আমরা যাকে নিয়ে আজ আলোচনা করব তিনি ছিলেন মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের মধ্যমণি। আধুনিককালেও যাঁকে মহাকবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এইএই বহুভাষাবিদ পন্ডিত, অনুবাদক মহাকবি আলোচনার পূর্বে তাঁর যুগ সম্বন্ধে জেনে নিলে মনে হয় সবার জন্য সুবিধা হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরাতন বলে মনে করা হয়। এই হাজার বছরকে পন্ডিতরা তিন ভাগে ভাগ করেছেন-প্রাচীন, মধ্য ও আধুনিক। ৬৫০ হতে ১২০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত প্রাচীন যুগ, ১২০১ হতে ১৮০০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত মধ্যযুগ এবং ১৮০১ হতে বর্তমান কাল পর্যন্ত আধুনিক যুগ। অবশ্য হিন্দু পন্ডিতরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ১২০১ হতে ১৩৫০ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত অন্ধকার যুগ বলে থাকেন। কারণ এই দেড়শ বছর মুসলমানদের ভারত আগমন তথা বাংলাদেশ দখলের দরুণ কোন সাহিত্য সৃষ্টি হয়নি বলে তারা মনে করে। অথচ সত্যি কথা হলো এই সময়েও সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে। যেমন শূন্য পূরাণ, কলিমা জালাল বা নিরঞ্জনের রুষ্মা, ডাক ও খনার বচন, সেক শুভোদয়া ইত্যাদি।
কবিগুরু মহাকবি আলাওল বা আলাউল এই মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম সাহিত্য ব্যক্তিত্ব। তিনি ১৫৯৭ খৃস্টাব্দে কারো কারো মতে ১৬০৫ বা ১৬০৭ খৃস্টাব্দে ফরিদপুর জেলার জালালপুরে জন্মগ্রহণ করেন। অবশ্য দু’একজন পন্ডিত ব্যক্তি আলাওলের জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার জোবরা গ্রামে বলে মনে করেন। কিন্তু কবির নিজের উক্তিকে সামনে রেখে প্রায় সকল পন্ডিতগণই ফরিদপুর জেলার জালালপুরের পক্ষে রায় দিয়েছেন। কবির পিতা ছিলেন ফতেহাবাদের রাজ্যেশ্বর মজলিশ কুতুবের মন্ত্রী। কবি তাঁর পদ্মাবতী কাব্যে আত্মকথায় লিখেছেন—
মুলুক ফতেয়াবাদ গৌড়েতে প্রধান।
তাহাতে জালাল পুর অতি পূণ্যস্থান।।
বহুগুণবন্ত বৈসে খলিফা ওলেমা।
কথেক কহিব সেই দেশের মহিমা।।
মজলিস কুতুব তখত অধিপতি।
মুই দীনহীন তান অমাত্য সন্তুতি।।
মহাকবি আলাওল ছিলেন ভাগ্যবিড়ম্বিত এক কবি। তিনি কৈশর বয়সে মন্ত্রী পিতার সাথে কার্যোপলক্ষে কোথাও যাত্রাকালে পথিমধ্যে দুর্ধর্ষ হার্মাদ জলদস্যূর কবলে পড়েন। কবির পিতা জলদস্যুদের হাতে শহীদ হন। কবি আহত হলেও প্রাণে রক্ষা পান। এরপর অনেক দুঃখ-কষ্ট অতিক্রম করে অনেক পথ অতিক্রম করে তিনি আরাকানে এসে উপস্থিত হন। বেঁচে থাকার তাগিদে কবি মগরাজার সেনাবাহিনীতে রাজ-আসোয়ারের চাকরি গ্রহণ করেন। রাজ আসোয়ার মানে অশ্বারোহী সৈনিক। এ সময় আরাকান রাজসভায় একটি চমৎকার সাহিত্যিখ আবহাওয়া বিরাজ করছিল। গুণী ব্যক্তিদেরকে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখা হত সে যে ধর্মেরই অনুসারী হোক না কেন। কবি নিজেই লিখেছেন-
বহু বহু মুসলমান রোসাঙ্গে বৈসন্ত।
সদাচারী, কুলীন, পন্ডিত, গুণবন্ত।।
ফলে অচিরেই কবি আলাওলের গুণগরিমা, বিদ্যা বুদ্ধি ও সাহিত্য প্রতিভার কথা অভিজাত মহলে ছড়িয়ে পড়ে এবং তিনি আরাকানের প্রধানমন্ত্রী মাগন ঠাকুরের আশ্রয় লাভ করেন। কবি বলেন,
তালিব আলিম বুলি মুঞি ফকিরেরে।
অন্নবস্ত্র দিয়ে সবে পোষন্ত আদরে।।
মূলত এখান থেকেই আলাওলের কাব্য সাধানার শুরু এবং এক আমত্যের পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি ক্রমাগত ১৬৫১ খৃ. হতে ১৬৭৩ খৃ. পর্যন্ত বেশ কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেন। মাঝে কবির উপর বয়ে যায় অনেক ঝড়ঝঞ্জা। কবিকে অনেক কষ্ট ক্লেশে নিপতিত হতে হয়। ১৬৫৯ খৃ. শাহসূজা বাংলাদেশ হতে বিতাড়িত হয়ে আরাকান রাজ্যে আশ্রয় লাভ করেন। যে কোন কারণেই হোক ১৬৯১ খৃ. তিনি আরাকান রাজ্যের বিরাগভাজন হয়ে নিহত হন। এ সময়ে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কবি আলাওল কারারুদ্ধ হন। পঞ্চাশ দিন কারাভোগের পর কবি মুক্তি পান। কিন্তু প্রতিকুল পরিবেশে সবাই কবির বিরুদ্ধে চলে যায়, ফলে তিনি অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে থাকেন। ঠিক এ সময়ে কবির প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাগন ঠাকুরের মৃত্যু হলে কবির দুর্ভোগ আরো বেড়ে যায়। এমনকি এ সময় তিনি ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে রোসাঙ্গ রাজসভার আমত্য সৈয়দ মূসা, সমরসচিব সৈয়দ মুহাম্মদ খান, রাজমন্ত্রী নবরাজ মজলিশ, অন্যতম সচিব শ্রীমন্ত সোলেমান প্রমুখদের নজরে আসেন। ফলে পুনরায় অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়।
তোমরা জানলে খুশি হবে যে, সেই যুগেও মহাকবি আলাওলের জানা ছিল অনেকগুলি ভাষা। তিনি মৈথিল, ব্রজভাখা, ঠেট, খাড়িবোলির মত উত্তর ভারতের উপভাষা ছাড়াও বাংলা, সংস্কৃত, আরবী ও ফারসীতে সমান দখল রাখতেন। অপর দিকে তাসাউফ ও যোগতন্ত্রেও ছিল পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান। যার কারণে তিনি অনুবাদে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সত্যি কথা বলতে তাঁর মত অনুবাদক কদাচিৎ দু/একজন মিলে। তিনি কাব্য ক্ষেত্রে ছিলেন স্বচ্ছন্দ্য। কাব্যতত্ত্ব, অলংকার শাস্ত্র ও ছন্দবিজ্ঞান ছিল তাঁর আয়ত্ত্বে। এমনকি তিনি কয়েকটি সংস্কৃত ছন্দও অত্যন্ত দক্ষতার সাথে বাংলায় প্রয়োগ করেন। তার রোসাঙ্গে তিনি তো সঙ্গীত শিক্ষক রূপেই পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
আলাওল অনেকগুলো পুস্তক রচনা করেন। তার মধ্যে-
১. পদ্মাবতীঃ প্রখ্যাত হিন্দি কবি মালিম মুহাম্মদ জায়সী ‘পদুমাবত’ কাব্যের বঙ্গানুবাদ। ১৬৫১ খৃস্টাব্দে মাগন ঠাকুরের নির্দেশে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ অনুবাদ করেন। এ কাব্যটি আলাওলের প্রথম ও সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্য।
২. সয়ফুলমুলক বদিউজ্জামানঃ আলাওলের দ্বিতীয় কাব্য। ১৬৫৮ খৃস্টাব্দে মাগন ঠাকুরের পরামর্শে ও উৎসাহে এ কাব্য লেখা শুরু করেন এবং পরে ১৬৬৯ খৃস্টাব্দে রোসাঙ্গ রাজের আমত্য সৈয়দ মূসার অনুরোধক্রমে তা সমাপ্ত করেন। এটি প্রেম মূলক কাহিনী কাব্য।
৩. সতীময়না ও লোরচন্দ্রানীঃ দৌলত কাজীর অসমাপ্ত কাব্য আমত্য সুলায়মানের অনুরোধে ও উৎসাহে ১৬৫৯ খৃস্টাব্দে সমাপ্ত করেন। এ কাব্যগ্রন্থটি আলাওলের তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ।
৪. সপ্তপয়কারঃ পারস্য কবি নিজামীর সপ্তপয়কর নামক কাব্যের ভাবানুবাদ। রোসাঙ্গরাজের সমরমন্ত্রী সৈয়দ মুহাম্মদের আদেশে ১৬৬০ খৃস্টাব্দে আলাওল এটির অনুবাদ করেন।
৫. তোহফাঃ এ গ্রন্থটিও অনুবাদ। বিখ্যাত সূফী সাধক শেখ ইউসুফ গদা দেহলভীর ‘তোহফাতুন নেসায়েহ’ নামক ফরাসী গ্রন্থের অনুবাদ। ১৬৬৪ খৃস্টাব্দে আলাওল এ কাব্যগ্রন্থটি সমাপ্ত করেন। এটি আলাওলের পঞ্চম রচনা।
৬. সেকান্দর নামাঃ এ ষষ্ঠ নম্বর কাব্যটি নিজামী গঞ্জভীর ফারসী সেকান্দর নামা গ্রন্থের অনুবাদ। আলাওল এ কাব্যটি সম্ভবত ১৬৭২ খৃস্টাব্দে রচনা করেন। আরাকান রাজ চন্দ্র সুর্ধমার নবরাজ উপাধীধারী মজলিস নামক জনৈক আমত্যের অনুরোধে আলাওল সেকান্দরনামা অনুবাদ করেন।
সঙ্গীতবিদ হিসেবেও আলাওলের প্রচুর খ্যাতি ছিল। তিনি সঙ্গীতের শিক্ষক ছিলেন। তিনি বেশ কিছু গীতও রচনা করেছেন। অপরদিকে তিনি বাংলা ও ব্রজবুলিতে বৈষ্ঞবপদও রচনা করেছেন।
কবি ‘মুকীম’ তার সম্বন্ধে লিখেছেন-
গৌরবাসী রৈল আমি রোসাঙ্গের ধাম
কবিগুরু মহাকবি আলাওল নাম।
যদিও কবি আলাওলের রচনা অনুবাদ প্রধান তবুও তার অনুবাদ মৌলিক রচনার সমপর্যায়ের। এই অসাধারণ প্রতিভাবান কবি, মহাকবি আলাওল আনুমানিক ৭৬ বছর বয়সে ১৬৭৩ খৃস্টাব্দে ইন্তিকাল করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন