বৃহস্পতিবার, ১৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৬

জবাব: হিজাবিদের সেক্স অ্যাপিল কি কেবলই চুলে?


লিখেছেন ফাহমিদা মুন্নী

বেশ কয়েকদিন আগে লূসিফার লায়লা নামে এদেশের সেক্যুলারপন্থী এক নারী এদেশের ফ্যাশনেবল হিজাবীদের কড়া সমালোচনা করে “হিজাবীদের সেক্স অ্যাপিল কি কেবলই চুলে?” নামক এক আর্টিকেল লিখেছেন। তথাকথিত এইসব হিজাবীদের সমালোচনা করা বা তাদের উপদেশ প্রদানের জন্য আমরা তাকে স্বাগত জানাই। কারণ, ইসলামে সৎ কাজের আদেশ করা এবং অসৎ কাজ থেকে কাউকে বিরত রাখার চেষ্টা করা একটি মহৎ কাজ। তাই মুসলিম হিসাবে উনি এ কাজ করতেই পারেন। তবে, উনার লেখার ধরণ আর ভাষার প্রয়োগ দেখলে মনে হয়, হিজাবীদের ভূল শোধরানোর বিষয়ে উনার যত না মনোযোগ ছিল, তার থেকে হিজাবীদের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার করতেই উনি বেশী সচেষ্ট ছিলেন। যেটা অবশ্যই উপদেশ প্রদানের কাজে উনি আসলে কতখানি আন্তরিক ছিলেন সে বিষয়কে মারাত্মক ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। তবে, উনার উদ্দেশ্য যাই হোক, সঙ্গত কারণেই তার লেখার সাথে আমি একমত হতে পারিনি। কারণগুলো এক এক ব্যাখ্যা করবো। 

প্রথমত: 
তার রচনার টাইটেল থেকেই বোঝা যায় যে, উনি ধরে নিয়েছেন যে, হিজাবীরা তাদের সেক্সঅ্যাপিল ঢাকার জন্য হিজাব পড়ে বা চুল ঢেকে রাখে। আসলে, উনার লেখার এই কনটেক্স বা প্রেক্ষাপটটাই একেবারে ভুল। তার কারণ, নিষ্ঠাবান মুসলিম নারীরা সেক্স অ্যাপিল ঢাকার জন্য হিজাব করে না। তারা শুধুমাত্র তাদের রবের সন্তুষ্টির নিমিত্তে রবের আদেশ পালনার্থে হিজাব ও জিলবাব পরে। অন্য কথায়, তারা যে কারণে সালাত আদায় করে কিংবা রোজার দিনে রোজা রাখে, ঠিক একই কারণে তারা হিজাব পরে কিংবা পর্দা করে। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেন: 

“ঈমানদার নারী ও পুরূষদের জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসুল কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয় তখন তারা সে বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে। আর যে আল্লাহ ও রাসূলকে অমান্য করলো সে তো স্পষ্ট ভাবে পথভ্রষ্ট।” (সুরা আহযাব: ৩৬) 

সুতরাং, উনার ভাষায় অন্যের লোভাতুর দৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা আসলে হিজাব পরার উদ্দেশ্য নয়। বরং, হিজাব পরিধানের মাধ্যমে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের নি:শর্ত আনুগত্য করাই হিজাব পরিধাণের মূল উদ্দেশ্য। 

দ্বিতীয়ত: 
বডি ফিটেড জিন্স ও টি-শার্ট এর সাথে কড়া মেকাপধারী এবং ফ্যাশনেবল হিজাবীদের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদগার করতে ব্যস্ত থাকায় উনি এটা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন যে, আসলে এ ধরণের ফ্যাশনেবল হিজাবীদের সাথে তার মতো লিবারেল সেক্যুলার বা উদারপন্থী তথাকথিত মুসলিম নারীদের মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। কারণ, জিন্স-টপস পরিহিত হিজাবীরাও আল্লাহ’র পরিবর্তে তাদের নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা বা তাদের মনের খেয়াল-খুশীকেই তাদের ইলাহ হিসাবে নির্ধারণ করে তাদের খুশী মতো শালীনতা বা পর্দার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে। আবার, উনাদের মতো উদারপন্থী তথাকথিত মুসলিমরাও আল্লাহ’র পরিবর্তে তাদের নিজস্ব বুদ্ধি-বিবেচনা এবং খেয়াল-খুশীকে ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করে তাদের নিজস্ব পছন্দ অনুযায়ী শালীনতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছেন। তাই, আল্লাহ’র দৃষ্টিতে বডি ফিটেড পোষাক পরিহিতা হিজাবী এবং উনাদের মতো শাড়ির সাথে বড় পিঠ খোলা ব্লাউজ পরিহিতা ও এলোকেশীদের মধ্যে আসলে মৌলিক কোন পার্থক্য নেই। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: 

“তুমি কি তাকে দেখেছো, যে তার নিজস্ব খেয়াল খুশীকে তার ইলাহ হিসাবে গ্রহণ করেছে? তারপরেও কি তুমি তাদের উকালতি করতে চাও? তুমি কি মনে কর তাদের বেশীর ভাগ কানে শোনে বা বোঝে? তারা তো আসলে গবাদিপশুর ন্যায়। না, বস্তুত: তারা গবাদিপশুর চাইতেও পথভ্রষ্ট।” (সুরা ফুরক্বান: ৪৩-৪৪) 

তৃতীয়ত: 
উনি একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দাবী করেছেন যে, যুগ বদলেছে। তাই আমাদের মা-খালা, চাচীদের মতো বখাটেদের নজর এড়াতে এখন আর মাথায় ঘোমটা টানার কোন প্রয়োজন নেই। কারণ, পিঠ খোলা ব্লাউজ পড়লে এখন নাকি আর কেউ তাদের দিকে তাকায় না। নারী-পুরূষ নির্বিশেষে নাকি এখন চোখ ট্যারা করে, ছোট করে, সরু করে শুধু হিজাবীদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার যুক্তির সমর্থনে তিনি পহেলা বৈশাখের উদাহরণ টেনেছেন। কিন্তু, মজার বিষয় হল, এবারের পহেলা বৈশাখে সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজে যত নারীকে লাঞ্ছিত করার দৃশ্য পরিস্কার ভাবে দৃশ্যমান হয়েছে, তার মধ্যে হিজাব পরিহিত কোন নারীকে দেখা যায়নি। বরং, আমরা দেখেছি উম্মত্ত হায়েনার দল উনাদের মতো শাড়ি কিংবা সালোয়ার কামিজ পরিহিতা এবং উনার দাবী অনুযায়ী অত্যন্ত শালীন (!) নারীদেরকেই রিকশা থেকে টেনে হিঁচড়ে নামাচ্ছে, কিংবা জানোয়ারের মতো খুবলে খাচ্ছে। তাহলে, যুগ বদলেছে, তাই এখন আর হিজাবের প্রয়োজন নেই তার এ দাবী সম্পূর্ন রূপে অগ্রহণযোগ্য। 

এছাড়া, উনি কি বলবেন, যুগের সাথে সাথে নারীর প্রতি পুরূষের দৃষ্টিভঙ্গি যদি এখন আগের থেকে অনেক উদার আর পরিবর্তিত হয়ে থাকে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো মুক্তচিন্তা আর নারী স্বাধীনতার ধ্বজাধারী দেশ কেন ধর্ষণে চ্যাম্পিয়ন হয়? কিংবা, ভারতের মতো একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশকে কেন ধর্ষকদের দেশ হিসাবে খেতাব পেতে হয়? ওখানেও কি হিজাবই নারীদের সমস্যার মূল কারণ নাকি? 

চতূর্থত: 
এছাড়া, উনি অন্যকে বকধার্মিক প্রমাণ করে তাদের অধর্মকারী আখ্যা দিয়ে কিংবা ঘৃণ্য মনমানসিকতা থেকে ভুল পথে থাকা আরেক মুসলিম বোনকে পর্নস্টার সানি লিওনের সাথে তুলনা করে নিজেকে আকারে-ইঙ্গিতে ভাল মুসলিম প্রমাণ করার চেষ্টা করলেও, হিজাব যে আল্লাহপ্রদত্ত অবশ্যপালনীয় বিধান তা মেনে নিতে উনার প্রবল আপত্তি রয়েছে। তার পুরো রচনায় তিনি হিজাবীদের সমালোচনা করতে গিয়ে আকারে ইঙ্গিতে বারে বারে হিজাবের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা ও বিতৃষ্ণা প্রকাশ করেছেন। আমি বলবো, উনার মতো বকধার্মিক মুসলিমদের জেনে রাখা উচিত, মুসলিম হবার প্রথম শর্ত হচ্ছে, ঈমান আনার পর আল্লাহ ও রাসুলের নি:শর্ত আনুগত্য করা, আল্লাহ’র হুকুমের বিরুদ্ধে বিষোদগার করা নয়। কিংবা, নিজের যেটুকু ভাল লাগে সেটুকু মানা নয়। আল্লাহ বলেন, 

“তারা (ঈমানদাররা) বলে, আমরা শুনলাম এবং আমরা মানলাম।” (সুরা বাক্বারা: ২৮৫ ) 

সুতরাং, সত্যিকার মুসলিমরা আল্লাহ’র হুকুমের নি:শর্ত আনুগত্য করে। এগুলোর বিষয়ে তর্কবিতর্ক করে না। তাই, আপনার ভাষায় ইসলাম যেমন তথাকথিত এইসব হিজাবীদের মনের মাধুরী মিশিয়ে ইসলাম পালনের পথ খোলা রাখেনি, তেমনি ইসলাম আপনাদের মতো সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী উদারপন্থী মুসলিমদের জন্যও সেক্যুলার, ডেমোক্রেটিক বা লিবারেল উপায়ে ইসলাম পালনের পথ খোলা রাখেনি। 

সবশেষে বলবো, মনের খুশী মতো হিজাব পরে দু’একটি আরবী শব্দ উচ্চারণ করে যেমন সত্যিকার মুসলিম হওয়া যায় না, ঠিক তেমনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে আক্রমণাত্মক শব্দ ব্যবহার করে, তীব্র বিষোদগার করে কিংবা কদর্য উদাহরণের মাধ্যমে কাউকে হেয় প্রতিপন্ন করেও কাউকে শোধরানো যায় না। তবে, এত কিছুর পরও আমরা আপনাকে তাসলিমা নাসরিনও বলবো না, কিংবা কদর্য অর্থে লুসিফারও বলবো না। আমরা বলবো, আপনি মুসলিম উম্মাহ’র আরও অসংখ্য সেক্যুলারপন্থী হতভাগ্য মুসলিমদের মতোই পথ হারানো একজন মুসলিম। যারা তাদের ঘিলু পশ্চিমাদের কাছে ইজারা দিয়েছেন, তাই খুলি দিয়ে এখন আর চিন্তা করতে পারছেন না। - See more at: http://lighthouse24.org/blog/post/viewPost/?postid=2225#sthash.IPxTgrU9.dpuf

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন