পরে তিনি মদীনায় হিজরত করলেন।
কিন্তু সেখানেও তারা লুটতরাজ, হামলা ও নানাবিধ চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র চালাতে লাগল। ফলে তাদের হামলা প্রতিরোধের
জন্য এবং অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর রাসূলকে যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয়
(হজ্জ ৩৯)। ফলে এটাই প্রমাণিত সত্য যে, হামলাকারীদের প্রতিরোধ ও তাদের ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য
যুদ্ধগুলি সংঘটিত হয়েছিল এবং কোথাও কখনো যুদ্ধের সূচনা মুসলমানদের পক্ষ থেকে
হয়নি।
(২) সমস্ত যুদ্ধই ছিল মূলতঃ
কুরায়েশদের হিংসা ও অহংকারের ফল। বনু কুরায়েশ, বনু গাত্বফান, বনু সুলায়েম, বনু ছা‘লাবাহ, বনু ফাযারাহ, বনু কেলাব, বনু আযল ও ক্বারাহ,
বনু আসাদ, বনু যাকওয়ান, বনু লাহিয়ান, বনু সা‘দ, বনু তামীম, বনু হাওয়াযেন, বনু ছাক্বীফ প্রভৃতি যে
গোত্রগুলির সাথে যুদ্ধ হয়েছিল, মূলতঃ এরা সবাই ছিল কুরায়েশদের পিতামহ ইলিয়াস বিন মুযারের বংশধর।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নিজেও ছিলেন কুরায়েশ বংশের বনু হাশেম গোত্রের।
ফলে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে
এদের যত লড়াই হয়েছে,
সবই ছিল মূলতঃ গোত্রীয়
হিংসার কারণে। এইসব গোত্রের নেতারা রাসূল (ছাঃ)-এর নেতৃত্ব ও প্রাধান্যকে বরদাশত
করতে পারেনি। বদরের যুদ্ধে বনু হাশেম গোত্র চাপের মুখে অন্যান্যদের সাথে থাকলেও
তারা রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি। কিন্তু আবু জাহল সহ বাকীরা সবাই ছিল মূলতঃ
ইলিয়াস বিন মুযারের বংশধর অন্যান্য গোত্রের।
(৩) রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনকালে
আরব উপদ্বীপের অন্য কোন গোত্রের সাথে তাঁর কোন যুদ্ধ বা সংঘাত হয়নি। তিনি সারা
আরবে লড়াই ছড়িয়ে দেননি।
(৪) রাসূল (ছাঃ)-এর
শত্রুতায় ইহুদীরা ছিল কুরায়েশদের সঙ্গে একাত্ম এবং গোপনে চুক্তিবদ্ধ।
(৫) নবুঅতের পুরা সময়কালে একজন
লোকও এমন পাওয়া যাবে না,
যে ব্যক্তি কেবলমাত্র
ধর্মীয় কারণে মুসলমানদের হাতে নিগৃহীত হয়েছে। যতক্ষণ না সে মুসলমানদের উপরে
চড়াও হয়েছে,
কিংবা ষড়যন্ত্র করেছে।
চাই সে মূর্তিপূজারী হৌক বা ইহুদী-নাছারা হৌক বা অগ্নিউপাসক হৌক।
(৬) মুশরিকদের হামলা ঠেকাতে
গিয়ে দারিদ্র্য জর্জরিত ও ক্ষুৎ পিপাসায় কাতর মুসলিম বাহিনী ক্রমে এমন শক্তিশালী
এক অপরাজেয় বাহিনীতে পরিণত হয় যে, রাসূল (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তারা কোন যুদ্ধেই পরাজিত হননি।
এমনকি তাঁর মৃত্যুর পরেও খেলাফতে রাশেদাহর যুগে এই বিজয়াভিযান অব্যাহত থাকে।
তৎকালীন বিশ্বশক্তি রোমক ও পারসিক শক্তি ঈমানের বলে বলীয়ান মুসলিম বাহিনীর হাতে
নাস্তানাবুদ হয়ে যায়।
(৭) রাসূল (ছাঃ) যুদ্ধকে পবিত্র
জিহাদে পরিণত করেন। কেননা জিহাদ হ’ল অন্যায় ও অসত্যের বিরুদ্ধে আল্লাহর উদ্দেশ্যে
ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সে যুগের যুদ্ধনীতিতে সকল প্রকার স্বেচ্ছাচার
সিদ্ধ ছিল। কিন্তু ইসলামী জিহাদের প্রতিটি ক্ষেত্রে আল্লাহ প্রদত্ত বিধি-বিধান
কঠোরভাবে অনুসৃত হয়। যা মানবতাকে সর্বদা সমুন্নত রাখে এবং যা প্রতিপক্ষের মনে
গভীরভাবে রেখাপাত করে। যে কারণে সারা আরবে ও আরবের বাইরে দ্রুত ইসলাম বিস্তার লাভ
করে মূলতঃ তার আদর্শিক ও মানবিক আবেদনের কারণে।
(৮) যুদ্ধবন্দীর উপরে বিজয়ী
পক্ষের অধিকার সর্বযুগে স্বীকৃত। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নীতি এক্ষেত্রে
নবযুগের সূচনা করে। প্রতিপক্ষ বনু হাওয়াযেন গোত্রের ১৪ জন নেতা ইসলাম কবুল করে
এলে তাদের সম্মানে ও অনুরোধে হোনায়েন যুদ্ধের ছয় হাযার যুদ্ধবন্দীর সবাইকে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বিনা শর্তে মুক্তি দেন। এমনকি বিদায়ের সময়ে তাদের প্রত্যেককে
একটি করে মূল্যবান ক্বিবতী চাদর উপহার দেন।
(৯) যুদ্ধরত কাফির বা বিচারে
মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত ব্যক্তি ব্যতীত কাউকে হত্যা করার বিধান ইসলামে নেই। সেকারণ
মাদানী রাষ্ট্রের অধীনে চুক্তিবদ্ধ অসংখ্য অমুসলিম নাগরিক পূর্ণ নাগরিক অধিকার
নিয়ে শান্তির সাথে বসবাস করত।
(১০) রাসূল (ছাঃ)-এর নির্দেশ
অর্থাৎ কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুমতি বা আদেশ ব্যতীত কাউকে হত্যা করা নিষিদ্ধ ছিল।
সেকারণ মক্কা বিজয়ের পূর্বরাতে মক্কার নেতা আবু সুফিয়ান হযরত ওমরের হাতে ধরা
পড়া সত্ত্বেও তাঁর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রতি ওমর
(রাঃ)-এর অটুট আনুগত্য প্রদর্শনের কারণে।
অতএব রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের
বাইরে এককভাবে কেউ কাউকে হত্যা বা যখম করতে পারে না। এতে বুঝা যায় যে, জিহাদ ফরয হ’লেও সশস্ত্র জিহাদ
পরিচালনার দায়িত্ব এককভাবে মুসলিম সরকারের হাতে ন্যস্ত, পৃথকভাবে কোন ব্যক্তি বা
সংগঠনের হাতে নয়। রাসূল (ছাঃ)-এর পরে খেলাফতে রাশেদাহর সময়েও একই নীতি অব্যাহত
ছিল।
মোট যুদ্ধ বা অভিযান সংখ্যা
এবং উভয় পক্ষে শহীদ ও নিহতদের সংখ্যা :
মানছূরপুরী মোট ৮২টি যুদ্ধ
অভিযানের তালিকা দিয়েছেন। আমরা তাঁর তালিকা ও মুবারকপুরীর তালিকা মিলিয়ে মোট
৮৬টি পেয়েছি,
যা লিপিবদ্ধ করলাম।
আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
মাদানী জীবনে ৮ বছরে সংঘটিত
৮৬টি গাযওয়া ও সারিইয়ার মধ্যে ২৯টি গাযওয়া ও ৫৭টি সারিইয়াতে উভয় পক্ষে নিহত ও
শহীদগণের সঠিক তালিকা নির্ণয় করা মুশকিল। মানছূরপুরী যে তালিকা দিয়েছেন, তাতে দেখা যায় যে, মুসলিম পক্ষে শহীদ হয়েছেন ২৫৯
জন এবং কাফের পক্ষে নিহত হয়েছেন ৭৫৯ জন। উভয়পক্ষে সর্বমোট নিহতের সংখ্যা ১০১৮
জন।
কিন্তু মানছূরপুরী ও
মুবারকপুরী উভয়ের দেওয়া যুদ্ধের বর্ণনা সমূহ হিসাব করে দেখা গেছে যে, মুসলিম পক্ষে ৩৩৯ জন এবং কাফির
পক্ষে ১০৯১ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে মানছূরপুরী সারিইয়া ইবনু আবিল আওজা-তে
(ক্রমিক ৬৫) মুসলিম পক্ষে ৪৯ জন শহীদ বলেছেন, যেটা ৩৩৯ জনের হিসাবে ধরা হয়েছে। কিন্তু মুবারকপুরী উক্ত
বিষয়ে কিছু বলেননি। অনুরূপভাবে গাযওয়া বনু কুরায়যাতে ইহুদীপক্ষে নিহতের সংখ্যা
মানছূরপুরী ৪০০ বলেছেন।
কিন্তু মুবারকপুরী ৬০০ থেকে
৭০০-এর মধ্যে বলেছেন। মানছূরপুরী ৪০০ ধরে হিসাব করেছেন। কিন্তু আমরা ৬০০ ধরে হিসাব
করেছি। ফলে কাফের পক্ষে আমাদের হিসাব তাঁর চাইতে বেশী হয়েছে। এর পরেও ৭টি
সারিইয়ায় প্রতিপক্ষের নিহতের সংখ্যা উল্লেখ না করে বলা হয়েছে ‘কিছু লোক’। অতএব
কাফের পক্ষে নিহতের সংখ্যা আরও কিছু বাড়তে পারে। উল্লেখ্য যে, সবচেয়ে বড় ৯টি যুদ্ধে অর্থাৎ
বদর (ক্রমিক- ৯) ওহোদ (২০),
খন্দক (৩১), খায়বর (৫২), মুতা (৬৯), মক্কা বিজয় (৭২), হোনায়েন (৭৭), ত্বায়েফ (৭৮) ও তাবূক (৮৪)
যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে যথাক্রমে ১৪, ৭০, ৬, ১৮, ১২, ২, ৬, ১২, ০০=১৪০ জন এবং কাফের পক্ষে ৭০, ৩৭, ১০, ৯৩, ০০, ১২, ৭১, ০০, ০০=২৯৩ জন সহ সর্বমোট ৪০৩ জন
নিহত হয়েছে। তাবূক যুদ্ধে কোন পক্ষে হতাহত হয়নি। আধুনিক জাহেলিয়াতের যুগে
তথাকথিত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যেভাবে দেশে দেশে নির্বিচারে মানুষ হত্যা
করা হয়, তার তুলনায় এগুলি তৃণসম বলা
চলে।
বিনিময়ে সমস্ত আরব উপদ্বীপে
প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী খেলাফত এবং যার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আল্লাহর
সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের সমান অধিকার। জান-মাল ও ইযযতের গ্যারান্টি লাভে
ধন্য হয়েছিল মানবতা। বিকশিত হয়েছিল সর্বত্র মানবিক মূল্যবোধের পুষ্পকলি। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক সমাজ
ব্যবস্থা নাগরিক জীবনে এনেছিল এক অনির্বচনীয় সুখ ও সমৃদ্ধির বাতাবরণ। সৃষ্টি
করেছিল সর্বত্র শান্তি ও নিরাপত্তার অনাবিল সুবাতাস।
ইসলামের যুদ্ধনীতি
ইসলামের দেওয়া যুদ্ধ নীতিতে
যোদ্ধা ও বিচারে দন্ডপ্রাপ্ত ব্যতীত কাউকে হত্যা করার যেমন কোন অনুমতি নেই। তেমনি
শরী‘আতের দেওয়া নিয়মনীতির বাইরে কোনরূপ স্বেচ্ছাচারিতার অবকাশ নেই। যেমন-
(১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ
করেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি কোন
চুক্তিবদ্ধ ব্যক্তিকে অর্থাৎ রাষ্ট্রের অনুগত কোন অমুসলিম ব্যক্তিকে হত্যা করে, তবে সে জান্নাতের সুগন্ধিও
পাবে না। অথচ তার সুগন্ধি ৪০ বছরের দূরত্ব হ’তে লাভ করা যাবে’।[16]
(২) অন্য হাদীছে আল্লাহর রাসূল
(ছাঃ) বলেন,
‘তোমরা যুদ্ধে চুক্তিভঙ্গ
করবে না, মৃতদেহ বিকৃত করবে না, বাড়াবাড়ি করবে না, শিশু-কিশোরদের হত্যা করবে না, গীর্জার অধিবাসী কোন
পাদ্রী-সন্ন্যাসীকে,
কোন মহিলাকে এবং কোন অতি
বৃদ্ধকে হত্যা করবে না।[17]
খাদ্যের প্রয়োজন ব্যতীত
কোন উট বা গাভী যবেহ করবে না …। যুদ্ধের প্রয়োজন ব্যতীত কোন ভৌতকাঠামো বিনষ্ট
করবে না বা কোন বৃক্ষ কর্তন করবে না। তোমরা দয়া প্রদর্শন কর। আল্লাহ দয়াশীলদের
পসন্দ করেন’।
আর সেকারণেই মক্কা বিজয়ের পর
দুশমননেতা আবু সুফিয়ানকে,
তার স্ত্রী হেন্দাকে
যিনি ওহোদ যুদ্ধে শহীদ হযরত হাসান (রাঃ)-এর নাক-কান কেটে গলার হার বানিয়েছিলেন ও
তার কলিজা চিবিয়েছিলেন,
অন্যতম নেতা আবু জাহলের
ছেলে ইকরিমা প্রমুখ শত্রুনেতা সহ সকলকে ক্ষমা করেছিলেন। কারু প্রতি সামান্যতম
প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেননি। আর এই উদারতার কারণেই তারা সবাই ইসলাম কবুল করেন ও
শত্রুতা পরিহার করে রাসূল (ছাঃ)-এর দলভুক্ত হয়ে যান।
(৩) তিনি সর্বদা সৈনিকদের বলতেন, يَسِّرُوْا وَلاَ تُعَسِّرُوْا وَسَكِّنُوْا وَلاَ تُنَفِّرُوْا
‘সহজ করো, কঠিন করো না। শান্ত থাক, ঘৃণা করো না’।[18] তিনি কখনো রাতে কাউকে হামলা
করতেন না। কাউকে আগুনে পোড়াতে তিনি কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। তিনি বলতেন, কোন আহতকে আক্রমণ করবে না, পলাতককে ধাওয়া করবে না, বন্দী এবং কোন দূতকে হত্যা
করবে না, লুটতরাজ করবে না। তিনি বলতেন, গণীমতের মাল মৃত লাশের ন্যায়
হারাম’।
(৪) মক্কা বিজয়ের দ্বিতীয়
দিনের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা হত্যা করা থেকে নিবৃত্ত হও। কেননা এর দ্বারা কোন লাভ
হ’লে এর সংখ্যা বেড়ে যেত’। অতএব এরপরে যদি কেউ হত্যা করে, তবে তার উত্তরাধিকারীদের জন্য
দু’টি এখতিয়ার থাকবে। তারা চাইলে হত্যার বদলে হত্যা করবে, অথবা রক্ত মূল্য গ্রহণ করবে’।
(৫) বিদায় হজ্জের ভাষণে
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
‘তোমাদের রক্ত, তোমাদের ধন-সম্পদ, তোমাদের ইযযত পরস্পরের উপরে
এমনভাবে হারাম,
যেমন এই দিন, এই শহর ও এই মাস তোমাদের জন্য
হারাম’।[19]
(৬) খ্যাতনামা খৃষ্টান পন্ডিত
‘আদী বিন হাতেম যখন মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন, তখন আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাকে বলেন, ‘আদী তুমি কি (ইরাকের সমৃদ্ধ
শহর) হীরা দেখেছ?
যদি তোমার জীবন দীর্ঘ
হয়, তবে তুমি দেখবে যে, একজন পর্দানশীন মহিলা হীরা
থেকে এসে কা‘বাগৃহ ত্বাওয়াফ করবে, অথচ সে আল্লাহ ব্যতীত কাউকে ভয় করবে না…।[20]
এতে বুঝা যায় যে, একমাত্র ইসলামী খেলাফতের
অধীনেই রয়েছে মুসলিম-অমুসলিম সকল নাগরিকের জান-মাল ও ইযযতের গ্যারান্টি। অতএব
ইসলামী জিহাদ-এর মূল উদ্দেশ্য হ’ল, মানুষকে শয়তানের দাসত্ব হ’তে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে
আনা এবং সর্বত্র আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠা করা। আর এর মধ্যেই রয়েছে মানবতার মুক্তি
ও কল্যাণের স্থায়ী নিশ্চয়তা।
অভিযান সমূহ পর্যালোচনা
অভিযানগুলির মধ্যে ১ হ’তে
৭২-এর মধ্যে মোট ২১টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে কুরায়েশদের বিরুদ্ধে। ১১ হ’তে ৫৩-এর
মধ্যে মোট ৮টি অভিযান পরিচালিত হয়েছে ইহুদীদের বিরুদ্ধে। ৪৪ হ’তে ৮৬-এর মধ্যে ৬টি
অভিযান খৃষ্টানদের বিরুদ্ধে এবং ১০ হ’তে ৮৩-এর মধ্যে মোট ৫১টি অভিযান পরিচালিত
হয়েছে নাজদ ও অন্যান্য এলাকার বেদুঈন গোত্র ও সন্ত্রাসী ডাকাত দলের বিরুদ্ধে। এর
মধ্যে ২৪, ২৫ ও ৩৭ নং সারিইয়াহ তিনটি
ছিল স্রেফ তাবলীগী কাফেলা এবং প্রতারণামূলকভাবে যাদের প্রায় সবাইকে হত্যা করা
হয়। বদর সহ প্রথম দিকের ৯টি অভিযান ছিল কুরায়েশদের বাণিজ্য কাফেলা লুট করে তাদের
আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের যুদ্ধ
প্রস্ত্ততি ভন্ডুল করার জন্য।
শুরুতে কুরায়েশদের মূল লক্ষ্য
ছিল তাদের ভাষায় ছাবেঈ (صابئي) বা বিধর্মী মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথী মুষ্টিমেয় মুহাজিরদের নির্মূল
করা এবং সেখানে আক্রোশটা ছিল প্রধানতঃ ধর্মবিশ্বাস গত। কিন্তু পরে তাদের প্রধান
লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় মদীনা হয়ে সিরিয়ায় তাদের ব্যবসায়িক পথ কণ্টকমুক্ত করা।
সেই সাথে ছিল তাদের বড়ত্বের অহংকার। কেননা মুহাম্মাদ তাদের বহিষ্কৃত সন্তান হয়ে
তাদের চাইতে বড় হবে ও তাদের উপরে প্রাধান্য বিস্তার করবে, এটা ছিল তাদের নিকটে নিতান্তই
অসহ্য। তাদের এই ক্ষুব্ধ ও বিদ্বেষী মানসিকতাকেই কাজে লাগায় ধূর্ত ইহুদী নেতারা ও
অন্যান্যরা। ফলে মক্কা বিজয়ের পূর্বেকার মুসলিম অভিযানগুলির অধিকাংশ ছিল প্রতিরোধ
মূলক।
ইহুদীদের বিরুদ্ধে অভিযানগুলি
হয় তাদের চুক্তিভঙ্গের কারণে এবং অবিরত ভাবে তাদের চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কারণে।
খৃষ্টানদের কোন তৎপরতা মদীনায় ছিল না। সিরিয়ার নিকটবর্তী দূমাতুল জান্দালে প্রথম
যে অভিযানটি (ক্রমিক-৪৪) তাদের দিকে প্রেরিত হয়, সেটি ছিল মূলতঃ তাবলীগী মিশন এবং তাতে তাদের
গোত্রনেতাসহ সকলে মুসলমান হয়ে যায়। পরে যে মুতার যুদ্ধ (ক্রমিক-৬৯) হয়, সেটি ছিল সিরিয়া অঞ্চলে রোমক
গবর্ণর শোরাহবীলের মুসলিম দূত হত্যার প্রতিশোধ হিসাবে। তাবূক যুদ্ধ ছিল আগ্রাসী
রোম সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং তার প্রেরিত বিশাল বাহিনীর মদীনা আক্রমণ ঠেকানোর জন্য।
অবশেষে রোমকরা ভয়ে পিছু হটে গেলে কোন যুদ্ধ হয়নি।
উল্লেখ্য যে, ৩য় হিজরীতে ওহোদ যুদ্ধে
মুনাফেকী করার কারণে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) তাদেরকে আর কোন যুদ্ধে যাবার অনুমতি
দেননি। কিন্তু আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ও অন্যান্যদের প্রকাশ্যে তওবা ও বারবার
অনুরোধে তিনি তাদেরকে ৫ম হিজরীতে মুছত্বালিক যুদ্ধে (ক্রমিক-৪৩) যাবার অনুমতি দেন।
কিন্তু তারা যথারীতি মুনাফেকী করে। পরে তাদেরকে আর কোথাও অনুমতি দেওয়া হয়নি।
কিন্তু তাবূক অভিযানে (ক্রমিক-৮৪) তাদের ১২ জন এজেন্ট গোপনে ঢুকে পড়ে ও
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়।
পরিশেষে বলা চলে যে, ইসলামের দাওয়াত মক্কায় ছিল
কেবল প্রচারমূলক। কিন্তু মদীনায় ছিল প্রচার ও প্রতিরোধ উভয় প্রকারের। যুগে যুগে
ইসলামী দাওয়াতে উভয় নীতিই প্রযোজ্য হয়েছে। এখানে হারাম মাসে যুদ্ধ করার অনুমতিও
পাওয়া গেছে বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে। যার সূত্রপাত ঘটে নাখলা যুদ্ধে (ক্রমিক-৮)। এ
প্রসঙ্গে সূরা বাক্বারাহ ২১৭নং আয়াতটি নাযিল হয়।
তুলনামূলক চিত্র
খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর উক্ত
ইসলামী বিপ্লবের পরে বিগত ১৩শ বছরে পৃথিবী অনেক দূর এগিয়েছে। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ, ফ্যাসিবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইত্যাকার
বহুতর মতবাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে আধুনিক পৃথিবীতে। গত প্রায় দুই শতাব্দীকাল
ব্যাপী চলছে কথিত গণতন্ত্র,
জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের
জয়জয়কার। যুলুম ও অত্যাচারের ষ্টীম রোলার চালানো হচ্ছে বিশ্বব্যাপী মূলতঃ ঐ
তিনটি গালভরা আদর্শের নাম নিয়েই। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে
কেবল বিংশ শতাব্দীতেই সংঘটিত প্রধান তিনটি যুদ্ধে পৃথিবীতে কত বনু আদমকে হত্যা করা
হয়েছে, তার একটা হিসাব আমরা তুলে ধরার
প্রয়াস পাব। তবে এ হিসাব পূর্ণাঙ্গ কি-না সন্দেহ রয়েছে। বরং প্রকৃত হিসাব
নিঃসন্দেহে এর চাইতে অনেক বেশী হবে।
১. ১ম মহাযুদ্ধ (১৯১৪-১৯১৮) :
মোট নিহতের সংখ্যা ৭৩ লাখ ৩৮ হাযার। তন্মধ্যে (১) রাশিয়ায় ১৭ লাখ (২) জার্মানীতে
১৬ লাখ (৩) ফ্রান্সে ১৩ লাখ ৭০ হাযার (৪) ইটালীতে ৪ লাখ ৬০ হাযার (৫) অষ্ট্রিয়ায়
৮ লাখ (৬) গ্রেট বৃটেনে ৭ লাখ (৭) তুরষ্কে ২ লাখ ৫০ হাযার (৮) বেলজিয়ামে ১ লাখ ২
হাযার (৯) বুলগেরিয়ায় ১ লাখ (১০) রুমানিয়ায় ১ লাখ (১১)
সার্বিয়া-মন্টিনিগ্রোতে ১ লাখ (১২) আমেরিকায় ৫০ হাযার। সর্বমোট ৭৩ লাখ ৩৮ হাযার।
এর মধ্যে ইংল্যান্ডের তালিকায়
ভারতীয়দের এবং ফ্রান্সের তালিকায় সেখানকার নতুন বসতি স্থাপনকারীদের নিহতের সংখ্যা
যুক্ত হয়েছে কি-না জানা যায়নি। তাছাড়া যুদ্ধে আহত, পঙ্গু, বন্দী ও নিখোঁজদের তালিকা
উপরোক্ত তালিকার বাইরে রয়েছে। অন্য এক হিসাবে নিহত ৯০ লাখ, আহত ২ কোটি ২০ লাখ এবং নিখোঁজ
হয়েছিল প্রায় ১ কোটি মানুষ।
২. ২য় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৪১-১৯৪৫)
: মোট নিহতের সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। তন্মধ্যে একা সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রায় ৮৯ লাখ
সৈন্য হারায় বলে মস্কো থেকে এএফপি পরিবেশিত ২০০৭ সালে প্রকাশিত রিপোর্টে জানা
যায়। এ সময় জাপানের হিরোশিমাতে নিক্ষিপ্ত এটমবোমায় তাৎক্ষণিক ভাবে নিহত হয় ১
লাখ ৩৮ হাযার ৬৬১ জন এবং ১৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ধ্বংসস্তূপ ও ছাইয়ে পরিণত হয়।
আমেরিকার ‘লিটল বয়’ নামক এই বোমাটি নিক্ষিপ্ত হয় ১৯৪৫ সালের ৬ই আগষ্ট সকাল সোয়া
৮-টায়। এর তিনদিন পরে ৯ই আগষ্ট বুধবার দ্বিতীয় বোমাটি নিক্ষিপ্ত হয় জাপানের
নাগাসাকি শহরে। যাতে সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে আড়াই লাখ বনু আদম।
উভয় বোমার তেজষ্ক্রিয়তার ফলে
ক্যান্সার ইত্যাদির মত দুরারোগ্য ব্যধিতে আজও সেখানকার মানুষ মরছে। বংশপরিক্রমায়
জাপানীরা বহন করে চলেছে এসব দুরারোগ্য ব্যাধি।[10] হিরোশিমা মিউনিসিপ্যালিটির
চেয়ারম্যান ১৯৪৯ সালের ২০শে আগষ্ট এক ঘোষণায় বলেন, ১৯৪৫ সালে ৬ আগষ্টের দিনে বোমা হামলায় মৃত্যু
বরণকারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১০ হাযার থেকে ৪০ হাযারের মধ্যে’।[11] এছাড়াও বর্তমানে সেখানে
জন্মগ্রহণকারী শিশুদের অধিকাংশ হচ্ছে পঙ্গু ও প্রতিবন্ধী। মূল ধ্বংসস্থলে আজও কোন
ঘাস পর্যন্ত জন্মায়না বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশ।
ভিয়েতনাম যুদ্ধ (১৯৫৫-১৯৭৩) :
আগ্রাসী মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে আক্রান্ত ভিয়েতনামীরা দীর্ঘ ১৮ বছর যাবৎ এই
যুদ্ধ করে। এতে এককভাবে আমেরিকা ৩৬ লাখ ৭২ হাযার মানুষকে হত্যা করে ও ১৬ লাখ
মানুষকে পঙ্গু করে এবং ৯ লাখ শিশু ইয়াতীম হয়।[12]
এতদ্ব্যতীত
বসনিয়া-হার্জেগোভিনা,
সোমালিয়া, সার্বিয়া, কসোভো, সূদান, শ্রীলংকা, কাশ্মীর, নেপাল, ইরাক, আফগানিস্তান ও অন্যান্য দেশ
সমূহে এইসব কথিত গণতন্ত্রী ও মানবাধিকারবাদী সাম্রাজ্যবাদীরা নিত্যদিন নানা
অজুহাতে যে কত মানুষের রক্ত ঝরাচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে?
জন ডেভেনপোর্ট তার An Apology for Muhammad
and Koran বইয়ে
কেবলমাত্র খৃষ্টান ধর্মীয় আদালতের নির্দেশে খৃষ্টান নাগরিকদের নিহতের সংখ্যা ১
কোটি ২০ লাখ বলেছেন। স্পেন সরকার ৩ লাখ ৪০ হাযার খৃষ্টানকে হত্যা করে। যার মধ্যে
৩২ হাযার লোককে তারা জীবন্ত পুড়িয়ে মারে।
এছাড়াও রয়েছে ২য়
বিশ্বযুদ্ধের সময় এডলফ হিটলার কর্তৃক জার্মানীতে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে ৬০ লাখ
ইহুদীকে হত্যা করার মর্মান্তিক বিভীষিকা এবং অন্যান্য নৃশংস হত্যার কাহিনী।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন