্তরা হুযুরের জন্য অনেক পান হাদিয়া আনে। হুযুর এসব বালিশের নিচে রাখেন। ওখান থেকে মাঝে মাঝে খান। একদিন সব পান ফুরিয়ে গেল। আমি বললাম, হুযুর! পান কিনে আনি? তিনি বললেন, ‘না। পেলে খাব। না পেলে খাব না। আমার কোন অসুবিধা নেই। আমি নফসকে এমনভাবে কন্ট্রোল করেছি। কোন জিনিসকে অভ্যাস বানাইনি।’
হাজী সাহেব (রহ.)-এর নফসের সাথে জিহাদ
হাজী সাহেব হুযুর (রহ.) বলেন, ‘দেখ! এক যমানায় আমি সে যামানার খুব দামি কাপড় আবদি কাপড় গায়ে দিতাম। খুব ভালো লাগত। একদিন নফসকে বললাম, হে নফস! তুমি সব সময় আবদি কাপড় গায়ে দাও। তুমি বিলাসী হয়ে গেছ। এসব বাদ দিয়ে মার্কিন কাপড় সিলাই করেছি। মার্কিন কাপড় কিছুদিন গায়ে দেওয়ার পর নফস বলছে, তুমি তো এখন বুযুর্গ হয়ে গেছ। এখন নফস উল্টা ধোঁকা দিচ্ছ। নফস যখন আমাকে ধোঁকা দিল, তখন মার্কিন কাপড় বাদ দিয়ে আবার পাতলা কাপড় সিলাই করেছি। আবার যখন সেটা ধোঁকা দিচ্ছে, মার্কিন কাপড় বানিেিছ।’ আসলে তাঁরা এমনিতে বুযুর্গ হননি। অনেক জিহাদ করেছেন। আল্লাহু আকবর।
আশরাফ আলী থানবী (রহ.)-এর খোদাভীতি
হযরত আল্লামা আশরফ আলী থানবী (রহ.) বয়ান করছিলেন। এত সুন্দর বয়ান করছিলেন যে, বয়ান শুনে পাবলিকের মধ্যে একজন দাঁড়িয়ে বলল, ‘হুযুর আপনি এত সুন্দর বয়ান করেন। আপনি এত বড় আলেম কীভাবে হলেন? এত বড় বুযুর্গ কীভাবে হলেন?’ থানবী (রহ.) সাথে সাথে উত্তর দিলেন, ‘আমি আশরফ আলী থানবীর কিছু নেই। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.) আমার দিকে তাওয়ায্যু দান করেছেন। সে জন্য আমার বয়ান তোমার ভাল লাগে।’ তাওয়ায্যু কার? হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রহ.)-এর। সে জন্য আমরাও বলি, বুযুর্গরা ইন্তিকাল করার পরেও তাদের রুহানি তাওয়ায্যু চালু থাকে।
পটিয়া মাদরাসার পুরাতন মসজিদ ভেঙে নতুন মসজিদ করবেন হাজী ইউনুস (রহ.)। সংকুলান হচ্ছে না। তখন ছাত্র বেড়ে গেছে। অনেকে আপত্তি করেছেন। বললেন, এটি মুফতী সাহেব হুযুর বানিয়েছেন। হাজী সাহেব ভেঙে ফেলেন। হুযুর সে দিন বলেছিলেন, ‘দেখ! আমি মুফতী সাহেব হুযুরের জীবদ্দশায় তাঁর হুকুম মতে সব কাজ করেছি। এখনও আমি হুযুরের থেকে জিজ্ঞেস করে করে কাজ করি। হুযুর তো কবরে। রুহানী তাআল্লুক আর সম্পর্ক। আত্মার সম্পর্ক। আল্লাহঅলারা রুহানী তাওয়ায্যু দিতে থাকেন।
বড় পীর শায়খ আবদুল
কাদের জীলানী (রহ.)-এর ঘটনা
বড় পীর সাহেব খাজা আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) একদিন তাহাজ্জুদের পরে মুরাকাবায় বসেছেন। বুযুর্গরা প্রতিদিন মুহাসাবা করেন। সারা দিন আমি ভালো কাজ করলাম না খারাপ কাজ করলাম? আগামী কাল কী করব? অডিট। মাসিক অডিট নায়, ডেলি অডিট। আমি ভালো কাজ কয়টা করেছি? খারাপ কাজ কয়টা করেছি। আল্লাহর হাবিব (সা.) বলেন,
«حَاسِبُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوْا وَزِنُوْا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُوْزَنُوْا».
‘আল্লাহর কাছে তোমার অডিট দেওয়ার আগে তোমাকে তুমি নিজে অডিট কর। তোমার হিসাব তুমি কর। তোমার আমল ওযন হওয়ার আগে তুমি মেফে দেখ তোমার কী পরিমাণ আমল আছে? নেকী কী পরিমাণ আছে? গোনাহ কী পরিমাণ আছে? এখন থেকে প্রস্তুত হও।’[১] বড় পীর সাহেব মুরাকাবায় বসেছেন। নিজের হিসাব-কিতাব নিচ্ছেন। ধ্যানে বসেছেন। ওই অবস্থায় দেখেছেন, আল্লাহ পাকের পক্ষ থেকে একটা আওয়াজ এলো। আবদুল কাদের! আজ থেকে দু’শত আড়াই শত বছর পরে হিন্দুস্থানে একজন লোক জন্মলাভ করবে। তিনি বিদআতকে মিঠিয়ে দেবেন। সুন্নতকে জিন্দা করবেন। তোমাকে জানিয়ে দিলাম। খাজা আবদুল কাদের জীলানী (রহ.) মুরাকাবা শেষ করার পরে খাদেমকে ডেকে বললেন, আমার জোব্বাটা নিয়ে আস। তাঁর একটি আরবি জোব্বা ছিল। এই জোব্বাটার দিকে তিনি তাওয়ায্যু দিলেন। অন্তরের দৃষ্টি দিলেন। চোখের দৃষ্টি না নয়। কচ্ছপ ছিনেন না? কচ্ছপ কোলে ডিম পাড়ে। ডিমের দিকে তাওয়ায্যু দেয় পানির ভেতর বসে। এমন তাওয়ায্যু দেয় যে, ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে যায়। কচ্ছপের তাওয়ায্যু দ্বারা যদি ডিম ফুটতে পারে। তাহলে আল্লাহঅলাদের তাওয়ায্যু দ্বারা আমাদের মাঝে ঈমান ফুটতে পারবে না কেন?
বড় পীর সাহেব জোব্বার দিকে তাওয়ায্যু দিলেন। খাদেমকে বললেন, এই জোব্বাটি তোমার কাছে রাখ। তুমি মারা গেলে তোমার পরবর্তী লোককে দেবে। সে মারা গেলে পরবর্তী লোককে দেবে। এভাবে করতে করতে আড়াই শত বছর পরে হিন্দুস্থানে একজন লোক বের হবেন। তাঁর কাছে আমার এ জোব্বাটি পৌঁছে দিলে আমার এ জোব্বাটি তার কাছে পৌঁছুবে। আড়াই শত বছর আগে তাওয়ায্যু দিলেন বড় পীর সাহেব (রহ.)। এ জোব্বাটি আড়াই শত বছর পরে শেষ পর্যন্ত পৌঁছুল বাগদাদের শাহ কামাল (রহ.)-এর কাছে। তিনিও যামানার বড় বুযুর্গ। সে সময় মুজাদ্দিদে আলফে সানী সাইয়েদ আহমদ সরহিন্দী (রহ.) জন্ম লাভ করেছেন। যিনি সম্রাট আকবর আর সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মুকাবেলা করেছেন।
বড় পীর সাহেব (রহ.) শাহ কামালকে স্বপ্ন দেখলেন, আমার জোব্বাটি মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.)-কে দিয়ে দিও। শাহ কামাল দেননি। কারণ বরকতময় জিনিস তো। তিনি মনে করলেন, আর কিছু দিন থাকুক বরকত বেশি পাব। সে জন্যে দেননি। যখন দেননি, বড় পীর সাহেব (রহ.) আরেকদিন স্বপ্ন দেখালেন। দেখ! তাড়াতাড়ি জোব্বাটি দিয়ে দাও। যদি না দাও তোমার বুযুর্গি যা আছে তাও চলে যাবে। শাহ কামাল (রহ.) জোব্বা নিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে হিন্দুস্থানে আসলেন। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর বাড়ির মসজিদে ফজরের নামায পড়লেন। নামায শেষ করে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে জোব্বাটি দিয়ে বললেন, হুযুর এই জোব্বাটি আপনার জন্য হাদিয়া। মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.) বললেন, কে হাদিয়া দিছে? শাহ কামাল বললেন বড় পীর সাহেব (রহ.)-এর হাদিয়া। মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.) সাথে সাথে জোব্বাটি গায়ে দিলেন। এতো মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর উন্নতি আরম্ভ হয়ে গেছে।
শেষ পর্যন্ত সম্রাট জাহাঙ্গীরের সাথে সংঘর্ষ শুরু হল। সম্রাট জাহাঙ্গীর যখন শিরক শুরু করল। তার দরবারে গেলে রুকু করতে হয়। মুজাদ্দিদ সাহেব (রহ.) ভাবলেন, কোন মানুষের সামনে সাজদাও করা যায় না, রুকুও করা যায় না। এটা হারাম। শিরক। এই শিরকের বিরুদ্ধে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) জিহাদ ঘোষণা করলেন। তখন জাহাঙ্গীরের রাজদরবারে তখন কিছু নামধারী মৌলভী ছিল। তারা বারবার বাদশাহর কানে কানে বলল, হুযুর! শুনেননি? মুজাদ্দিদে আলফে সানী আপনার হুকুমতের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। বারবার বলে। জাহাঙ্গীর বাদশাহ এসব কানে নেন না। শেষপর্যন্ত একদিন জাহাঙ্গীর বাদশাহ পুলিশ ডেকে বললেন, ‘মুজাদ্দিদকে গ্রেফতার করে নিয়ে আস।’ গ্রেফতার করতে গেল। মুজাদ্দিদকে তারা চিনে। তারা বলল, হুযুর! বাদশাহ আপানাকে যেতে বলছেন। গ্রেফতার করেনি। হুযুর তো বুঝতে পেরেছেন। তিনি একটি লাঠি, একটা পাগড়ি, একটি মিসওয়াক এবং একটা লোটা নিয়ে বের হলেন। এই লোটা হল মুসলমানের হাতিয়ার। এই লোটার পানি দিয়ে অযু করে নামাযে দাঁড়ালে সমস্ত বাতিল শক্তি মিসমার হয়ে যায়।
আল্লাহর ভয় যার কাছে আছে তাঁকে কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) খাদেমকে সাথে নিলেন। অযু করার লোটা ও মিসওয়াক সাথে নিলেন। এটিও হাতিয়ার। এক যুদ্ধে সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধ করছিলেন। দেখা গেল, সাহাবীর সংখ্যাও বেশি কিন্তুযুদ্ধ করে জয় লাভ করতে পারলেন না। আমির সাহেব পরামর্শ করলেন, দেখ তো! কোনো সুন্নত আমরা বাদ দিয়েছি কিনা? দেখা গেল মিসওয়াকের সুন্নতটি এক সপ্তাহ যাবৎ বাদ দেওয়া হয়েছে। মিসওয়াক করতে পারেননি। আমির সাহেব বললেন, এই কারণে আমরা জয়ী হতে পারছি না। তোমরা আগামী কাল সকালে সকলে একসাথে দাঁড়িয়ে মিসওয়াক করবে। সকাল বেলা যখন একসাথে সকলে দাঁড়িয়ে মিসওয়াক আরম্ভ করে দিলেন। কাফেরদের ক্যাম্প ওদিকে সামনে। ওরা ক্যাম্প থেকে দেখছে। একজন আরেকজনকে বলছে, মুসলমান তো আজকে খুব রাগের মধ্যে আছে দেখা যায়। ওরা দাঁত যেভাবে ধার করছে। আমাদের তো আজকে চাবিয়ে চাবিয়ে খেয়ে ফেলবে। অতঃপর শত্রুরা সব পালিয়ে গেল। মিসওয়াকের সুন্নতের ওপর আমল করার কারণে।
রসুল (সা.)-এর প্রত্যেকটা সুন্নতে বিজ্ঞান আছে। মিসওয়াক সম্পর্র্কে আছে মিসওয়াকে ৭০টি ফায়েদা আছে। সর্বশেষ ফায়েদা হচ্ছে মৃত্যুর সময় কালেমা নসিব হবে। আল-হামদুলিল্লাহ।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) একটি মিসওয়াক, একটি বদনা, একটি পাগড়ি, আরেকটি লাঠি; এসব নিয়ে জাহাঙ্গীর বাদশাহর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। দেখলেন, সামনে একটি গেইট আছে রুকু করে যেতে হয়। গেইটটি এত নিচু করে করা হয়েছে যে, মানুষ রুকু করতে বাধ্য। বাদশাহকে রুকু করে সেখানে ঢুকতে হয়। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বললেন, গেইটটি ভেঙে ফেলুন। বাদশাহর কাছে যদি আমার যেতে হয়। তাহলে গেইট ভেঙে ফেলুন। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বিক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন। বললেন, ‘রাজ-দরবারের মান-সম্মানের প্রশ্ন, রুকু করে আসতে হবে, সেটি আগে করুন।’ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) মাথা নত করবেন না। কারণ এই ঘাড়ের ওপর তাওহীদের তেল মালিশ করা আছে। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বললেন, ‘তোমার লজ্জা লাগে না? আমি তো সাজদা করব আল্লাহকে। তোমার কাছে আমি কেন সাজদা করব? তুমি ভাত খাও। তুমি পেশাব কর। তুমি পায়খানা কর। তোমার মতো মানুষের সামনে আমি কেন মাথানত করব?’ বাদশাহ বিক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন। বাদশাহ বললেন, ‘জল্লাদ! এই মওলানা সাহেবকে নিয়ে যাও। এতো হেফাযতে ইসলাম করে। সে জামানার হেফাযতে ইসলাম আর কি?’
জল্লাদ লাল কাপড় গায়ে দিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে নিয়ে যাচ্ছে। আর তিনি মুচকি মুচকি হাসছেন। কারণ তিনি জানেন, হায়াতের মালিক আল্লাহ। মওতের মালিক আল্লাহ। জাহাঙ্গীর বাদশাহর কোনো ক্ষমতা নেই আমাকে মারার।
জল্লাদ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে নিয়ে যাচ্ছে। এখন তাঁকে হত্যা করবে। ইতিহাসে লেখা আছে, আল্লাহ তো সাথে আছেন। আর যে অর্ডার করেছে তার সামনে শয়তান আছে। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বসা। তার সামনে টেলিফোনের মতো রিং আসছে। হে জাহাঙ্গীর! কাকে কতল করছ? এই মুজাদ্দিদকে যদি কতল কর তোমার রাজ্য তছনছ হয়ে যাবে। বাদশাহ ভয় পেয়ে গেল। শাস্তি কমিয়ে দিয়েনেছ। জেলখানায় রেখেছেন। মুজাদ্দিদ (রহ.) জেলখানায় গিয়ে দেখে সব চোর। ভালো লোক কি জেলখানায় যায়? চোর হয়ে ডুকে ডাকাত হয়ে বের হয়। কিন্তু কিছু কিছু আল্লাহঅলাও দেখা যায়। খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দীক আহমদ (রহ.)-কে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে জেলখানায় রাখা হয়েছিল। তিনি প্রত্যেক দিন সেখানে নামায পড়াতেন। ওয়ায-নসীহত করতেন। চোর সব ভালো লোক হয়ে গেছে।
মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সেখানে গিয়ে দেখলেন, কামরায় কামরায় সব চোর। তাঁকে একটি কামরায় রাখা হয়েছে। শেষরাত্রে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার পর যখন ফজর শুরু হল, তিনি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আযান আরম্ভ করে দেন। এটি শয়তানের জন্য এটম বোম। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) আযান দেওয়ার পরে প্রত্যেকের রুমে রুমে গিয়ে বললেন, উঠ! উঠ! কেউ উঠে না। একজন দরজা খুলে জিজ্ঞেস করল, বলেন কী? মুজাদ্দিদ সাহেব বললেন, নামায পড়ার জন্য ডাকছি। যে আল্লাহ আসমান-জমিন, হায়াত-মওতের মালিক। সে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নামায পড়ার জন্য আযান দেওয়া হয়েছে। কেউ আসে না। অনেক দিন আযান দেওয়ার পর একজন বলল, হুযুর আপনি তো একা। আমি আপনার সাথে নামায পড়ব। আমি আপনার পার্টিতে শরীক হব। এটি মুসল্লি পার্টি। এমনিতে তো এক পার্টিতে আরেক পার্টি নেই। কিন্তু মুসল্লি পর্টিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাসদ-বাসদ সব পার্টির লোক আছে কিনা? মুসল্লি পার্টির প্রেসিডেন্ট হল ইমাম সাহেব। সেক্রেটারি হল মুযায্যিন সাহেব। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) সেই মুসল্লিকে বলল, আমি ইমাম তুমি মুয়ায্যিন। দুই সদস্য বিশিষ্ট পার্টি। আযান দেওয়া আরম্ভ হয়েছে। কিছুদিন পর আরেকজন এসেছে। এভাবে পুরো জেলখানার সব মুসল্লি হয়ে গেল। এটি আসলে আল্লাহ পাকের মরজি। আল্লাহ পাক জেলখানার লোকগুলোকে হেদায়ত করার জন্য মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে সেখানে ডুকিয়েছেন। তাঁর কাছে মুরিদ হয়ে প্রত্যেকটি লোক আল্লাহঅলা হয়েছেন। যখন সব লোক মুসল্লি হয়ে গেল, এখন মুজাদ্দিদে আলফো সানী (রহ.)-এর কাজ শেষ। যে কাজের জন্য আল্লাহ পাক পাঠিয়েছেন, সে কাজ শেষ।
এ দিকে জাহাঙ্গীর বাদশাহ রুমে শুয়ে আছেন। স্বপ্নে দেখছেন, দিল্লীর জমে মসজিদের সামনে একটা হাউজ। সেই হাউজে বসে রসুল (সা.) অযু করছেন। জাহাঙ্গীর বাদশাহ পেছনে দাঁড়িয়ে সালাম দিলেন। রসুল (সা.) উত্তর দেননি। আরেক দিকে গিয়ে আবার সালাম দিলেন। রসুল (সা.) কোনো উত্তর দেননি। অযু করে যখন হুযুর (সা.) দাঁড়িয়েছেন। আবার সালাম দিলেন। রসুল (সা.) উত্তর দেননি। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বললেন, হুযুর আপনি আমার প্রতি অসন্তুষ্ট কেন? রসুলে আকরাম (সা.) বললেন, আমার একটি কুকুর তুমি বেঁধে রেখেছ। কেন তোমার সালামের উত্তর দেব? তাঁকে ছেড়ে দাও। না হয় তোমার রাজত্ব থাকবে না। ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম থেকে উঠে একাএকা বেরিয়ে গেলেন। সাথে কেউ নেই। অথচ দিল্লীর বাদশাহ যখন বের হন, আগে পরে কয়েক শত পুলিশ থাকে। আজকে গার্ডও নেই। পায়ে জুতাও নেই। সরাসরি জেলখানায় চলে গেলেন। লোকেরা সরে যাচ্ছে। ওরা মনে করছে, বোধ হয় বাদশাহর ব্রেইন নষ্ট হয়ে গেছে। আসলে ব্রেইন ঠিক আছে। প্রহরী জিজ্ঞেস করল, আপনি কেন এসেছেন? বাদশাহ বললেন, জেলখানার গেইট খোল। মুজাদ্দিদে আলফে সানী কোথায় আছেন? আমাকে সেখানে নিয়ে যাও। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর রুমে গিয়ে দেখেন তিনি তাহাজ্জুদ নামায পড়ছেন, সাজদায় আছেন। এই তাহাজ্জুদের নামাযের ধক্কা লেগেছে রাজ-দরবারে। আল্লাহ পাক বলেন,
رَبُّ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ لَاۤ اِلٰهَ اِلَّا هُوَ فَاتَّخِذْهُ وَكِيْلًا۰۰۹
বাদশাহ বসে আছেন। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) নামায পড়ে দুআ করে বসছেন। বাদশাহ পায়ের ওপর পড়ে গেলেন। বললেন, হুযুর! আমাকে মাফ করে দিন। আপনাকে গ্রেফতার করার কারণে আল্লাহর রসুল আমার সালামের উত্তর দেননি। আমি আপনাকে মুক্তি দান করলাম। আজ থেকে আপনি মুক্ত। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বললেন, শুধু আমাকে মুক্তি দান করলে হবে না। এখানে যত লোক আছে সব অলী আল্লাহ হয়ে গেছেন। এদেরকেও মুক্তি দিতে হবে। শধু তাই নয়, বাদশাহ আকবর যে দিনে ইলাহী আবিষ্কার করেছেন। সেটা ক্যান্সেল করতে হবে। জাহাঙ্গীর বাদশাহ বললেন, হুযুর! আপনার সামনে ঘোষণা করলাম, আজ থেকে সেই ধর্ম ক্যান্সেল। আমার রাজ-দরবারে আর রুকু করতে হবে না। তারপর দিন সকালে জাহাঙ্গীর বাদশাহ শাহজাহানকে পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাদশাহ বললেন, শাহজাহান! তুমি গিয়ে কয়েক শত পুলিশ নিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানীকে আমার রাজ-দরবারে নিয়ে এস এবং জেলখানায় যত বন্দী আছে সবাইকে জেলখানা হতে মুক্ত করে দাও। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে রাজ-দরবারে নিয়ে আসার পর বাদশাহ নিজ পুত্র শাহজাহানকে বললেন, শাহজাহান! তুমি হুযুরের কাছে মুরিদ হয়ে যাও। আমিও মুরিদ হব। জাহাঙ্গীর বাদশাহও মুরিদ হয়ে গেলেন। তখন যুদ্ধ চলছিল। মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে একটা পালকিতে বসিয়ে যুদ্ধে নিয়ে গেলেন। তখন গাড়ি ছিল না। মুজাদ্দিদ সহেব (রহ.)-কে একটি রুমে রাখা হল। বাদশাহ সারাদিন যুদ্ধ করেন। শেষরাত্রে এসে মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-এর পা টিপেন।
মসজিদে নববীতে রসুল (সা.) একটা শুকনা খেজুর গাছের সাথে ঠেক লাগিয়ে খুতবা দিতেন। তখন মিম্বর তৈরি হয়নি। যখন মিম্বর তৈরি হল, রসুল (সা.) মিম্বর খুতবা দিতে উঠলেন। কোথা হতে কান্নার আওয়াজ আসে। কে কাঁদছে? রসুল (সা.) খুতবা বন্ধ করে দিলেন। এদিক সেদিক তাকান। কারো চোখে কান্না দেখা যায় না। দেখা যায় খেজুর গাছ হতে ফোটা ফোটা পানি পড়ছে।
হুযুর (সা.) কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কেন কাঁদছ? খেজুর গাছ বলে, এতদিন মিম্বর ছিল না। আমার শরীরের সাথে আপনার শরীর লাগতো। আমি আনন্দ ভোগ করতাম। এখন মিম্বর তৈরি হয়েছে। আমাকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। বিয়োগ-ব্যথায় কাঁদছি। রসুল (সা.) বললেন, ‘দেখ! তোমাকে পুরষ্কার দেব, মুহাব্বতের বদলা। তোমাকে দুটি প্রস্তাব দেব। যথা- ১. এখান থেকে উঠিয়ে তোমাকে আমি একটি জায়গায় লাগাব। তুমি তাজা হয়ে যাবে। কিয়মত পর্যন্ত খেজুর ধরবে। ২. তোমাকে এখান থেকে উঠিয়ে মানুষের মতো মাটিতে দাফন করব। আমি যখন বেহেস্তে যাব। তোমাকে বগলের নিচে নিয়ে বেহেস্তে চলে যাব। তুমি কোনটা করবে বল। খেজুর গাছ বলল, হুযুর! বগলের নিচে করে বেহেস্তে যেতে চাই।
খতীবে আযম আল্লামা সিদ্দিক আহমদ সাহেব (রহ.) বলেছেন, আল্লাহ মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.)-কে দিয়ে জাহাঙ্গীর বাদশাহকে মুক্তি দান করেছেন। একদিন মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রহ.) বলেছেন, জাহাঙ্গীর! আল্লাহ যদি আমাকে বেহেস্ত দান করে। তোমাকেও সাথে নিয়ে যাব। জাহাঙ্গীর আল্লাহর অলী হয়ে গেছেন না?
আমি যখন টাঙ্গাইলে ছিলাম। আমি এক মসজিদে নামায পড়াতাম। সাইন্সের এক প্রফেসর। লোকটি নামাযী। তিনি প্রত্যেক দিন আমাকে একটি করে প্রশ্ন করেন। বিজ্ঞানভিত্তিক। একদিন বললেন, হুযুর! অযুর ফরয কয়টি? আমি বললাম, চারটি। তিনি বললেন, কুলি করা, নাকে পানি দেওয়া, শুরুতে হাত ধোয়া এসব তো কুরআনে নেই। এসব কেন করেন? যুক্তি দিয়ে বোঝান। আমি বললাম, কুরআনে আছে। সে বললেন, কই? দেখা যায় না। আমি বললাম, অনেক জিনিস থাকলেও দেখা যায় না। আপনার পেটের ভেতর নাড়ি-বুড়ি আছে না? তিনি বললেন, আছে তো। আমি বললাম, দেখা যায়? তিনি বললেন, না। মাঝে মাঝে অফারেশন করলে দেখা যায়। আমি বললাম, কুরআন শরীফেও অফারেশন করলে এগুলো দেখা যাবে। অপারেশন মানে, তফসীর। তিনি বললেন, কেমন? আমি বললাম, আল্লাহ পাক বলেছেন,
يٰۤاَيُّهَا الَّذِيْنَ اٰمَنُوْۤا اِذَا قُمْتُمْ اِلَى الصَّلٰوةِ فَاغْسِلُوْا وُجُوْهَكُمْ وَاَيْدِيَكُمْ اِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوْا بِرُءُوْسِكُمْ وَاَرْجُلَكُمْ اِلَى الْكَعْبَيْنِؕ ۰۰۶ {المائدة}
তোমরা যখন নামায পড়ার ইচ্ছা কর, প্রথমে চেহারা ধোয়ে নেবে। এখন ওই পানি তরল কিনা? পাক কিনা সেটি দেখতে হবে না? এখন যদি একজন অন্ধ মানুষ মনে করে সে কীভাবে বুঝবে বরফ না পানি? যদি ভেতরে হাত ডুকে যায়, তাহলে পানি, আর না হয় বরফ। এ জন্য প্রথমে দু’হাত ধোয়ে নিতে হয়। দ্বিতীয় তরল তো বুঝলাম, ডালও তো তরল। এটি তো ডালও হতে পারে। তাই একটু মেখে দিয়ে টেস্ট করতে হয়। ডাল না পানি? তৃতীয় এখন বুঝলাম, এটি পানি। এখন এখানে নাপাক পড়ছে কিনা? নাপাক পড়লে তো দুর্গন্ধ হয়ে যায়। তাই একবার নয়, তিনবার নাকে দিয়ে এটাকে টেস্ট করতে হয়। যখন বুঝলেন, এটা পানি, এটা বরফ নয়, এটা ডাল নয়, আবার নাপাকও নয় এবার আপনি অযু করতে পারেন।
আমি বললাম, আপনি তো বিজ্ঞানের প্রফেসর। আপনার লাইনে আমি একটু প্রশ্ন করি। তিনি বললেন, কী? আমি বললাম, কালোর সাথে কালো মিশলে কী হবে? তিনি বললেন, কালো বাড়বে। আমি বললাম, সিলেট কালো, পেন্সিলও কালো, কাল পেন্সিল দিয়ে সিলেটে লিখলে সাদা কেন বের হয়? আমি বললাম, লাল আর সাদা মিশ্রিত হলে কী রকম হবে? তিনি বললেন, গোলাপী হবে। আমি বললাম, লাল আগুন দিয়ে সাদা কাগজ জ্বালালে ছাইগুলো গোলাপী হওয়া দরকার ছিল। কালো কেন হয়? তিনি বললেন, আমি এসব বুঝি না। বোঝা এখনও শেষ নয়। কুরআনী বিজ্ঞান যার কাছে আছে, আর আমেরিকান বিজ্ঞান যার কাছে আছে, তাদের মধ্যে আসমান-জমিন ব্যবধান।
এই যে, জাহাঙ্গীরের কথা বলছিলাম। তাঁর পিতার নাম হল আকবর। আকবরের দরবারে কিছু মওলানা সাহেব রেখেছিলেন। আর কিছু হিন্দু পণ্ডিতও রেখেছেন। মওলানা ছিলেন মোল্লা দুফইয়াদা। তিনি ভালো লোক ছিলেন। আজে-বাজে কথা বন্ধ করার বন্য চেষ্টা করতেন। মোল্লা দুফইয়াদা একদিন বাদশাহকে বললেন, বাদশাহ সাহেব! তিনটা জিদ খুব প্রসিদ্ধ। যথা- ১. ঘোড়ার জেদ। ঘোড়া যখন জেদ ধরে, তখন মালিককে কাঁটা বনে গিয়ে ফেলে। ২. স্ত্রীর জেদ। সে যখন বাপের বাড়ি যেতে চায়। স্বামী যদি না নিয়ে যায়, পাক ঘরে গিয়ে কান্নাকাটি আরম্ভ করে। বলে, সারা জীবন আমাকে এরকম রাখে। এ ঘরে একদিনও আমি সুখ পায়নি। কথায় আছে, রাজার রাজ্য শাসন আর রানির রাজা শাসন। ৩. ছোট ছেলের জেদ। বাদশাহ বলে এটি কেমন? ছোট ছেলে যা চায় তা দিলে তো তার কান্না বন্ধ হয়ে যায়। মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, এত সহজ নয়। না হয় পরীক্ষা করুন। কিছুক্ষণের জন্য আপনি পিতা হন। আমি ছেলে হবো। আপনি চেয়ারে বসেন। আমি ছেলে হয়ে নিচে বসে থাকি। বাদশাহ বললেন, আচ্ছা! ঠিক আছে। বাদশাহ আকবর বসা। মোল্লা দুফইয়াদা নিচে বসা। বাদশাহ বললে, কি চাও? মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, আমি মিটায় খাব। এনে দিলেন। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, আর কী চাও? মোল্লা বললেন, মিষ্টি খাব। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, এখনও কেন কাঁদ? মোল্লা বললেন, আমাকে একটা হাড়ি এনে দিন। বাদশাহ এনে দিল। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, এখনও কেন কাঁদ? মোল্লা বললেন, আমাকে একটি হাতি দিতে হবে। বাদশাহর রাজদরবার থেকে একটি হাতি এনে দিলেন। আবার কাঁদে। বাদশাহ বললেন, এখনও কেন কাঁদ। মোল্লা বললেন, হাতিটা পাতিলের ভেতর ভরে দিন। এখন আর পারে না। মোল্লা ভরে দেন ভরে দেন বলে কাঁদছে। কাঁদা আর বন্ধ হয় না।
মোল্লা দুফইয়াদা এবার বাদশাহকে বললেন, আমি বলছিলাম না ছোট ছেলের জেদ। তাদের কান্না থামা যায় না। বাদশাহ স্বীকার করলেন। মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, আপনার মাথায় কুরআন নেই। সে জন্য আটকে পড়েছেন। আমি যদি পিতা হতাম আর আপনি যদি ছেলে হতেন। যা চান তা দিতাম। কারণ আমার ভেতরে কুরআন আছে। কুরআনের দাম বোঝাচ্ছেন। বদশাহ বললেন, ঠিক আছে আপনি কিছুক্ষণের জন্য পিতা হন। আমি নিচে বসব। মোল্লা দুফইয়াদা এসে শাহী চেয়ারে বসে গেল। কুরআনের দাম বাড়িয়েছে আল্লাহ।
কুরআন কারো দাম বাড়ায়। কারো দাম কমায়। মোল্লা দুফইয়াদা যা যা বলছেন বাদশাহও তা বলছেন। বলতে বলতে বাদশাহ যখন বললেন, আমাকে একটা হাতি দেন। মোল্লা দুফইয়াদা একটি ছোট ছেলেদের খেলনার হাতি এনে দিলেন। এখন বাদশাহ হাতিটা পিতলে ভরে দেন আর বলে না। কারণ এটা তো পিতলে ডুকে যাবে। মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, দেখুন আপনি আমার কান্না থামাতে পারছিলেন না। বাদশাহ বললেন, আপনি এত ছোট হাতি কেন এনে দিয়েছেন? মোল্লা দুফইয়াদা বললেন, বাচ্ছাদের হাতি কোনটা সেটা বুঝতে হবে না? এত বড় হাতি নিয়ে ছেলেরা খেলা করে? আপনি তো এখন বাচ্ছা, তাই আপনাকে ছোট হাতি এনে দিয়েছি। এজন্য মাদরাসার প্রয়োজন। ঈমানী বিজ্ঞান শিখার জন্য মাদরাসার প্রয়োজন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে তাওফীক দিয়েছেন জলসায় আসার জন্য। আপনারা অনেকে কষ্ট করেছেন। ক্ষমা করে দেবেন এবং মাদরাসার জন্য দুআ করবেন। দেশের জন্য দুআ করবেন।
অনুলিখন: রিদওয়ানুল হক শামসী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন