আবার যখন মিলবে হেথায় শরাব সাকির আঞ্জামে,
হে
বন্ধুদল, একটি
ফোটা অশ্রু ফেলো মোর নামে।
চক্রাকারে
পাত্র ঘুরে আসবে যখন সাকীর পাশ,
পেয়ালা
একটি উল্টে দিয়ো স্মরণ করে খৈয়ামে।
বহুমুখী প্রতিভার দৃষ্টান্ত দিতে বলা হলে বিশ্বসাহিত্য কিংবা ইতিহাসে যাদের নাম উপেক্ষা করা কঠিন ওমর খৈয়াম তাদের মধ্যে অন্যতম ও শীর্ষস্থানীয়। গত ১৮ ই মে ছিল বিশ্ববিশ্রুত ইরানী মনীষী, বিজ্ঞানী ও কবি হাকিম ওমর খৈয়ামের প্রতি সম্মাননা প্রদর্শনের দিবস। এ উপলক্ষ্যে ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয়েছে একটি সম্মেলন এবং কবির জন্মস্থান নিশাপুরেও পালিত হয়েছে বিশেষ উৎসব। এসব অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা ওমর খৈয়ামের অবদান, চিন্তাধারা, কবিতা এবং তার জীবনের কিছু গুরুত্বপুর্ণ দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাই এ উপলক্ষ্যে আমরাও বিশ্ববরেন্য এই মনীষীর প্রতি সম্মাননা জানানোর উদ্দেশ্যে তার পরিচিতির নানা দিক, অবদান ও প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করব।
ইরানের প্রথম সারির কবিদের মধ্যে হাকিম ওমর খৈয়াম সারা বিশ্বেই অত্যন্ত জনপ্রিয়। বিশেষ করে, গত দুই শতকে তিনি পাশ্চাত্যে কবি হিসেবে অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন। তার নামে পাশ্চাত্যে গড়ে উঠেছে অনেক ফ্যান-ক্লাব এবং সভা-সমিতি। কয়েক বছর আগে ইরান সফরের সময় তৎকালীন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন খৈয়ামের কবিতার প্রতি তার গভীর অনুরাগের কথা জানিয়েছিলেন।
ওমর খৈয়াম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন হিজরী পঞ্চম শতকের শেষের দিকে সেলজুক যুগে । তিনি ছিলেন মালিক শাহ সেলজুকের সমসাময়িক। অনেক ইতিহাসবিদের মতে সুলতান মাহমুদের মৃত্যুর কিছু আগে ওমর খৈয়াম জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে উচ্চ পর্যায়ের দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, লেখক ও কবি। ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞানের সোনালী যুগে তথা এখন থেকে প্রায় এক হাজার বছর আগে বীজগণিতের যেসব উপপাদ্য এবং জ্যোতির্বিদ্যার তত্ত্ব ওমর খৈয়াম দিয়ে গেছেন সেগুলো এখনও গণিতবিদ এবং মহাকাশ গবেষক বা জ্যোতির্বিদদের গবেষণায় যথাযথ সূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। আসলে খৈয়াম নিজ যুগে মূলতঃ গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ হিসেবেই খ্যাত ছিলেন এবং তিনি নিজেও তাই মনে করতেন।
মার্কিন কবি জেমস রাসেল লোয়েল ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতাগুলোকে "চিন্তা-উদ্দীপক পারস্য উপসাগরের মনিমুক্তা "বলে অভিহিত করেছেন। ওমর খৈয়ামের রুবাই বা চারপংক্তির কবিতাগুলো প্রথমবারের মত ইংরেজীতে অনূদিত হয় খৃষ্টীয় ১৮৫৯ সালে। এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের এই অনূবাদের সুবাদেই ওমর খৈয়াম বিশ্বব্যাপী কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। এ অনুবাদের মাধ্যমে ফিটজেরাল্ড নিজেও খ্যাতিমান হয়েছেন। তার এই অনুবাদ গ্রন্থ দশ বার মুদ্রিত হয়েছে এবং ওমর খৈয়াম সম্পর্কে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হাজার হাজার প্রবন্ধ ও বই লিখিত হয়েছে।
ফার্সী কাব্য-জগতে ওমর খৈয়াম এক বিশেষ চিন্তাধারা ও বিশ্বদৃষ্টির পথিকৃৎ। তিনি এমন সব চিন্তাবিদ ও নীরব কবিদের মনের কথা বলেছেন যারা সেসব বিষয়ে কথা বলতে চেয়েও প্রতিকূল পরিস্থিতির কারণে তা চেপে গেছেন। কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার নামে বা তার কবিতার অনুবাদের নামে নিজেদের কথাই প্রচার করেছেন। আবার কেউ কেউ ওমর খৈয়ামের কবিতার মধ্যে নিজের অনুসন্ধিৎসু মনের জন্য সান্তনা খুঁজে পেয়েছেন।
অসাধারণ জ্ঞানী ওমর খৈয়াম জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতের অনেক কঠিন রহস্য বা প্রশ্নের সমাধান দিয়ে গেলেও অনেক অজানা বা রহস্যময় বিষয়গুলোর সমাধান জানতে না পারায় আক্ষেপ করে গেছেন। তাই তিনি জীবন এবং জগতের ও পারলৌকিক জীবনের রহস্য বা দর্শন সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। এসব প্রশ্ন শুধু তার মনেই নয়, যুগে যুগে জ্ঞান-তৃষ্ণার্ত বা অনুসন্ধানী মানুষের মনের প্রশান্ত সাগরেও তুলেছে অশান্ত ঝড়। দার্শনিকরা এ ধরনের প্রশ্নই উত্থাপন করেছেন। দর্শনের যুক্তি দিয়ে অনেক কিছু বোঝানো সম্ভব হলেও তারও একটা সীমাবদ্ধতা আছে। দর্শন বা বিজ্ঞান দিয়ে যে ভাব তুলে ধরা যায় না খৈয়াম তা কবিতার অবয়বে তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর তাই যুক্তি ও আবেগের করুণ রসের প্রভাবে ওমর খৈয়ামের চার-লাইন বিশিষ্ট কবিতাগুলো কবিতা জগতে হয়ে উঠেছে অনন্য। দার্শনিকরা একটি বই লিখেও যে ভাব পুরোপুরি হৃদয়গ্রাহী করতে পারেন না, গভীর অর্থবহ চার-লাইনের একটি কবিতার মধ্য দিয়ে ওমর খৈয়াম তা সহজেই তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন,
اسرار ازل را نه تو دانی و نه من
وین حرف معما نه تو خوانی و نه من
هست از پس پرده گفتگوی من و تو
چون پرده بر افتد ، نه تو مانی و نه من
সৃষ্টির রহস্য জানো না তুমি, জানি না আমি
এ এমন এক জটিল বাক্য যা পড়তে পারো না তুমি, না আমি
পর্দার আড়ালে তোমায় ও আমার মাঝে চলছে এ আলাপ
পর্দা যেদিন উঠে যাবে সেদিন থাকবে না তুমি ও আমি।
অর্থাৎ সৃষ্টির রহস্যকে আমাদের কাছে রহস্যময় ও পর্দাবৃত মনে হয়। কিন্তু মনের চোখ বা আসল চোখ দিয়ে দেখা সম্ভব হলে এ পর্দা থাকে না।
অন্য অনেক জ্ঞানী ও কবির মত ওমর খৈয়ামও তার যুগের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি এসব চিন্তাধারার ব্যাপারে নিজের মত বা প্রতিক্রিয়া কবিতায় তুলে ধরেছেন। তার কবিতায় যেসব বিষয় বার বার উল্লেখিত হয়েছে বা প্রাধান্য পেয়েছে, সেসবের মধ্যে পার্থিব জীবনের অস্থায়ীত্ব, পার্থিব জীবন ও বর্তমান সময়কে যথাযথভাবে কাজে লাগানো, সন্দেহ ও বিভ্রান্তি, মৃত্যু ও পরকাল, উদাসীনতা প্রভৃতি। ওমর খৈয়াম যেসব কথা বলতে চেয়েছেন তার পরে ও তার আগে অনেকেই সেসব কথা বলেছেন। কিন্তু এসব চিন্তার পরিবেশনা ও রূপকের ব্যবহারের মধ্যেই রয়েছে তার বিশিষ্টতা। যেমন, ওমর খৈয়াম অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সংলাপ তুলে ধরেছেন তার অনেক চতুস্পদী কবিতায়। হওয়া বা সৃষ্টি, অতীতে বিরাজিত এবং মৃত্যু বোঝাতে তিনি মাটির কলসী বা পাত্র ও মাটিকে রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। আল্লাহকে জানতে হলে আগে নিজেকে জানা প্রয়োজন এমন ইসলামী বর্ণনা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি লিখেছেনঃ
বিশ্ব-দেখা জামশেদিয়া পেয়ালা খুঁজি জীবন-ভর
ফিরনু বৃথাই সাগর গিরি কান্তার বন আকাশ-ক্রোড়।
জানলাম শেষ জিজ্ঞাসিয়া দরবেশ এক মুর্শিদে
জামশেদের এই জাম-বাটি এই আমার দেহ আত্মা মোর।
মহান আল্লাহর দয়া সম্পর্কে খৈয়াম প্রার্থনাসূচক রুবাইয়ে লিখেছেন,
দয়া যদি কৃপা তব সত্য যদি তুমি দয়াবান
কেন তবে তব স্বর্গে পাপী কভু নাহি পায় স্থান?
পাপীদেরই দয়া করা সেই তো দয়ার পরিচয়
পূণ্যফলে দয়া লাভ সে তো ঠিক দয়া তব নয়।
আমরা দেখি বাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলও বলেছেন অনেকটা একই ধরনের কথাঃ
বিচার যদি করবে কেন রহমান নাম নিলে ?
ঐ নামের গুণে তরে যাব কেন এ জ্ঞান দিলে?
..রোজ হাশরে আল্লাহ আমার কোরো না বিচার।
অনেকে ওমর খৈয়ামকে নৈরাশ্যবাদী এবং ভোগবাদী বলে ভুল ধারণা করে থাকেন। আসলে তিনি আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর অস্তিত্বকেই নশ্বর বা অস্থায়ী বলতে চেয়েছেন। এভাবে তিনি মানুষকে স্থায়ী শক্তি বা সত্ত্বা হিসেবে আল্লাহমুখী হবার ওপরই জোর দিয়েছেন। অনেকেই মনে করেন ওমর খৈয়াম ছিলেন একজন বড় সুফী সাধক বা আরেফ। একটি সূফীতাত্ত্বিক রুবাইয়ে তিনি লিখেছেন,
ধুলি মুছি ধরণীর আত্মা যদি ইচ্ছামত পারে
চলে যেতে শুণ্য-পথে অবহেলে স্বর্গের দুয়ারে
নহে কিগো এটা তার দারুন লজ্জার কথা তবে-
পড়ে থাকা এতকাল মাটির এ দেহ লয়ে ভবে?
যুগের অন্যতম সেরা জ্ঞানী হওয়া সত্বেও বিনয় বা নম্রতা ছিল ওমর খৈয়ামের অন্যতম প্রধান ভূষণ। তাইতো মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থাশীল ওমর বলেছেন,
একদা মোর ছিল যৌবনের অহঙ্কার
ভেবেছিলাম গিঁঠ খুলেছি জীবনের সব সমস্যার ।
আজকে হয়ে বৃদ্ধ জ্ঞানী বুঝেছি ঢের বিলম্বে,
শূন্য হাতড়ে শূন্য পেলাম যে আঁধারকে সে আঁধার।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন