আব্দুল্লাহ আল মাসূম :: আল্লাহ তাআলা মানবজাতির পথ নির্দেশনার লক্ষ্যে যুগে যুগে অসংখ্য নবি এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। নবুয়তের এ সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘটে আমাদের প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে। তিনি কিয়ামত পর্যন্ত আগত-অনাগত সমস্ত মানুষের নবি। নবির অনুপস্থিতিতে তার উম্মতকে বিচ্যুতি থেকে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তাআলা নবুয়তের দায়িত্ব এই নবিরই উম্মতের উপর অর্পণ করেন।
প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহাবিরা সর্বপ্রথম সেই মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। এ ক্রমধারায় আল্লাহর রাসুলের কিছু সাহাবি ভারত উপমহাদেশ পেরিয়ে চীনে আগমন করেন।
ইসলামের বহু আগে প্রাচীনকাল থেকেই চীন দেশের সাথে আরবদের যোগাযোগ ছিলো। চীনের সাথে তাদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো। বাণিজ্যের সূত্র ধরে বঙ্গসহ উপমহাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আরব বণিকদের জাহাজের যাতায়াত ছিলো।
সাহাবি আবু ওয়াক্কাসের রাযি. নেতৃত্বে তিনজন সাহাবি ও কিছু সংখ্যক হাবশি মুসলমানদের একটি প্রচারক দল চীনে গমন করেন। দলের আমির সাহাবি আবু ওয়াক্কাস রাযি. চীনের ক্যান্টন বন্দরে অবস্থান করেন। তার প্রতিষ্ঠিত কোয়ান্টাং মসজিদটি এখনো সমুদ্র তীরে সুউচ্চ মিনার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদের অদূরেই তার কবর রয়েছে। বর্তমানে সেই মসজিদটি দাওয়াত ও তাবলিগের মারকায হিসেবে পরিচিত।
অন্য দুজন সাহাবি চীনের উপকূলীয় ফু-কিন প্রদেশের চুয়াংচু বন্দরের নিকটবর্তী লিং পাহাড়ের উপর সমাহিত রয়েছেন। চতুর্থজন সাহাবি চীনের অভ্যন্তরে চলে গিয়েছিলেন। এরপর শুরু হয় চীন মহাদেশে ইসলামের সূচনা।
রাসুলের এই সাহাবিরা চীনে এসে প্রথমে ব্যবসা শুরু করেন। আল্লাহর রাসুলের সাহাবিরা হলেন বিক্রেতা আর চীনা জনগণ ক্রেতা। এভাবে কিছুদিন চলার পর চীনের বড়ো বড়ো শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীগণ চীনের রাজ দরবারে অভিযোগ পেশ করে, আরবের কিছু বণিকদের কারণে আমাদের ব্যবসা লাটে উঠেছে। আমাদের রাস্তায় বসার উপক্রম হয়েছে। অচিরেই ব্যবস্থা না নিলে আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবো। চীনের রাজ দরবার থেকে আরব বণিকদেরকে বহিষ্কার করার ফরমান জারি করা হলো।
সাথে সাথে পুরো চীনে তোলপাড় শুরু হলো। জনগণ রাজদরবারের এই ফরমান শুনে ফুঁসে উঠলো। তারা আরব বণিকদেরকে বহিষ্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে এলো। চীনের রাজা তো এ অবস্থা অবলোকন করে নড়েচড়ে বসলো। রাজদরবারের বিষ্ময়ের শেষ রইলো না। বিক্ষোভকারীদেরকে তলব করে এর কারণ জিজ্ঞাসা করা হলো। রাজতদন্ত শুরু হলো। কী কারণে চীনের সাধারণ জনগণ আরব বণিকদের পক্ষাবলম্বন করলো, এর কোনো কারণ নিশ্চয়ই আছে বটে।
অবশেষে জানা গেলো, আগত আরব বণিকদের দৃঢ় ব্যক্তিত্বের প্রভাব, ব্যবসায় সততা, ন্যায্য মূল্যে পণ্য বিক্রয়, ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, কোনো কারণে মাল ফেরত দিতে চাইলে খুশিমনে তা পূর্ণ মূল্য ফেরত দিয়ে ফেরত নিয়ে নেওয়া ও ভোক্তাদের সাথে আরব বণিকদের সুসম্পর্ক বজায় রাখা ইত্যাদির ফলে চীনের সাধারণ জনগণ এদের প্রতি প্রবলভাবে মুগ্ধ।
অপরদিকে চীনের ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি কর্তৃক হঠকারিতা, মজুতদারির সীমাহীনতা, অতিরিক্ত মুনাফার লোভ, ভেজাল পণ্যের সয়লাব, সময়মতো জরুরি পণ্য সরবরাহে ব্যর্থতা ও গ্রাহক কিংবা সাধারণ ক্রেতাদের দুর্ভোগ লাঘবে সচেষ্ট না হওয়ার কারণে তারা এদের প্রতি চরম অতিষ্ঠ।
এ তথ্য উদঘাটিত হওয়ার পর চীনের রাজ দরবারের পক্ষ থেকে আরব বণিকদের বহিষ্কারের ফরমান প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। জয় হয় ইসলামের। জয় হয় প্রিয় নবির সাহাবিদের উচ্চমানের আখলাকের। ইসলামে ঘোষিত ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত সুস্পষ্ট নীতিমালার ইতিবাচক প্রতিফলন চীনবাসীদের চোখ খুলে দেয়। আরব বণিকবেশধারী প্রিয় নবির সাহাবিদের আচরণে মুগ্ধ হয়ে দলে দলে চীনের মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়।
এভাবে চীনে ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হয়। সাহাবিরা তাদের সঙ্গী-সাথীদের সাথে নিয়ে চীনের জনসাধারণের সাথে মিশে ইসলামের দাওয়াত দেওয়া শুরু করেন।
এরপর কালের পরিক্রমায় দীর্ঘদিন যাবত ইসলামের দাওয়াত ও এর মেহনত দুর্বল হতে হতে একপর্যায়ে চীন থেকে ইসলাম বিদায় নেয়। প্রিয় নবির সাহাবিরা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু হয়। জাতি ও শ্রেণিগত বিভিন্ন মানুষের আবাস গড়ে উঠে চীনে। বৌদ্ধ থেকে নাস্তিক্যবাদ প্রবল হয়ে উঠে। যার প্রমাণ বর্তমান চীনের অবস্থা। এখন সেখানে কমিউনিস্টের শাসন চলছে। অনেকদিন ধরে কমিউনিস্ট মতবাদ দোর্দ- প্রতাপের সাথে চীন শাসন করে আসছে। চীনের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৩৫ কোটির উপরে। এর প্রায় ৪৮ কোটি মুসলমান।
আল্লাহ তাআলা হযরতজি মাওলানা ইলিয়ার রহ. এর মাধ্যমে দাওয়াত ও তাবলিগের নামে পুনরায় ইসলামের দাওয়াতের মেহনত চালু করার পর আবারো চীনে সেই মেহনত শুরু হয়। কীভাবে তা শুরু হয়- এর ঘটনা আরও বিষ্ময়কর।
ইসলামের দাওয়াত, শিক্ষা ও এর মেহনত না থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন চীনে সামান্য সংখ্যক কিছু মুসলমান ছিলেন। কিন্তু তাদের ইসলামের মৌলিক বিষয়েও কোনো জ্ঞান ছিলো না। কালিমা, নামায, হজ্জ- এ কয়েকটি নাম শুধু বলতে পারতো। কীভাবে তা পালন করতে হয়- তাও জানতো না। একবার চীনের কয়েকজন মুসলমান হজ্জের নিয়ত করে। কিন্তু হজ্জ কীভাবে করতে হয়, এর জন্য কোথায় যাওয়া লাগে- এটাও তাদের জানা ছিলো না। হজ্জের স্থানে যাওয়ার নিয়তে টিকিট বুকিং দিতে গেলে তাদেরকে বলা হলো- তোমরা দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশ থেকে আরবের বিমানে যাত্রা করো। পরে তারা বাংলাদেশে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। ভাষা না বোঝার ফলে কাকরাইল মারকাযের পক্ষ থেকে নিয়োজিত এস্তেকবালের সাথীরা তাদেরকে সরাসরি মারকাযে পাঠিয়ে দেন। সেখান থেকে তাদেরকে নির্দেশনা সহকারে চার মাসের সফরে যথারীতি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সাথে কয়েকজন বাংলাদেশি সাথী ছিলেন। তারা চাইনিজ ভাষা বুঝতেন না। ইশারা-ইঙ্গিতে সবই চলতে লাগলো। এদিকে আসল রহস্য এখনো অজানা। চীনা মুসলমানরাও কিছু বুঝছে না। তারা এই সফরকেই হজ্জ মনে করলো।
এরই মাঝে কানাডা প্রবাসী এক ইঞ্জিনিয়ার- যিনি চাইনিজ ভাষা বুঝতেন, তিনি কাকরাইলে আসেন। তাকে হজ্জবেশী সেই চীনা জামাতের কাছে প্রেরণ করা হলে এতোক্ষণ লুকিয়ে থাকা গোমড় ফাঁস হয়। তখন চীনা মুসলমানরা আগে দ্বীন ও দ্বীনের মেহনত শিখে এরপর হজ্জ করার নিয়ত করেন। এরপর চীনে দাওয়াত ও তাবলীগের জামাত প্রেরণ করা হয়। দীর্ঘদিনের বিরতির পর আবার চীনে ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। এর ধারাবাহিকতায় টঙ্গীতে অনুষ্ঠিত গত বিশ্ব ইজতেমায় প্রায় ৮০০০ চাইনিজ মুসলমান উপস্থিত হন। তাদের জন্য আলাদা তাঁবুর ব্যবস্থা করা হয়। সুবহানাল্লাহ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন