পর্দা যে ইসলামের একটি বিধান তা
মুসলিম-সমাজের সকলেই জানেন। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, দ্বীনদার-দ্বীনহীন সবারই জানা
আছে যে, বেগানা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা ইসলামে পাপ। সমাজের ব্যাপক পর্দাহীনতার
কারণে এই পাপের অনুভূতি ক্রমশ লোপ পেলেও মূল বিধানটি সবারই জানা আছে। এ ধরনের
বিধানকে, যার সাথে মুসলিম-সমাজের ছেলেবুড়ো সবাই পরিচিত, পরিভাষায় ‘জরুরিয়াতে
দ্বীন’ বলে। অর্থাৎ দ্বীন-ধর্মের সর্বজনবিদিত ও স্বতঃসিদ্ধ বিষয়।
জরুরিয়াতে দ্বীনের প্রসঙ্গটি অতি সংবেদনশীল। এটি ব্যক্তির ঈমান ও ইসলামের
মানদন্ড। ইসলাম তো আর কিছু নয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি বিশ্বাস ও
সমর্পণেরই পারিভাষিক নাম। তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের যে বিধান ও শিক্ষা দ্ব্যর্থহীন
ও সর্বজনবিদিত তা সমর্পিত চিত্তে মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো ব্যক্তি কীভাবে
মুমিন-মুসলমান থাকতে পারে?
মুসলিম হওয়ার মাণদন্ড জ্ঞান নয়, সমর্পণ। জ্ঞান তো কাফিরদেরও ছিল
এবং আছে। কুরআন মজীদে বলা হয়েছে-(তরজমা) ‘তারা নিশ্চিতভাবে জানার পরও অন্যায় ও
অহংকারবশত তা অস্বীকার করেছে।’ অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, (তরজমা)
তারা তাঁকে তেমন (নিশ্চিতভাবে) চেনে যেমন চেনে নিজেদের পুত্রদেরকে।
সুতরাং নিছক জ্ঞান মুসলিম হওয়ার পক্ষে যাথেষ্ট নয়; মুসলিম
সে-ই, যে আল্লাহর বিধানের সামনে সমর্পিত হয়। তো অন্য অনেক বিধানের মতো পর্দার
বিধানও যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান-এ সম্পর্কে কোনোরূপ অস্পষ্টতা নেই। পর্দার
সকল মাসআলা সবার জানা না-ও থাকতে পারে, কোনো কোনো মাসআলায় ইমামদের
মতভেদও থাকতে পারে,
কিন্তু মূল পর্দা-বিধান সম্পর্কে কোনোরূপ অস্পষ্টতা নেই এবং
এ বিষয়ে কারো কোনো মতভেদও নেই। এখন এটা এক ঈমানী পরীক্ষা যে, এই
বিধানের সামনে নিজেকে বিনীত ও সমর্পিত করতে পারছি কি না?
দুই. পর্দা একটি কুরআনী বিধান। কুরআন মজীদের অনেকগুলো আয়াত পর্দা সম্পর্কে
নাযিল হয়েছে। পর্দা ইসলামের ঐসকল বিধানের অন্যতম, যেগুলোর বিভিন্ন দিক
বিস্তারিতভাবে কুরআন মজীদে আছে। তেমনি হাদীস শরীফেও এর আরো দিক পরিষ্কারভাবে
বর্ণিত হয়েছে। তো পর্দার বিধান হচ্ছে ইসলামের একটি অটল ও অকাট্য বিধান।
তিন. পর্দার বিধান পরিষ্কারভাবে কুরআন-সুন্নাহয় ঘোষিত হওয়ার কারণে এ বিষয়ে
গোটা মুসলিম উম্মাহর ইজমাও রয়েছে। সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে
তাবেয়ীন যুগে মুসলিমসমাজের ব্যবহারিক জীবনেও তা ছিল প্রতিষ্ঠিত। বস্ত্তত পর্দার
বিধান হল কুরআনের ভাষায় ‘সাবীলুল মুমিনীন’, যা পরিত্যাগকারীকে জাহান্নামের
কঠিন হুঁশিয়ারি শোনানো হয়েছে।
সুতরাং মুমিনমাত্রেরই অপরিহার্য কর্তব্য, পর্দা বিধানের সামনে আত্মসমর্পণ
করা। নিজের ও অধীনস্তদের বাস্তব জীবনে তা প্রতিষ্ঠিত করা।
পর্দা-প্রসঙ্গে দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে, পূর্ণাঙ্গ ধারণা। পর্দা-বিধানের
প্রতি অনেক মুসলমানের মানসিক আনুগত্য থাকলেও পূর্ণাঙ্গ ধারণা নেই। বহু ভ্রান্ত ও
খন্ডিত ধারণা পর্দা সম্পর্কে দেখা যায়। পর্দা বিধানকে আমরা বলতে পারি, পর্দা-ব্যবস্থা।
এর অনেকগুলো দিক আছে,
অনেক নীতি ও বিধান আছে, যা মুসলমানের ব্যক্তি জীবন থেকে
রাষ্ট্রীয় জীবন পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সবগুলোর সমষ্টির নাম পর্দা বিধান। সুতরাং তা
অন্যান্য সাধারণ বিধানের মতো নয়। একজন সমর্পিত মুসলিমের কর্তব্য, ইসলামের
এই পর্দা-ব্যবস্থা সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা অর্জন করা। এরপর নিজের ও অধীনস্তদের
জীবনে তা বাস্তবায়িত করা।
পর্দা সম্পর্কে খন্ডিত ধারণার কারণে অনেকে মনে করেন যে, পর্দা
শুধু নারীদের বিধান,
পুরুষ এই বিধান থেকে মুক্ত। এই ধারণা ঠিক নয়। নারী-পুরুষ
উভয়কেই পর্দার বিধান দেওয়া হয়েছে। এমনকি কুরআন মজীদেও শুধু নারীকে নয়, নারী-পুরুষ
উভয়কেই সম্বোধন করা হয়েছে। তবে নারী-পুরুষের স্বত্তা ও স্বভাবগত ভিন্নতা এবং
কর্ম ও দায়িত্বগত পার্থক্যের কারণে অন্য অনেক বিষয়ের মতো পর্দার ক্ষেত্রেও
ভিন্নতা ও পার্থক্য হয়েছে। আমরা যদি ইসলামের সামগ্রিক পর্দা-ব্যবস্থাকে
পর্যালোচনা করি তাহলে তিন ধরনের বিধান পাই : ১. কিছু বিধান নারী-পুরুষ উভয়ের
ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন সতরের বিধান, নজরের বিধান, নারী-পুরুষের
মেলামেশার বিধান ইত্যাদি। ২. কিছু বিধান শুধু নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন গৃহে
অবস্থানের বিধান,
প্রয়োজনে বাইরে যাওয়ার সময় নিজেকে আবৃত করার বিধান, সজ্জা
ও অলংকার প্রদর্শন না করার বিধান ইত্যাদি। ৩. কিছু বিধান মৌলিকভাবে পুরুষের
ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন পরিবারের কর্তা হিসেবে অধীনস্তদের পর্দা সম্পর্কে অবগত
করার বিধান এবং তাদের পরিচালনা ও তত্ত্বাবধানের বিধান এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের
পরিচালক হিসেবে সর্বশ্রেণীর মুসলিম নর-নারীর জন্য পর্দার বিধান জানা ও মানার
ব্যবস্থা, পর্দা-বিরোধী সকল অপতৎরতা বন্ধ এবং সমাজে পর্দাহীনতা ও অশ্লীলতা বন্ধে
সর্বাত্মক প্রয়াস গ্রহণ করার বিধান ইত্যাদি।
মোটকথা, ইসলামের পর্দা বিধান শুধু নারীর জন্য নয়, নারী-পুরুষ উভয়ের জন্য। তেমনি
পর্দা-বিধান শুধু ব্যক্তিজীবনের বিষয় নয়। পারিবারিক, সামাজিক
ও রাষ্ট্রীয় জীবনেরও বিষয়।
ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থা যদি পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়িত হয় তাহলে মুসলিম
নর-নারীর ব্যক্তি জীবনের সাথে সাথে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনও
সুস্থ ও পবিত্র হবে। পক্ষান্তরে পর্দা-বিধান কার্যকর না থাকলে যেখানে যেখানে তা
অনুপস্থিত সেখানে সেখানেই পঙ্কিলতা ও অস্থিরতার অনুপ্রবেশ ঘটবে। এ কারণে ইসলামের
পর্দা বিধান হল ব্যক্তি ও সমাজের রক্ষাকবচ। এই সত্য আমরা যত দ্রুত উপলব্ধি করব তত
দ্রুত কল্যাণ লাভ করব। এ কারণেই
ইসলামের পর্দা-ব্যবস্থার যারা বিরোধী তারা শুধু দ্বীন-ধর্মেরই বিরোধী নয়, সমাজ ও
রাষ্ট্রেরও বিরোধী;
তারা মানব ও মানবতার মুক্তি ও কল্যাণেরও বিরোধী। সঙ্গত
কারণেই পর্দা-বিধানকে বলা যায় বর্তমান মুসলিমসমাজের জন্য আসমানী ফুরকান তথা এমন
এক ঐশী মানদন্ড,
যা মুমিন-মুনাফিকের মাঝে টেনে দেয় পরিষ্কার পার্থক্যরেখা।
আজ সকল মুসলিমের ঈমানী কর্তব্য, পর্দার বিধানের দিকে ফিরে আসা।
ব্যক্তি ও পরিবার এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের শান্তি-শৃঙ্খলা এবং স্বস্থি ও পবিত্রতা
রক্ষার এ ছাড়া দুসরা কোনো পথ নেই। মেহেরবান আল্লাহ আমাদের সকলকে সত্যকে সত্য
জানার এবং সমর্পিত চিত্তে তা অনুসরণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রাববাল
আলামীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন