বৃহস্পতিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৫

জাতীয়তা ও ধর্র্মনিরপেক্ষতা: এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় ও দ্বিজাতিতত্ত্ব

খুব গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক আলোচনায় না গিয়েও সহজভাবে বলা যায়, ধর্ম হচ্ছে, যা মানুষ ধারণ করে জীবনযাপন করে থাকে। আর তা কি শুধু ব্যক্তিজীবনেই সীমাবদ্ধ? না শুরু করে সামাজিক, রাষ্ট্র্রীয় ও আন্তর্জাতিক জীবন পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত?
যখন ১৯৮৬-৮৭ সালে আমি পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় মিশরের আল-আযহারে ছিলাম, তখনকার আমার একজন শ্রদ্ধেয় উস্তাদ ড. আবদুল ওদূদ শালাবীর একটি খেদোক্তি মনে পড়ে গেল। তিনি ছিলেন কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মতত্ত্বে ডক্টরেট করা একজন পণ্ডিত এবং সে দেশের একজন খ্যাতিমান লেখক! তিনি একদিন আমাদের কা্লসে দুঃখ করে বলেছিলেন, প্রাচ্যবিদরা কিন্তু প্রাচ্যের বা মধ্যপ্রাচ্যের কেউ নয়, অথচ ওরাই ঠিকানানির্দেশ করে বলে দেয়, কতটুকু প্রাচ্য আর কতটুকু মধ্যপ্রাচ্য! আর আমরাও চোখ কান বুঁজে তা মেনে নেই!” আজ আমরা পরম বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছি যে, ধর্ম বা ধর্মশিক্ষার সাথে যাদের  সামান্যতম সম্পর্ক নেই, তারাই ধর্ম ও ধর্র্মনিরপেক্ষতার সীমানানির্দেশ করে চলেছেন! এমন কি উঁচু পর্যায়ের দায়িত্বশীল পদে বসেও দিব্যি এ অনধিকার চর্চা করা হচ্ছে! ঐ মহাপন্ডিত ব্যক্তিগণকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, আপনাদের পড়াশোনা কি কুরআন-হাদীস এবং দ্বীন ও শরীয়ত সম্পর্কে? না যে বিষয়ে দায়িত্বপালন করছেন সে সম্পর্কে? তাহলে জনগণকে চোখ কান বুঁজে রেখে আপনাদের এসব অত্যাচার সহ্য করে যেতে হবে কেন?
সমপ্রতি এলাহাবাদ হাই কোর্টের হিন্দু বিচারপতিগণ এ ধরনের একটি অনধিকার চর্চাই করেছেন। এঁদের কেউই তো হিন্দু মন্দির বা টোলের অথবা কওমী বা সরকারী কোনো মাদ্রাসার ডিগ্রীপ্রাপ্ত কেউ নন! এঁদের সকলেই রোমান ল’, ব্রিটিশ ল’ পড়া লোক! যেসব সাধারণ লোক শুধু একটা লম্বা জোব্বা বা দীর্ঘ দাড়ির সুবাদে অনেক সময় ইমামতির দায়িত্ব বা ইসলামী শিক্ষায় ঠিক ঐ পর্যায়েরই যোগ্যতা নিয়ে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পেয়ে যান তাঁদের মধ্যে তো সেটুকুও নেই! আলেকজাণ্ডারের ভাষায় বলতে হয়, ‘কী বিচিত্র এই দেশ সেলুকাস!’

অবিভক্ত ভারতবর্ষের-মুসলিম সমাজের একচ্ছত্র নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ-যাঁকে তাঁর প্রতিপক্ষ হিন্দু নেতা মহাত্মা গান্ধীই “কায়েদে আযম” খেতাব দিয়ছিলেন আর ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সরোজিনী নাইডু একদিন যাঁকে “হিন্দু মুসলিম মিলনের অগ্রদূত” খেতাব দিয়েছিলেন তিনিও মূলতঃ একজন জাঁদরেল আইনজীবি ও ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের লোক ছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়েও যখন তিনি হিন্দু নেতাদের উগ্র সামপ্রদায়িক হিন্দুত্ব থেকে মুক্ত করে মুসলমানদের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকারের বিষয়ে একটুও নমনীয় করতে পারলেন না,পণ্ডিত মতিলাল নেহরু ১৯২৮ সালে মুসলমানদের ন্যায্য রাজনৈতিক অধিকার তথা জাতীয়  অস্তিত্বকে অস্বীকার করে কুখ্যাত “নেহরু রিপোর্ট” ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জাতীয় প্লাটফর্ম থেকে ঘোষণা করে বসলেন, কেবল তখনই তিনি “হায় গোলাম হোসায়ন, উপায় নেই’ বলে ভারতবর্ষকে খণ্ডিত করে ভারতবর্ষের মুসলমানদের স্বতন্ত্র অসি-ত্ব রক্ষার স্বার্থে পাকিস্তান রাষ্ট্র  গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মতলববাজ হিন্দু নেতারা সবকিছু বুঝেই কিছুই না বোঝার ভান করে একে জিন্নাহর ধর্মান্ধতা, ভারত-মাতার অঙ্গচ্ছেদ,‘বঙ্গমাতার’ গলায় ছুরি চালানো ইত্যাদি নামে অভিহিত করতে থাকেন। পাকিস্তানের পাঞ্জাবী ব্যুরোক্র্যাসী, সুন্নীবিদ্বেষী উগ্র শিয়া ও কাদিয়ানী মিলিটারী নেতৃত্ব ও তথাকথিত গণতন্ত্রপন্থী ও সমাজতন্ত্রবাদী  নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাঙ্গালীবিরোধী যোগসাজসের মোকাবেলায় যখন বাঙ্গালী মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্যে বহু বাঙ্গালী-বিহারী মুসলমানের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এবং সর্বভারতীয় হিন্দুনেতৃত্ব কর্তৃক অফিসিয়েলী স্বীকৃত এই ভূখ  তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে বাধ্য হল,অমনি আকাশবাণী থেকে প্রচার প্রোপাগান্ডা শুরু হয়ে গেল যে, জিন্নাহর দ্বি-জাতি তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে! আমরা বাঙ্গালী মুসলমানরাই শত ভয়ভীতি ও প্রতিকূলতাকে ডিঙ্গিয়ে যে দ্বি-জাতি তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলাম শেরে বাংলা-নাযিমুদ্দীন্তসোহরাওয়ার্দী-ভাসানী-মাওলানা আকরম খাঁ-আতহার আলী-আবুল হাশিম প্রমুখ বাঙ্গালী মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় নেতাদের নেতৃত্বে, সেই আমাদের মুখ দিয়েই এমন মিথ্যা একটা কথা হাজারবার উচ্চারণ করিয়ে নেয়া হল! একটা জাতি কতটুকু আত্মবিস্মৃত ও আত্মস্বার্থ বিস্মৃত হলে এমনটি হতে পারে, তা কল্পনা করতেও কষ্ট হয়। আমরা যারা জীবনের বিগত সত্তুর বছরের  রাষ্ট্রীয় ভাঙ্গাগড়ার ইতিহাস স্বচক্ষে দেখেছি, আমাদের কেউই এ মর্মবেদনা থেকে মুক্ত থাকতে পারি না। আমরা দেখেছি, কোনদিন যাদের জন্মভূমি বিহার, মধ্যপ্রদেশ, যুক্তপ্রদেশ, আসাম, উড়িষ্যা প্রভৃতি হিন্দুপ্রধান এলাকার পাকিস্তানভুক্ত হওয়ার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না সে সব এলাকার মুসলমানরাও তাদের বাড়িঘর জমিজিরাত এমনকি নিজেদের প্রাণও উগ্র হিন্দুদের হাতে হারাবার ঝুঁকি নিয়ে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান দিয়ে পাকিস্তান সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন! মুসলিমপ্রধান এলাকাসমূহের  হিন্দুরাও এ আন্দোলন ও সংগ্রামকে ঠেকাতে গিয়ে সেদিন অকাতরে প্রাণ দেয়া-নেয়ার খেলায় মেতে উঠে দ্বি-জাতি তত্ত্বের    বাস্তবতা ও সত্যতা প্রমাণে পিছিয়ে ছিলেন না। ১৯৪৬ সালের কোলকাতার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় দশ লাখ আদমসন্তানের নির্মম হত্যাযজ্ঞ ছিল বিশ্ববাসীর সম্মুখে এর জীবন্ত সাক্ষী। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গে (যা একান্তই প্রশাসনিক স্বার্থে বৃটিশ সরকার করেছিল আর ঘটনাচক্রে তাতে আজকের  বাংলাদেশীদের তথা মুসলমানদের ফায়দা নিহিত ছিল) যে হিন্দু নেতৃত্ব গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে চীৎকার জুড়ে দিয়েছিল যে “বঙ্গমাতাকে” নির্দয়ভাবে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়া হল, সেই তারাই ১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের সময় নির্লজ্জের মত দাবী তুললো যে, তাদের সেই তথাকথিত “বঙ্গমাতাকে” দ্বিখণ্ডিত করে যেন যেকোনো মূল্যে দয়া করে  একটা কিম্ভুৎকিমাকার হিন্দু পশ্চিমবঙ্গ গড়ে দেওয়া হয়! কেবল বাঙ্গালী হিন্দুরাই নয়, মাড়োয়ারী হিন্দু নেতা মোহন চাঁদ, করম চাঁদ গান্ধী থেকে শুরু করে কাশ্মীরী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু ও আসামের মুখ্যমন্ত্রী বড়দলই পর্যন্ত সকলেই সমস্বরে সে আওয়াজ তুলেছিলেন। অথচ ঐ অবাঙ্গালীদের তো এ নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনোই কারণ ছিল না! আমাদের তদানীন্তন পূর্ববাংলার সন্তান হয়েও ময়মনসিংহের ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজা, অন্নদাশঙ্কর রায়, নাটোরের মহারাজা, ঢাকার বিধান রায়-জ্যোতিবসু (দু’জনই পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী)-এর  বিরোধিতা তো বোধগম্যই ছিল। অর্থাৎ তারা জেনে শুনে স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে এখানকার সর্বসত্ত্ব ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের নেতৃত্ব-কর্তৃত্ব নিজেদের হাতে তুলে নিয়েছেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা যে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র কায়েম করেছেন তার ফল এই দাঁড়িয়েছে যে, সেখানকার শতকরা ২৭%জন মুসলিম নাগরিকের মধ্যে শুধু ২% এর ভাগ্যে সরকারী চাকুরী জুটে থাকে-তাও যে আবার তলানী গোছের চাকুরী সে তো বলাই বাহুল্য। তাই পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানরা ব্রিটিশ আমলের পরাধীনতা-পশ্চাৎবর্তিতা থেকে একটুও এগিয়ে আসতে পারেনি। ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র তাদের জন্যে অর্থহীন বুলি ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষান্তরে আমাদের এ পূর্ববাংলা যেহেতু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে তাই এখানে আর ইসলামের নাম নেয়া যাবে না!
ঐতিহাসিক বাস্তবতার নিরিখে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে শামিল হয়েছিল নিজেদের ভাগ্যোন্নয়নের স্বপ্ন নিয়ে (যে ভাগ্য নিয়ে প্রায় দু’শ বছর প্রতিবেশী সমাজের লোকেরা তাদের নতুন মনিব ইংরেজদেরকে হাতে নিয়ে নির্দয়ভাবে খেলেছে) পাঞ্জাবী ব্যুরোক্র্যাসী, কাদিয়ানী ও সুন্নীবিদ্বেষী উগ্র শিয়া মিলিটারী নেতাদের অপরাধে-যার সাথে সেখানকার সাধারণ নাগরিক বা ইসলামী আদর্শের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না মুসলিম-বাংলার খাস সত্ব এ দেশ ছেড়ে যাওয়া সেই সব বাবুদের বা তাদের আত্মীয়স্বজন ও ভাই বেরাদরদের মধ্যে ভাগবন্টন করে দিতে হবে যারা পশ্চিমবঙ্গের ৯৮% সুযোগ সুবিধা হাতিয়ে নিয়ে সেখানকার বাংগালী মুসলমানসমাজকে বঞ্চিত করে রেখেছেন! এর অর্থ কী দাঁড়াল? এর সোজাসাপটা মানে হচ্ছে, গাছের ওপরের ও তলার সবকিছুই উনাদের পদপ্রান্তে অর্ঘস্বরূপ বিলিয়ে দিয়ে উভয় বাংলার মুসলমানরা বসে বসে আঙ্গুল চুষুন! এর খাসা যুক্তি তো আছেই, হিন্দুভারত মুক্তিযুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করেছে। হ্যাঁ, সাহায্য তো করেছেই। আমি নিজে এবং আমার অনুজ স্বাধীনবাংলা বেতারের শব্দসৈনিক মাওলানা জালালাবাদীসহ মেঘালয়ের রাজধানী শিলং পর্যন্ত গিয়ে ওদের মেহমানদারী ভোগ করেছি। অবশ্য যে দিন স্পষ্ট প্রমাণ পেয়েছি যে, ওরা মেহমানদারীর ছলে আসলে নজরদারী করছে-যেমনটি মওলানা ভাসানীও দেশে ফিরে বলেছিলেন, সেদিনই ভারতীয় গোয়েন্দা অফিসারদেরকে বলেছিলাম, দয়া করে আমাকে আমার দেশের সীমানে- পৌছিয়ে দিন! মরতে হয় ওদের গুলিতেই মরবো,তবুও অবিশ্বাসের এ পরিবেশে থেকে স্বাধীনভাবে জুমার নামায পড়ার সুযোগটা ছাড়তে চাই না। আর ভারতের সাহায্য-সংক্রান্ত মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম, এ জি ওসমানীর মূল্যায়নটাও রেকর্ডে রাখার উদ্দেশ্যে বলছি, স্বাধীনতার অব্যবহিত  পরে সিলেট রেজিষ্টারী মাঠের সর্বপ্রথম বক্তৃতায়ই তিনি বলেছিলেন,“ভারত সাহায্য না করলে বড়জোর আমাদেরকে আরো ছ’টি মাস বেশী লড়তে হতো।” সেদিন ঐ সভায় উপসি’ত থেকে আমি নিজ কানে তাঁর সে বক্তব্যটুকু শুনেছিলাম। সুতরাং তাদের ঐটুকু দানের বিনিময়ে আমরা আমাদের জাতীয় পরিচয়টুকুও ভুলে যাবো, তা তো হতে পারে না!
এ কথাও ভুললে চলবে না যে, আমাদের সে দিনের বন্ধুরা আমাদের গায়ের ঘাম শুকাবার আগেই তাদের সাহায্যের শতগুণ বেশি সম্পদ আমাদের রসুইঘর পর্যন্ত খালি করে নিয়ে গেছেন। তারা শুধু আট হাজার কোটি টাকার মূল্যবান অস্ত্রশস্ত্রই নয়, কলকারখানা, রেলের ওয়াগন, মোটরকার, জীপ যা ই হাতের কাছে পেয়েছেন উজাড় করে নিয়ে গেছেন! তার পরপরই আবার সেই পূর্ববৈরিতায় ফিরে গেছেন। স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর সাথে চুক্তি করেও চুক্তিমতে আমাদের প্রাপ্য আমাদেরকে না দিয়েই প্রতিরক্ষা সামরিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিশাল বেরুবাড়ি এলাকায় নিজেদের দখলদারী প্রতিষ্ঠা,ফারাক্কা বাঁধ, তিনবিঘা করিডোর, তালপট্টি দ্বীপ দখল, প্রতিদিন সীমানে- বাংলাদেশী নাগরিকদেরকে গুলি করে হত্যা এসবই হচ্ছে তাদের বৈরিতার জাজ্জ্বল্যমান প্রমাণ। এমন কি বঙ্গবন্ধু হত্যারোধের ব্যাপারেও তারা কোনো অবদানই রাখেনি। কথায় কথা আসে। এই গত সপ্তাহেই হত্যাকারী সংস্থা বিএসএফ-এর প্রধান আমাদের ঢাকায় দাঁড়িয়েই সীমানে- তাদের মানুষ হত্যার সাফাই দিতে গিয়ে বললেন, “ওরা সব ক্রিমিন্যাল! ভারতীয় বাংলাদেশী উভয়দেশীয় ক্রিমিন্যালই আছে।’’ বলিহারি, চোরাচালানীদের শাস্তি কি ভারতীয় কোডে বিনা বিচারে অন দি স্পট মৃত্যু  নাকি? তা না হলে ঐরূপ বক্তব্য কী করে মেনে নেয়া যায়? আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে, ঐ প্রশ্নটি করার মতো আমাদের কোনো চৌকস সাংবাদিক সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। ওয়াকিফহাল মহল জানেন, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, চব্বিশ পরগণা, বশীরহাট সীমান্তের ভারতীয় নাগরিকরাও হলেন গো-মাংসভোজী মুসলমান্তযাদের জন্যে চোরাচালান ছাড়া তেমন কোন অর্থকরী কাজের পথ দাদারা খোলা রাখেননি। সুতরাং ওদের শাস্তি তো মৃত্যুদ ই হবে! ফারাক্কা বাঁধের অভিশাপে প্রমত্ত হয়ে ওঠা গঙ্গানদীর ভাঙ্গনে যে অসহায় লোকদের বাড়িঘর জমিজিরাত বিলীন হয়ে যায়,তাদের সিংহভাগও এ হতভাগারাই। তাই এর প্রতিবাদ করেও তারা কোনোই ফল পাচ্ছে না।
মুসলিম নাগরিকদের প্রতি এরূপ বৈরী ও  বিমাতাসুলভ  মনোভাব যে শুধু পুলিশ-মিলিটারীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, ভারতীয় উচ্চ আদালত পর্যন্ত এ মহাব্যাধিতে আক্রান্ত বিগত ৩০ অক্টোবরের বাবরী মসজিদ-রামজন্মভূমি বিরোধ সংক্রান্ত  রায়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট সে প্রমাণই বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরেছে। তা থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, ওদের বিচারপতিদের দৃষ্টিভঙ্গিও এর চাইতে ভিন্ন্‌ কিছু নয় । তাই তো চার শতাধিক বছরের পুরনো ঐতিহাসিক  পবিত্র মসজিদে রাতের আঁধারে রামমূর্তি স্থাপন করা হল, এরপর গোটা বিশ্বের টিভিদর্শকদের  সম্মুখে হৈ হৈ রৈ রৈ করে মসজিদটি ধ্বংস  করা হল, দুই সহস্রাধিক মুসলমানকে হত্যা করা হল। এত কিছুর পর উগ্রবাদ হিন্দু মাস্তানরা কিছুই অপরাধ করেনি; বরং মসজিদটির মূল গম্বুজের ঠিক নিচের স্থানটুকুতেই রামজন্মভূমিরূপে তাদের দখল স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে! ঐ রায়টি যারা দিয়েছেন তারা কোন নিম্ন আদালতের  তরুণ ম্যাজিষ্ট্যাট নন, হাইকোর্টের বয়োঃবৃদ্ধ বিচারপতি! পরে অবশ্য তাদের একজন মন্ত্রী মুখরক্ষার জন্যে বলেছেন,‘না না, ঐ মসজিদ ভাঙ্গার মামলা কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি।’ জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, দীর্ঘ আঠারো বছরেও যা শেষ হলো না ইহজন্মে তা শেষ হবে এমন কোন ভরসা আছে কি? নাকি গোটা প্রজন্মটি বিনা বিচারেই পার পেয়ে যাক সে অপেক্ষাই করা হচ্ছে? এই একবিংশ শতকেও মানুষকে এত বোকা ভাববার কি কোন যুক্তি আছে?
দলীল প্রমাণের পরিবর্তে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের তথাকথিত ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের’ ভিত্তিতে রায় দিয়ে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বিচারকরা মুসলমানদের উপর অবিচার করেছেন এটা স্বয়ং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মোলায়েম সিং যাদবেরই অভিযোগ। পৃথিবীর তাবৎ আইনে বিশ্বাসী লোক একথাই বলবেন। কিন্তু যে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত একান্তই পৌত্তলিক হিন্দুদের ‘বন্দে মাতরম’(মা, তোমার বন্দনা করি’)সে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র ধ্বজাধারী বিচারপতিরা যদি তাদের সংখ্যাগুরু হিন্দুজাতির ‘ধর্মীয় বিশ্বাসের’ দোহাই দিয়ে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠির-যাদের সংখ্যা ২৬ কোটি এবং সে দেশের মোট জনসংখ্যার ২৩%-ধর্মীয় অধিকার ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলিকে উড়িয়ে দেয়া ন্যায়সঙ্গত ও গণতন্ত্রসম্মত বলে রায় দিয়ে দেন তা’হলে কার কী বলার থাকতে পারে? হ্যাঁ, এটাই পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে কথিত ভারতের আদি ও অকৃত্রিম রূপ। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর অপরাধটা ছিল এই যে, তিনি আজ থেকে ৬৪ বছর পূর্বেই তাঁর তীক্ষ্ণ দূরদৃষ্টি দিয়ে মুখে রাম রাম আর বগলে ছুরিধারী গান্ধী-নেহরুদের গণতন্ত্রের নামে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার দুরভিসন্ধির কথাটা সঠিকভাবে আঁচ করতে পেরেছিলেন।
এবার আমাদের এ দেশের কোনো কোনো বিচারপতির ধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণার কথায় আসা যাক। পাঠকের অবশ্যই স্মরণ থাকবে, কয়েক বছর আগে আমাদেরই হাইকোর্টের এক মুসলিম বিচারপতি তার সুয়েমেটো রায়ে ‘ফতোয়া’কে অবৈধ ঘোষণা করেছিলেন। এবার নতুন রায় এসেছে, বাংলাদেশ ভূখন্ডে কোনো মহিলাকে বোরখা পরতে বাধ্য করা যাবে না! এ সবই কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়েই বলা হচ্ছে! এখন আমাদের জিজ্ঞাস্য, ‘ফতোয়া’ না থাকলে ধর্মীয় আইন ও মূল্যবোধের ব্যাখ্যা দেবেন কোন্‌ বৈধ কর্তৃপক্ষ? রায়টা কিন্তু একান্তই এদেশের সংখ্যাগুরু ৮৭% মুসলমানের উপরই প্রযোজ্য! কেননা সংখ্যালঘু নাগরিকদের অভিধানে এ শব্দটি নেই। তাহলে যে দেশকে পৃথিবীর সর্বাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমানের দেশ বলে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু আর এগুলোকে পুঁজি করে মুসলমানদের ঈমানী চেতনা ও আদর্শের বিরুদ্ধে যে বহু কুচক্রি মহর মেতে উঠেছে তাদেরই বা প্রতিরোধ করারকত উপায় কি? বুক ফুলিয়ে গর্ব করতেন, তাঁর সে সোনার বাংলায়ই ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ চিরতরে বাতিল হয়ে গেল? ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের পবিত্র মাতৃভূমিতে দাঁড়িয়ে এজাতীয় অর্বাচীন ও কা জ্ঞানহীন বক্তব্যদানের সাহস তারা কোত্থেকে পায়? আওয়ামী লীগের শাসনামলেই যখন  এরূপ বক্তব্য আমাদের উচ্চ আদালত থেকে বেশি বেশি উচ্চারিত হয় তখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের লোকদের, বিশেষত তাদের ‘আওয়ামী উলামাদের’ ও তাদের মনোনীত ‘জাতীয় খতীবের’ পজিশনটা কী দাঁড়ায়? রায়ের বাজার বধ্যভূমির বুদ্ধিজীবি হত্যাযজ্ঞের অন্যতম শিকার বঙ্গবন্ধুর অন্যতম সহযোগী ‘আওয়ামী উলামা পার্টির’ প্রধান শহীদ মওলানা অলিউর রহমানের আত্মার কাছেই বা আমাদের কী কৈফিয়ত?
জিজ্ঞেস করি, বোরকা পরা কাদের জন্যে? অমুসলিম মহিলাদেরকে কি জোর করে বোরকা পরানো হচ্ছে? নাকি মুসলিম তরুণীদেরকে তাদের ধর্মীয় বিধানমতে বোরকা বা একটা বড় ওড়না পরে শালীনতা রক্ষা করে চলতে বলা হচ্ছে? আর কেবল মুসলিম তরুণীদের বেলায়ই বা এটা প্রযোজ্য হবে না কেন? ওদেরকে কি আমরা উচ্ছৃঙ্খলদের হাতে অসহায় শিকাররূপে ছেড়ে দিতে বা উচ্ছৃঙ্খলদেরকে আরো উচ্ছৃঙ্খল করে তোলার সুযোগ করে দিতে ছেড়ে দেবো? উর্দূ কবি হাফিয জলন্ধরীর ভাষায়:
জোয়ান আওরত জব খুলি ছর ছরে-বাজার চলতি হ্যায়
রগে সব্‌র ও শকীবা পর এক তলোয়ার চলতি হ্যায়
অর্থাৎ-তন্বী নারী খোলা মাথায় যখন চলে বাজার দিয়ে
ধৈর্যশিরার উপরে যেন আঘাত হানে তলোয়ার দিয়ে!
যুবকদেরকে বিশেষত অপরিণামদর্শী কোমলমতি কিশোর তরুণদেরকে ধর্ম-নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে এরূপ উন্মাদনার পথে ঠেলে দেয়ার  ফ্রি লাইসেন্স তো কাউকেই দেয়া যেতে পারে না! যুবক যুবতীদের চরিত্র ও শালীনতা রক্ষার দায়িত্ব কেবল শিক্ষকদেরই নয়,তাদের অভিভাবকদেরও বটে। এ পবিত্র দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্র ও আদালত তাদেরকে উৎসাহিত করবে, নাকি ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে তাদেরকে নিরুৎসাহিত করবে? কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাচ্ছি? নাটোর কলেজের দীর্ঘ শ্বশ্রূধারী বয়োবৃদ্ধ যে অধ্যক্ষকে আদালতে ডেকে এনে হেনস্থা করা হলো,তার কি আদৌ কোন দুরভিসন্ধিমূলক অপরাধ ছিল-যা অগ্রাহ্য করে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগকে খারিজ করে দেয়া যেতোনা? টেলিভিশনের পর্দায় দেশবাসী দেখেছেন, তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে এটাকে তাঁর বিরুদ্ধে একটা পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বলে জানিয়েছেন।
এবার আমাদের জিজ্ঞাস্য, বাংলাদেশের তরুণীদেরকে শালীনতাপূর্ণ নিরাপদ ও সম্ভ্রম রক্ষার সহায়ক পোষাক পরে কলেজে আসতে বললে এটা কি ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী হয়? ইসলামে কি পর্দার সুস্পষ্ট ও অলঙ্ঘনীয় বিধান নেই?  যদি তা থেকেই থাকে আর  ইসলাম সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞানের অধিকারীদেরও জানা আছে যে, ইসলামে অবশ্যই পর্দার বিধান রয়েছে; তাহলে শিক্ষক বা অভিভাবক স্থানীয়রা তাদের ছাত্রী বা মেয়েদেরকে সে নির্দেশ দিলে তা’ ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী হয় কী করে? বরং ধর্মত জরুরী এ বিধান পালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিই হবে ধর্মনিরপেক্ষতার বিরোধী-ধর্মবিরোধী। আর কেবল মুসলমানদের কথাই বা বলি কেন? হিন্দুসমাজে কি সেই প্রাচীন কাল থেকেই ওড়না মাথায় দেয়ার বিধানটি চলে আসছে না? বাঙলা ভাষায় সুপ্রচলিত ‘অ-সূর্যস্পর্শা’ সতী নারীদের নিয়ে গর্ব করার ব্যাপারটি কি সেই প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে না? এখন ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে তাদেরকে গুণ্ডাপাণ্ডাদের সহজ শিকারে পরিণত করাটাই কি খুব জরুরী হয়ে পড়লো? এরূপ ক্ষেত্রে আল-কুরআনের
لا اكراه في الدين
আয়াতাংশ উদ্ধৃত করে যারা ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে থাকেন তারা আসলে এ আয়াতের মর্ম বা স্পিরিট না বুঝেই এমনটি বলে থাকেন।  আসলে এর অর্থ হচ্ছে কাউকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা যাবে না। কেউ ইসলাম গ্রহণ করবে কি করবে না, এটা একান্তই তার নিজের ইচ্ছা, এব্যাপারে বলপ্রয়োগ করা যাবে না। অন্য আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে-
افانت تكره الناس حتى يكونوا مؤمنين
অর্থাৎ তারা ঈমান না আনা পর্যন্ত কি তুমি তাদের উপর জোর জবরদস্তি চালিয়ে যাবে (হে রাসূল)? (১০:৯৯) একজন আনসারী সাহাবীর দুজন সন্তান  পূর্ব থেকে বিধর্মী ইয়াহূদী পরিবেশে পালিত হয়ে স্বভাবতই ইয়াহূদীরূপে বেড়ে উঠছিলেন। তিনি যখন রাসূ্‌লুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও সাল্লামকে জিজ্ঞেস করেন, ইয়া রাসূ্‌লুল্লাহ! আমি কি জোর করে তাদেরকে ইসলামে দীক্ষিত করবো, তখন ঐ প্রেক্ষাপটে এ আয়াতখানা নাযিল হয়েছিল। কিন্তু কেউ যখন স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে ইসলামগ্রহণ করে ফেলে তখন তার জন্যে ইসলামের তাবৎ ফরয-ওয়াজিব মেনে চলতে হবে। (থানবী,বয়ানুল কুরআন)
এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে এরূপ যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা সামাজিক সংগঠনের আপনি সদস্য হবেন কি হবেন না, তা একান্তই আপনার ইচ্ছা,কিন্তু তাতে ভর্তি হওয়ার পর বলবেন, নিয়ম নীতি মানা না মানা আমার ইচ্ছা , আপনি তাতে জোর জবরদস্তি করার কে, তা তো হতে       পারে না!
তাহলে বোঝা গেল, জোরজবরদস্তি  করে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা যাবে না-এটা ইসলামেরই শিক্ষা, আলকুরআনের শিক্ষা। কিন্তু কেউ স্বেচ্ছায় ইসলাম  গ্রহণ করে মুসলিম বলে নিজের পরিচয় দিবে, আর নামায-রোযা, পর্দাপুশিদার প্রভৃতি ফরয-ওয়াজিবের কথা বললেই বলবে, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করবেন না, এটা চলবে না। আসলে এরূপ ব্যক্তিকে নিয়ম মেনে চলতে বলাটাই আইন ও যুক্তির দাবী। এটাকে কোনোভাবেই টালবাহানা করে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। যারা ধর্মনিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব কিছুকেই ধর্মের আওতামুক্ত করে ধর্মকে মসজিদে মন্দিরে বা গীর্জার চৌহদ্দির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দিতে চান তারা তো আসলে ধর্মনিরপেক্ষ নন, ধর্ম বর্জনের বাহানা অনুসন্ধানকারী। ইসলাম যেহেতু একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানের ধারক তাই তাকে কোনো নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ করা যাবে না এবং জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ ও রাসূলের বিধান মেনে চলতে হবে। যেমন নাকি কুরআন মজীদে বলা হয়েছে, কোনো মুসলিম নরনারীর জন্যে এ সুযোগ নেই যে, আল্লাহ ও  রাসূলের পক্ষ থেকে নির্দেশ আসার পর বলবে, তা মানা না মানা আমার ইচ্ছা।
কারো এরূপ অধিকার মেনে নিলে কুরআন মজীদের শত শত আয়াত, হাজার হাজার হাদীস এবং গোটা ফিকহশাস্ত্র অচল ও পরিত্যক্ত হয়ে যাবে। এটা কি ধর্মনিরপেক্ষতা, না ধর্মের প্রতি বৈরিতা হবে? হিন্দু ধর্মের রামায়ণ মহাভারত বা বেদের ঐ সমস্ত বাণীরই বা কি অর্থ হবে, যা অর্জূন যুদ্ধক্ষেত্রে উপদেশস্বরূপ তার অনুসারীদের জন্য উচ্চারণ করেছিলেন? তৌরাতে মুসা আ. ও অন্যান্য নবীগণের যুদ্ধ বিগ্রহের যে সমস্ত বর্ণনা রয়েছে সেগুলিরই বা কি ব্যাখ্যা হবে? সেগুলো কি ব্যক্তিগত পর্যায়ের কথা ছিল? কুরূপা বের যুদ্ধে নাকি আমাদের এ বাংলাদেশের সিলেটের জৈন্তা রাজ্যের রাণীও সশরীরে অংশগ্রণ করতে গিয়েছিলেন! ওগুলো হিন্দু ধর্মের পুস-কের বর্ণনামতে ধর্মযুদ্ধই ছিল। তাহলে ধর্ম ব্যক্তিজীবনের ছোট্ট পরিসরে সীমাবদ্ধ এ ধারণার স্বীকৃতি সে ধর্মেই বা কোথায়?
পক্ষান্তরে ইসলামে রয়েছে পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। আল্লাহর সেরা ও সর্বশেষ রাসূল হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে রাষ্ট্র পরিচালনা করে আদর্শ রাজনীতি অর্থনীতির বিশদ রূপরেখা রেখে গেছেন। তাঁকে রাসূল বলে স্বীকার করে নিয়ে কালিমা পাঠের পর একজন মুসলিম ঐসব ক্ষেত্রে কী করে ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে? বিশেষত যেখানে দুই শত বছরের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনত-সংগ্রামের মূল লক্ষ্যই ছিল ইসলামের  সোনালী শাসন প্রতিষ্ঠা করে অত্যাচারিত মানব শ্রেণীকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে তাদের স্বাধীন সত্তা বিকাশের দ্বার উন্মোচন করা।
তাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের লোক হয়েও মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ বলেছিলেন, আলকুরআনই হবে আমাদের স্বাধীন পাকিস্তানের শাসনসংবিধান। তাঁর পরবর্তী নালায়েক শাসকরা সে ওয়াদা পূর্ণ না করায় প্রদেশে প্রদেশে ও সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে বৈষম্য ও বৈরিতা বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাদেরকে তথা বাঙালী মুসলমানকে পুনরায় স্বাধীনতার পথ বেছে নিতে হয়। এটা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল না। বা এদেশের মুসলমানরা ধর্মকে বাতিল করে দেয়নি। বরং আজও গোটা পৃথিবী বাঙালী মুসলমানরাই সবচেয়ে ধর্মভীরু জাতি। পাকিস্তান ত্যাগ করা মাত্র আমরা ইসলামাবাদের সাথে সাথে ইসলামের থেকেও মুক্ত হয়ে কুফরকে (আলকুরআনের ভাষায় আলোর পরিবর্তে অন্ধকারকে) বেছে নিয়েছি  বা আলো-অন্ধকারকে সমান বলে মেনে নিয়েছি এরূপ অপব্যাখ্যা কেবল ইসলামের শত্রুরাই করতে পারে। আজকের সংখ্যাগুরুর সমর্থিত সরকার তাই ইসলামের তথা কুরআন্তহাদীসের বিরোধী কোনো আইন প্রণয়ন না করার অঙ্গীকারে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। এই ওয়াদা থেকে যেদিন জাতি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে সেদিন তার স্বতন্ত্র্য অস্তিত্বই অর্থহীন হয়ে যাবে। অর্থহীন হয়ে যাবে দুই শ বছরের স্বাধীনতা-সংগ্রামের শহীদদের রক্ত। অন্যদের ব্যর্থতার জন্যে আমরা আমাদের ধর্ম ও ঐতিহ্য থেকে হাত গুটিয়ে নিয়ে তথাকথিত বাংলাপ্রেমিক বাবুদের মতো কপট মুনাফিক হতে যাব-এটা আমরা কোনো দিন কল্পনাও করতে পারি না। এ জাতিয় ভদ্রবেশী ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের সাথে জাতির নাড়ি-নক্ষত্রের কোনোই সম্পর্ক নেই। এরা হয় মূর্খ, না হয় ইসলামের শত্রুদের পোষা এজেন্ট।  এদের দুরভিসন্ধি সম্পর্কে সকলকে সাবধান থাকতে হবে। আল্লামা ইকবালের ভাষায়-
কওম মাযহাব সে হেঁ, যব মাযহাব নেহী তো তুম ভি নেহী।
জযমে বাহাম নেহীঁ তো মাহফিলে আনজুম ভি নেহীঁ।
অর্থাৎ ধর্ম থেকে সৃষ্টি জাতির, ধর্ম নেই তো জাতিও নেই।
পরস্পরের টান না রইলে তারকাদের মাহফিলও নেই।
স্বাধীনতার মাধ্যমে পাকিস্তান ভাগ হয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুটি রাষ্ট্র হয়েছে। একান্তবর্তী একটি পরিবার ভিন্ন হয়ে দুটি পরিবার হয়ে গিয়েছি। ঐ একান্নবর্তী পরিবার কিন্তু প্রধানত আমাদের বাংলাদেশের মুসলমানদের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল। কারণ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পশ্চিম পাকিস্তানের তথা আজকের পাকিস্তানের অধিবাসীদের অবদান তেমন বেশি কিছু ছিল না। এখন ভিন্ন হয়ে গেছি বলেই আমাদের পৈতৃক উত্তরাধিকার চিরদিনের জন্যে এবং সর্বোতভাবে অন্য ভাইকে দিয়ে দিয়েছি এরূপ কথা যারা বলে বা বোঝায় তারা আসলে আমাদের পৈর্তৃক পরিচয়, গোত্রপরিচয় ও ঐতিহ্য থেকে আমাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে একটি নাম-গোত্র পরিচয়হীন জাতিতে পরিণত করার হীন স্বপ্নে বিভোর। তাদের স্বপ্ন হচ্ছে আমাদেরকে জাহিলিয়াতের সেই অন্ধকার যুগে ফিরিয়ে নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের মধ্যে একটি হীনম্মন্যতাবোধ ও শূন্যতাবোধ সৃষ্টি করা। আমাদের হাজার বছর পূর্বের মুর্তিপুজক ঠাকুর দা’দের সাথে আমাদের কোষ্ঠি মিলিয়ে দেওয়া। তাহলে তো এত কাঠখড় পুড়িয়ে, এত ত্যাগ স্বীকার করে আমাদের একটি ভিন্ন জাতিসত্তা গড়ে তোলার আদৌ কোনো প্রয়োজন ছিল না। রবি ঠাকুরের ‘মহাভারতের মহামানব সাগরতীরে’ আমরা পিপিলিকাবৎ প্রাণীরূপে অবস্থান করে শকহূনদলের মতো চিরদিনের মতো বিলীন হয়ে যেতাম। সেটা আমাদের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন পূর্বপুরুষগণ চাননি বলেই অনেক রক্তের বিনিময়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম মুসলিমরাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। তারা আমাদেরকে দুইশ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামে ৩০ কোটি মুসলিম মুজাহিদের রক্তের গৌরবোজ্জল উত্তরাধিকার ভুলিয়ে দিতে চায়। তারা বলতে চায়, জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্ব ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। ওরা তো প্রতিহিংসাবশে সানন্দে এরূপ উক্তি করে এই ভেবে যে, ভারতীয় মুসলমানদের দুইশ বছরের ত্যাগের ফসল শেষ পর্যন্ত আবার তাদের ঘরেই গিয়ে উঠেছে। কিন্তু ছাগলের তৃতীয় বাচ্চারূপে আমাদের এখানকার যে বুদ্ধিজীবীরা ঐ শ্লোগান দেন তারা কী পেয়ে এমন করেন? ওদের মতে দ্বিজাতি তত্ত্ব ব্যর্থ হয়ে গেছে। কিন্তু এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতিরা আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন যে, দুধ দুধই আর পানি পানিই। তেলে পানিতে কোনো দিন মিশ খায় না। তাই ভারতের ২৬ কোটি মুসলমানকে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করেছে। তিনজন বিচারপতির মধ্যে হিন্দু দুইজন হিন্দু জনতার আস্থা বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে চারশ  বছরের পুরনো ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদকে রামজন্মভূমি বলে রায় দিয়েছেন। আর একমাত্র মুসলিম বিচারপতি তার নোটে বলেছেন, ওটা যে রামজন্মভূমি বা কোনো দিন রামমন্দির ছিল তার কোনো প্রমাণই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ এলাহাবাদ হাইকোর্টের ওই রায়টি আবারো খণ্ডিত ভারতের ২৬ কোটি মুসলমানের আরেকটি স্বতন্ত্র্য আবাসভূমি নতুন একটি পাকিস্তান বা নতুন একটি বাংলাদেশ ভারতেরই মধ্যে গড়ে তোলার আন্দোলনের দিকেই পথনির্দেশ করছে। এ হিন্দুস্তান্তপাকিস্তান চেতনা কেবল হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, নব্বই কোটি ভারতীয় নাগরিককেই আবারো হয়তো নতুনভাবে বিভক্ত করবে। কেননা, হিন্দুমানস কোনোদিনই মুসলমানদেরকে নাগরিক-অধিকার দিতে রাজি নয়। সেটা যেমন জিন্নাহ-গান্ধীর আমলে সত্য ছিল তা-ই নয়, ৬৪ বছর পর আজও তা দিবালোকের ন্যায় সত্য। সুপ্রিম কোর্টে আপিলের রায় যদি আবারো সেই সংকীর্ণ হিন্দু-মানসিকতার পরিচয় দেয় তাহলে এটা হবে বর্তমান যুক্তভারতের কফিনের শেষ পেরেক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন