বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম।
কুরআনের আয়াত নিয়ে ভ্রষ্ট কাদিয়ানিদের কতিপয় অপব্যাখ্যা ও তার খণ্ডন এবং মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়াত দাবি কুরআন ও হাদিসের আলোকে প্রত্যাখ্যাত :
ভুমিকা :
মহান আল্লাহতালা মানুষের হেদায়াতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা) সর্বশেষ নবী হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন। তাঁর পরে দুনিয়ায় আর কোনো নতুন নবীর আবির্ভাব হবেনা। কেয়ামত পর্যন্ত তিনিই একমাত্র নবী। তাঁর নবুওয়াতই অক্ষুণ্ণ থাকবে। তাঁর আগমন মানব জাতির মধ্যেই হয়েছিল। মানুষের ন্যায় তাঁরও সৃষ্টিমূল উপাদান মাটি ছিল।
সহিহ মুসলিম শরিফের ২৭৮৯ নং হাদিসে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ হয়েছে و خلق النور يوم الاربعاء অর্থাৎ আল্লাহতালা বুধবারে নূর সৃষ্টি করেছেন। একই হাদিসে শনিবারে আসমান এবং জমিন সৃষ্টির কথাও রয়েছে। কাজেই প্রমাণিত হল যে, নূরের আগেই মাটির সৃষ্টি । তাই বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে নূর অপেক্ষা মাটির ফজিলত বেশি বলেই সকল নবী রাসূল ও আশ্রাফুল মাখলূকাত মাটির নির্যাস হতেই সৃষ্ট।
কেয়ামত পূর্ব সময়ে আগমনকারী ইমাম মাহদি এবং আসমান থেকে অবতরণকারী হযরত ঈসা মাসীহ উনাদের কেউ নিজেদের নবী দাবি করবেননা। বরং শেষনবীর উম্মত হয়েই দুনিয়ায় দ্বীন পালন করবেন এবং শেষনবীর অনুকরণ আর অনুসরণে দ্বীনে মুহাম্মদীর দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ জারি রাখবেন।
.
শেষনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) ইন্তেকাল করেছেন। তিনি ছিলেন হায়াতুন্নবী। তাঁর ইন্তেকাল পরবর্তি অবস্থা আমাদের মত স্বাধারণ মানুষের মত নয়। তাঁর পরে যাঁরা নিজেদের নবী দাবি করেছিল এবং ভবিষ্যৎকালেও করবে তারা কাজ্জাব ও মিথ্যাবাদী। যেমন, ইয়েমেন বংশোদ্ভূত মুসাইলামাতুল কাজ্জাব (মৃত ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ) এবং ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের কাদিয়ান গ্রামের বংশোদ্ভূত বৃটিশের দালাল মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী (মৃত ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দ) সেসব কাজ্জাব ও মিথ্যাবাদীদের অন্যতম।
.
বিজ্ঞ পাঠকবৃন্দ! শুরুতেই দুটি কথা জেনে নিন।
প্রথমত, সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতের ভাষ্য : “তিনি (মুহাম্মদ) আল্লাহ তায়ালার রাসূল এবং খাতামুন্নাবিয়্যীন বা নবীদের সীল-মোহর।”
.
মুসলিম শরিফের হাদিসে এর ব্যাখ্যায় ‘শেষনবী’ উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও নবীজি (সা) সুনানে তিরমিযির আরেকটি হাদিসে সুস্পষ্টভাবে এ কথাও বলেছেন যে, ﺍﻥ ﺍﻟﺮﺳﺎﻟﺔ ﻭﺍﻟﻨﺒﻮﺓ ﻗﺪ ﺍﻧﻘﻄﻌﺖ ﻓﻼ ﺭﺳﻮﻝ ﺑﻌﺪﻱ ﻭ ﻻ ﻧﺒﻲ
.
অর্থাৎ নবুওয়াত আর রেসালতের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব আমার পরে কোনো নবী রাসূল নেই।”
↓
দ্বিতীয়ত, সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াত দ্বারা কাদিয়ানীদের মতে ‘আরো নতুন নবীর আবির্ভাব হওয়ার ধারণাটিও অসার এবং মিথ্যা’ বলেই প্রমাণিত হয়ে গেছে।
.
কারণ, একে তো নতুন নবীর আবির্ভাব হওয়ার এ বিশ্বাস সূরা আহযাবের ৪০ নং আয়াতের প্রকাশ্য বিরুধী, দ্বিতীয়ত আয়াতটির শানে নুযূল দ্বারা বুঝা যায় যে, আয়াতটির বিষয়বস্তু রোজ কেয়ামতের সাথেই খাস, দুনিয়ার জীবনের সাথে তার কোনো সম্পর্কই নেই। কাজেই মির্যার অনুসারীদের প্রচলিত ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল। (তাফসীরে ইবনে কাসীর) ।
.
♦খতম আর খাতাম শব্দের বিশ্লেষণ :
.
খাতমুন নাবুওয়াত এর পরিচয় প্রদানে ﺍﻻﺳﺘﻘﺎﻣﺔ ﻋﻠﻲ ﺍﻻﻳﻤﺎﻥ গ্রন্থকার বলেন:
.
ﺧﺘﻢ ﺍﻟﻨﺒﻮﺓ ﻫﻲ ﺍﻥ ﻳﺆﻣﻦ ﻋﻠﻲ ﺍﻥ ﺁﺧﺮ ﺍﻻﻧﺒﻴﺎﺀ ﻭ ﺧﺎﺗﻢ ﺍﻟﺮﺳﺎﻻﺕ ﻫﻮ ﺳﻴﺪﻧﺎ ﻭ ﻧﺒﻴﻨﺎ ﻣﺤﻤﺪ ﺻﻠﻌﻢ ﺣﻴﺚ ﺍﻥ ﺍﻟﻠﻪ ﻗﺪ ﺧﺘﻢ ﺑﻪ ﺳﻠﺴﻠﺔ ﺍﻟﻨﺒﻮﺓ ﻭﺍﻟﺮﺳﺎﻟﺔ. ﻭ ﻛﻞ ﻣﻦ ﺍﺩﻋﻲ ﺑﺎﻟﻨﺒﻮﺓ ﺑﻌﺪﻩ ﻓﻬﻮ ﻣﻦ ﻗﺒﻴﻞ ﺍﻟﺪﺟﺎﻟﻴﻦ ﻭﺍﻟﻜﺬﺍﺑﻴﻦ .
অর্থাৎ খাতমুন নাবুওয়াত হল হযরত মুহাম্মদ (সা)-কে সর্বশেষ নবী ও রাসূল বলে এভাবে বিশ্বাস করা যে, অবশ্য আল্লাহতালা তাঁর মাধ্যমে নাবুওয়াত ও রেসালাতের ধারাবাহিকতা সমাপ্ত করে দিয়েছেন। আর যারা তারপর নবুওয়াতের দাবি করবে, তারা দাজ্জাল ও মিথ্যাবাদী।
জ্ঞাতব্য :
কাদিয়ানী সম্প্রদায় নিজেদের গোমরাহিকে জিইঁয়ে রাখার শেষরক্ষা হিসেবে পবিত্র কুরআনের আয়াতে অপব্যাখ্যা করা সহ কতেক গোঁজামিলের আশ্রয় নেয়। যা সীমাহীন মুর্খতার শামিল।
√ তারা বলে যে, খতম শব্দের অর্থ —শেষ’।
√ আর খাতাম শব্দের অর্থ — মোহর, সীল এবং আংটি।
পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত শব্দটি — খাতাম (মোহর, সীল এবং আংটি)। কাজেই হযরত মুহাম্মদ (সা) ছিলেন পূর্বেকার নবী রাসূলদের নবুওয়াত এর সীল মোহর। আর সেই সীল মোহর তিনি একাই ছিলেন।
.
আর খাতাম শব্দের পরবর্তি শব্দটি — নাবিয়্যীন (নবীগণ)। এখানে নবীগণ দ্বারা উদ্দেশ্য হল ‘শরীয়ত সহ আগমনকারী নবী’। অর্থাৎ তাঁর দ্বারা ﺍﻻﻧﺒﻴﺎﺀ ﺫﻭ ﺍﻟﺸﺮﻳﻌﺔ বন্ধ হয়েছে ; কিন্তু স্বাধারণ নবীদের আগমন বন্ধ হয়নি। (এ পর্যন্ত কাদিয়ানীদের বক্তব্য শেষ হল)।
↑
আমাদের জবাব :
নবুওয়াতের দাবিদার মির্যার অনুসারীদের উপরুল্লিখিত উদ্দেশ্যমূলক দাবিগুলোর জবাব নিম্নরূপ–
১-
খাতাম শব্দের আভিধানিক অর্থ — ছাপ, সীল মোহর বা আংটি ; বহুবচনে ﺧﻮﺍﺗﻢ (খাওয়াতিম)।
কিন্তু কাদিয়ানিদের দাবি অনুসারে পবিত্র কুরআনে উল্লিখিত “খাতাম ( ﺧﺎﺗﻢ)” শব্দটিকে ‘সীলমোহর’ অর্থে ধরে নিলেও হযরত মুহাম্মদ (সা) তিনি শেষনবী হিসেবে সাব্যস্ত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো ধরণের বিপত্তি বাধেনা। কেননা তাদেরই উক্ত দাবি অনুসারে হযরত মুহাম্মদ (সা) পূর্বেকার নবী রাসূলদের নবুওয়াতের ক্ষেত্রে একমাত্র ‘খাতাম’ বা ‘সীল-মোহর’ হওয়াই প্রমাণিত হল। যার ফলে পবিত্র কুরআন একথা বুঝাতে চাচ্ছে যে, হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পরে সব ধরণের নতুন নবী আসার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। সেজন্য যারাই মুহাম্মদ (সা)-এর পর নতুন ভাবে নবুওয়াতের দাবি করবে, তারা দাজ্জাল ও মিথ্যাবাদী। একথা বুঝার জন্য আমাদের বেশিদূর যেতে হবেনা। আমাদের পার্থিব কিছু নিয়ম কানূন থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে।
.
মনে করুন, আগামীকাল সারা দেশে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। প্রজাতন্ত্রের নির্বাচন কমিশনার সারা দেশে ব্যালট পেপার পাঠাতে শুরু করল। আর সবাই একথা ভাল করেই জেনে থাকবেন যে, প্রতিটি ব্যালট পেপার যেসব ব্যাগপত্রে থাকে সেসব ব্যাগপত্রের মুখ সীল করে দেন। যাতে উক্ত ব্যাগপত্রে অসৎ উপায়ে কেউ কোনো রকম হস্তক্ষেপ করা মাত্রই ধরা পড়ে যায়।
ঠিক তেমনি আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর মাধ্যমে আল্লাহতালা পৃথিবীতে নতুন করে নবী রাসূল আসার ধারাও সীল করে দিয়েছেন। ফলে নতুন করে নবী হওয়ার পূর্বাপর ধারাটি চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়। (সুবহানাল্লাহ)
২-
একটু আগেই “খাতামুন্নাবিয়্যীন” মানে নবীগণের সীল-মোহর এ অর্থ মেনে নিয়েই আমরা প্রমাণ করলাম যে, হযরত মুহাম্মদ (সা) তিনিই সর্বশেষ নবী। উনার নবুওয়াতের মাধ্যমে কেয়ামত পর্যন্ত দুনিয়ায় নবীদের নবুওয়াতধারা সীল তথা রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
.
এবার দেখার বিষয় হল, স্বয়ং নবী মুহাম্মদ (সা) হতে উক্ত খাতামুন্নাবিয়্যীন শব্দের সুস্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা সহিহ হাদিসে রয়েছে কিনা?
.
হ্যাঁ নিশ্চয়ই। আমরা বুখারি মুসলিম সহ অনেক কিতাবে এর প্রমাণ পেয়ে যাই। সহিহ বুখারি এবং মুসলিম কিতাবে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে —
.
و انا العاقب والعاقب الذي ليس بعده نبي
.
অর্থাৎ হযরত জুবাইর ইবনুল মুতঈম (রা) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (সা) ফরমায়েছেন ‘আমি হলাম আক্বিব। আক্বিব তিনি, যার পরে কোনো ধরণের নবী নেই।’
.
জ্ঞাতব্য :
.
উক্ত হাদিসে ‘আক্বিব’ তথা শেষে হওয়া— শব্দের উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও হাদিসে উল্লিখিত نبي (নবী) শব্দটি اسم النكرة (অনির্দিষ্ট বাচক বিশেষ্যপদ)। এতে বুঝানো হয়েছে যে, সকল প্রকারের নবুওয়াত-বাহক নবীর আগমন নিষিদ্ধ। হোক সেই নতুন শরীয়ত-বাহক কিংবা আগের নবীর অনুসরণে নতুন কোনো নবী— সবই নিষিদ্ধ। কাজেই মির্যার অনুসারীদের সকল দায় সারা অপব্যাখ্যা হাদিসের এ নীতি-বিরুদ্ধ হওয়ায় ধোপে টিকেনা।
.
সহিহ মুসলিম শরিফে আরো সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে যে, و ارسلت الي الخلق كافة و ختم بي النبيون
.
অর্থাৎ হযরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত রাসূল (সা) ফরমায়েছেন “আমি প্রেরিত হয়েছি সমগ্র সৃষ্টির প্রতি। আমার মাধ্যমেই নবীগণের নবুওয়াতের ধারা সমাপ্ত করা হয়েছে।”
.
জ্ঞাতব্য :
.
উক্ত হাদিসে একদম সুস্পষ্টভাবে ختم (খতম) শব্দের উল্লেখ রয়েছে। যার প্রকৃত অর্থ সমাপ্তি। সুতরাং বুঝা গেল, আয়াতের ভেতর خاتم النبيين শব্দের অর্থ ‘নবীগণের সমাপ্তকারি’ উদ্দেশ্য নেয়ারও যথেষ্ট কারণ ও যুক্তি রয়েছে। কারণ, পবিত্র হাদিস হচ্ছে পবিত্র কুরআনেরই পরিপূরক ও বিশ্লেষণ। তাই হাদিস ছেড়ে কুরআন বুঝার চেষ্টা করা সীমাহীন পথভ্রষ্টতারই আলামত।
.
সহিহ মুসলিম শরিফে (৪/১৭১৯) আরো এসেছে, হযরত ছাওবান (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) ফরমায়েছেন إنه سيكون في امتي كذابون ثلاثون كلهم يزعم انه نبي و أنا خاتم النبيين لا نبي بعده رواه مسلم.
.
অর্থাৎ আমার উম্মতের মধ্যে অচিরেই এমন ত্রিশ জন মিথ্যাবাদীর আবির্ভাব হবে, যাদের প্রত্যেকেই নিজেদের নবী দাবি করবে। অথচ আমিই হলাম খাতামুন্নাবিয়্যীন, আমার পর কোনো নবী নেই।
.
জ্ঞাতব্য :
.
এ হাদিসে খাতামুন্নাবিয়্যীন শব্দের ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে ‘লা নাবিয়্যা বা’দী’ (আমার পরে কোনো ধরণের নবী নেই)। উল্লেখ্য, হাদিসে “নবী” শব্দটি অনির্দিষ্ট বাচক বিশেষ্যপদ। এ সম্পর্কে একটু আগে আলোচনা করেছি।
যাইহোক, সহিহ হাদিসে খাতামুন্নাবিয়্যীন এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকার পরেও তার মর্মার্থ “সর্বশেষ নবী” এরকম মানে করার ক্ষেত্রে যাদের আপত্তি থাকবে, তাদের অজ্ঞতা আর অন্তরের বক্রতা এ দুটির চিকিৎসা অতিব জুরুরি।
.
এবার আমাদের জানার বিষয় হল, নবী এবং রাসূল এ দুটি শব্দের বর্ণনায় সালফে সালেহীন ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ কী ব্যক্ত করে গেছেন! সংক্ষেপে নিম্নরূপ-
.
১- নবীর পরিচিতি:
.
(ক) নবী শব্দের আক্ষরিক অর্থ বার্তাবাহক। কিন্তু পরিভাষায় ‘মিছবাহুল লুগাত’ অভিধানের ৮৪৭ পৃষ্ঠায় লেখা আছে
“আল্লাহ কি তরফ ছে গায়েব কি বাতীঁ বাতানে ওয়ালা। খোদা কি তরফ ছে পয়গম্বর।”
অর্থাৎ আল্লাহর পক্ষ হতে অদৃশ্য বার্তার প্রবক্তা বা আল্লাহর পক্ষ হতে বার্তাবাহক।
.
(খ) শরহে আক্বায়েদ আন-নাসাফী কিতাবের সম্মানিত লেখক প্রখ্যাত আকাইদ শাস্ত্রের ইমাম আল্লামা তাফতাযানী (রহ) লিখেছেন :
“নবী হলেন তাঁরা যাঁদেরকে আল্লাহতালা সৃষ্টি জগতের প্রতি শরীয়তের বাণী পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছেন। তবে এতে নতুন শরীয়ত তথা নতুন আসমানি কিতাব থাকা শর্ত নয়।”
.
(গ) আল্লামা শাহ আনোয়ার কাশ্মীরি (রহ) লিখেছেন : “নবীকে নতুন শরীয়ত বিহীন (আগের নবী রাসূলের অনুকরণ আর অনুসরণে) প্রেরণ করা হয়।”
.
২- রাসূল এর পরিচিতি:
.
আল্লামা ইমাম তাফতাযানী (রহ) লিখেছেন : الرسول انسان بعثه الله تعالي الي الخلق لتبليغ الاحكام و قد يشترط فيه الكتاب بخلاف النبي فانه اعم. كذا في شرح عقائد النسافي
.
অর্থাৎ “রাসূল হলেন তাঁরা যাঁদেরকে আল্লাহ তায়ালা সৃষ্টি জগতের প্রতি ইসলামী শরীয়তের তাবলীগ করার জন্য প্রেরণ করেছেন এবং তাদের ক্ষেত্রে নতুন আসমানি কিতাব (তথা নতুন শরীয়ত) হওয়া শর্ত।”
প্রসিদ্ধ আক্বায়েদ কিতাব “এক্বদুল ফারায়েদ” কিতাবের ২৪ নং পৃষ্ঠাতেও এমনি উল্লেখ রয়েছে।
.
এককথায় আমরা অবশেষে বুঝলাম যে, রাসূল হতে হলে নতুন শরীয়ত সহ নতুন কিতাবপ্রাপ্ত হতে হবে। তবে নবীদের জন্য নতুন কিতাব বা নতুন শরীয়তপ্রাপ্ত হওয়া শর্ত নয়। সেজন্য প্রত্যেক নবীকে রাসূল বলা যাবেনা, তবে প্রত্যেক রাসূল একই সাথে নবী ও রাসূল— দুটোই।
♦মির্যা কাদিয়ানী নিজেকে নতুন শরীয়তবাহক রাসূল দাবি করার প্রমাণ :
.
মির্যা কাদিয়ানীর পুত্র মির্যা বশীরুদ্দিন মাহমুদ “হাকীকাতুন নবুওয়াত” পুস্তকে কতেক তথাকথিত ইলহামকে তার পিতার নবী এবং রাসূল হওয়ার পক্ষে স্বতন্ত্র দলিল বলে উল্লেখ করেছেন। এরূপ ৩৯টি ইলহামের উল্লেখ তিনি করেছেন। আমি তন্মধ্য হতে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করছি। যেমন –
.
১- মির্যার কথিত আরবী ভাষার ইলহামের একটি ছিল এই যে, اني مع الرسول أقوم و أفطر و أصوم অর্থাৎ আমি (আল্লাহ)রাসূলের সাথে কিয়াম করব, রোযা রাখব এবং ইফতার করব।
.
২- আরেক স্থানে রয়েছে : هو الذي أرسل رسوله بالهدي و دين الحق و تهذيب الأخلاق. অর্থাৎ তিনি আল্লাহ যিনি তার রাসূলকে(কাদিয়ানী) পাঠিয়েছেন হিদায়াত দিয়ে, সত্য দীন দিয়ে এবং চরিত্রের সংস্কারকর্ম দিয়ে।
.
৩- আরেক জায়গায় রয়েছে : إني مع الرسول أقوم و ألوم من يلوم অর্থাৎ আমি রাসূলের (কাদিয়ানী) সাথে দাঁড়াব এবং তিরস্কার করব যাকে তিনি তিরস্কার করবেন।
.
৪- আরেকটি জায়গায় এটিও রয়েছে যে, سيقول العدو لست مرسلا سنأخذه من ماره او خرطوم অর্থাৎ শত্রুরা বলবে, তুমি রাসূল নও। আমি (আল্লাহ) অচিরেই ধরব তার নাকের নরম জায়গা বা শক্ত জায়গা।
.
৫- কথিত আরেকটি ইলহামের ভাষ্য হল, إني مع الرسول أقوم و من يلومه ألوم অর্থাৎ আমি আমার রাসূলের সাথে দাঁড়াব। যাকে তিনি শাসন করবেন, আমিও করব।”
.
এভাবে মির্যা কাদিয়ানী কথিত খোদায়ি ইলহামের প্রচারণার মাধ্যমে মির্যা নিজেকে আল্লাহতালার তরফ হতে প্রেরিত একজন নতুন নবী রাসূল বলে দাবি করেছিল। তো কাদিয়ানীরা এর পরেও মির্যাকে মুরতাদ বলে স্বীকার না করলে আমাদের কিবা করার আছে!
.
♦ সূরা নিসা, আয়াত নং ৬৯-এর অপব্যাখ্যা খণ্ডন :
Mirza Golam Ahmad Qadiani
কাদিয়ানী সম্প্রদায় বড্ড অদ্ভুত প্রাণী! ! হাদিসের সাথে মহা ধৃষ্টতা দেখানোর পাশাপাশি তারা আয়াতের ভেতরও সুবিধামত অপব্যাখ্যা দেয়। এভাবে তারা সীমাহীন অজ্ঞতা আর নির্বুদ্ধিতার দৃষ্টান্ত রেখে চলছে।
.
তারা চিরাচরিত অভ্যাস মাফিক সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াতের অপব্যাখ্যা করে পৃথিবীতে আরো আরো নতুন নবী আসার দাবি করে। যা আগ থেকেই আমার জানা ছিল। যেজন্য তাদের এহেন অপব্যাখ্যার স্বরূপ উন্মোচন করে দিতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। ইতিমধ্যে সেগুলোর চুলচেরা অনুসন্ধান চালিয়ে উপযুক্ত জবাবও দিয়ে আসছি। আয়াতটি হল:
.
ﻭَﻣَﻦ ﻳُﻄِﻊِ ﺍﻟﻠّﻪَ ﻭَﺍﻟﺮَّﺳُﻮﻝَ ﻓَﺄُﻭْﻟَـﺌِﻚَ ﻣَﻊَ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺃَﻧْﻌَﻢَ ﺍﻟﻠّﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻬِﻢ ﻣِّﻦَ ﺍﻟﻨَّﺒِﻴِّﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺼِّﺪِّﻳﻘِﻴﻦَ ﻭَﺍﻟﺸُّﻬَﺪَﺍﺀ ﻭَﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦَ ﻭَﺣَﺴُﻦَ ﺃُﻭﻟَـﺌِﻚَ ﺭَﻓِﻴﻘًﺎ
.
অর্থাৎ আর যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে তাঁদের সঙ্গী হবে। তাঁরা হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। আর তাদের সান্নিধ্যই হল উত্তম। (সূরা নিসা: ৬৯)
.
জ্ঞাতব্য :
তারা এ আয়াত হতে যে ব্যাখ্যা ধরে নেয় তা সীমাহীন ভুল এবং চরম বিকৃত মর্মার্থ। যে ব্যাখ্যা একমাত্র মির্যা কাদিয়ানীর অনুসারীরা ছাড়া পৃথিবীর কোনো মুফাসসীর করেন নি। উক্ত আয়াতের শানে নুযূল (আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট) যাচাই করে দেখলেই কাদিয়ানীদের উদ্দেশ্যমূলক সেই চরম বিভ্রান্তির মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যায়। তাফসীরে ইবনে কাসীর কিতাবের সরাসরি লিংক নিচে দেয়া হল। সেখান থেকেও আয়াতটির শানে নুযূল দেখা যেতে পারে।
.
♦সূরা নিসার ৬৯ নং আয়াত নাযিলের প্রেক্ষাপট :
.
সূরা নিসার ৬৯নং আয়াতের শানে নুযূল আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ) বেশকিছু রেওয়ায়েত উল্লেখ করেছেন। যেখানে সবগুলো রেওয়ায়েতই বুঝিয়েছে যে, উক্ত আয়াতের বিষয়বস্তু দুনিয়ার সাথে নয়, বরং পরকালিন জীবনের সাথেই সম্পর্কিত। অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসারিরা নাবিয়্যীন, সিদ্দিকীন, শুহাদা আর নেককারদের সংগী হওয়ার বিষয়টি কেবল পরকালিন জীবনেই ঘটবে। যেহেতু মুহাম্মদ (সা)-ই শেষ নবী। তাঁর মাধ্যমে পরবর্তী নবুওয়াতের ধারাকে সীল (চিরতরে বন্ধ) করে দেয়া হয়েছে।
পবিত্র কুরআনে মুহাম্মদ (সা)-কে খাতামুন্নাবিয়্যীন তথা নবীগণের সীল-মোহর বা শেষনবী বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
মির্যা কাদিয়ানীর অনুসারীদের একাংশ উক্ত আয়াতের শানে নুযূল এর প্রতি কোনো রকম ভ্রুক্ষেপ না করেই উদ্ভট ব্যাখ্যার আশ্রয় নেয়। তারা এ থেকে হযরত মুহাম্মদ (সা)-এর পরেও আরো নবী দুনিয়ায় আবির্ভাব হবার দাবিদার। মূলত তাদের এসব কাণ্ডজ্ঞানহীন দাবি— মির্যার মুখ রক্ষা করা।
ইতিহাস স্বাক্ষী যে, মির্যার জ্ঞানগর্ভ কথার চেয়ে বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথাবার্তাই বেশি ছিল। তাফসীরে ইবনে কাসীরের ভেতর আয়াতটির শানে নুযূল বর্ণনা করতে গিয়ে একদম প্রথমেই বিশিষ্ট সাহাবী হযরত ছাওবান (রা)-এর একটি হৃদয় নিংড়ানো ঘটনা আলোকপাত করেছেন। তিনি হযরত ‘কালবি’ (রহ) এর সূত্রে লিখেছেন :
↓
ﻗﻮﻟﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ: } ﻭَﻣَﻦ ﻳُﻄِﻊِ ﭐﻟﻠَّﻪَ ﻭَﭐﻟﺮَّﺳُﻮﻝَ {… ﺍﻵﻳﺔ. [ 69]. ﻗﺎﻝ ﺍﻟﻜﻠﺒﻲ: ﻧﺰﻟﺖ ﻓﻲ ﺛَﻮْﺑَﺎﻥَ ﻣﻮﻟﻰ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ، ﻭﻛﺎﻥ ﺷﺪﻳﺪ ﺍﻟﺤﺐ ﻟﻪ، ﻗﻠﻴﻞ ﺍﻟﺼﺒﺮ ﻋﻨﻪ؛ ﻓﺄﺗﺎﻩ ﺫﺍﺕ ﻳﻮﻡ ﻭﻗﺪ ﺗﻐﻴﺮ ﻟﻮﻧﻪ ﻭﻧﺤﻞ ﺟﺴﻤﻪ، ﻳﻌﺮﻑ ﻭﺟﻬﻪ ﺍﻟﺤﺰﻥ، ﻓﻘﺎﻝ ﻟﻪ [ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ]: ﻳﺎ ﺛَﻮﺑَﺎﻥُ، ﻣﺎ ﻏﻴَّﺮ ﻟﻮﻧﻚ؟
ﻓﻘﺎﻝ: ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﻣﺎ ﺑﻲ ﻣﻦ ﺿﺮ ﻭﻻ ﻭﺟﻊ، ﻏﻴﺮ ﺃﻧﻲ ﺇﺫﺍ ﻟﻢ ﺃَﺭَﻙَ ﺍﺷﺘﻘﺖ ﺇﻟﻴﻚ، ﻭﺍﺳﺘﻮﺣﺸﺖ ﻭﺣﺸﺔ ﺷﺪﻳﺪﺓ ﺣﺘﻰ ﺃﻟﻘﺎﻙ، ﺛﻢ ﺫﻛﺮﺕ ﺍﻵﺧﺮﺓ ﻭﺃﺧﺎﻑ ﺃﻥ ﻻ ﺃﺭﺍﻙ ﻫﻨﺎﻙ؛ ﻷﻧﻲ ﺃﻋﺮﻑ ﺃﻧﻚ ﺗُﺮْﻓَﻊُ ﻣﻊ ﺍﻟﻨﺒﻴّﻴﻦ، ﻭﺃﻧﻲ ﺇﻥ ﺩﺧﻠﺖ ﺍﻟﺠﻨﺔ ﻛﻨﺖ ﻓﻲ ﻣﻨﺰﻟﺔ ﺃﺩﻧﻰ ﻣﻦ ﻣﻨﺰﻟﺘﻚ، ﻭﺇﻥ ﻟﻢ ﺃﺩﺧﻞ ﺍﻟﺠﻨﺔ ﻓﺬﺍﻙ ﺃﺣْﺮَﻯ ﺃﻥ ﻻ ﺃﺭﺍﻙ ﺃﺑﺪﺍً. ﻓﺄﻧﺰﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ ﻫﺬﻩ ﺍﻵﻳﺔ
.
অর্থাৎ এ আয়াত রাসূলের ক্রীতদাস হযরত ছাওবান (রা) এর প্রেক্ষিতে নাযিল হয়েছে। তিনি রাসূল (সা)-কে খুবই ভালবাসতেন। রাসূলকে ছাড়া কোনো কিছুতেই ধৈর্য ধারণ করতে পারতেন না। একদা রাসূল (সা) তার নিকট আগমন করলেন। ইত্যবসরে (তিনি দেখতে পেলেন) ছাওবান এর শরীর বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ছে। চেহারায় দুশ্চিন্তা বুঝাচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে রাসূল (সা) ছাওবানকে জিজ্ঞেস করলেন, কিসে তোমায় বিবর্ণ করে দিয়েছে?
.
জবাবে হযরত ছাওবান বললেন : আমার এ অবস্থা কোনো ক্ষতিকর বা অপদস্ততার জন্য নয়। তবে ব্যাপারটি হল, আমি আপনাকে যখন দেখিনা তখন দেখা পেতে অতিব আগ্রহী হয়ে পড়ি। আপনার সাক্ষাৎ পাওয়া পর্যন্ত আমি ভীষণ নির্জনতা অনুভব করতে থাকি।
অতপর পরকালিন জীবনের আলোচনা করলাম। (ছাওবান বললেন) আমি পরকালে (কিয়ামতে) আপনাকে দেখতে না পাওয়ার আশংকা করছি। কেননা আমি জানি যে, আপনি নিশ্চয় নবীদের সাথেই উত্থিত হবেন। আর আমি যদি জান্নাতি হইও, তো আপনা তুলনায় খুব নিম্নমানের জান্নাতি হয়ে (আপনার কাছ থেকে দূরে) থাকব। আর যদি জান্নাতে প্রবেশ নাই করি, তাহলে তো সেই পরকালিন জীবনে কখনোই আপনার দেখা পাবো না” -এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা ﻗﻮﻟﻪ ﺗﻌﺎﻟﻰ: } ﻭَﻣَﻦ ﻳُﻄِﻊِ ﭐﻟﻠَّﻪَ ﻭَﭐﻟﺮَّﺳُﻮﻝَ {… ﺍﻵﻳﺔ. [ এ আয়াত নাযিল করেছেন।
(তাফসীরে ইবনে কাসীর : সূরা নিসা, আয়াত ৬৯)।
.
তাফসীরে ইবনে কাসীরের লিংক : ( www.alro7.net/ayaq.php?aya=69&sourid=4#top0)
.
যাইহোক, বুঝতে পারলাম যে, উক্ত আয়াতটির বিষয়বস্তু হিসেবে যা ফুটে উঠে তার সম্পর্ক দুনিয়ার সাথে নয়, বরং পরকালের সাথে। অর্থাৎ যে কেউ আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রসূলের হুকুম মান্য করবে, তাহলে যাঁদের প্রতি আল্লাহ নেয়ামত দান করেছেন, সে রোজ কেয়ামতে তাঁদের সঙ্গী হবে। আল্লাহর নেয়ামতপ্রাপ্তগণ হলেন নবী, ছিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিবর্গ। সুতরাং কাদিয়ানিদের ব্যাখ্যাটি অসার ও বানোয়াট।
কাজেই উক্ত আয়াতের অপব্যাখ্যা করে যারা দুনিয়াতে আরো নতুন নবী-রাসূল আবির্ভাব হবার আক্বিদা রাখবে কিংবা বলবে যে ‘কুরঅানে আছে, তাঁর অনুসরনে ও অনুকরনে তাঁর উম্মত হতে আরো নবী আসতে পারে’— (নাউযুবিল্লাহ), তারা নিঃসন্দেহ আয়াতের অর্থ বিকৃতিকারী এবং কাফির।
কারণ উক্ত আয়াত অবতরণের প্রেক্ষাপট যাচাই করলে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে যে, আয়াতটিতে যেসকল নেয়ামতপ্রাপ্তদের সঙ্গী হবার সুসংবাদ দান করা হয়েছে সেই সুসংবাদটি কার্যত রোজ কেয়ামতের সাথেই সম্পর্কিত, দুনিয়ার জীবনের সাথে নয়।
.
♦মির্যার অনুসারীদের প্রতি চ্যালেঞ্জ :
.
সূরা নিসার উক্ত আয়াত দিয়ে আপনারা যে ধুম্রজাল সৃষ্টি করছেন তার অসারতা তো একটু আগেই প্রমাণ হয়ে গেল! এখন আমি আপনাদের প্রশ্ন রাখতে চাই যে, শুধু কুরআন থেকে সুস্পষ্ট অর্থবোধক এমন একটি আয়াত (অর্থ এবং তাফসির সহকারে) দেখান, যেখানে শরীয়তবাহী কিংবা শরীয়তবিহীন নতুন কোনো নবী আসার পক্ষে বক্তব্য রয়েছে। জানি, কস্মিনকালেও পারবেন না!
.
আরেকটি প্রশ্ন, আপনাদের দাবি অনুসারে যদি পবিত্র কুরআনে নতুন করে কোনো নবী আসার প্রতি ইংগিত থাকত, তাহলে ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে নবীজির জীবদ্দশাতেই মুসাইলামাতুল কাজ্জাব নামক এক ব্যক্তি যখন নিজেকে নবী হওয়ার দাবি করল, তখন সাহাবায়ে কেরাম (রাদি:) কেন তার সাথে লড়াই করে তাকে হত্যা করলেন?
নবীজি (সা)ও বা কেন তাকে হত্যা করার জন্য সাহাবাদের প্রেরণ করেছিলেন??
নাকি নবীজি (সা) কুরআনের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন!! নাউযুবিল্লাহ।
ফলে বুঝা গেল, ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে নবী দাবিদার মির্যাকেও সে অভিন্ন কারণেই হত্যা করার হুকুম ছিল। কিন্তু বৃটিশের আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকায় মির্যা সাহেব বেচে গেলেন।
.
♦হাদিস অমান্য করার অভিনব কারসাজি :
.
মির্যার অনুসারীরা পবিত্র হাদিসকে বাতিল করার জন্য কিছু শয়তানি চালবাজির আশ্রয় নেয় এবং আয়াতকে ভুলভাবে উপস্থাপন করে। যার কারণে ওরা নিজেদের ভুলটি সংশোধন করার পথ খুঁজে পায়না। তারা হাদিসকে অমান্য করার বেয়াদবি স্বরূপ সূরা জাশিয়ার ৬ নং আয়াতের মধ্যে যে ভুলটি করেন তা নিম্নরূপ। আয়াত হল- فباي حديث بعدالله و آياته يؤمنون
↓
মির্যার অনুসারীরা পবিত্র হাদিসকে বাতিল করে মতলব হাসিল করার জন্য সূরা জাশিয়ার উক্ত আয়াতের মধ্যে যে ভুল অনুবাদটি করে তা হল — ‘আল্লাহ এবং তার আয়াতের বিরুদ্ধে কোনো হাদিসই গ্রহণযোগ্য নয়’।
.
ভুল অনুবাদ সনাক্তকরণ :
↓
উক্ত আয়াতের ভেতর “আয়াত” শব্দের অর্থ হবে “নিদর্শনাবলি”। যার প্রমাণ আয়াতটির পূর্বোক্ত আয়াতেই রয়েছে। একটু খুঁজে দেখুন। অথচ তারা এস্থানে “আয়াত” মানে আয়াতই অর্থ নিয়েছে, যা সুস্পষ্ট ভুল।
এরপর “বা’দাল্লাহ ওয়া আয়াতিহী” এর অর্থ করেছে “আল্লাহ এবং তার আয়াতের বিরুদ্ধে” । কিন্তু এটাও ভুল। অথচ এর অর্থ হবে “আল্লাহ এবং তার নিদর্শনাবলির পর”।
তারপর তারা “ইউমিনূন” এর অর্থ করেছে “গ্রহণযোগ্য নয়”। এটাও চরম বিকৃতি এবং ভুল অর্থ। অথচ এখানে এর অর্থ হবে “বিশ্বাস স্থাপন করবে”। সুতরাং এবার আয়াতের অর্থ হবে — ” অতএব তোমরা আল্লাহ এবং তাঁর নিদর্শনাবলির পরেই কোন কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবে?”
.
যাইহোক, যাদের অনুবাদ এতটাই গলত আর বিকৃত তাদের বিশ্লেষণ কতটা সহিহ আর স্বচ্ছ হবে তা সবাইকে একবার ভেবে দেখা দরকার! এবার আমরা হাদিস শরিফের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে একটু আলোচনা করব।
.
♦ হাদিসের গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা :
.
ইমাম আবু হানিফা (রহ) (মৃত ১৫০ হিজরী) হাদিসের গুরুত্ব আর প্রয়োজনীয়তা বুঝাতে গিয়ে লিখেছেন : لولا السنة ما فهم احد منا القرآن অর্থাৎ সুন্নাহ বা হাদিস বিদ্যমান না থাকলে আমাদের কেউই কুরআন বুঝতে পারত না।”
.
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ) (মৃত ২৪১ হিজরী) লিখেছেন : إن السنة تفسير الكتاب و تبينه অর্থাৎ সুন্নাহ বা হাদিস হল কুরআনের ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণকারী।”
.
শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ) লিখেছেন : السنة بيان للكتاب و لا تخالفه অর্থাৎ সুন্নাহ বা হাদিস হল কুরআনের ব্যাখ্যাদানকারী এবং সুন্নাহ কুরআনের বিরুধিতা করেনা।”
.
কিন্তু আফসোস! !! কাদিয়ানিরা নিজেদের ভ্রান্ত মতবাদ জিইঁয়ে রাখার উদ্দেশ্যে একদিকে হাদিসকে অমান্য করার ধৃষ্টতা দেখায় আর অপর দিকে কুরআনের ভেতর অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছে। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।
.
আরেকটি প্রশ্ন হল, মির্যার অনুসারীরা انا خاتم النبيين لا نبي بعدي শীর্ষক হাদিসের মধ্যে ভুল অনুবাদ করে বলে যে, “আমাকে বাদ দিয়ে কোনো নবুওয়াত নেই”।
.
আমার প্রশ্ন, মির্যার উম্মতেরা যদি নিজেদেরই মতাদর্শে সঠিক হয়ে থাকে তাহলে আমাকে বলুন ﻻ ﻧﺒﻲ ﺑﻌﺪﻱ এর অনুবাদের ক্ষেত্রে “আমাকে বাদ দিয়ে” এ অর্থ কোথায় এবং কিভাবে রয়েছে ? এ অতিরঞ্জিত অংশটুকুর আরবীটা কী? অথচ ইতিপূর্বে প্রমাণ করা হল যে, কুরআনের কোনো আয়াতই সুন্নাহ বা হাদিসের বিরুদ্ধে যায়না।
এতদ্ব্যতীত নবীজি (সা) সুনানে তিরমিযির আরেকটি হাদিসে সুস্পষ্টভাবে এ কথাও বলেছেন যে, ﺍﻥ ﺍﻟﺮﺳﺎﻟﺔ ﻭﺍﻟﻨﺒﻮﺓ ﻗﺪ ﺍﻧﻘﻄﻌﺖ ﻓﻼ ﺭﺳﻮﻝ ﺑﻌﺪﻱ ﻭ ﻻ ﻧﺒﻲ
.
অর্থাৎ নবুওয়াত আর রেসালতের ধারা বন্ধ হয়ে গেছে। অতএব আমার পরে কোনো নবী রাসূল নেই।” তো এর কী উত্তর দেবেন? নাকি এখানেও অপব্যাখ্যার আশ্রয় নেবেন?
যাইহোক, গত ১৭/০১/২০১৩ ইং -এ দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকাতে কাদিয়ানিদের একটি ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হয়েছিল। তা নিশ্চয় সবার জানা আছে। সেখানে সুস্পষ্টভাবে লেখা আছে “আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ের সংগে বিশ্বাস রাখি, কুরআন শরিফ শেষ ঐশীগ্রন্থ এবং এর শিক্ষা, বিধান, আদেশ ও নিষেধের মাঝে এক বিন্দু বা কণা পরিমাণ সংযোজনও হতে পারেনা……” এতে একথাও সুস্পষ্ট হয়ে গেল যে, মির্যা কাদিয়ানীর নবুওয়াত দাবিটি গ্রহণযোগ্য ছিল না।
কারণ, যদি তাকে নবী মানা হয়, তাহলে তার কথিত ওহী এবং ইলহাম দ্বারা রচিত পুস্তক “বুশরা” (মির্যার কথিত আসমানি কিতাব) পুস্তকটি শেষ ঐশীগ্রন্থ হওয়ারই দাবি রাখত, তাই নয় কি? অথচ কাদিয়ানীদের ক্রোড়পত্রটিতে বুশরাকে নয়, বরং পবিত্র কুরআনকেই সর্বশেষ ঐশীগ্রন্থ বলা হয়েছে! তো এর মানে কি মির্যাও নবী? নাকি সেখানেও কাদিয়ানীদের ধুর্তামি বা গণমাধ্যমকে প্রতারিত করাই উদ্দেশ্য?
.
আরো মাজার ব্যাপার হল, পাকিস্তানের কাদিয়ানী লাহোরি পার্টির অনুসারীরাও মির্যা কাদিয়ানীকে নবী মানেনা। কিন্তু কেন?
আশাকরি, মির্যার নবুওয়াত দাবির অন্তর্নিহিত রহস্যের জট কিভাবে উন্মোচিত হয়েছে তা এ সংক্ষিপ্ত পরিসরে বুঝতে পেরেছেন।
.
লেখক প্রিন্সিপাল
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন