মঙ্গলবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৫

"বুদ্ধিজীবি দিবস ও ঐতিহাসিক দায়ভার..."

(Mustafiz Nadem, Secretary, BICS, CU)
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে সদ্য স্বাধীন একটি জাতি যেন মাথা তুলে দাড়াতে না পারে সে জন্যই পরিকল্পিত এই হত্যাকান্ড। কিন্তু স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এসে আজো আমরা অন্ধকারে, প্রকৃত হত্যাকারী কারা? হত্যাকারীদের কে খোজে বের করে বিচারের আওতায় আনার ঐতিহাসিক দায়িত্বটি স্বাভাবিক ভাবেই স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের উপর বর্তায়। সেই ঐতিহাসিক দায়ীত্বপালনে শিথিলতা চেপে যাওার জন্য ইতিহাস যদি কাওকে দোষী সাব্যস্ত করে তাহলে নিশ্চই অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো সময় ধরেই বুদ্ধিজীবিদের হত্যা করা হয়। কিন্তু বিজয়ের ঠিক আগমুহুর্তে এই হত্যাকান্ডটি যে অনেক পরিকল্পিত ও গোছানো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বুদ্ধিজীবি হত্যার কারণ নিয়ে বর্তমান সময়ের বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণের সার সংক্ষেপ প্রায় একই রকম ”শুরু থেকেই দমিয়ে রাখার চেষ্টা”। কিন্তু সুচনা থেকেই ইতিহাসের যে অংশে ধুম্রজাল সৃষ্টি হয়েছে তা এখনো আগের মতই আছে। আর তা হচ্ছে প্রকৃত ঘাতক কারা?
বুদ্ধিজীবি হত্যার রহস্য উন্মোচনে শুরু থেকেই অনাগ্রহী ছিল তৎকালীন শাষক দল বরং অসহযোগীতার অভিযোগই প্রকট। আশির দশকে এই হত্যাকান্ড নিয়ে অভিযোগের অনেক ডাইমেনশন দেখা গেলেও বর্তমানে মিডিয়ার কল্যানে তা অনেকটা সরল রৈখিক। একতরফা ভাবে হানাদার বাহিনীকে বাদ দিয়ে দায়ভার এখন জামায়াতের কাধেঁ। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হচ্ছে নিভর যোগ্য কোন তথ্য-উপাত্ত নেই বা থাকলেও তা বিনষ্ট করা হয়েছে। এ সম্পর্কে যৎসামান্য পড়াশোনায় যে প্রশ্নগুলো আমার মত একজন সাধারণ পাঠককে কৌতুহলী করে তা হচ্ছে…
১. ১৪ ডিসেম্বরে নিহত বুদ্ধিজীবিদের যুদ্ধকালীন ভূমিকা কি ছিল?
২. নিহত বুদ্ধিজীবিদের রাজনৈতিক দর্শন কি ছিল?
৩. বিজয়ের ঠিক আগ মুহুর্ত ঢাকার নিয়ন্ত্রন কাদের হাতে ছিল?
৪. স্বাধীন বাংলাদেশ দুর্বল থাকলে কৌশলগত ভাবে কাদের লাভ?
৫. যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সরকার বুদ্ধিজীবি হত্যার জন্য কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেনি কেন?
স্বাধীনতা যুদ্ধে ঠিক কত জন বুদ্ধিজীবি এই নির্মমহত্যার শিকার হয়েছিলেন তার প্রকৃত হিসাব নিয়েও বেশ বিতর্ক রয়েছে। বাংলাপিডিয়ায় প্রকাশিত পরিসংখ্যানে তথাকথিত হাজার হাজার বুদ্ধিজীবি নিহত হওয়ার তথ্য যথার্থ নয় বলে প্রমাণিত। এ পরিসংখ্যান অনুসারে মুক্তিযুদ্ধে সারা দেশে মোট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ২১ জন, মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক ৫৯ জন, সাংবাদিক ১৩ জন, চিকিৎক ৪৯ জন, উকিল ৪১ জন এবং সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ত্ব ও প্রকৌশলী সহ অন্যান্য আরো ১৬ জন নিহত হন।
১৪ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ঠিক কত জন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়েছিল তার প্রকৃত হিসাব নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। ডিসেম্বরের শেষ দিনগুলোতে বিুদ্ধিজীবি হত্যাসংক্রান্ত বিষয়ে Daily Telegraph ২০ ডিসেম্বরে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। একই ভাবে ১৯ ডিসেম্বর প্রতিবেদন প্রকাশ করে New York Times । প্রতিবেদনে পত্রিকা দুটি ঢাকার অদুরে যথাক্রমে ২০০ জন ও ১২৫ জন বুদ্ধিজীবিকে বেয়নেট দিয়ে খুচিয়ে, শ্বাস রোধ করে ও গুলি করে হত্য করা হয়েছে বলে প্রচার করে। এ সময় সকল মৃত ব্যাক্তির হাত পেছনে বাধা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় পশ্চম পাকিস্তানী সৈনিক ও তাদের স্থানীয় সহযোগীদের দ্বারা নিহত প্রায় ৩০০ জন বাঙালী বুদ্ধিজীবির একটি অংশ তারা।
এ প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো প্রতিবেদন প্রকাশ করে যে, রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ২০০ বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করা হয়েছে। ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়া বলেন, “ ঢাকার মোহাম্মদপুর পশ্চিম প্রান্তের ইটখোলা ও মীরপুরের উত্তরের কবরস্থানের পাশে ৫০-৬০ জনের লাশ পাওয়া যায়।…….উল্লেখ্য, মোহাম্মদপুর ও মীরপুর আবাসিক এলাকা দুটো ছিল মূলত অবাঙালী অধ্যুষিত অঞ্চল।”
বাংলাপিডিয়ার পরিসংখ্যান থেকে দেখাযায় শুধু ঢাকায় নিহত বুদ্ধিজীবির সংখ্যা মোট ৭১ জন। এদের মধ্য থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হিসাব বাদ দিলে( প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষকদের সাধারণত বুদ্ধিজীবি বলা হয় না) বাকি থাকে ২৬ জন । এদের মধ্যেও অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেব সহ অন্তত ১০ জন যারা নিহত হন ডিসেম্বরের আগেই। তা হলে বাংলাপিডিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী আর থাকে ১৬ জন। স্বাধীনতার ৪২ বছর পরে এসে আমাদের প্রশ্ন রায়ের বাজারে প্রকৃত পক্ষে কত জন বুদ্ধিজীবি কে হত্যা করা হয়েছিল? বিদেশী গনমাধ্যম দুটির প্রতিবেদন বস্তুনিষ্ট ছিল কি না? বাংলাপিডিয়ার পরিসংখ্যান যদি সঠিক হয়ে থাকে তা হলে রায়ের বাজারের লাশগুলো কাদের?
বুদ্ধিজীবিদের কে হত্য প্রসঙ্গে রাও ফরমান আলী বলেন, “ …কিছু লোককে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আমি আজ পর্যন্ত জানি না যে তাদেরকে কোথায় রাখা হয়েছিল। সম্ভবত এমন কোথাও রাখা হয়েছিল যার দায়িত্বে ছিল মুজাহিদরা। আত্নসমর্পনের পর কোর বা ঢাকা গ্যারিসনের কমান্ডাররা তাদের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছিলেন এবং তারা মুক্তি বাহিনীর ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান আর্মীকে দুর্নাম দেয়ার উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী বা ইন্ডিয়ান আর্মীও বন্দী ব্যাক্তিদের হত্যা করতে পারে। ভারতীয়রা ইতিমধ্যেই ঢাকা দখল করে নিয়েছিল।”
বৃটিশ সাবেক মন্ত্রী জন স্টোন হাউজ ২০ ডিসেম্বর হিন্দুস্তান টাইমসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে এই হত্যার জন্য পাকিস্তানের ১০ জন সেনা অফিসারকে দায়ী করেন। এবং এ বিষয়ে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠনের দাবী জানান।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৭ই মে দেশের প্রায় ৫৫ জন বিশিষ্ট ব্যাক্তি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে বিবৃতি প্রদান করেন। এদের অনেকেই আজ শহীদ বুদ্ধিজীবি। প্রশ্ন হল পাকিস্তান পন্থী এইসব বিশিষ্ট ব্যক্তিকে পাকিস্তান কেন হত্যা করবে? এ প্রশ্নের সমাধানের জন্য ১৪ তারিখে নিহত বুদ্ধিজীবিদের রাজনৈতিক দর্শন জানা জরুরী। আমার সামান্য অনুসন্ধানে যা পেয়েছি তা হল, নিহতদের অধিকাংশই চিনা পন্থী কমিউনিষ্ট।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর যাতে চিনা পন্থী কমিউনিষ্টরা এদেশে প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে সে জন্য আগে থেকেই সতর্কতা। RAW এক ঢিলে দুই পাখি মেরেছে অর্থাৎ চিনা পন্থী কমিউনিষ্টদের হত্যা করে মাওবাদী কম্যুনিজমের উত্থানকে রোধ করেছে, দ্বিতীয়ত: এর দায়ভার রাজাকার আলবদরদের উপর চাপিয়ে ইতিহাসে পরিষ্কার থেকেছে।
বি.দ্র.: লেখার কলেবর ছোট রাখতে তথ্য সুত্র উপস্থাপন করা হয়নি।।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন