সৃষ্টির অগণিত রহস্যের
মধ্যে আমাদের গৃহপালিত পক্ষীকুলের একটি হল মোরগ মুরগি। তাকিয়ে দেখুন তাদের জন্ম
রহস্য এবং চলাফেরার মধ্যে কত আশ্চর্যজনক দৃশ্যমান ও অদৃশ্য বিষয় রয়েছে। মোরগ-মুরগি
ভোর বেলায় ঘর থেকে বেরিয়ে এসেই তারা তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যের সন্ধানে আবর্জনার
স্তূপের দিকে এগিয়ে যায় এবং সেখান থেকে তারা পছন্দ ও রুচি-মত খাদ্য সংগ্রহ করতে
থাকে। তাদের বিচিত্র পছন্দ থেকে পোকামাকড়, সাপের বাচ্চা, বিচ্ছু, কীটপতঙ্গ,ঘাস, ফল-ফুল, কাচ পাথর বালি সোনা-চাঁদি-কিছুই বাদ পড়ে না। তাদের পাকস্থলী
আল্লাহ তা‘আলার নির্মিত এমনই এক অভিনব কারখানা যেখানে পড়ার সাথে সাথে সকল কিছু হজম
বা আত্মস্থ হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় উপাদান তাদের শরীরে পৌঁছে যাওয়ার পর বর্জ্য-পদার্থ
মল আকারে বেরিয়ে যায়। এমন পাকস্থলী বাঘ-ভল্লুক
হাতি-ঘোড়া, এমনকি মানুষেরও নেই, যেখানে লোহা-কাচ পাথর, শাক-সবজি, ঘাস-পাতা, তরিতরকারি, গোশত, মাছ-সবকিছুই হজম হয়ে যায়। যা তার শরীরের অভ্যন্তরীণ
প্রয়োজন মেটানোর জন্য প্রকৃতি থেকে উপাদান সংগ্রহ করে। শুধু তাই নয়, রাব্বুল আলামিন তার মধ্যে এমন বীজ
রেখে দিয়েছেন, যার ফলে এমনি আরো মুরগি
পয়দা হবে এবং দুনিয়ায় তাদের বংশ বিস্তার হতে থাকবে। এইভাবে, প্রতিনিয়তই আমরা দেখতে পাব যে
প্রকৃতির মধ্যে অবস্থিত জীব-জন্তু ও পক্ষীকুলকে আল্লাহ তা‘আলা ভিন্ন ধরনের ওহি বা
ইলহাম দ্বারা তাদের কার্যক্রম ও খাদ্য গ্রহণ নিয়ন্ত্রণ করছেন। রাব্বুল আলামিনের
ইলহামী ইশারাতে মুরগি জমিনের অভ্যন্তরে ও উপরিভাগের অসংখ্য জিনিস থেকে ডিম দেয়ার
জন্য প্রয়োজনীয় মালমসলা সংগ্রহ করে নেয়। কিন্তু যখন ডিম দেয়ার মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তখন
আল্লাহপাক তাকে গোপন ওহির মাধ্যমে নির্দেশ দেন : এখন তার এতসব খাদ্য দরকার নেই, এতদিন ডিমের খোলস শক্ত বানানোর জন্য নানাবিধ
খাদ্যসহ ওইসব ধাতব দ্রব্য প্রয়োজন ছিল। এখন ডিম দেয়া বন্ধ, কাজেই ঐগুলি আর খেয়ো না এবং প্রজননের জন্য এখন
নর ও মাদির মিলনের দরকার নেই। এবার একুশ দিনের জন্য বসে যাও, ডিমগুলি তা দিতে থাক। এ জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখার
তাগিদে যতটুকু প্রয়োজন আল্লাহ তা‘আলার হুকুমে ততটুকু খাদ্য গ্রহণের জন্য দিনে
একবার বের হবে।কতটুকু তাপ কত সময় ধরে দিতে হবে সে বিষয়েও তাকে ইলহামের মাধ্যমে
জানানো হয়। তাই সে প্রথম সপ্তাহে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে বেরিয়ে কিছু
খাবার খেয়ে আবার গিয়ে বসে। দ্বিতীয় সপ্তাহে তার বের হওয়ার সময় আরও কমিয়ে দেওয়া হয়
এবং তৃতীয় সপ্তাহে তাপ আরও দীর্ঘক্ষণ ধরে রাখার প্রয়োজনে ডিম থেকে উঠে আসা আরও
কমিয়ে দেয়া হয়। শুধু যে ডিমের তাপ সংরক্ষিত রাখার জন্য তার বসে থাকতে হয়, তা নয়, বরং ডিমগুলি মাঝে মাঝে নাড়তে হয়। নেড়েচেড়ে তার সকল দিকের
পরিচর্যা সুসমঞ্জসভাবে করা লাগে। এ বিষয়েও তাকে গায়েবি নির্দেশ দেয়া হয়। একুশ দিন পূর্ণ হয়ে যাওয়ার
পর ডিমের মধ্যে বাচ্চার গঠন যখন পূর্ণ হয়ে যায় তখন গায়েবি নির্দেশ আসে : এখন আর
ডিম নাড়াচাড়া নয়, এখন দুনিয়ার জীবনে পদার্পণ
করার জন্য বাচ্চা প্রস্তুত, তার দেহ অত্যন্ত নাজুক ; অতএব সে নিজে নিজে চেষ্টা করে শক্ত খোলটি ভেঙে
ফেলে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে। সুতরাং সবর করতে হবে, যখন তার কানে হালকা হালকা মনোরম আওয়াজ
আসতে থাকে। এ সময়ে বাচ্চাকে দেখার জন্য মুরগিটি অস্থির হয়ে উঠে। এজন্য সে ডিমের
উপর বার বার ঠোকর দিতে থাকে। তখন তাকে সতর্ক করার জন্য তার কানে গায়েবি শব্দ
বেসে আসে : হে নাদান মুরগি, তোর সামান্য ভুলের কারণে
ডিমের মধ্যে এতদিন ধরে লালিত বাচ্চাটি মারা যেতে পারে। তুই যদি তোর চঞ্চু দিয়ে
ঠোকর মেরে বাচ্চাকে তাড়াতাড়ি বের করার চেষ্টা করিস সেই আঘাত বা চাপে বাচ্চাটা মারা
যেতে পারে। সুতরাং মুরগির কর্তব্য হচ্ছে, বাচ্চা নিজে নিজেই খোল
ভেঙে বেরিয়ে আসুক-তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকা। গায়েবের জগতে আল্লাহ
তা‘আলার প্রতিপালন, রহমত এবং হেদায়েত দানের
কাজ একই সাথে চলছে। এখন আসুন, আমরা বুঝতে চেষ্টা করি
কেমন করে অদৃশ্য জগৎ থেকে কীভাবে ডিমের মধ্যে প্রাণ সৃষ্টি সম্ভব হয়। অতি দুর্বল
নবজাতক মুরগি বা মুরগির বাচ্চা কঠিন একটি পরদা ও তার উপরের শক্ত খোলের মধ্যে
কীভাবে প্রাণ পেল, কীভাবে বন্দী জীবন যাপন
করল, কীভাবে পেল পরদা ও খোলের জিন্দানখানা
ভেঙে দুনিয়াতে আসার সামর্থ্য ! যে পরদা ও খোলের মধ্যে এতদিন সে বাস করল, সেখানে না ছিল চোখ খোলার কোন উপায়, না বাহু বা পাখনা মেলার জায়গা। সেখানে
সে না পা বিস্তার করতে পারে, আর না বাহ্যিক জগতের সাথে
তার কোন সম্পর্ক গড়ে উঠে যার ফলে বাইরের কোন সাহায্য পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব। এ সময়
তার মালিক, বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা
দয়াময় আল্লাহ তা‘আলাই তার একমাত্র সাহায্যকারী এবং ত্রাণকর্তা, আর অবশ্যই তার জীবনশিরা বা শাহ্রগ
থেকেও তিনি তার সন্নিকটে। ঐ রহস্যময় অজানা-অচেনা গভীর অন্ধকার জগৎ থেকে
দিকনির্দেশনা আসে ডিমের খোলের মধ্যে আগত নবীন ঐ বাচ্চাটির জন্য এবং তখন সে তার
ছোট্ট মোলায়েম ঠোঁট বা চঞ্চু দিয়ে ঠোকর মেরে মেরে পরদার স্তরগুলি ছিঁড়ে ফেলতে থাকে
এবং পরিশেষে বাহিরের শক্ত খোলটি ভেঙে সে বাহিরে আসার পথ করে নেয়। ঠিক কোন্
মুহূর্তে কীভাবে সে পথ করে নেবে, তা তাকে জানানো হতে থাকে
কুল মখলুকাতের মালিকের পক্ষ থেকে। যাঁর একক নিয়ন্ত্রণে সবকিছু চলছে ও সংঘটিত
হচ্ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে ডিমের মধ্যে রক্ষিত বিভিন্ন স্তর ও আকৃতি উদ্দেশ্যবিহীন
নয়। লাটিমের মত এই গোলকটির নীচের দিকে থাকে একটি কালো ক্ষুদ্র গোলক। এই কালো
বিন্দুকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে তার মাথা এবং উপরের মোটা অংশটিতে ধড়। এভাবে আরও
বিভিন্ন স্তরে তার পাখনা, হৃৎপিণ্ড, যকৃৎ, পাকস্থলী ইত্যাদির গঠন হতে থাকে মালিকের ইচ্ছা মত। এসব
কিছুর পরিচর্যার জন্য সে ব্যবস্থা নিতে থাকে।
ডিমের সরু অংশ যেখানে
ছোট্ট গোলকটি উৎপন্ন হয়ে মাথা তৈরির কাজ করে, ঠোকর মেরে খোলসটি ভাঙ্গার
কাজ কিন্তু ওখান থেকে হয় না। কারণ ঐ অংশটি থাকে অপেক্ষাকৃত ছোট ও শক্ত। ওখান থেকে
মাথা বের হতে পারলেও বড় ধড়টি বের হওয়া মুশকিল। এজন্য খোলটির সাথে সংলগ্ন উপরের
ঝিল্লির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাচ্চাটিকে ঘুরতে হয় এবং এটা রাব্বুল আলামিনের
নির্দেশেই সে করে। তবে, গম্বুজের মত মোটা অংশের
দিকে ঘুরে সে ঠোকরাতে থাকে না। এ পদ্ধতি তার বাহিরে বেরিয়ে আসার পথ সুগম না হয়ে
তার মৃত্যু ডেকে আনবে। যেহেতু মোটা অংশে থাকে অক্সিজেন ট্যাংক, এজন্য তাকে পাশে ঠোকর দিয়ে বেরোনোর পথ
করে নিতে হয়। একটু খেয়াল করলেই আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের ব্যবস্থাপনা ও সরাসরি
নিয়ন্ত্রণ বুঝতে পারব। নরম তুলতুলে ঐ মুরগির বাচ্চাটির শরীরে কোন প্রকার চাপ বা
আঁচড় না লাগে তার জন্য তাকে তিনি এলহামের মাধ্যমে নির্দেশ দিচ্ছেন :
ধীরে ধীরে ঠোকর দিয়ে খোলটির এমনভাবে দাগ করে দাও যেন খোলটি দুর্বল হয়ে দু‘ভাগে
বিভক্ত হয়ে যায় এবং তুমি আসানীতে দুনিয়ার আলোতে বেরিয়ে আসতে পার। কে তাকে এই
সুনিপুণভাবে ডিমের গায়ে দাগ লাগিয়ে দেয়ার কৌশল ও টেকনিক শেখাল ? এসব আর কিছু নয়, প্রকৃতির যাবতীয় বিষয়ের উপর আল্লাহ তা‘আলার নিয়ন্ত্রণ ও
হেদায়েত বা ওহির মাধ্যমে পরিচালনার ফল যা ভাসা ভাসা দৃষ্টিতে তাকালে বুঝা যাবে না।
মাকড়সা
সকল গৃহের মধ্যে যে ঘরটি
সব থেকে সূক্ষ্ম এবং নরম তা হচ্ছে মাকড়সা নির্মিত ঘর। মাকড়সা নিজেও অত্যন্ত নাজুক।
এদেরকে রক্তপায়ী প্রাণী-যেমন বিচ্ছু ইত্যাদির বংশোদ্ভুত মনে করা হয়। এরা দুরন্ত অনুভূতিশীল এবং
অত্যন্ত মেধাবী বা স্মরণ শক্তিসম্পন্ন প্রাণী।আল্লাহ রাব্বুল আলামিন
তাদেরকে এক আশ্চর্যজনক জ্ঞান দিয়েছেন। তাদের ঘর তৈরির সকল সরঞ্জাম বা উপাদান তারা
তাদের নিজেদের শরীর থেকেই পেয়ে থাকে। বাইরের মাটি পাথর ঘাস পানি ইত্যাদি কোন
কিছুরই প্রয়োজন হয় না এবং তারা নিজেরাই এর নির্মাতা। তাদের নিজেদের অস্তিত্ব থেকে
সংগৃহীত নির্মাণ সামগ্রী দ্বারা তৈরি এ ঘরই তাদের একমাত্র নিরাপদ বাসস্থল এবং এই
ঘর থেকেই তারা তাদের জীবন ধারণ সামগ্রী লাভ করে। এ ঘরের সুন্দর জালে ধরা পড়ে পোকা
মাকড়, মশা-মাছি এবং ছোট ছোট
পাখি তাদের খোরাকে পরিণত হয়। আজব এ পোকার জ্ঞান, অদ্ভুত তার বাসগৃহ, আশ্চর্যজনক তার বুনন পদ্ধতি, এ ঘরের দেয়াল ও দরজা বিস্ময়কর, তাঁর জীবনটাও বড় চমকপ্রদ, মৃত্যুও ততোধিক বিচিত্র। মাকড়সা যখন
গর্ভবতী হয় তখন গাছের খোল অথবা পাথরের ফোকরের মধ্যে স্থান গ্রহণ করে। তার পেট থেকে
ডিম বের হওয়া থেকে নিয়ে বাচ্চা ভূমিষ্ঠ না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সে বসে থাকে এবং
বাচ্চারা ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর পরই তারা মাকে খাওয়া শুরু করে দেয় এবং শক্তিশালী হয়ে
চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এসব পর্যবেক্ষণ করে
বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে বলতে ইচ্ছা হয়। ‘হে সকল বিস্ময়কর ও অজানা বিষয়ের প্রকাশক, অবশ্যই আপনি সর্বজ্ঞ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাময়’।
একটি সিজদা হাজার গোলামি থেকে
মুক্তি
আমরা পূর্বেই বলেছি যে, মূলত: আল্লাহ তা‘আলার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার প্রবণতা
ইতিহাসের কোন যুগেই ছিল না। নবী রাসূলগণ আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করানোর
উদ্দেশ্যে এ পৃথিবীতে আসেন নি। কাফেরদের যখন জিজ্ঞাসা করা হতো যে, এ চন্দ্র, সূর্য, আকাশ, পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তখন তারা বলতো, আল্লাহ। নবী রাসূলগণ এসেছেন আল্লাহকে
আড়াল করে সমাজে যে সমস্ত কুসংস্কারের জন্ম হয়েছিল, তা দূর করার জন্য। আল্লাহর গুনাবলী, তাঁর পবিত্র নাম, অন্য কথায় তাঁর সার্বভৌমত্বের
স্বীকৃতির প্রতি মানুষকে আহ্বান করার জন্যই তাঁরা পৃথিবীতে এসেছিলেন। আল্লাহই
সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তাঁর সৃষ্টি- নৈপুণ্যে অন্য কারো বিন্দুমাত্রও অংশীদারিত্ব
নেই। যিনি সৃষ্টি করেছেন, তিনিই একমাত্র মালিকানার
দাবি করতে পারেন। যিনি রিজিক দান করেন, তিনিই আনুগত্য চাইতে
পারেন। যিনি প্রতি মুহূর্তে আলো-বাতাস আর পানি-অক্সিজেন ইত্যাদির মাধ্যমে
প্রতিপালন করে যাচ্ছেন এবং আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন-মাথা শুধু তাঁর সামনে অবনত হতে
পারে। অন্য সব মিথ্যা ক্ষমতা আর অসত্য গুণের দাবিদারকে অস্বীকার করে সর্বময়
ক্ষমতার প্রকৃত মালিককে স্বীকার করানোর জন্যই পৃথিবীতে নবী ও রাসূলগণ এসেছেন। আর
তাঁরা যা নিয়ে এসেছেন, আর নামই হলো ইসলাম।
প্রকৃত মালিকের আনুগত্যের স্বীকৃতি। আর এ আনুগত্যের মাধ্যমেই আসে ইহকাল ও পরকালের
শান্তি। এটাই হচ্ছে ইসলামের অর্থ ! মূলত: একমাত্র মালিকের আনুগত্য স্বীকার করার
মধ্যে বান্দার প্রকৃত আজাদি রয়েছে। এ একটি সত্তার আনুগত্য স্বীকার করলে তাকে
অসংখ্য শক্তির সম্মুখে মাথা নত করতে হয় না। আর এটাই সমস্ত কথার মূলকথা। এই কথাকেই
ড. ইকবাল তাঁর কবিতায় এভাবে বলেছেন-
সে হলো একটি সিজদা-
সে হলো একটি সিজদা-
যাকে তুমি বোঝা মনে কর,
প্রকৃতপক্ষে
সে সিজদাই তোমাকে
আরো হাজার সিজদা থেকে নিষ্কৃতি দেয়।
ডিএনএ সংক্রান্ত জ্ঞান
চিকিৎসা বিজ্ঞানে নজিরবিহীন অগ্রগতি এনে দিয়েছে ক্ষুধা
দারিদ্র্য অজ্ঞতা এবং রোগব্যাধি মানুষের চিরন্তন শত্রু। মানুষ সবসময় এর যন্ত্রণা ও
পীড়া থেকে মুক্তির প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে সার্বিক
ক্ষেত্রে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু এখনও মানুষের অনেক কিছু অর্জনের বাকি রয়েছে।
সুদীর্ঘ গবেষণার ফসল হিসাবে ডিএনএ সংক্রান্ত পরিষ্কার ধারণা আমাদের সম্মুখে এসে
গেছে। এর ফলে মানসিক রোগ, হৃদ্রোগ, বহুমূত্র, হুপিংকাশি, মাদকাসক্তি এবং আরো অনেক দুরারোগ্য
ব্যাধির কারণ নির্ণয় ও প্রতিকারের ব্যবস্থা সহজ হয়ে গেছে। এখন এর মাধ্যমে অঙ্গ
বিকৃতি ব্যাধি সমূহের প্রতিরোধ সম্ভব হয়ে উঠবে। সত্যি বলতে কি একুশ শতক জিন থেরাপী
যুগের সূচনা করেছে।
ধর্ম-বিমুখতা ও এইডসের
আজাব
আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাস ও
ধর্ম-বিমুখতার কারণে বর্তমান বিশ্বে অবাধ যৌনাচার তীব্র হয়ে উঠেছে। এমনকি
সম-মৈথুনও ব্যাপকতর হচ্ছে। কোন কোন নবীর যুগেও তার জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম-মৈথুনের
প্রচলন ছিল। এই অপবিত্র অপকর্ম পরিহার করার জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে
সতর্ক-বাণীও উচ্চারিত হয়েছিল। আল্লাহর শাস্তি হিসাবে লুতের জনগোষ্ঠীর অনিবার্য
ধ্বংসের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই জনগোষ্ঠী সব ধরনের সতর্ক-বাণীকে অগ্রাহ্য
করে। এর পরিণতিতে আল্লাহ প্রদত্ত শাস্তি গন্ধক ও অগ্নি বৃষ্টির সম্মুখীন হয়ে পুরো
জনগোষ্ঠী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এইসব অপকর্মের শাস্তি হিসাবে গত কয়েক শতাব্দী
ধরে সিফিলিস ও গনোরিয়ার প্রাদুর্ভাব হয়। বর্তমানে মানব হন্তা নতুন রোগ এইডস
বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। এ রোগ অবাধ যৌনাচারের মধ্য দিয়ে ছড়িয়ে থাকে। এ জন্য এ থেকে নিষ্কৃতির
পথ হল পরিচ্ছন্ন ও পবিত্রভাবে জীবন-যাপন করা।
এ যুগের নাস্তিক বনাম জাহেলী যুগের কাফির
রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর যুগের বড় বড় কাফির আবু জাহেল, আবু লাহাবও আল্লাহর অস্তিত্বকে কোনদিন
অস্বীকার করে নি। তারা অস্বীকার করত শুধু
তাঁর গুণাবলি ও সর্বময় ক্ষমতার একক অধিকারকে। অন্ধকার যুগ বলে আমরা যাকে আখ্যায়িত
করি, সে যুগের লোকেরাও আল্লাহর অস্তিত্বে
বিশ্বাস করতো। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়,
রাসূলসাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর জন্মের পূর্বে আবরাহা বাদশা যখন কাবা-ঘর ধ্বংস করতে আসল
এবং তার সৈন্যরা কোরাইশ সম্প্রদায়ের কিছু উট ছিনিয়ে নিল। এ উটের মধ্যে রাসূল
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর দাদা আব্দুল মুত্তালিবের কিছু উটও ছিল, তিনি আবরাহার দরবারে
উপস্থিত হয়ে বললেন, আপনার লোকজন আমার উট
ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে, আমি তা ফেরত চাই। বাদশাহ
আশ্চর্য হয়ে বললেন, আমরা কা’বাঘর ধ্বংস করতে
এসেছি, সে ব্যাপারে কোন কথা না
বলে আপনি সাধারণ উটের কথা বললেন। আব্দুল মুত্তালিব উত্তরে বললেন, আমি উটের মালিক, আমি উট চাই, কা’বাঘরের একজন মালিক আছেন, তিনিই এটা রক্ষা করবেন।
কাজেই, এখান থেকে বুঝা যায়, জাহেলিয়াতের যুগেও লোকেরা আল্লাহর
অস্তিত্বে বিশ্বাস করতো। তারা হজ ও উমরা পালন করত। এর সাথে সাথে তারা দেব-দেবীরও
পূজা করত।
ইতিহাসের এক পর্যায়ে সত্য-মিথ্যার ফয়সালা হয়েছিল বদরের
ময়দানে,
সেখানে
আরবের শক্তিধর সেনাপতি আবু জাহেল বদরের ময়দানের দিকে রওনার পূর্ব ক্ষণে কা’বাঘরের
গিলাফ ধরে বলল, হে ঘরের মালিক, আমাদের দ্বীন যদি সত্য হয়, তাহলে মুহাম্মদ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে মুসলিম বাহিনী নিয়ে বদরের ময়দানে আসছে, তার একজনও যেন জিন্দা
অবস্থায় ফিরে যেতে না পারে। আমরা যেন তাদেরকে ধরাশায়ী করতে পারি। আর যদি মুহাম্মদের
দ্বীন সত্য হয়, তাহলে আমরা আরবের সর্দার
৭০ জনের একজনও যেন জিন্দা অবস্থায় ফিরে না আসি। আল্লাহ তা‘আলা আবু জাহেলের দোয়া
কবুল করলেন।
নাস্তিকদের নিকট একটি
জিজ্ঞাসা ???
পূর্বের আলোচনা থেকে বুঝা
গেল জাহেলিয়াতের জমানায়ও তারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করত। আমাদের এ যুগের
তথাকথিত বুদ্ধিজীবী নাস্তিকরা আবু জাহেল, আবু লাহাব থেকেও অনেক অধম, হতভাগ্য। দুঃখ হয় এদের বুদ্ধির দাবি
শুনলে। মূলত: এরাই সর্ব-যুগের
সর্বশ্রেষ্ঠ জাহেল। এসব নাস্তিকদের আমরা জিজ্ঞেস করতে চাই : ধরে নেয়া যাক আল্লাহ নেই, কিন্তু মৃত্যুর সময় যখন ঘনিয়ে আসবে, দুটি চক্ষু মুদিত হয়ে আসার সাথে সাথে যখন দেখতে
পাবে ফেরেশতাদের, দেখবে জান্নাত- দোজখ, আর দেখবে সবকিছুই এক এক করে উদ্ভাসিত হচ্ছে, তখন কি করবে ? এ অবস্থায় যারা আল্লাহকে
বিশ্বাস করে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পূর্বাহ্নেই প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে, তারা তো বেঁচে যাবে। আর আল্লাহ
তা‘আলার বেহেশ্ত-দোজখ, ফেরেশতা যদি নাও থাকে
(নাউযুবিল্লাহ) তাতেও তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না। তাহলে বুদ্ধিমানের কাজ হলো এমন পরিস্থিতির
জন্য প্রস্তুতি নিয়ে উভয় অবস্থায় বিপদমুক্ত থাকার চেষ্টা করা। এ কথাগুলো গভীরভাবে
চিন্তা করার জন্য আমরা মুক্তমনের বুদ্ধিমানদেরকে আহ্বান জানাচ্ছি। এতে তাঁরা
নিজেরা বেঁচে যাবেন অনন্ত অসীম জগতে, যেখানে আর কোন মৃত্যু
আসবে না। কুরআনে আল্লাহ তাআলা এভাবে বলেছেন :
وَالَّذِينَ كَفَرُوا لَهُمْ نَارُ جَهَنَّمَ لَا يُقْضَى عَلَيْهِمْ فَيَمُوتُوا وَلَا يُخَفَّفُ عَنْهُمْ مِنْ عَذَابِهَا كَذَلِكَ نَجْزِي كُلَّ كَفُورٍ (وَهُمْ يَصْطَرِخُونَ فِيهَا رَبَّنَا أَخْرِجْنَا نَعْمَلْ صَالِحًا غَيْرَ الَّذِي كُنَّا نَعْمَلُ أَوَلَمْ نُعَمِّرْكُمْ مَا يَتَذَكَّرُ فِيهِ مَنْ تَذَكَّرَ وَجَاءَكُمُ النَّذِيرُ فَذُوقُوا فَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ نَصِيرٍ (فاطر: 36-37
আর যারা
অস্বীকার করবে, তাদের জন্য রয়েছে
জাহান্নামের আগুন। তাদের জন্য মৃত্যুর আদেশও দেওয়া হবে না যে তারা মরে যাবে এবং
শাস্তিও লাঘব করা হবে না। আমরা এভাবেই প্রত্যেক অকৃতজ্ঞকে শাস্তি দিয়ে থাকি।
যেখানে তারা আর্তনাদ করে বলবে, হে প্রভু! আমাদের বের করে
নাও এখান থেকে, (এবার) আমরা সৎকাজ করব, পূর্বে যা করতাম, তা আর করব না। আল্লাহ
তা‘আলা উত্তর দেবেন, আমি কি তোমাদেরকে পূর্বেই
সময় দেই নি, যখন যা চিন্তা করার বিষয়
চিন্তা করতে পারতে ? উপরন্তু তোমাদের কাছে
সতর্ককারীও আগমন করেছিলেন। এবার আজাব ভোগ কর। মূলত: জালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী
নেই। (সূরা-ফাতের: ৩৬-৩৭)
একটি বিতর্কসভার কাহিনী
আমরা একজন প্রখ্যাত
ইসলামি চিন্তাবিদের সাথে এক নাস্তিকের বিতর্ক-সভার বর্ণনা দিয়ে এই আলোচনা শেষ
করছি। এক বিরাট জনসমাবেশে উক্ত নাস্তিকের সাথে তার বিতর্কের প্রোগ্রাম ঠিক হলো।
কিন্তু উক্ত ইসলামি চিন্তাবিদ অনেক দেরিতে উপস্থিত হলেন। নাস্তিক ভদ্রলোক বলল, এত দেরি করে কেন আসলেন ? আপনি ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। উত্তরে তিনি
বললেন, আমরা আসার পথে ছিল একটি
নদী। পারাপারের উপায় ছিল না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ কি দেখলাম ! আমার
সম্মুখেই একটা বৃক্ষ গজাচ্ছে। এ বৃক্ষটা অল্প সময়েই বড় হয়ে গেল। অত:পর আসল একটা
কুড়াল। এই কুড়ালটি গাছটিকে কেটে ফেলল। তার পর দেখলাম আসল করাত। করাত গাছটিকে ছিলে
তক্তা বানিয়ে ফেলল। অত:পর পেরেক হাতুড়ি ইত্যাদি এসে গেল। আর তৈরি হয়ে গেল নৌকা। সে
নৌকাটি আমার সম্মুখে চলে আসল এবং সে নৌকা দিয়েই আমি পার হয়ে আসলাম। এতে একটু দেরি
হয়ে গেল বৈকি ? নাস্তিক চিৎকার করে উঠল, সাহেব আপনি কি পাগল হয়ে গেলেন? এতগুলো কাজ কীভাবে নিজে নিজে হয়ে গেল ? চিন্তাবিদ বললেন, এটাই হচ্ছে আপনার বিতর্ক সভার উত্তর।
আপনি কীভাবে চিন্তা করতে পারলেন যে, এই বিশাল সৃষ্টি জগতে
গ্রহ, নক্ষত্র, আকাশ-পৃথিবী, আলো-বাতাস, গাছ-পালা, মানুষ, পশু-পাখি, অসংখ্য জীব-জন্তু এসব
কিছু নিজে নিজেই তৈরি হয়ে গেল ? উত্তর শুনে নাস্তিক হতবাকহয়ে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে
ঘোষণা করল এর পিছনে একজন শক্তিশালী সুনিপুণ কারিগর অবশ্যই আছেন। আর তিনিই হচ্ছেন
সর্বশক্তিমান আল্লাহ, এ জগতের সৃষ্টিকর্তা ও
তার একমাত্র মালিক।
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ (البقرة: 163
নিঃসন্দেহে আসমান জমিনের সৃষ্টির মাঝে, রাত্রি ও দিনের আবর্তনের
মাঝে, মহাসাগরে ভাসমান
জাহাজসমূহে, যা মানুষের জন্য কল্যাণকর
দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে ঘুরে বেড়ায়-(এ সবকিছুতে রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার নিদর্শন), আরো রয়েছে আল্লাহ তা‘আলার
বর্ষণ করা বৃষ্টির পানির মাঝে, ভূমির নির্জীব হওয়ার পর
তিনি এ পানি দ্বারা তাতে নতুন জীবন দান করেন, অত:পর এই ভূখণ্ডে সব ধরনের প্রাণের আবির্ভাব ঘটান। অবশ্যই
বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি করার মাঝে এবং সেই মেঘমালা যাকে আসমান জমিনের মাঝে অনুগত
করে রাখা হয়েছে -তার মাঝে সুস্থ বিবেকবান সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন রয়েছে।
(বাকারাহ ১৬৩ )
কালামে পাকের এই একটিমাত্র আয়াতে বিধৃত আল্লাহ পাকের এই
নিদর্শন সমূহ চিন্তাশীলদের মনোযোগ আকর্ষণ করে :
o (ক) আসমান জমিনের সৃষ্টি।
o (খ) রাত্রি এবং দিনের
পার্থক্য।
o (গ) সাগরে ভাসমান জাহাজ
সমূহের মধ্যে মানবকল্যাণ।
o (ঘ) মহান আল্লাহ কর্তৃক
আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণের পর বিরান ভূমির সজীব ও প্রাণবন্ত হয়ে উঠা এবং সেখানে সব
ধরনের প্রাণী আবির্ভূত হওয়া।
o (ঙ) বাতাসের প্রবাহ সৃষ্টি
o (চ) মেঘমালাকে আকাশ ও
পৃথিবীর মধ্যে অনুগত করে রাখা।
সমাপ্তি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন