আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে মামার বাড়ি যাই।
হ্যাঁ। এ জসীম উদ্দীনে কবিতার লাইন। জসীম উদ্দীনের কবিতার ধরনই আলাদা, স্বাদই আলাদা। তিনি গ্রাম বাংলার সাধারণ আষয় বিষয়, সাধারণ মানুষের জীবন অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। সত্যিকার অর্থে এমনটি আর কোন কবি সাহিত্যিক করেন নি। যার কারণে বাংলার মানুষ তাদের এই প্রিয় কবিকে পল্লীকবি বিশেষণে বিশেষিত করেছে।
১৯০৩ সালে ১ জানুয়ারী ফরিদপুর সংলগ্ন তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়িতে জসীম উদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাসও ফরিদপুর জেলা শহরের উপকন্ঠ গোবিন্দপুর গ্রামে। কবির পিতার নাম মৌলভী আনসার উদ্দীন। তিনি অত্যন্ত সুপুরুষ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। আনসারউদ্দীন সাহেব এর হাত দু’টি ছিল আজানুলম্বিত এবং মুখ ভরা ছিল চাপ দাড়ি। এতে করে কবির পিতাকে অসম্ভব সুপুরুষ ও সুদর্শন মনে হত। তা’ছাড়া সাদা ধুতি পরে, গায়ে পাঞ্জাবী চাপিয়ে যখন মাথায় টুপি দিতেন তখন তাঁকে আরো আকর্ষণীয় চেহারার মানুষ মনে হত। সাদা পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন কবির পিতা গ্রামের এম.ই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।
জসীম উদ্দীনের লেখাপড়ার হাতে খড়ি হয় তাঁর পিতা আনসার উদ্দীনের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরু হয় পার্শ্ববর্তী শোভারামপুরের আম্বিকা পন্ডিতের পাঠশালায়। এখান থেকে তিনি গ্রামের এম.ই স্কুলে চলে আসেন এবং পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ গ্রহণ করেন। ঐ পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াকালে তাঁকে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করা হয়। আজন্ম রসিক জসীম উদ্দীন এ স্কুলে ভর্তি হবার পর স্কুলের শিক্ষক ও ছাত্ররা তাঁকে কিভাবে গ্রহণ করেছিল তা অত্যন্ত রসিয়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “সন্নাসীর ভক্ত হইয়া আমি পায়ে জুতা পরিতাম না। পাড়হীন সাদা কাপড় পড়িতাম। ক্লাসের ছাত্ররা প্রায় সবাই শহরবাসী। আামকে তাহারা গ্রাম্য ভূতের মতই মনে করিত। আমি কাহারো কাছে যাইয়া বসিলে সে অন্যত্র বসে। আমি শত চেষ্টা করিয়াও কাহারো সাথে ভাব জমাতে পারি নাই। আমি সঙ্কোচে পেছনের বেঞ্চে আমার চাচাতো ভাই নেহাজ উদ্দীনের সঙ্গে জড়সড় হইয়া বসিয়া থাকিতাম। শিক্ষকেরা অন্য ছাত্রদের লইয়া কতো হাসি তামাসা করিতেন, এটা ওটা প্রশ্ন করিতেন। আমাদিগকে কিছুই জিজ্ঞাসা করিতেন না।”
বুঝতেই পারছো, কবির এ বর্ণনার মধ্যে তাঁর ছোটকালের ব্যথাতুর মনের পরিচয় পাওয়া যায়। শত অবহেলার মধ্যেও এ স্কুল হতেই কবি ১৯২১ সালে দ্বিতীয় বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ হতে ১৯২৪ সালে আই.এ এবং ১৯২৯ সালে বি.এ পাশ করেন। বিএ পাশ করার পর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৩১ সালে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ পাশ করেন।
জসীম উদ্দীনের বাল্যকাল খুবই আর্থিক অনটনের মধ্য দিয়ে কেটেছে। তিনি নিজেই লিখেছেন, “আমাদের দু’খানা খড়ের ঘর। চারিধারে নলখাগড়ার বেড়া। চাটাইয়ের কেয়ার বা ঝাঁপ বাঁধিয়া ঘরের দরজা আটকানো হয়। সেই ঘরের অর্ধেক খানিতে বাঁশের মাচা। মাচায় ধানের বেড়ি, হাড়ি-পাতিল থরে থরে সাজানো। সামনে সুন্দর কারুকার্য্ খচিত বাঁশের পাতলা বাখারী দিয়া নক্সা করা একখানি বাঁশ টাঙান।…………এই ঘরের মেঝেতে সপ বিছাইয়া আমরা শুইয়া থাকিতাম।—–বাজান ঘর-সংসারের কাজ ফেলিয়া স্কুলে যাওয়া আসা করিতেন বলিয়া দাদা ছমির উদ্দীন মোল্লা বাজানের ওপর বড়ই চটা ছিলেন। বাজান তাঁহার একমাত্র পুত্র। বৃদ্ধ বয়সে তিনি সংসারের সকল কাজ দেখাশুনা করিতে পারিতেন না। কোনো কঠিন কাজ করিতে কষ্টসাধ্য হইলে তিনি বাজানকে খুব গালমন্দ করিতেন।” সত্যিই কবি সবদিক থেকে এদেশের মানুষের হৃদয়ের অত্যন্ত কাছাকাছির মানুষ ছিলেন।
কবির পিতা আনছারউদ্দীন সাহেব যেমন অত্যন্ত পরিপাটি ও ছিমছাম মানুষ ছিলেন, কবি ঠিক তার উল্টো অর্থাৎ অগোছালো ছিলেন। বাল্যকালে কবি এক সাধুর শিষ্য হয়েছিলেন। সাধুর প্রতি অগাধ বিশ্বাসের কারণে তিনি সাধুর জীবন গ্রহণের মানসে ঐ বাল্যকালেই পায়ে জুতা পরিতেন না, গায়ে জামা পরতেন না। শুধুমাত্র পাড়হীন একখন্ড সাদা ধুতির মত কাপড় দিয়েই সব কাজ চালাতেন। কখনো যদি জামা পরেছেন তো সে জামা হতো বোতামহীন।
কবির বাবা আনসারউদ্দীন ও একজন স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি কথায় কথায় কবিতা ছড়া বাঁধতে পারতেন বলে জানা যায়। এ প্রসংগে ইসলামী বিশ্বকোষ লিখেছে, “বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ছিল তাঁর অগাধ অনুরাগ। তাঁহার কবিত্বও শক্তিও ছিল। গাজীপুর উপজেলার কবি গোবিন্দদাসের ন্যায় তিনি স্বভাব কবি ছিলেন। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে পদ্য রচনা করিতে পারিতেন। জসীমউদ্দীন উত্তরাধিকার সূত্রে সকল পৈতৃক গুণের অধিকারী হয়েছিলেন।”
দশম শ্রেণীতে পড়াকালীন জসীম উদ্দীন রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতা যা ১৯২৬ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকার তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ‘কবর’ পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর রাতারাতিই জসীম উদ্দীনের কবিখ্যাতি বাঙালী পাঠকের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্র-নজরুল যুগে সম্পূর্ণ ভিন্ন সুরের এ কবিতা পড়ে ডঃ দীনেস চন্দ্র সেন কবিকে লিখেন, “দুরাগত রাখালের বংশী ধ্বনির মত তোমার কবিতা আমার অন্তরকে স্পর্শ করেছে। তোমার কবিতা পড়ে আমি কেঁদেছি।” ডঃ সেন ইংরেজী পত্রিকা Forward এ জসীম উদ্দীনের ওপর একটি পুরো ইংরেজী প্রবন্ধ লিখেন, যার শিরোনম ছিল `An young mohammadan poet’.
সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনা হলো, কবি যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র তখনই এই ‘কবর’ কবিতাটি পুস্তকে সংকলিত হয় এবং ম্যাট্রিক ক্লাসে পাঠ্য হয়।
ছাত্রাবস্থায়ই কবি কর্মজীবনে জড়িয়ে পড়েন। ১৯২৪ সালে তিনি ৭০ টাকা আর্থিক মাসোহারার বিনিময়ে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন পল্লী সাহিত্য সংগ্রাহক নিযুক্ত হন। এম.এ পাস করার পূর্ব পর্যন্ত এ কাজে নিযুক্ত ছিলেন। এরপর ড. দীনেস চন্দ্র সেনের অধীনে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রামতন লাহিড়ী রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট নিযুক্ত হন এবং ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৩৭ সালে কবি বিবাহ করেন। পরের বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষকতা করেন। ১৯৪৪ সালে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক সরকারের প্রচার বিভাগের পাবলিসিটি অফিসার পদে যোগ দেন এবং ১৯৬৮ সালে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। এ সময়ে কন্ঠশিল্পী আব্বাস উদ্দীন তাঁর সহকর্মী ছিলেন।
কবির মনটি ছিল আকাশের মত উদার। আর সে মানুষ যদি হয় গায়ের লোক, বা তোমাদের শিশু কিশোর তা’হলে তো কথাই নেই। ছোট সুন্দর ফুটফুটে খুকী দেখলে কবি অমনি খলবলিয়ে বলে উঠেন-
“এই খুকীটি আমায় যদি একটু আদর করে
একটি ছোট কথা শোনায় ভালবাসায় ভরে;
তবে আমি বেগুন গাছে টুনটুনিদের ঘরে,
যত নাচন ছড়িয়ে আছে আনব হরণ করে;
তবে আমি রূপকথারি রূপের নদী দিয়ে,
চলে যাব সাত সাগরে রতন মানিক নিয়ে;
তবে আমি আদর হয়ে জড়াব তার গায়,
নুপুর হয়ে ঝুমুর ঝুমুর বাজত দুটি পায়।”
আসমানী কবিতায় দরিদ্র, অভাব অনটনে জর্জরিত শিশুদের নিয়ে তিনি লিখেছেন-
“পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের কখান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে ক’দিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হ’তে হাসির প্রদীপ রাশি
তারপরেতে নিবিয়ে গেছে দারুণ অভাব আসি।”
এমনি দরদ দিয়ে লিখতে পারা সত্যি সবার পক্ষে সম্ভব নয়।
ছোটদেরকে তাঁর বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে লিখেছেন-
“আমার বাড়ি যাইও পথিক
বসতে দেবো পিঁড়ে
জলপান যে করতে দেবো
শালি ধানের চিড়ে।
উড়কি ধানের মুড়কি দেব
বিন্নী ধানের খই
ঘরে আছে ফুল বাতাসা
চিনি পাতা দই।”
কি জিহবায় পানি এসে যাচ্ছে, তাই না? আবার শহুরে বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে লিখেছেন-
“তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে
আমাদের ছোট গায়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায়
উদাসী বনের বায়।”
ইত্যাদি হাজারো উদ্ধৃতি দেওয়া যাবে তাঁর লেখা হতে।
তাঁর শিশুতোষ লেখার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বইগুলো হচ্ছে- হাসু, একপয়সার বাঁশি, ডালিম কুমার এবং বাংগালীর হাসির গল্প ১ম ও দ্বিতীয় খন্ড। তিনি শুধু ছোটদের জন্যই লিখেন নি, বড়দের নিয়েও প্রচুর লিখেছেন। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কাব্য ২০ খানা, নাটক ১৩ খানা, জারী ও মুর্শিদী গানের সম্পাদনা করেছেন দু’খানা বই।
কবির বহুল পাঠ্য কাব্যগ্রন্থ হচ্ছে নকশী কাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট ও রাখালী। যা দেশে বিদেশে কবিকে বহুল পরিচিতি ও খ্যাতির আসনে সমাসীন করেছে।
নকশী কাঁথার মাঠ, বেদের মেয়ে, বাংলাদেশের হাসির গল্প ও জসীম উদ্দীনের নির্বাচিত কবিতা ইংরেজী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। কবি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। তিনি ‘হলদে পরীর দেশ’ নামক গ্রন্থের জন্য ইউনেসকো পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলেও সত্য যে বাঙালীর এই প্রিয় কবি, পল্লী কবিকে বাংলা একাডেমী কোন সম্মানে ভূষিত করেনি। এটা বাংলা একাডেমী ও এ জাতির জন্য সত্যিই লজ্জার। অবশ্য তাঁর বাসস্থান ‘পলাশ বাড়ি’ যে রোডে অবস্থিত তার নাম ‘কবি জসীম উদ্দীন স্মরণী’ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হলের নাম ‘কবি জসীম উদ্দীন হল’ রাখা হয়েছে।
কবি জসীম উদ্দীন তাঁর নিজ বাসভবন ‘পলাশ বাড়ি’তে ১৯৫৩ সাল হতে একটি সাহিত্য সভার আয়োজন করে আসছিলেন, যা আমৃত্যু জারি রেখেছিলেন। ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তারিখে সাহিত্য সভায় উপস্থিত হওয়ার জন্য সাহিত্যিক সাংবাদিক মোদাব্বের ও কবি আজিজুর রহমান উপস্থিত হয়ে সাহিত্য সভার বদলে কবির জানাযা পড়েছিলেন। অর্থাৎ ১৯৭৬ সালের ১৪ মার্চ তারিখে বাংলার আপামর জনসাধারণের নয়নের মণি পল্লীকবি জসীমউদ্দীন ইন্তিকাল করেন। এ সময়ে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন