# কুরবানীর বিধান আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরীয়তেই বিদ্যমান ছিল
কুরবানীর ইতিহাস ততোটাই প্রাচীন যতোটা প্রাচীন মানব অথবা ধর্মের ইতিহাস। আল্লাহ পুরস্তির কুরবানী নামক এ মহান নিদর্শন মানব জাতির প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত সকল শরীয়তেই কার্যকর ছিলো। সকল নবীর উম্মতকেই কুরবানী করতে হয়েছে। প্রত্যেক উম্মতের ইবাদতের এ ছিল একটা অপরিহার্য অংশ। আল্লাহতায়ালার এ বিধান মানব জাতির সৃষ্টি লগ্ন থেকেই কার্যকর হয়ে আসছে ।
মানব সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস এটাই সাক্ষ্য দেয় যে, পৃথিবীর সব জাতি ও সম্প্রদায় কোন না কোন ভাবে আল্লাহর দরবারে নিজেদের প্রিয় বস্তু উৎসর্গ করে । এটাই মানুষের চিরন্তন স্বভাব বা ফিতরাত।
এ ফিতরাতের স্বীকৃতি প্রদান করে মহান আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষণা করেছেন ঃ
وَلِـكُلِّ اُمَّةٍ جَعَـلْـنَا مَنْسَكًا لِّـيَـذْكُرُوْا اسْمَ اللهِ عَلى مَـا رَزَقَـهُمْ مِنْ بَـهِيـْمَةِ الْاَنْـعَـامِ
“আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্যে কুরবানীর এক বিশেষ রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেন তারা ওসব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন”। { সূরা আল হজ্জ-৩৪}
মানব ইতিহাসের সর্ব প্রথম কুরবানী
মানব ইতিহাসের সর্ব প্রথম কুরবানী হযরত আদম আ. এর দু’পুত্র হাবিল ও কাবিলের কুরবানী। এ ঘটনাটি বিশুদ্ধ ও শক্তিশালী সনদ সহ বর্ণিত হয়েছে। ইবনে কাসীর একে ওলামায়ে মোতাকাদ্দেমীন ও ওলামায়ে মোতায়াখ্খেরীনের সর্ব সম্মত উক্তি বলে আখ্যা দিয়েছেন। ঘটনাটি এই :
যখন আদম ও হাওয়া আ. পৃথিবীতে আগমন করেন এবং সন্তান প্রজনন ও বংশ বিস্তার আরম্ভ হয়, তখন প্রতি গর্ভ থেকে একটি পুত্র ও একটি কন্যা এরূপ যমজ সন্তান জন্ম গ্রহণ করত। তখন এক শ্রেণীর ভাই বোন ছাড়া হযরত আদমের আর কোন সন্তান ছিলনা। অথচ ভাই বোন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না।
তাই মহান আল্লাহ উপস্থিত প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে আদম আ. এর শরীয়তে বিশেষ ভাবে এ নির্দেশ জারি করেন যে, একই গর্ভ থেকে যে যমজ পুত্র ও কন্যা জন্ম গ্রহণ করবে, তারা পরস্পর সহোদর ভাই-বোন গণ্য হবে। সুতরাং তাদের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক হারাম হবে। কিন্তু পরবর্তী গর্ভ থেকে জন্ম গ্রহণকারী পুত্রের জন্য প্রথম গর্ভ থেকে কন্যা সহোদরা বোন গণ্য হবে না। তাই তাদের পরস্পর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া বৈধ হবে।
কিন্তু ঘটনাক্রমে কাবিলের সহজাত সহোদরা বোনটি ছিল খুবই সুশ্রী-সুন্দরী তার নাম ছিল ‘আকলিমা’ আর হাবিলের সহজাত বোনটি ছিল তুলনামূলক কম সুন্দরী তার নাম ছিল ‘গাজা’। বিবাহের সময়ে হলে নিয়মানুযায়ী হাবিলের সহজাত অসুন্দরী কন্যা কাবিলের ভাগে পড়ল। এতে কাবিল অসন্তুষ্ট হয়ে হাবিলের শত্রু হয়ে গেল। সে জেদ ধরল যে, আমার সহজাত বোনকেই আমার সঙ্গে বিবাহ দিতে হবে। হযরত আদম আ. তাঁর শরীয়তের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে কাবিলের আবদার প্রত্যাখ্যান করলেন।
অতঃপর তিনি হাবিল ও কাবিলের মতভেদ দূর করার উদ্দেশ্যে বললেন, তোমরা উভয়েই আল্লাহর জন্য নিজ নিজ কুরবানী পেশ কর। যার কুরবানী গৃহীত হবে, সে-ই উক্ত কন্যার পানি গ্রহণ করবে। হযরত আদম আ. এর নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল যে, যে সত্য পথে আছে, তার কুরবানীই গৃহীত হবে।
তৎকালে কুরবানী গৃহীত হওয়ার একটি সুস্পষ্ট নিদর্শন ছিল এই যে, আকাশ থেকে একটি অগ্নি শিখা এসে কুরবানীকে ভস্মীভূত করে আবার অন্তর্হিত হয়ে যেত। যেমন মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন ঃ
بِـقُـرْبَـانٍ تَـأكُـلُـهُ الـنَّـارُ “ঐ কুরবানী যাকে আগুন গ্রাস করে নিবে”। { সূরা আলে ইমরান-১৮৩।}
আর যে কুরবানীকে অগ্নি ভস্মীভূত করত না, সেটাকে প্রত্যাখ্যাত গণ্য করা হত। কুরবানীর এ তরীকা খাতামুল আম্বিয়া হযরত মুহাম্মদ সা. এর যুগ পর্যন্ত সকল পূর্বেকার নবীর যুগে বলবৎ ছিল।
হাবিল ভেড়া, দুম্মা ইত্যাদি পশু পালন করত। সে একটি উৎকৃষ্ট দুম্বা কুরবানী করল। কাবিল কৃষি কাজ করত। সে কিছু শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানীর জন্যে পেশ করল। { তাফসীরে ইবনে কাসীর, সূত্র হযরত ইবনে আব্বাস রা. কর্তৃক বর্ণিত। } অতঃপর নিয়মানুযায়ী আকাশ থেকে অগ্নি শিখা অবতরণ করে হাবিলের কুরবানীটি ভস্মীভূত করে দিল এবং কাবিলের কুরবানী যেমন ছিল তেমনি পড়ে রইল। এ অকৃতকার্যতায় কাবিলের দুঃখ ও ক্ষোভ বেড়ে গেল। সে আত্মসংবরণ করতে পারল না। তাই সে হাবিলকে হত্যা করার সংকল্প করল এবং এক পর্যায়ে তাকে হত্যা করে ফেলল। { মাআ’রেফুল কুরআন বাংলা সংস্করণ-৩২৪ পৃষ্ঠা। }
হাবিল ও কাবিলের কুরবানীর ঘটনা পবিত্র কুরআনে এ ভাবে বর্ণিত হয়েছে,
وَاتْلُ عَلَيْـهِمْ نَبَاَ ابْـنَـىْ ادَمَ بِـالْـحَـقِّ- اِذْ قَـرَّبَـا قُـرْبَانًا فَـتُـقُـبِّـلَ مِنْ اَحَدِهِمَا وَلَمْ يُـتَـقَبَّلْ مِنَ الْاخَرِ- قَالَ لَاَقْتُلَـنَّكَ- قَالَ اِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِيْنَ- لَئِنْ بَسَطْتَّ اِلَىَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِىْ مَا اَنَا بِبَاسِطٍ يَّدِىَ اِلَيْكَ لِاَ قْتُلَكَ- اِنِّىْ اَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعلَمِيْنَ- اِنِّىْ اُرِيْدُ اَنْ تَبُـوْاَ بِـاِثْمِىْ وَاِثْمِكَ فَتَكُـوْنَ مِن اَصْحبِ النَـارِ- وَذلِكَ جَزؤُ الظّلِمِيْنَ- فَطَوَّعَتْ لَـهُ نَـفْسُه قَـتْلَ اَخِـيْـهِ فَقَـتَـلَهُ فَاَصْبَحَ مِنَ الْـخسِرِيْنَ- فَبَـعَـثَ اللهُ غُـرَابًا يَبْحَثُ فِى الْاَرْضِ لِيُرِيَهُ كَـيْـفَ يُـوَارِىْ سَـوْءَةَ اَخِيْهِ- قَالَ يـوَ يْلَتـى اَعَجَزْتُ اَنْ اَكُوْنَ مِـثْلَ هـذَا الْغُرَابِ فَاُوَارِىَ سَـوْءَةً– فَاَصْبَحَ مِنَ النّدِمِيْنَ
“আপনি তাদেরকে আদমের দু’ পুত্রের ঘটনাটি ঠিকভাবে শুনিয়ে দিন। (তা হচ্ছে এই যে,) যখন তারা উভয়ে কুরবানী পেশ করলো, তখন তাদের একজনের কুরবানী গৃহীত হল আর অপর জনের কুরবানী গৃহীত হলোনা। তখন সে ভাইকে বলল- অবশ্যই আমি তোমাকে হত্যা করব। সে উত্তরে বলল আল্লাহ তো মুত্তাকীদের কুরবানীই কবুল করেন।
যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে আমার দিকে হস্ত প্রসারিত কর, তবে আমি তোমাকে হত্যা করতে তোমার দিকে হস্ত প্রসারিত করব না। নিশ্চয়ই আমি বিশ্ব জগতের পালন কর্তা আল্লাহকে ভয় করি। আমি চাই যে, আমার পাপ ও তোমার পাপ তুমি নিজের মাথায় চাপিয়ে নাও। অত:পর তুমি দোযখীদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে যাও। এটাই অত্যাচারীদের শাস্তি। অতঃপর তার অন্তর তাকে ভ্রাতৃ হত্যায় উদ্বুদ্ধ করল। অনন্তর সে তাকে হত্যা করল। ফলে সে ক্ষতি গ্রস্তদের অন্তর্ভূক্ত হয়ে গেল।
আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সে কিভাবে সমাহিত করবে। সে বললো, আফসোস! আমি কি এ কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ সমাহিত করি! অত:পর সে অনুতাপ করতে লাগল”। { সূরা আল মায়িদাহ, ২৭-৩১ আয়াত। }
উল্লেখ্য যে, হযরত আদম আ. এর পর সকল উম্মতের মধ্যেই অবিচ্ছন্ন ভাবে কুরবানীর ধারাবাহিকতা চলতে থাকে।
আমাদের কুরবানী সুন্নাতে ইবরাহীমী
কুরবানী ইবাদত হিসেবে যদিও আদম আ. এর যুগ হতে হয়ে আসছে কিন্তু পরবর্তীতে হযরত ইবরাহীম আ. এর এক ঐতিহাসিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে শুরু হয়েছে। আমরা হযরত ইবরাহীম আ. এর মিল্লাতের উপর প্রতিষ্ঠিত আছি। এ মিল্লাতের প্রতিষ্ঠাতা ও মুসলিম জাতির পিতা হচ্ছেন হযরত ইবরাহীম আ.। তিনি যেমন আল্লাহর নির্দেশে জীবনের সবচাইতে প্রিয় বস্তু- পুত্র ইসমাঈলকে তাঁর উদ্দেশ্যে কুরবানী করতে প্রস্তুত ছিলেন, ঈদুল আয্হার দিন মুসলমানরাও তেমনি পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের প্রিয়তম জান-মাল আল্লাহর পথে কুরবানী করার সাক্ষ্য প্রদান করেন।
মুসলিম মিল্লাতের পিতা হযরত ইবরাহীম আ. এর সেই মহত্ব ও মাকবুল কুরবানীকে শাশ্বত রূপদানের জন্যেই আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর রাসূল সা. এই দিনে মুসলমানদেরকে ঈদুল আয্হা উপহার দিয়েছেন এবং এ কুরবানী করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হযরত ইবরাহীম আ. কর্তৃক স্বীয় পুত্র ইসমাঈলের কুরবানীর জীবন্ত ইতিহাস
মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মহান নবী হযরত ইবরাহীম আ. কে আল্লাহ তায়ালা বিভিন্ন ধরনের কঠিন থেকে কঠিনতর পরীক্ষা করেছেন। তিনি প্রত্যেকটি পরীক্ষায় পূর্ণ সফলকাম প্রমাণিত হয়েছেন। পরীক্ষাগুলি হলো-
এক. তাওহীদের হেফজতের প্রয়োজনে চিরদিনের জন্য প্রিয় জ¤œভূমি ত্যাগ করে হিজরত করলেন। হযরত লূত আ. যিনি ইতিপূর্বে তাঁর উপর ঈমান এনেছিলেন তাকে সাথে নিয়ে নিজ জ¤œভূমি ইরাক থেকে হিজরত করে ফিলিস্তিনের কেনানে অবস্থান নিলেন। ৮৬ বৎসর বয়সে সেখানে বসে আওলাদের জন্য দোয়া করলেন
رَبِّ هَـبْ لِىْ مِـنَ الـصَّالِـحِيْـنَ “হে আল্লাহ আমাকে সৎ পুত্র দান করুন”। { সূরা আসসাফ্ফাত-১০০।}
মহান আল্লাহ তায়ালা সুসংবাদ দিয়ে বললেন
فَـبَـشَّـرْنهُ بِـغُـلـمٍ حَـلِـيْـمٍ
“ইবরাহীমকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। ৯৯ বৎসরের সময় আরেক জন ছেলে হয়েছে তার নাম ইসহাক”। { সূরা আসসাফ্ফাত-১০১।}
দুই. নমরুদ কর্তৃক প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হয়ে চরম ধৈর্য্যরে ও আল্লাহ প্রেমের পরাকাষ্ঠ প্রদর্শন করেন। আল্লাহ তায়ালা তাঁর খলীলের জন্য আগুনকে ফুলবাগীচায় পরিণত করে দিয়েছিলেন।
মহান আল্লাহ্ বলেন
قُلْنَا يا نَارُ كُوْ نِىْ بَرْدًا وَ سَلَا مًا عَلى اِبْرَاهِيْمَ
“আমি বললাম, হে আগুন, তুমি ইবরাহীমের উপর শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও”। { সূরা আল আম্বিয়া -৬৯। }
তিন. অতঃপর যখন তাঁর প্রিয় আদরের পুত্র ইসমাঈল ও প্রিয় স্ত্রী হযরত হাজেরা আ. কে মক্কার বিরাণ মরুভূমিতে ছেড়ে আসার আদেশ হলো। সেটাও ছিল কঠিন পরীক্ষা। কেননা বার্ধক্য ও শেষ বয়সের বহু আকাংখার স্বপ্নসাধ, দিবা রাত্রির প্রার্থণার ফল এবং পরিবারের একমাত্র আশার আলো হযরত ইসমাঈল কে শুধু আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পানি ও জনমানবহীন মরু প্রান্তরে রেখে এসেছেন। অথচ একবারও পিছনের দিকে ফিরেও তাকাননি। যেন এমন না হয় যে, পিতৃ¯েœহ উথলিয়ে উঠে এবং আল্লাহর আদেশ পালনে কোন প্রকার বিচ্যুতি ঘটে যায়। স্ত্রী ও পুত্রকে সেখানে রেখে এসে তিনি কেবল আল্লাহ তায়ালার নিকট দোয়া করলেন:
رَبَّناَ اِنِّىْ اَسْكَنْتُ مِنْ ذُرِّيَّتِىْ بِوَادٍ غَيْرِ ذِىْ زَرْعٍ عِنْدَ بَيْتِكَ الْمُحَرَّمِ- رَبَّنَا لِيُقِيْمُوْا الصَّلوةَ فَا جْعَلْ اَفْئِدَةً مِّنَ النَّاسِ تَهْوِىْ اِلَيْهِمْ وَاَرْزُقْهُمْ مِّنَ الثَمَرَاتِ لَعَلَّهُمْ يَشْكُرُوْنَ
“হে আল্লাহ! আমি নিজের এক বংশধরকে আপনার পবিত্র ঘরের নিকট অনাবাদ জায়গায় বসবাস করালাম। হে আল্লাহ ! যেন তারা নামায কায়েম করে। অত;পর আপনি কিছু লোকের অন্তর তাদের প্রতি আকৃষ্ট করুন এবং তাদের ফল ফলাদি দ্বারা রুজি দান করুন। আশা করি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে”। { সূরা আল ইবরাহীম -৩৭।}
চার. উপরোল্লিখিত পরক্ষিাগুলির কঠিন মঞ্জিল অতিক্রম করার পর হযরত ইবরাহীম আ. কে স্বপ্নের মাধ্যমে সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন করা হয়। যা বিগত পরীক্ষাগুলির চেয়ে ও অধিক কঠিন, হৃদয় বিদারক ও আল্লাহ প্রেমের কঠিন পরীক্ষা। কোন কোন বর্ণনা মতে জানা যায় যে, এই স্বপ্ন তিনি পরপর তিন রাত্রি দেখেন।
স্বপ্নে তিনি একমাত্র প্রিয় পুত্র ইসমাঈল কে কুরবানী করতে আদিষ্ট হন। প্রাণ প্রিয় পুত্রকে কুরবানী করার নির্দেশ তাঁকে এমন সময় দেয়া হয়েছিল, যখন অনেক দোয়া কামনা করে পাওয়া সন্তানকে লালন পালন করার পর পুত্র পিতার সাথে চলাফেরা করতে পারে এবং তাঁকে সাহায্য করার যোগ্য হয়েছে। তাফসীরবিদগণ লিখেছেন: এ সময় হযরত ইসমাঈলের বয়স ছিল তের বছর। কেউ কেউ বলেছেন তিনি তখন বয়প্রাপ্ত হয়ে গিয়েছিলেন। { তাফরীরে মাযহারী।}
তবে তাফসীরে রুহুল বয়ানে আছে ৯ বছরের কথা। এ কথা অকাট্যভাবে প্রমাণিত সত্য যে, নবী রাসূলগণের স্বপ্নও ওহীর অর্ন্তভূক্ত। তাই এ স্বপ্নের অর্থ ছিল এই যে, আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে হযরত ইবরাহীম আ. এর প্রতি একমাত্র পুত্রকে যবেহ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এ হুকুমটি স্বপ্নের মাধ্যমে দেয়ার কারণ হলো হযরত ইবরাহীম আ. এর আনুগত্যের বিষয়টি পূর্ণমাত্রায় প্রমাণিত করা। হযরত ইবরাহীম আ. মহান প্রতি পালকের নির্দেশ সত্বর পালনের নিমিত্তে যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন। কিন্তু এ পরীক্ষাটি যেহেতু ইবরাহীম আ. এর ব্যক্তিত্বের সাথে সাথে তার পুত্রও সংশ্লিষ্ট ছিলেন তাই তিনি তার পুত্র ইসমাঈলকে লক্ষ্য করে বললেন
قَالَ يبُنَىَّ اِنِّىْ اَرى فِى الْمَنَـامِ اَنِّى اَذْ بَـحُـكَ فَـانْـظُـرْ مَـاذَا تَـرى-
“হে প্রাণ প্রিয় পুত্র আমার! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি। সুতরাং তুমি চিন্তা ভাবনা করে দেখ এবং এ স্বপ্নের ব্যাপারে তোমার অভিমত কি? তা বল”। { সূরা আস-সাফফাত-১০২ ।}
যেমন বাপ, তেমন বেটা। পুত্রও ছিলেন যেন হযরত ইবরাহীম আ. এর ছাঁচে গড়া, কেননা তিনি ও ভাবী নবী। তাই তৎক্ষণাৎ আত্মসর্ম্পনে মস্তক অবনত করে পুত্র জবাবে বললেন :
قَالَ يـاَبَتِ افْـعَـلْ مَا تُـؤْمَرُ- سَـتَـجِـدُ نِىْ اِنْ شَـاءَ اللهُ مِنَ الـصّـبِـرِيْـنَ-
“হে আমার পিতাজী! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন। ইনশা আল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্যশীলদের মধ্যে পাবেন”। { সূরা আস সাফ্ফাত-১০২।}
পুত্রের সাথে পরামর্শের হিকমত ছিল এই যে,
প্রথমত: পুত্রের দৃঢ়তা, হিম্মত এবং আল্লাহর আনুগত্যের জয্বা সৃষ্টি হওয়ার পরীক্ষা স্বরূপ।
দ্বিতীয়ত : সে আনুগত্য স্বীকার করলে সওয়াব ও প্রতিদানের অধিকারী হবে। কেননা সওয়াবের জন্য নিয়ত ও আগ্রহ জরুরী।
তৃতীয়ত : যবেহের সময় মানুষ হিসেবে এবং স্বভাবজাত পিতৃ¯েœহের কারণে কোন ভূল ভ্রান্তি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থেকে অনেকটা মুক্ত থাকার প্রবল আশা সৃষ্টি হবে।{ তাফসীরে রুহুল বয়ান।}
পরামর্শ শেষে পিতা ও পুত্র মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে কুরবানীর নির্দেশ পালনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন এবং এ কাজ সমাধার জন্য তারা মিনা প্রান্তরে গমন করেন।
ইতিহাস ও তাফসীর ভিত্তিক কোন কোন রেওয়ায়াত থেকে জানা যায় যে, শয়তান কুরবানীর মহান একাজে বিভিন্নভাবে বাঁধার সৃষ্টি করে । সে প্রথমে মা হাজেরা ও ইসমাঈল আ. কে উল্টো বুঝিয়ে এ থেকে বিরত রাখতে চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁরা শয়তানের প্ররোচনায় কোন পাত্তা দিলেন না। মরদুদ শয়তান হযরত হাজেরা আ. ও হযরত ইসমাঈল আ. কে ধোঁকা দেয়া থেকে নিরাশ হয়ে মিনা যাওয়ার পথে ‘জামরায়ে আকাবাহ’, ‘জামারায়ে উসত্বা’ এবং ‘জামরায়ে উলা’ এই তিন জায়গায় তিনবার হযরত ইবরাহীম আ. কে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে এবং হযরত ইবরাহীম আ. প্রত্যেকবারই তাকে সাতটি করে কংকর নিক্ষেপের মাধ্যমে তাড়িয়ে দেন। অদ্যাবধি এ প্রশংসনীয় কাজের স্মৃতি স্বরূপ মিনায় ঐ তিনটি স্থানে কংকর নিক্ষেপ করার বিধান হাজীদের জন্য ওয়াজিব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
অবশেষে পিতা-পুত্র উভয়ে যখন এই মহান কুরবানীর ইবাদত পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানগাহে পৌঁছলেন এবং ইবরাহীম আ. কুরবানী করার জন্য ইসমাঈল আ. কে শোয়ালেন, তখন পুত্র ইসমাঈল আ. পিতা ইবরাহীম আ. কে বললেন আব্বাজান! আমার হাত পা খুব শক্ত করে বেঁধে নিন যাতে আমি নড়াচড়া করতে না পারি। আর আপনার পরিধেয় বস্ত্রাদি সামলে নিন, যাতে আমার রক্তের ছিটা না পড়ে। অন্যথায় এতে আমার ছওয়াব হ্রাস পেতে পারে। এছাড়া রক্ত দেখলে আমার মা অধিক ব্যাকুল হবেন। আপনার ছুরিটি ধার দিয়ে নিন এবং আমার গলায় দ্রুত চালাবেন, যাতে আমার প্রাণ সহজে বের হয়ে যায়। কারণ, মৃত্যু বড় কঠিন ব্যাপার। আপনি আমার আম্মাজানের নিকট আমার শেষ বিদায়ের সালাম টুকু অনুগ্রহ পূর্বক পৌঁছে দিবেন। যদি আমার জামা তার নিকট নিয়ে যেতে চান, তবে নিয়ে যাবেন।
একমাত্র আদরের সন্তানের মুখে এমন কথা শুনে পিতার মানসিক অবস্থা কি যে হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। কিন্তু হযরত ইবরাহীম আ. দৃঢ়তায় অটল পাহাড় হয়ে জবাব দিলেন, ওগো আমার প্রাণ প্রিয় বৎস! আল্লাহর নির্দেশ পালন করার জন্য তুমি আমার চমৎকার সহায়ক হয়েছ। অতঃপর তিনি পুত্রকে আদর করে চুম্বন করলেন এবং অশ্রু সজল নয়নে তাকে বেঁধে নিলেন ।
অতঃপর তাঁকে সোজা করে শুইয়ে দিয়ে তার গলায় ছুরি চালালেন। কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার যে, বার বার ছুরি চালানো সত্বেও গলা কাটছে না। কেননা আল্লাহ তায়ালা স্বীয় কুদরতে পিতলের একটা টুকরা মাঝখানে অন্তরায় করে দিয়েছিলেন।
তখন পুত্র নিজেই আবদার করে বললেন, আব্বাজী! আমাকে উপুড় করে শুইয়ে নিন। কারণ, আমার মুখমন্ডল দেখে আপনার মধ্যে পিতৃ ¯েœহ উথলে উঠে। ফলে গলা কাটা যাচ্ছে না। এ ছাড়া ছুরি দেখে আমি ঘাবড়ে যাই। সে মতে হযরত ইবরাহীম আ. তাকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন এবং পুনরায় সজোরে প্রাণপণে ছুরি চালালেন।
কিন্তু তখন ও গলা কাটতেছেনা। হযরত ইবরাহীম আ. চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। হযরত ইবরাহীম আ. এর এ প্রাণন্তর প্রচেষ্টা প্রত্যক্ষ করে মহান আল্লাহ সন্তুষ্ট হলেন এবং হযরত ইসমাঈলের বিনা যবেহেই তার কুরবানী কবুল করে নিলেন। এ ব্যাপারে হযরত ইবরাহীম আ. এর উপর ওহী নাযিল হলো। { তাফসীরে রুহুল মাআ’নী। সূত্র হযরত কাতাদাহ রা. হতে বর্নিত, তাফসিরে ইবনে কাসীর মসনদে আহমদ থেকে নকল করা হয়েছে। সূত্র হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত।}
فَلَمَّا اَسْلَمَا وَتَلَّه لِلْجَبِيْنِ- وَنَادَيْنهُ اَنْ يَّا اِبْرَاهِيْمَ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّءْيَا- اِنَّا كَذلِكَ نَـجْـزِى الْـمُحْسِنِيْـنَ- اِنَّ هـذَا لَهُـوَ الْـبَلـؤُ الْمُبِيْـنُ- وَقَـدَيْنهُ بِـذِبْحٍ عَـظِـيْمٍ-
“অবশেষে যখন পিতা-পুত্র উভয়ে আল্লাহর কাছে নিজেদের কে সোপর্দ করলো এরং ইবরাহীম আ. পুত্রকে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন (যবেহ করার জন্যে), তখন আমরা তাকে সম্বোধন করে বললাম, হে ইবরাহীম! তুমি সপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখিয়েছ। আমরা সৎকর্মশীলদের এরূপ প্রতিদানই দিয়ে থাকি। বস্তুত এ এক সুস্পষ্ট কঠিন পরীক্ষা। আর আমরা বিরাট কুরবানী ফিদিয়া স্বরূপ দিয়ে তাকে (ইসমাঈলকে) উদ্ধার করেছি”। { সূরা আস-সাফ্ফাত ১২০-১০৭।}
অতঃপর আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিলেন এখন পুত্রকে ছেড়ে দিন এবং আপনার নিকট যে দুম্বাটি দাঁড়ানো রয়েছে, পুত্রের পরিবর্তে সেটাকে যবেহ করুন। তখন ইবরাহীম আ. পিছনের দিকে তাকিয়ে দেখেন, একটি হৃষ্ট পুষ্ট দুম্বা দাঁড়ানো আছে। আল্লাহর শোকর আদায় করে তিনি সেই দুম্বাটিকে যবেহ করলেন।
এটাই সেই কুরবানী যা আল্লাহর দরবারে এতই প্রিয় ও মাকবুল হয়েছিল যে, আল্লাহ তায়ালা পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে তা অবিস্মরণীয় রূপে বিরাজমান রাখার ব্যবস্থা করে দিলেন।
যদ্দরুণ মিল্লাতে ইবরাহীমে তথা দ্বীন ইসলামে এক মহান ওয়াজিব ইবাদত ও শিয়ার প্রতীক হিসেবে এ কুরবানী আজও পালিত হয়ে আসছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা পালিত হতে থাকবে।
তাই মহান আল্লাহ বলেন
وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِى الْا خِرِيْنَ
“আর আমরা ভবিষ্যতের উম্মতের মধ্যে ইবরাহীমের এ সুন্নাত স্মরণীয় করে রাখলাম”। { সূরা আস আস সাফ্ফাত ১০৮।}
বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা. এর প্রতি কুরবানীর নির্দেশ
আল কুরআনে নবী করীম সা. কে সালাত আদায় করার মতো কুরবানী করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে ঃ فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ
“তোমার রবের জন্য নামায পড় এবং কুরবানী করো”। { সূরা আল কাউসার -০২}
মহান আল্লাহ কুরবানী ও জীবন দানের প্রেরণা ও চেতনা সমগ্র জীবনে জাগ্রত রাখার জন্যে নবী সা. কে আরো নির্দেশ দিয়ে বলেছেন
قُلْ اِنَّ صَلوتِىْ وَنُسُكِىْ وَمَحْيَاىَ وَمَمَاتِىْ لِلّهِ رَبِّ الْعلَمِيْنَ– لَا َشَرِيْكَ لَه وَبِذ لِكَ اُمِرْتُ وَاَنَا اَوَّلُ الْمُسْلِمِيْنَ-
“বলুন! হে মুহাম্মদ! আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সব কিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্যে। তাঁর কোন শরীক নেই। আমাকে তাঁরই নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি সকলের আগে তাঁর অনুগত ও ফরমাবরদার”। { সূরা আল আনআম-১৬২}
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত যে, নবী করীম সা. মদীনায় দশ বৎসর অবস্থান করেন। এ সময় তিনি প্রতি বছর কুরবানী করতেন। { সুনানে আত তিরমিযী}
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন