পৃথিবী অনেক বিশাল হলেও মহাবিশ্বের তুলনায় ছোট, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দুমাত্র। এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি সম্পর্কে যত মতবাদ (theory)-ই পেশ করা হোক না কেনো, প্রকৃত সত্য এই যে এই মহাবিশ্ব ও তন্মধ্যস্থিত সবকিছু মানুষের সৃষ্টি নয় বরং পরম জ্ঞানবান ও শক্তিধর কুশলী মহান আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টি। সেই পরম শক্তিমান আল্লাহই এই পৃথিবী ও আসমান সৃষ্টি করেছেন। দিবা-নিশির পরিবর্তনের পূর্ণ রহস্য উদঘাটন ও তা জানার ব্যাপারে মানুষের অদম্য আগ্রহে আজও ভাটা পড়েনি। বর্তমান রকেটের যুগেও মানুষ সামুদ্রিক জলযানের ওপর নির্ভরশীল। বৃষ্টির পানি আল্লাহর আরেক বিস্ময়কর কুদরাত। পানির জন্য মানুষ আজও বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। বায়ুপ্রবাহ যে কোন জায়গার আবহাওয়ার জন্য দায়ী। সমুদ্রের নাবিকরা বায়ুপ্রবাহের প্রভাব বেশ ভালভাবেই উপলব্ধি করেন। আধুনিক যন্ত্র ও রাডার নিয়ন্ত্রিত জাহাজ আবিষ্কারের পরও বায়ু প্রবাহের প্রভাব অক্ষুন্ন রয়েছে। মেঘমালাও আল্লাহর নিয়ন্ত্রনাধীন। আল্লাহর শক্তিমত্তার বর্ণনা কুরআনে এভাবে এসেছে-
“নিশ্চয়ই আসমান ও যমীনের সৃষ্টিতে, রাত-দিনের আবর্তনে, মানব কল্যাণের জন্য সাগরে বিচরণশীল যেসব নৌযান চলাচল করে, আল্লাহ আকাশ থেকে যে পানি বর্ষণ করেন এবং তার মাধ্যমে মৃত ভূমিকে জীবিত করেন, আর তাতে যাবতীয় জীবজন্তু বিস্তার করেন ও বায়ুর দিক পরিবর্তনে এবং আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যবর্তী নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবানদের জন্য অবশ্যই নিদর্শন রয়েছে। “
বস্তুজগতের তথ্য উদঘাটন ও নতুন বস্তু আবিষ্কার যে বিদ্যার মাধ্যমে হয়, সেই বিশেষ জ্ঞানই বিজ্ঞান। এক কথায় বলতে পারি বস্তুজগতের জ্ঞানই বিজ্ঞান। উল্লিখিত আয়াত থেকে বুঝা যায় যে, বিজ্ঞান শিক্ষা করা ও বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করা আল্লাহর নির্দেশ। বিজ্ঞানে বুৎপত্তি অর্জন করে মহান স্রষ্ট্রার পরিচিতি লাভ করা যায়। সুতরাং বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
কুরআনের এ শিক্ষা যেদিন মুসলমানরা বাস্তবে পরিণত করেছিল, সেদিন তারা গোটা পৃথিবীতে সমগ্র মানবজাতির শিক্ষাদাতা হতে পেরেছিল। আল বিরুনী, আল হাইয়ান ও ইবনে সিনা ছিলেন এই বিজ্ঞানের মহাপুরোহিত ও জনক। কিন্তু যেদিন মুসলমানরা প্রাচুর্যের মোহে বিজ্ঞানচর্চা পরিহার করল, ভোগ-বিলাস ও তথাকথিত ললিতকলার সেবা শুরু করল; তখন থেকেই মুসলমানদের অধ:পতন ও জাতীয় জীবনে ধীরে ধীরে নেমে এলো পরাধীনতা, অবক্ষয় ও হীনমন্যতাবোধের ঘোর অমানিশা। ধর্মীয় জ্ঞানচর্চা যেমন ফরজ তেমনি বিজ্ঞান-চর্চাও আল্লাহর নির্দেশ। কুরআন বিজ্ঞান চর্চার প্রধান লক্ষ্য নির্দেশ করছে এভাবে-
“নিশ্চয়ই আসমান ও জমীন সৃষ্টিতে, রাত-দিনের পরিবর্তনে নিশ্চিত নিদর্শন রয়েছে জ্ঞানবানদের জন্য। তারা আল্লাহকে স্মরণ করেন দাঁড়িয়ে, বসা ও শয়নরত অবস্থায়;আর আসমান ও যমীন সৃষ্টিতে চিন্তা করে বলেন, হে আমাদের রব! এসব আপনি অনর্থক সৃষ্টি করেননি। পবিত্রতা আপনার, আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে বাঁচান।”
কুরআনে প্রায় আয়াতের শেষে আল্লাহ তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা গবেষণা করার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিয়েছেন। সৃষ্টিজগৎ ও সৃষ্টিজীব সম্বন্ধীয় তত্ত্ব উদঘাটন যদিও ফরজ নয়;তবে মহান স্রষ্ট্রার ঐকান্তিক বাঞ্ছা প্রত্যেক বান্দা সৃষ্টি তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করুক। যারা চিন্তা-ভাবনা করবেন, তারা বুদ্ধিমান ও বিজ্ঞানী হবেন। এজন্যই সৃষ্টিভাবনা সম্পর্কে তাফসীরের এক মৌলিক নীতি হচ্ছে- (আল্লাহর সৃষ্টিজগৎ ও সৃষ্টিজীব নিয়ে গবেষণা করো;তবে আল্লাহর অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তাও করো না।)
নতুনের প্রতি আকর্ষণ, নতুন কিছু জানার প্রতি অপার প্রেরণা মানুষের জন্মগত। নিত্যদিনের সংবাদ জানার কৌতুহল আজও অম্লান ও অনিঃশেষ। এই সংবাদ যদি বিজ্ঞান বিষয়ক হয়, তাহলে মানুষের আগ্রহ কেমন তুঙ্গে উঠে যায়। এই উদ্দীপনা না থাকলে মানুষ পাথরের যুগ থেকে এ্যাটমের যুগ পর্যন্ত পৌঁছতে পারত না, উট ও গরুর গাড়ি থেকে উড়োজাহাজ পর্যন্ত অগ্রসর হতে পারত না, মাটির প্রদ্বীপ ও বা মোমবাতির থেকে বিজলিবাতি, সার্চ লাইট পর্যন্ত উন্নতি করতে পারত না। এসবই মানুষের বস্তুনিষ্ঠ উৎকর্ষ ও বৈজ্ঞানিক সাফল্য।
প্রকৃতির ধর্ম ইসলাম কেবল ‘নতুন’ হওয়ার কারণে কোনো বিষয়ে শিক্ষাগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। বরং কারিগরি, শিল্প, যুদ্ধের কলাকৌশল ও মানবকল্যাণে ব্যবহার্য বস্তু আবিষ্কারে বিপুল উৎসাহ দিয়েছে। হযরত সালমান ফারসী রা. এর পরামর্শক্রমেই নবীজী সা. তায়েফ যুদ্ধে দুটো নতুন যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করেছেন। কোনো কোনো বর্ণনামতে সেগুলো সালমান রা. নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন। একটি আধুনিক কালের আগ্নেয়াস্ত্র জাতীয় অস্ত্র ছিল, অপটি ট্যাংক জাতীয় ছিল। রাসূল সা. এর ঐকান্তিক অভিলাষ ছিল, একটি দল প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহার রপ্ত করুক। ইবনে কাসীর রহ. বর্ণনা করেছেন, রাসূল সা. হযরত উরওয়া ইবনে মাসউদ ও গায়লান ইবনে সালমাকে সিরিয়ার ‘ জরস্ ’ নামক শহরে পাঠিয়েছিলেন, যাতে সেখানে তারা আগ্নেয়াস্ত্র, কামান, ট্যাংক তৈরির প্রযু্ক্তি শিক্ষা লাভ করেন। এই দুই সাহাবী সিরিয়ার সমরাস্ত্র বিদ্যা অর্জনে বেশ গভীরভাবে নিবিষ্ট ছিলেন বলে হুনাইন ও তায়েফ যুদ্ধে শরীক হতে পারেননি। কৃষি ও খনিজ দ্রব্য থেকে উপকার লাভ করার জন্য রাসূল সা. ইরশাদ করেছেন: ভূগর্ভে লুকায়িত নিয়ামাতের মাঝে রিযিক সন্ধান করো।
আরব্য জাতি নৌজাহাজ কী তা জানত না। রাসূল সা. হর্ষোৎফুল্ল হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশ্যে পরাক্রমশালী সম্রাটের মতো সামুদ্রিক তরঙ্গমালার ওপর দিয়ে সফর করবে। হযরত মুয়াবিয়া রা. সর্বপ্রথম নৌবহর পরিচালনা করেছেন।
নিছক নতুন হওয়ার দরুণ আধুনিক আবিষ্কার বা পদক্ষেপের ওপর ইসলাম আপত্তি তোলেনি। বৈধ উদ্দেশ্যে সাধনের জন্য বৈধ পরিধিতে অবস্থান করে আধুনিকতা প্রীতি প্রশংসিত।
সারা বিশ্বে আজ উলঙ্গপনা আর অশ্লীলতার নিত্যনতুন পন্থা ও পদ্ধতি আবি®কৃত হচ্ছে। পরস্পরের সন্তুষ্টিতে ব্যাভিচারকেও বৈধতার সনদ দেওয়া হচ্ছে, এমনকি আজ বৃটেনের সংসদে প্রবল করতালীর মাঝ দিয়ে সমকামিতার বিল মঞ্জুর করানো হয়েছে। এ কিসিমের আধুনিকতা প্রীতির পরিণতিতে আজ পশ্চিমা নারীরা গর্ভপাত ঘটানোর অনুমোদনের জন্য সোচ্চার হয়েছে। এ রকম আধুনিকতাপ্রীতি জঘন্য ও ধ্বংসাত্বক। তবে বিজ্ঞানের বহু আবিস্কার এমন যে, তার ব্যবহারের উপর বৈধতা ও অবৈধতা নির্ভর করে। যেমন টেপরেকর্ডার, এদ্বারা গানও শোনা যায় যা অবৈধ। আবার এ দ্বারা তিলাওয়াতও শোনা যায় যা বৈধ। বস্তুতঃ ব্যবহারকারী কোন কাজে তা ব্যবহার করবে তার উপর সেটি কল্যাণকর হওয়া বা অকল্যাণকর হওয়া নির্ভরশীল।
সর্বযুগের আলেমগণ সেযুগের অভিনব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। লোকদের সামনে বিদ্যুৎ, তার, টেলিফোন, টেলিপ্রিন্টার, ওয়্যারলেস, রেডিও, টেপরেকর্ডার, গাড়ি, মটর, হাওয়াই জাহাজ, ষ্টিমার, রেলগাড়ি, যুদ্ধাস্ত্রের মাঝে ট্যাংক, কামান নানান কিসিমের বোমা, ফাইটার বিমান, সাবমেরিন, রকেট, মিসাইল, রাডার, শিল্প বিষয়ক নানা রকমের মেশিন, কারখান; কৃষিবিষয়ক ট্রাকটর, রাসায়নিক সার, কীটনাশক ঔষধ; চিকিৎসা বিষয়ক অপারেশনের যন্ত্রপাতি, রোগনির্ণয়ের যন্ত্রপাতি; শিক্ষাবিষয়ক কলা, বানিজ্য, হিসাব বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোল, জ্যোতি বিদ্যা, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের শিক্ষা অর্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছেন। অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে ইসলামের সাথে পরিচয় করাচ্ছে। ইসলামের সাথে মূলত: বিজ্ঞানের কোনো বৈপরীত্য নেই; যদি বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ প্রত্যক্ষ পরীক্ষা নিরীক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়।
বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল। ইসলাম চিরন্তন ও অপরিবর্তনশীল। খৃষ্টানদের মতো ইসলাম বিজ্ঞানশিক্ষাকে নিষেধ করেনি। ইউরোপের পুনর্জাগরণের সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল ঈসায়ী ধর্ম ও তাদের পাদ্রীগণ। ইউরোপের উপর যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন ছিল; ততক্ষণ সমগ্র ইউরোপ মূর্খতার আঁধারে আচ্ছন্ন ছিল। পাদ্রীগণ নিজস্ব নেতৃত্ব বজায় রাখার জন্য জনসাধারণের মাঝে শিক্ষাসচেতনতায় উদ্বুদ্ধ সকল আন্দলনকেই জোর করে দমন করার প্রানান্ত চেষ্টা করেছিল। জানহাস্ ও জেরুমের লোকদেরকে কন্সটান্স শহরে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নতুন নতুন পথ উন্মুক্ত করার অপরাধে বিজ্ঞানী গ্যালিলিত্তকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু ক্রমান্বয়ে চতুর্দিক থেকে এই জাগরণের প্রতিধ্বনি উঠতে থাকে। কোনো বাধাই তাদেরকে বিজ্ঞানচর্চা থেকে সরাতে পারেনি।
অবশেষে মার্টিন লুথার, জুহুলি সাহস করে পোপদের জগদ্দল পাথর রাস্তা থেকে অপসারণ করেছেন। সুযোগ করে দিয়েছেন এ বিপ্লবের প্রচার-প্রসারের। পরবর্তী যুগে রুশো, হারনিক, রেনানের মতো আধুনিকপন্থীরা ধর্মের ভিতর ব্যাপক পরিবর্তন করে ধর্মকে সেযুগের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করেছেন। জাতিকে পোপীয় আগ্রাসন থেকে মুক্তি দিয়েছেন, উৎকর্ষ ও অগ্রগতির পথ নিষ্কন্টক করেছেন। খৃষ্টান ধর্মের মতো ইসলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিতে শংকিত নয়। ইসলামের আলেমগণ পোপদের মতো কখনো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগ্রহণের বিরোধিতা করেননি। এ বিরোধিতা করার অধিকার কারো নেই। আলেগণ তো পোপদের মতো ধর্মপ্রবর্তক নন। তাছাড়া পোপ একটি নির্ধারিত গোত্র। যে কেউ পোপ হতে পারেন না। অথচ ইসলামে গোত্র-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই আলেম হওয়ার অধিকার রাখেন। প্রকৃত উদারতার ধর্ম ইসলাম। ফলে নিজস্ব ধর্মবাণী ও ব্যাখ্যা সুরক্ষিত। পোপতন্ত্রে ধর্ম অরক্ষিত, বিকৃত ও পরিবর্তিত।
বিজ্ঞান পরিবর্তনশীল, কালজয়ী নয়। আজ যে থিওরি ও দর্শন সত্য বলে প্রতিভাত হচ্ছে; কাল তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হচ্ছে। মূলত বৈজ্ঞানিক গবেষণা দুই ধরনের। ১. প্রত্যক্ষ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর প্রতিষ্ঠিত। এ কিসিমের গবেষণা কখনো কুরআন-সুন্নাহর বিপরীত প্রমাণিত হয়নি। হতে পারেই না। যেমন- মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ। এই তথ্য আধুনিক বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার। অথচ কুরআন এ তথ্য চৌদ্দশ বছর আগে দিয়েছে- (আমি স্বীয় ক্ষমতাবলে আকাশ সৃষ্টি করেছি এবং আমিই সম্প্রসারক।)
কুরআনের সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিস্কৃত সম্প্রসারণ তথ্য সম্পূর্ণ মিলে যায়। এদেশ মুসলিম দেশ হওয়া সত্ত্বেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে আতংক। জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে মহাবিপদ মনে করছি। নবজাতকের মুখ দেখেই অস্থির। তার খাবার আসবে কোত্থেকে। বাসস্থান সংকুলান হবে কীভাবে। পশ্চিমারা জনসংখা হ্রাস করতে আজ জন্মনিয়ন্ত্রণে উৎসাহ দেয়। অথচ কুরআন মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ ঘটার তথ্য দিয়েছে, দেশের আয়তন বৃদ্ধির প্রমাণ করেছেন বিজ্ঞানীরা। তারপরও পশ্চিমাদের পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করে প্রশান্তির ঢেকুর দিই। নবজাতকের হাত দুটো তো অকেজো নয়। গণচীন শতকোটি মানুষ নিয়ে কীভাবে জীবিত আছে! আমাদের দেশের মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করেনি। জন্মনিয়ন্ত্রণ ছাড়াই তারা এত অল্প সময়ের ভিতর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিস্ফোরণ ঘটাল। এখনো প্রতিটি নতুন শিশু তাদের জন্য আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। তার মূলে আমরা দেখি যে, তারা প্রভাব তাড়িত নয়। পশ্চিমাদের ধোয়াটে কথা তাদের আদর্শের পথে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারেনি।
আরেকটি দৃষ্টান্ত। পৃথিবী ছাড়াও আরো অনেক গ্রহের অস্তিত্বের তথ্য প্রাচীন কাল থেকে মানুষ জানত (বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনি)। আধুনিককাল আরো তিনটি গ্রহের অস্তিত্ব বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন। সেগুলো হল ইউরেনাস, নেপচুন ও প্লুটো। কুরআনে বর্ণিত হযরত ইউসুফ আ. স্বপ্নে ১১টি গ্রহ দেখেছিলেন। আমরা বিশ্বাস করি; অদূর ভবিষ্যতে আরো দুটো গ্রহ আবিস্কৃত হয়ে ১১টি সংখ্যা পূর্ণ হবে।
বিজ্ঞানীদের গবেষণার ২য় প্রকার ১. যা শুধু ধারণা অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। এই প্রকারের বিজ্ঞানীরা নিশ্চত ফলাফলের সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেনা। এ ধরনের আবিষ্কারই কুরআনের বিপরীত হয়ে থাকে। এ প্রকারের গবেষণার ব্যাপারে আমাদের ধর্মীয় অনুভূতি ও মানসিকতা থাকবে এরূপ যে, সন্দেহতীতভাবে কুরআনের সুস্পষ্ট ঘোষণা উপর পূর্ণ ঈমান রাখতে হবে, আর অপূর্ণ জ্ঞানের কারণে বিজ্ঞান এখনো মূল তত্ত্ব উদঘাটন করতে পারেনি এরূপ বিশ্বাস রাখতে হবে। যেমন: আনষ্টাই ও তার মতালম্বী বিজ্ঞানীরা বলেছেন সূর্য ঘোরে। এ মত কুরআনের। সূরা ইয়াসিনে সূর্য ঘোরার বক্তব্য রয়েছে, সূর্য তার নির্দিষ্ট কক্ষপথে পরিভ্রমণ করছে।
কিন্তু নিউটন ও তার মতালম্বী বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। এ দুটি মতের মাঝে বৈপরিত্য নেই। কেননা, সূর্য আপন কক্ষে পরিভ্রমনরত; এমতাবস্থায় পৃথিবী তার চারদিকে ঘুরে।
খৃষ্টানদের ধর্মগ্রন্থের চেয়ে বিপুল পরিমাণে বিজ্ঞান বিষয়ক তথ্য, সূত্রের প্রতি কুরআনে আলোকপাত করা হয়েছে। কুরআন মূলত: হেদায়াতের গ্রন্থ। বৈজ্ঞানিক আলোচনা কুরআনে উদ্দেশ্যে নয়। তবু প্রাসঙ্গিকভাবে বহু ত্যথ কুরআনে আলোচিত হয়েছে।
বিজ্ঞানের যে সমস্ত তথ্য কুরআনে স্থান পায়নি, সে ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা সম্ভব না হয়, তাহলে তাদের দেওয়া তথ্য বিশ্বাসও করবো না, আবার মিথ্যারোপ করবো না। যেমন : পৃথিবী গোলাকার না চ্যাপ্টা, পৃথিবীর বয়স ইত্যাদি।
কিছু কিছু তথ্যের ব্যাপারে খোদ বিজ্ঞানীদের মাঝে মতভিন্নতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে কুরআনে বা হাদীসে বর্ণিত তথ্যই আমরা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করবো। যেমন-‘ সূর্য থেকে পৃথিবীর জন্ম হওয়ার ধারনা। ’ বিষয়টি আমরা যেমন বিশ্বাসও করতে পারি না আবরা অবিশ্বাসও করতে পারি না। কোনো কোনো বিজ্ঞানী তা বলেছেন।
বিজ্ঞানীদের কিছু গবেষণা নিরর্থক। যেমন: মহাশূণ্য অভিযান। মহাশূণ্যযানের মাধ্যমে যদিও মানুষ প্রথমবার অতি কাছ থেকে চন্দ্র অবলোকন করেছে, নভোযান প্রেরণ থেকে প্রত্যাবর্তন পর্যন্ত মহাশূণ্য ভ্রমণের প্রতিটি স্তরই সাধারণ মানুষের জন্য অত্যন্ত বিস্ময়কর। কিন্তু মানবকল্যাণ এতে একদম অনুপস্থিত। অষ্টম এ্যাপোলো যাতায়াতে ব্যয় হয়েছিল বার হাজার কোটি টাকা। দশম এ্যাপোলোর ব্যয় তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি, ক্ষুধা ও দরিদ্রের কষাঘাতে পৃথিবী যেখানে জর্জরিত, কোঠি কোঠি আদম সন্তান পেট ভরে দুমুঠো খেতে পায় না, ঔষধ পথ্য ও চিকিৎসার অভাবে অসংক্ষ মানুষ কাতর-বিপন্ন , শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত; সেখানে লক্ষ কোটি টাকা ব্যয়ের এই অভিলাস কীভাবে করেন? যার মনে বিন্দুতম মানবতাবোধ আছে সে এরূপ নিঃস্ফল কাজে অর্থ ব্যায় করতে পারে না।
জাপানও বলেছে, ‘মহাশূণ্য অভিযান একদম অনর্থক খাটুনি। যুদ্ধবাজি ও শূণ্য বাজির পরিবর্তে সমুদ্র নিয়ে গবেষণা করে মানবকল্যাণ সাধন করা যায়। নিকটতম উপগ্রহ থেকেও সুমুদ্র মানুষের অভিযানের নাগালে। আমাদের পৃথিবীর দুই তৃতীয়াংশ জুড়ে মহাসমুদ্র। বৈজ্ঞানিক গবেষণার বৃহৎ ক্ষেত্র যদি সুমুদ্রকে করাহয়, পৃথিবীর জনসংখ্যা বর্তমানের চেয়ে দশগুণ বৃদ্বি পেলেও কেউ অন্ততপক্ষে না খেয়ে মরবে না। কারণ সমুদ্রের গভীরে খনিজ সম্পদের বিপুল সমাহার রয়েছে। তাছাড়া মহাশূণ্যের নভোচারীরা যদি অন্তর্দৃষ্টি খুলে গবেষণা করতেন, ইসলামের সত্যতার প্রামাণ্যচিত্র তাদের সামনে উদ্ভাসিত হত দিবালোকের মতো। রাসূল সা. এর মিরাজ গমনের সময় ‘বুরাক’ যানের দ্রুতগমন অগাধ আস্থা যুগিয়েছে এই মহাশূণ্য অভিযানে। বর্তমান যুগের নভোচারীরা এক ঘন্টার কম সময়ে সারা পৃথিবী ভ্রমণ করে প্রমাণ করেছেন, গতি নিদিষ্ট সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়।
বৈজ্ঞানিক তৎপরতা যতই সমৃদ্ধ হবে ইসলামের সত্যতা ততই সুস্পষ্ট হবে। একটি দেশ উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করার প্রধান চালিকাশক্তি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আবিষ্কারে ও ব্যবহারে অগ্রসরমানতা। যে জাতি যত বেশি উন্নত সে জাতি তত বেশি শিক্ষা-দীক্ষায়, জ্ঞান-বিজ্ঞানে ও প্রযুক্তি ব্যবহারে ঋদ্ধিমান। ইসলাম তো প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছে। কোনো কোনো বিষয়ে ইসলাম প্রযুক্তিতে সম্পদশালী হওয়াকে অপরিহার্য করেছে। এমনকি প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধ হতে গিয়ে পরজাতি বা পরদেশের উপর নির্ভরশীলতাকেও ইসলাম অপছন্দ করেছে। প্রবাস থেকে প্রযুক্তি শিক্ষালাভ ভিন্ন ব্যাপার। তাই বলে স্বনির্ভর হওয়ার শক্তি পঙ্গু করে পরজাতির মুখাপেক্ষী থাকা সকলের কাছেই অগ্রহণযোগ্য।
উন্নয়নের একমাত্র সোপান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে স্বনির্ভর হওয়া প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য আবশ্যক। আমাদের অতি আধুনিকমনা ভাইয়েরা নাচগান, বেপর্দা, সহশিক্ষা, খেলাধুলা ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রধান আকর্ষণ দিগম্বর হওয়াকে অগ্রগতির চাবিকাঠি মনে করেন। আর মোল্লাদের শিক্ষাকে মনে করেন অনগ্রসরমানতা ও স্থবিরতা। আল্লামা ইকবাল বলেছেন-
নগ্নঊরু প্রদর্শনীর যাদুতে বাড়েনি অগ্রগতি
দাড়ি গোঁফ কামিয়ে আসেনি উন্নতি
ধর্মহীনতায় পায়নি তারা সাফল্য
ইংরেজি অক্ষরে নেই কোনো যাদুমন্ত্র
পশ্চিমা উন্নতি এসেছে জ্ঞান-বিদ্যায়
আজ তারা মহাধনী মোদের ছেড়ে দেওয়া পেশায়
শার্ট-প্যান্ট-টাই পরার নাম নয় প্রগতি
দাড়ি-টুপি-পাগড়ী নয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরোধী।
তাই আমাদেরকে উন্নতির সোপানে উঠতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষায় প্রতিযোগী হতে হবে। আইনকে শ্রদ্ধা করতে হবে। চারিত্রিক আচরণে অনন্য হতে হবে। বিজ্ঞান শিখবো আল্লাহর পরিচয় পাওয়ার জন্য। বিজ্ঞান শিখব নাস্তিক ও খোদাদ্রোহী শক্তিকে পরাস্ত করার জন্য। আল্লাহ তৌফিকদাতা।
লেখক: আব্দুল গাফ্ফার,
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন