মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আকাবিরের নকশে কদম থেকে দূরে সরে যাওয়া ঠিক নয়। যে অঞ্চলে যাদের মাধ্যমে দ্বীনের প্রচার প্রসার হয়েছে তারাই সে অঞ্চলের আকাবির। তবে শর্ত হল তাদেরকে হতে হবে ‘মুনীব ইলাল্লাহ’। কুরআনে কারীমে আছে-
وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيّ
এমনিভাবে আছে,
أُولَئِك الَّذِينَ هَدَى اللَّهُ فَبِهُدَاهُمُ اقْتَدِهْ
অর্থাৎ তাদেরকে হিদায়াতের উপর প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এরপর কারো ইকতিদার জন্যে যে শরয়ী ‘মি’য়ার’ আছে তার উপস্থিতির পর নতুন কোনো শর্ত আরোপ করা ঠিক নয়।
এই উপমহাদেশে ‘মুনীব ইলাল্লাহ’ হলেন আকাবিরে দেওবন্দ। শুধুই তাঁরা নন। বরং আরো অনেকেই। তবে তাঁদের কুরবানী ও মুজাহাদা এ অঞ্চলে অনেক বেশি এবং তাঁদের সময়ে তাঁদের খেদমতই বেশি বিস্মৃত। তাছাড়া আমাদের উপর তাঁদের ইহসান অনেক। একদিকে তাঁদের ইহসান, অন্যদিকে এই এলাকায় তাদের তালীম-তরবিয়তের চর্চা। সেজন্যে স্বাভাবিকভাবেই আমরা তাঁদের অনুসরণ করি। তবে এসবের আগে আমরা দেখে নিয়েছি যে, তাঁদের মাঝে শরয়ী মিয়ার বা মানদন্ড আছে কি না। সেটা আছে। কারণ যেমনিভাবে তাঁরা মুনীব ইলাল্লাহ, তেমনিভাবে রববানী হিদায়াতের উপরও প্রতিষ্ঠিত।
আর ইত্তিবার ক্ষেত্রে তো ‘যাল্লাত’ সবসময়ই ‘মুসতাসনা’। অতএব যখন শরয়ী মিয়ার উপস্থিত, আবার যাল্লাত মুসতাসনা, তখন কেউ নজদের, নাকি অন্য কোনো অঞ্চলের সে বিষয় নিয়ে পেরেশান হওয়ার কিছু নেই। নজদওয়ালারা নজদী শায়খের ইত্তিবা করুক। আর আমরা আমাদের এখানে যাঁদের তালীম-তরবিয়ত মারূফ ও মুরাওয়াজ এবং আমরা আমাদের মায়ের কোল থেকেই যাদের দ্বীনী তত্ত্বাবধান পেয়ে এসেছি তাঁদের ইত্তিবা করি। আর এটাই স্বাভাবিক। এই স্বাভাবিকতা থেকে আমরা সরে আসতাম যদি তাঁদের মাঝে শরয়ী মিয়ার না থাকতো।
কোনো অমুসলিম যদি ‘মুহাররাফ’ ইসলামওয়ালা কারো কাছে ইসলাম গ্রহণ করে; তাহলে কি পরেও সেই ইসলামের উপরই তাকে বহাল থাকতে হবে?
যেমন কেউ যদি কোনো বেরেলবীর হাতে ইসলাম গ্রহণ করে, যাদের মধ্যে ‘ইনাবাত’ নেই, হিদায়াতের সঠিক তালীম নেই, সুন্নতের ইত্তিবা নেই, এমনকি ফরয পর্যায়ের অনেক আকীদায় যাদের গড়বড়ি আছে, তাহলে তাকে অবশ্যই সহীহ ও সঠিক দ্বীনের পথে ফিরে আসতে হবে। আকীদা দুরস্ত করতে হবে। হিদায়াতের সঠিক তালীম নিতে হবে এবং সুন্নতের পূর্ণ ইত্তিবা তাকে করতে হবে। তবে ইসলাম গ্রহণে সেই বেরেলবীর মধ্যস্থতার জন্য তার শোকরগুযার সে হবে, তার ইহসান সে স্বীকার করবে। সেটা ঠিক আছে; বরং তাকেও সুন্নতের দিকে নিয়ে আসার চেষ্টা করে যাবে।
তো আমরা যে আকাবিরে দেওবন্দের ইত্তিবাকে গ্রহণ করেছি, সেটা এইজন্য নয় যে, তাঁরা আমাদের অঞ্চলের এবং তাদের মানহাজ ও মাশরাবে আমাদের পড়াশোনা ও বেড়ে উঠা, এককথায় তাঁদের অনেক ইহসান আমাদের উপর, এইসব বিষয় ওজহে তারজীহ, তবে তাঁদের ইত্তিবাকে ইখতিয়ার করার মূল কারণ হল, তাঁদের ইনাবাত ইলাল্লাহ। এবং ‘ইহতিদা’র মিয়ারে তাঁদের উত্তীর্ণ হওয়া। সেজন্যে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আকীদা ও আমল এবং মাসলাক-মাশরাবের উপর প্রতিষ্ঠিত যেকোনো আকাবিরের ইত্তিবাকে আমরা গ্রহণ করতে পারি। এবং সেই গ্রহণ করার দ্বারা আমাদের মাকসাদ হাসিল হয়ে যাবে। তবে আকাবিরে দেওবন্দকে আমরা প্রাধান্য দেব এইজন্য যে, এই দেশে তাঁদের তালীম তারবিয়তের চর্চা হয়েছে এবং তাঁদের মাধ্যমে অনেক ইহসান আমাদের উপর আছে। আজ অবশ্য সেকথা বলার জন্য বসিনি। আজ বসেছি এবিষয়ে মুযাকারা করার জন্য যে, ধীরে ধীরে কেবলই আমরা আমাদের আকাবিরের মেযায ও মিনহাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আকাবিরের সাওয়ানেহ-মালফুযাত মুতালাআ করা বন্ধ করে দিচ্ছি। ফলে এখন আর আমাদের তালিবুল ইলম ভাইয়েরা আকাবিরের কে কোন যুগের সেকথাই বলতে পারে না। অথচ আমাদের কর্তব্য ছিল, কমপক্ষে সিলসিলায়ে আসানীদের সকলের তরজমা-সাওয়ানেহ মুতালাআ করা এবং তাঁদের জন্ম-মৃত্যুসন মুখস্থ রাখা। বিশেষ করে শুরু এবং শেষ। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম থেকে নিয়ে খাইরুল কুরূনের তিন ‘কুরূন’ এবং আমাদের নিকট অতীতের আকাবির উলামায়ে কেরামের তরজমা-সাওয়ানেহ মুতালাআ করা এবং তাঁদের হালাত সম্পর্কে ওয়াকেফহাল থাকা। তাসাওউফ বা সলূক ও ইহসানের সবক যাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছি, ইলমে তাফসীর, ইলমে হাদীস, ইলমে ফিকহ্ এবং এই সমস্ত ইলমের জন্য সহযোগী অন্যান্য ইলম যাদের কাছ থেকে গ্রহণ করেছি তাদের জীবনী পড়া থাকা জরুরী। তাঁদের মালফুযাত মাকতুবাত মুতালাআ থাকা জরুরী।
যদি সবার তরজমা বিস্তারিতভাবে মুতালাআ করার সুযোগ না হয় তাহলে কমপক্ষে এবিষয়ের যেসব মজমুআ পাওয়া যায় সেগুলো মুতালাআয় থাকা জরুরী। যেমন ‘তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমত’ ‘উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী’ ‘উলামায়ে হক’ এমনিভাবে আরবীতে ‘নুযহাতুল খাওয়াতির বা আল ই’লাম বিমান ফিল হিন্দি মিনাল আ’লাম’, ‘রিজালুল হিন্দি ওয়াস সিন্দ’ এই ধরনের মজমুআ।
আরেকটা হল স্বতন্ত্র জীবনীগ্রন্থ মুতালাআ করা। যেমন ‘তাযকিরাতুর রশীদ’ ‘তাযকিরাতুল খলীল’ ‘আশরাফুস সাওয়ানেহ’ ‘নকশে হায়াত’ ‘নফহাতুল আনবার ফি সিরাতিশ শায়খ আনওয়ার’ সাথে সাথে ‘আব বীতী’। এমনিভাবে বড়দের কারো বিষয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যা। যেমন, ‘আলবালাগ মুফতিয়ে আযম নম্বর’, ‘আলবালাগ আরেফী নম্বর’, ‘বায়্যিনাত ইউসূফ বানূরী নম্বর’, ‘বায়্যিনাত শহীদ (ইউসূফ লুধিয়ানবী) নম্বর’, ‘বায়্যিনাত জামিল খান’, ‘আলহক আবদুল হক নম্বর’, ‘আলফুরকান শাহ ওয়ালি উল্লাহ নম্বর’, ‘আলফুরকান মুজাদ্দিদে আলফে সানী নম্বর’, ‘আলফুরকান শাইখুল হাদীস যাকারিয়া নম্বর’, ‘আলফুরকান হযরতজী ইউসূফ নম্বর’। আর ‘আহওয়াল ওয়া আছার’ নামে নূরুল হাসান রাশেদ কান্ধলবী দামাত বারাকাতুহুম যে পত্রিকা বের করেন সেটারও তো অনেক সংখ্যা বের হয়ে গেছে। হযরত নানুতবী সম্পর্কে, হযরত গঙ্গুহী সম্পর্কে, শাহ ইসমাইল শহীদ সম্পর্কে, এনামুল হাসান কান্ধলবী সম্পর্কে, আর হযরত শাইখুল হিন্দ সম্পর্কে সামনে আসছে।
‘সাওয়ানেহে হযরত শাইখুল হাদীস যাকারিয়া’, ‘হযরত মাওলানা ইলইয়াস আওর উনকি দ্বীনী দাওয়াত’, ‘সাওয়ানেহে হযরত মওলানা ইউসূফ কান্ধলবী’, এইসব সাওয়ানেহের সবই হল হুদা ও নূর। কারণ এসব তাঁদের সাওয়ানেহ যারা সুন্নাহর আলোকে নিজেদের জীবনকে আলোকিত করেছেন।
তো আপনার পড়ার একটা বিষয় হতে হবে আকাবিরের সাওয়ানেহ-সীরাত, খুতুবাত-মালফুযাত ও মাকাতীব। এভাবে আপনি আকাবিরের মেযাজ পাবেন। আর সেটা ঐ মেযাজ যা প্রত্যেক যুগের মুনীব ইলাল্লাহর মেযাজ। আর খাইরুল কুরূন থেকে নিয়ে এই পর্যন্ত যত মুনীব ইলাললাহ আছেন তাঁদের সবার সায়্যিদ, মাতবু এবং মুকতাদা হলেন হযরত রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ।
لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِي رَسُولِ اللَّهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللَّهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللَّهَ كَثِيرً
এখন যদি কেউ বলে, তাহলে সরাসরি সুন্নাহ-সীরাত পড়লেই হয়। আর কিছু পড়ার তো দরকার নেই। আকলের দাবীও তাই। কিন্তু বাস্তবতা হল, দরকার আছে। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ব্যাপারে তো একথা বলা হয়েছে,
كان خلقه القران
তাহলে তো শুধু কুরআন পড়লেই হয়। আকলও তাই বলে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা সেটা করেননি। তিনি কুরআনের সাথে মুআল্লিম পাঠিয়েছেন এবং সেই মুআল্লিমকে অনুসরণের আদেশ দিয়েছেন।
এরপর সে মুআল্লিম যে কাফেলা তৈরী করেছেন উসওয়ায়ে হাসানা বুঝার জন্য সেই কাফেলাকেও বুঝতে হবে। সেই কাফেলাকে অনুসরণ করতে হবে। সেজন্যই তো বলেছেন-
وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ
এখানে ‘হুম’ বলার দরকার পড়ল কেন? মুহাজির আনসার সবাই তো রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অনুসারী। এরপরও কেন তাঁদের কথা বললেন? কারণ এটা সুন্নাতুল্লাহ। আল্লাহ এমনটাই চান।
আল্লাহ তাআলা কুরআনের মধ্যে কেবল তাঁর ‘আমর’ আর ‘নাহি’ এর উল্লেখ করেই শেষ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি সেটা করেননি। বরং ‘হিকায়াত’ ও ‘কাছাছ’ শুনিয়েছেন। এমনকি শুধু নবীদের ‘কাছাছ’ই শোনাননি ওলীদের কথাও নকল করেছেন। লুকমানের মালফুযাত উল্লেখ করে দিয়েছেন। ‘মুমিনু আলি ফিরআউনে’র মালফুযাত উল্লেখ করে দিয়েছেন। কুরআনের কী দরকার ছিলো এসব উল্লেখ করার? কেউ হয়তো বলবে, কুরআনে যেসব হিকায়াত উল্লেখিত হয়েছে তাতেই যথেষ্ট, ওসব ছাড়া আর অন্য কোনো হিকায়াত কাছাছ এর প্রয়োজন নেই। তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী ইসরাঈলের ঘটনা কেন উল্লেখ করলেন? বুখারীতে, হাদীসের অন্যান্য কিতাবে।
كان رجل فيمن كان قبلكم
এইসব হিকায়াত বর্ণনার কী দরকার ছিল? কুরআনের এত আলোচনার পর, তাঁর হাদীসের এত বিবরণের পর এইসব কেন তিনি শোনালেন? এরপর আবার সাহাবায়ে কেরামকে বলে গেলেন
حدثوا عن بني اسرائيل ولا حرج
আর সাহাবায়ে কেরামও তো সেসব বর্ণনা করেছেন।
হাঁ, এইসব বিষয়ের মুতালাআ করতে হবে তারতীব বানিয়ে। নিজের মুতালাআর তালিকায় ‘আহাদীস’ যেমন থাকবে, ‘সিয়ারুস সাহাবা ওয়াত তাবীয়ীন’ও থাকবে। এরপর দ্বীনের মৌলিক বিষয়ের মুতালাআও থাকবে। এমন ‘যেহনিয়ত’ রাখা যাবে না যে, কেবল এসবই মুতালাআর বিষয়। তিলাওয়াত-আযকারের খবর নেই। দিনরাত শুধু সিয়ার-তারাজিমের কিতাব মুতালাআর মধ্যেই সে থাকবে; বরং ওগুলো আসল। আর এগুলো তার সহায়ক। এগুলোকে বাদও দেয়া যাবে না। আবার একেবারে আসলও বানিয়ে ফেলা যাবে না।
যাইহোক, আমি বলছিলাম, আকাবিরের মেযাজ মিনহাজ আমাদেরকে বুঝতে হবে। তাঁদের তাফাক্কুহ, তাওয়াযু ‘বাহামী উলফত’ এবং সময় সচেতনতা এসব গুণ আমাদেরকে অর্জন করতে হবে।
আকাবিরের সাওয়ানেহ-তারাজেম মুতালাআর কিছু উসূল আছে । সেসব জানার জন্যে মুতালাআ করা যায়-‘মাজালিসে মুফতীয়ে আযম’ নামে মুফতী শফী রাহ.-এর যে মজলিস তাঁর খলীফা মুফতী আবদুর রউফ ছাহেব সংকলন করেছেন সেটার শুরুতে লেখা তাকী ছাহেব হুজুরের ভূমিকা। এমনিভাবে ‘আশরাফুস সাওয়ানেহে’র শুরুতে হযরত থানভী রাহ.-এর ভূমিকা এবং ‘মাজালিসে হাকীমুল উম্মত’-এর শুরুতে মুফতী শফী রাহ.-এর ভূমিকাগুলো।
সাওয়ানেহ-তারাজেম, খুতুবাত, ‘মালফুযাত-মাকতুবাত’ মুতালাআর ক্ষেত্রে একটা মৌলিক নীতি হল, এসব কিতাবে ‘গাইরে শুউরী’ভাবেই কিছু ‘তাসাহুল’ হয়। যেহেতু এসব কোনো হাদীস, ফিকহ বা তাফসীরের কিতাব নয়, তাই অনেক সময় এগুলোতে নিজের অজান্তেই কিছু তাসাহুল থেকে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এগুলোকে যার সাওয়ানেহ তার তাসনীফের যে মান সেই মান দেয়া যাবে না। তাছাড়া তাসাহুল, তাসামুহ ও যাল্লাতের কথা তো এমনিতেই ভিন্ন। এসবের মধ্যে তাকলীদ করার তো কোনো সুযোগ নেই।
আর একটা বিষয় হল, এসব কিতাবে আকাবিরের ‘ফিকরে মুতাওয়ারাস’ এবং ইলমী অনেক ফাওয়ায়েদ ও আদাব আখলাকের অনেক হেদায়াত যেমন আপনি পাবেন তেমনি কিছু ‘যাওকিয়াত’ও পাবেন। তো সেই যাওকিয়াতকে যাওকিয়াতের মানেই রাখতে হবে। তার উপরে উঠানো যাবে না এবং অন্যের উপরও সেসব চাপানো যাবে না। আর কীভাবেই বা চাপাবেন, দশজন আকাবিরের সাওয়ানেহ পড়লে কোনো বিষয়ে তো দশ রকমের তবয়ী যাওকও পাওয়া যেতে পারে। সেক্ষেত্রে কারটা কার উপরে চাপাবেন?
আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো, ইত্তিবায়ে আকাবির এবং তাযকিরায়ে আকাবিরের ক্ষেত্রে আসাবিয়্যাতের পিছনে পড়া যাবে না। প্রথম কথা যখন এটাই যে, তাঁদের সবাই আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাতের অন্তর্ভুক্ত, এরপর মানুষ হিসাবে প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন রং থাকতেই পারে, ভিন্ন তবিয়ত থাকতে পারে। এখন আপনার কাছে কারো যাওক তবিয়ত ভালো লাগে এবং লাগতেই পারে। এসব তবয়ী বিষয়। তাবয়ী মুবাহাত (طبعي مباحات)। এখানে কারো তবিয়ত কারো কাছে ভালো লাগা দোষের কিছু নয়। কিন্তু তাই বলে আপনি সেই যাওককে অন্য সবার উপর প্রাধান্য দিবেন এবং এমনভাবে প্রাধান্য দিবেন যে অন্যদের তানকীছ হয় সেটা তো হবে না।
تِلْكَ الرُّسُلُ فَضَّلْنَا بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ
এই বাস্তবতা সত্তেবও একজনকে অন্যজনের উপর তারজীহ দিতে গিয়ে এমন আন্দায অবলম্বন করা যাবে না, যার দ্বারা অন্য কারো ‘তানকীছ’ লাযেম আসে। এটা হল এমন ক্ষেত্রে যেখানে সরাসরি দলীল আছে। আর যেখানে কোন দলীল নেই, সেখানে!?
কারো আফযালিয়াতের দলীল থাকলেই যদি এমন ‘মুহতাত’ আন্দাযে সেটা বর্ণনা করতে হয় যাতে অন্যের ‘তানকীছ’ লাযেম না আসে তাহলে যার আফযালিয়াতের দলীল নেই সেখানে কীভাবে বর্ণনা করতে হবে?!
এখন দেখুন, আকাবিরের কে কার থেকে আফযাল সে বিষয়ে কোনো দলীল আপনার কাছে আছে কি না। এক তো হল
إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ
সেটা গায়েবের বিষয়। কারণ তাকওয়ার যে ‘মাখফি’ দিক রয়েছে
সেটা তো সম্পূর্ণই গায়েব। আর যাহিরী যেসব দিক আছে সেগুলোর তত্রে কি আপনি কারো চবিবশ ঘন্টা সময়ের পুরোটাই দেখেন? তার সব হালতই কি আপনার সামনে থাকে? তাহলে তার যাহিরী দিকগুলোও তো আপনার সামনে নেই। আপনি কোন্ একীনী দলীলের ভিত্তিতে হুকুম লাগাবেন? তারজীহ দিবেন?
আর কারো ইলম ও কামালের বিষয়, সেত্রে কয়জনের হালাত মুতালাআ করতে পারবেন? আপনার নিজের খবরই কি ঠিকমতো রাখতে পারে?! আপনি জানেন আপনার হুদুদে আরবাআ কি?
এখন কারো জীবনীতে তার কোনো গুণ, কোনো যওক আমার ভালো লাগে, আর সেই ভালো লাগাটাই ‘মিয়ার’ হয়ে যায়, তাই আমি তাকে তারজীহ দিব, সেই তারজীহের উপর ‘ইসরার’ করব, অন্যদের ‘তানকীদ’ করব, সেগুলো নিয়ে অন্যদের সাথে লড়াই ঝগড়া করব, এই ‘আসাবিয়াত’ জায়েয নয়।
আর যিনি আমার পছন্দের, তার কোনো ‘যাল্লাত’ আমার কাছে যাল্লাত না, কেউ যদি সেই যাল্লাতের উপর আদবের সাথে তাম্বীহ করে সেটা আমি পছন্দ করি না, এটা আসাবিয়াত। দলিল ছাড়া তাফযীল, অথবা ধারণার ভিত্তিতে ‘একীনী তাফযীল’, এসবই আসাবিয়াত। তার যওকিয়াতকে অন্যের উপর চাপানো আসাবিয়াত। তার ইজতিহাদকে অন্যের ইজতিহাদের খন্ডন হিসাবে পেশ করা, জবরদস্তি অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা আসাবিয়াত। মুশাজারাতে আকাবিরের ক্ষেত্রে কোনো একদিকে ঝুঁকে অন্যদিকের বুযুর্গের ব্যাপারে ‘বদযবানী’ এমনকি ‘বদগুমানী’তে লিপ্ত হওয়াও আসাবিয়াত। এক্ষেত্রে অনুসরণীয় পথ সেটিই যা শাইখুল হাদীস রাহ. তাঁর ‘আল ই‘তিদাল ফী মারাতিবির রিজাল’ এবং ‘তাকমিলাতুল ই’তিদাল’-এ উল্লেখ করেছেন।
কেউ আমার পছন্দের; সেজন্যে অন্যের গীবত করব, তার সাথে যার ‘আদাওয়াত’ আমার সাথেও তার ‘আদাওয়াত’ হয়ে যাবে, এসব আসাবিয়াত।
আসাবিয়াত খুব সুপ্ত ‘মরয’। নিজেদের খবরই থাকে না যে, আমার মাঝে আসাবিয়াত আছে। জলী আসাবিয়াত খফী আসাবিয়াত সবগুলো থেকেই আমাদেরকে বাঁচতে হবে।
তো মূল কথা ছিল আকাবিরের মেযাজ ও মিনহাজ থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি। সেজন্যে তাঁদের সীরাত সাওয়ানেহের মুতালাআ আমাদের বাড়াতে হবে এবং ‘ইফরাত’‘তাফরীত’ ও সব ধরনের আসাবিয়াত থেকে মুক্ত হয়ে তাঁদের সীরাত-সাওয়ানেহ থেকে আমাদের উপকৃত হতে হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে পূর্ণ তাওফীক নসীব করুন। আমীন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন