কে ঐ শোনাল মোরে
আজানের ধ্বনি
মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর
আকুল হইল প্রাণ
নাচিল ধমনী
কি মধুর
আজানের ধ্বনি।
যদি তোমাদেরকে এখন প্রশ্ন করি এ কবিতাটি কার লিখা তোমরা নিশ্চয় এক বাক্যে বলবে কবি কায়কোবাদের। হ্যাঁ কবি কায়কোবাদের ‘আজান’ কবিতার প্রথম স্তবক এটি। তিনি মহাকবি কায়কোবাদ নামেই সবার কাছে পরিচিত। আসলে তার প্রকৃত নাম মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী। জানা যায়, হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশী নামে তাঁর জনৈক পূর্ব পুরুষ বাদশাহ শাহাজানের সময়ে বাগদাদ নগরীর নিকটবর্তী কোন স্থান থেকে দিল্লীতে এসে বসতি স্থাপন করেন। হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশী ছিলেন আরবী ও ফারসী ভাষায় সুপন্ডিত। যে কারণে তিনি সহজেই বাদশাহ শাহজাহানের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। বাদশাহ তাঁর গুণে মুগ্ধ হয়ে দিল্লী জামে মসজিদের সহকারী ইমামের পদে তাঁকে নিয়োগ দেন। এই হাফিজ উল্লাহ আল কোরেশীর প্রপৌত্র মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশী দিল্লী হতে বাংলাদেশে চলে আসেন এবং ফরিদপুর জেলার গোড়াইল গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। আমাদের আলোচ্য কবি এই মাহবুব উল্লাহ আল কোরেশীর প্রপৌত্র। তাঁর দাদার নাম নেয়ামত উল্লাহ আল কোরেশী এবং আব্বার নাম শাহমত উল্লাহ আল কোরেশী ওরফে এমদাদ আলী।
মহাকবি কায়কোবাদ ১৮৫৭ খৃস্টাব্দে ঢাকা জেলার নওয়াবগঞ্জ থানার আগলা পূর্বপাড়া গ্রামে মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের নাম জরিফউন্নেছা খাতুন। কায়কোবাদ ছিলেন বাবা মায়ের প্রথম পুত্র। তাঁর অন্য দু’জন ভাই হলেক আবদুল খালেক ও আবদুল বারী যারা যথাক্রমে সাবডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট এবং ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের সার্জন ছিলেন।
কায়কোবাদের লেখাপড়া শুরু হয় পিতা শাহমত উল্লাহর কর্মস্থল ঢাকাতে। তিনি ঢাকার পগোজ স্কুলের ছাত্র ছিলেন। অবশ্য ১১ বছর বয়সে মা এবং ১২ বছর বয়সে আব্বা মারা যাওয়ায় ইয়াতিম কবি নানাবাড়ি আগলাপাড়া গ্রামে ফিরে যান এবং সেখানে এক বছর সময় কাটান। পরে তিনি পুনরায় ঢাকাতে ফিরে এসে ঢাকা মাদ্রাসায় ভর্তি হন। এ সময়ে মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষক ছিলেন বাবু রাজেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দীর পিতা মওলবী ওবায়দুল্লাহ আল ওবায়দী সোহরাওয়ার্দী। অপরদিকে কবির সহপাঠী ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পিতা জাস্টিস জাহিদ সোহরাওয়ার্দী। ঢাকা মাদ্রাসায় কায়কোবাদ এন্ট্রাস পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। মাদ্রাসার শিক্ষা জীবন শেষ হলে তিনি ১৮৮৭ সালে ডাক বিভাগে চাকুরি নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন এবং ১৯১৯ সালে চাকুরী জীবন হতে অবসর গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য যে, ছাত্র জীবনেই তার ‘কুসুম কানন’ ও ‘বিরহ গোলাপ’ নামে দুটি কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
আনন্দের কথা হলো, এ কাব্য গ্রন্থ দুটি প্রকাশিত হলে তা পড়ে কাশিম বাজারের মহারাণী দশ টাকা এবং কাশীর ভূবন মোহিনী চতুর্ধারিণী পাঁচ টাকা পাঠিয়ে কিশোর কবি কায়কোবাদকে বরণ করে নেন। ঘটনাটি ছিল নিঃসন্দেহে কবির জন্য উৎসাহ অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যাপার।
কর্মজীবনে প্রবেশ করার আগেই তিনি অভিভাবকদের মতানুযায়ী মামা হেদায়াত আলী সাহেবের বড় মেয়ে তাহেরউন্নেছা খাতুনকে বিয়ে করেন।
১৩০২ বঙ্গাব্দে ঢাকা হতে সৈয়দ এমদাদ আলীর তত্ত্বাবধানে প্রকাশিত হয় ‘অশ্রু মালা’ খন্ড কাব্যগ্রন্থটি। এ সময়ে কবি ময়মনসিংহের জামুরকী পোস্ট অফিসে কর্মরত ছিলেন। অশ্রুমালা প্রকাশিত হওয়ার পরপরই কায়কোবাদের কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ঐ সময়কার সেরা কবি নবীনচন্দ্র সেন আলিপুর হতে কবিকে লিখে পাঠান-
‘মুসলমান যে বাংলা ভাষায় এমন সুন্দর কবিতা লিখতে পারে, আমি আপনার উপহার না পাইলে বিশ্বাস করিতাম না। অল্প সুশিক্ষিত হিন্দুরই বাংলা কবিতার উপর এরূপ অধিকার আছে।”
১৩১১ বাংলা সনে কবির সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতি ‘মহাশ্মশান’ মহাকাব্য প্রথম প্রকাশিত হয়। এটিই বাংলা সাহিত্যের সর্ববৃহৎ মহাকাব্য। বাংলা ভাষায় মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, ইসমাইল হোসেন সিরাজী, শেখ হবিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ও ফররুখ আহমদ মহাকাব্য রচনা করেন। তবে ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে কায়কোবাদই মহাকাব্য রচনা করেন। পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ নিয়ে এ মহাকাব্য রচিত। তিনখন্ডে বিভক্ত ৮৭০ পৃষ্ঠাব্যাপী এ মহাকাব্য রচনায় দীর্ঘ দশ বছর সময় লেগেছিল।
এ মহাকাব্য সম্বন্ধে আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, “মহাশ্মশান কাব্য বঙ্গীয় মুসলমান সমাজে একটি উজ্জ্বল রত্ন। মহাশ্মশানের ন্যায় বৃহদাকার কাব্য বোধহয় বঙ্গ সাহিত্যে আর নেই।”
এই কাব্যের মাধ্যমে কবি মুসলমানদের জাগরণের বাণী শুনিয়েছেন-
“পড়ে নাকি মনে সেই অতীত গৌরব?
সুদূর আরব ভূমে যে বীর জাতি
মধ্যাহ্ন মার্তন্ড প্রায় প্রচন্ড বিক্রমে
যাইত ছুটিয়া কত দেশ দেশান্তরে
আফ্রিকার মরুভূমে বালুকা প্রান্তরে
বিসর্জিয়া আত্মপ্রাণ কেমন বিক্রমে
স্থাপিয়াছে ধর্মরাজ্য ‘আল্লা’ ‘আল্লা’ রবে
আজিও ধ্বনিত সেই নীলনদ তীরে।”
১৩২৮ বংগাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘বিশ্বমন্দির’ কাব্য। এই কাব্যের বিষয়বস্তু অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ভাওয়াল এলাকার মুসলমান জমিদার নুরুউদ্দিন হায়দারের একমাত্র পুত্র আলাউদ্দীন হায়দরকে তারই দেওয়ান সুধীর চন্দ্র জমিদারীর লোভে কূপে ফেলে হত্যা করে এবং এই কূপের উপর নির্মাণ করে শিবমন্দির। এই দুঃখজনক ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে বিশ্বমন্দির কাব্য।
১ ফাল্গুন ১৩২৯ বংগাব্দে প্রকাশিত হয় ‘অমিয় ধারা’ খন্ড কাব্য। এ কাব্যে অনেকগুলি কবিতা রয়েছে। তবে কাব্যের প্রথম কবিতা ‘আজান’ খুবই জনপ্রিয় একটি কবিতা। যার প্রথম স্তবক আজকের লেখার শুরুতেই উল্লেখ করছি।
১৩৩৯ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় কায়কোবাদের আরেকখানি মহাকাব্য ‘মহরম শরীফ’। কারবালার যুদ্ধের কারণ ও ইতিহাস বিবৃত হয়েছে এ কাব্যে। ৩ খন্ডে সমাপ্ত এ কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দে রচিত।
অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা ‘শ্মশান ভস্ম’ কাব্য উপন্যাসখানি ১৩৪৫ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়। কায়কোবাদের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয় –প্রেম পারিজাত, প্রেমের ফুল, প্রেমের রাণী, মন্দাকিণী ধারা প্রভৃতি কাব্য।
২ সেপ্টেম্বর ১৯২৫ খৃস্টাব্দে নিখিল ভারত সাহিত্য সংঘ কায়কোবাদকে ‘কাব্যভূষণ’, ‘বিদ্যাভূষণ’ ও ‘সাহিত্য রত্ন’ উপাধিতে ভূষিত করে। তাঁকে ‘মাইকেল দি সেকেন্ড’ ও বলা হতো।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাথে দেখা করার জন্য কায়কোবাদ কলকাতাও গিয়েছিলেন। কাজী সাহেবের সাথে দেখা হলে তিনি কায়কোবাদের পা ছুঁয়ে সালাম করে বলেছিলেন, ‘ইনিই মহাকবি কায়কোবাদ, মহাশ্মশান অমর কাব্যের স্রষ্টা-আমাদের অগ্রপথিক।’ এ ঘটনা হতেই বুঝা যায় কায়কোবাদ কত বড় কবি ছিলেন।
ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সভাপতিত্ত্বে ১৩৫২ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ হলে কায়কোবাদকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
কবি ইসমাইল হোসেন শিরাজী কায়কোবাদকে সম্মাননা হিসেবে সোনার দোয়াত কলম উপহার দেয়ার আয়োজন করেছিলেন, কিন্তু বিশেষ কারণে তা আর দেওয়া হয় নি।
ব্রঙ্কো নিউমেনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ২১ জুলাই ১৯৫১ খৃষ্টাব্দে মহাকবি কায়কোবাদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন। ঢাকার আজিমপুর গোরস্তানে তাকে দাফন করা হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন