বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৫

আদর্শের মানদন্ড মুহাম্মাদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাওলানা আবু সুফিয়ান

রাসূলুল্লাহ সা. হচ্ছেন কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকলের জন্য আদর্শের মানদন্ড এবং অনুসরণীয় ও অনুকরণীয়। তাঁর অনুসরণ ও অনুকরণ করা আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেকের জন্য অত্যাবশ্যক করে দিয়েছেন। যদি কেউ আল্লাহকে ভাল বাসতে চায়, তাঁর ক্ষমা ও সন্তুষ্টি লাভ করতে চায় এবং কিয়ামতের দিন রাসূল সা. এর সুপারিশ ও তাঁর হাতে হাউজে কাওসারের পানি পান করতে চায়; তাহলে ব্যক্তি, পারিবার, সামাজসহ মানব জীবনের সকল বিষয়ে সকল সেক্টরে রাসূল সা.এর জীবনাদর্শ, তাঁর নীতি ও দর্শন অনুসরণ ও অনুকরণ করা অবশ্যই কর্তব্য। সেই শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত হতে পেরে আমরা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের প্রশংসা জ্ঞাপন করছি এবং স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, তিনি ব্যতীত সত্যিকারের আর কোন মা‘বুদ নেই। সালাত ও সালাম জানাই বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ সা., তাঁর সকল সাহাবায়েকেরাম, তাবেয়ী, তাবে তাবেয়ী ও কিয়ামত পর্যন্ত আগত সকল অনুসারীদের প্রতি। 
এক নজরে রাসূল সা. এর ব্যক্তিত্ব
রাসূল সা. এর পবিত্র মুখমন্ডল, তাঁর দৈহিক গঠন, চাল-চলন ও সৌন্দর্যের যে ছাপ ১৪শ বছরের দূরত্ব পেরিয়ে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে তা এমন একজন মানুষের ভাবমূর্তি প্রতিফলিত করে, যিনি একাধারে অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান, সাহসী, ধৈর্যশীল, আদর্শে অবিচল, সৎ ও ন্যায়পরায়ণ, উদার ও মহানুভব, দাতা, দায়িত্ব সচেতন, বিনয়ী ও ভাবগম্ভীর এবং শুদ্ধভাষী ছিলেন। আরো সঠিকভাবে বললে বলতে হয়, তাঁর দৈহিক কাঠামোতে নবুয়্যতের ছাপ লক্ষ্যণীয়ভাবে বিদ্যমান ছিল। তাঁর সুদর্শন দেহ সৌষ্ঠব তাঁর উচ্চ মর্যাদার প্রতীক ছিল। এ প্রসঙ্গে রাসূল সা. একটি উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেনঃ “ আল্লাহভীতি মানুষের চেহারাকে উজ্জ্বল ও সুন্দর করে”। নবুয়্যত যখন ঈমান ও আল্লাহভীতির সর্বোচ্চ স্তর, তখন নবীর চেহারা আলোকময় না হয়ে পারে না। 

দৈহিক সৌন্দর্য ঃ আব্দুল্লাহ্ বিন সালাম (রাঃ) ছিলেন একজন বড় মাপের ইহুদি আলেম। তাঁর নাম ছিল হাসীন। রাসূল সা. মদীনায় হিজরত করলে তিনি তাঁকে দেখতে যান এবং দেখেই তিনি বর্ণনা করেনঃ “ আমি রাসূল সা. কে দেখেই চিনে ফেলেছিলাম। তাঁর চেহারা কোন মিথ্যাবদীর চেহারা হতে পারে না” এ বলে তিনি সাথে সাথে ইসলাম কবুল করে মুসলমান হয়ে যান। 
হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “রাসূল সা. কে যে দেখতো, সে প্রথম দৃষ্টিতেই বিমোহিত হয়ে যেত”। 
জাবের বিন সামুরা (রাঃ) বলেনঃ 
رأيت رسول الله صلى الله عليه وسلم في ليلة اضحيان وعليه حلة حمراء فجعلت أنظر إليه وإلى القمر فهو عندي أحسن من القمر. (شمائل ترمذي) 
আমি একবার জ্যোৎস্না রাতে রাসূল সা.কে দেখছিলাম। তিনি তখন লাল পোশাকে আবৃত ছিলেন। আমি একবার চাঁদের দিকে আর একবার তাঁর দিকে তাকাচ্ছিলাম। অবশেষে আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যে, রাসূল সা. চাঁদের চেয়েও সুন্দর”। (শামায়েলে তিরমিযী) 

উম্মে মা‘বাদ (রাঃ) এর বর্ণনায় রাসূল সা.এর সামগ্রিক চিত্র ঃ যদিও রাসূল সা. এর বহু সংখ্যক সাহাবী (রাঃ) রাসূল সা. সম্পর্কে অনেক চমকপ্রদ বিবরণ দিয়েছেন, কিন্ত উম্মে মা‘বাদের বিবরণের কোন তুলনা নেই। “গারে ছাওর” বা ছাওর পর্বতের গুহা থেকে যখন রাসূল সা. মদীনায় হিজরত করার জন্য রাওয়ানা দিলেন, তখন প্রথম দিনই খুযায়া গোত্রের এ মহিয়সী বৃদ্ধার বাড়ীতে যাত্রা বিরতি করেন। রাসূল সা. ও তাঁর সাহাবীগণ তৃষ্ণায় কাতর ছিলেন। আল্লাহর বিশেষ মেহেরবানীতে বৃদ্ধার জরাজীর্ণ ক্ষুধার্ত বকরী এ সময় এত দুধ দিল যে, রাসূল সা. ও তাঁর সাথীরা পেটপুরে খাওয়ার পর আরো খানিকটা দুধ অবশিষ্ট রইল। উম্মে মা‘বাদের স্বামী বাড়ী ফিরে দুধ দেখে অবাক হয়ে গেল। সে জিজ্ঞেস করল এ দুধ কোথা থেকে এল। উম্মে মা‘বাদ সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করল, তখন তার স্বামী বলল, এই কুরাইশী যুবকের আকৃতির বিবরণ দাও তো, তিনি সেই প্রত্যাশিত ব্যক্তি কিনা দেখি? তখন উম্মে মা‘বাদ চমৎকার ভাষায় তার বিবরণ দিল। সে বিবরণটি নিম্নে উপস্থাপন করা হলো। 

পবিত্র ও প্রশস্ত মুখমন্ডল, প্রিয় স্বভাব, পেট উঁচু নয়, মাথায় টাক নেই, সুদর্শন, সুন্দর, কালো ও ডাগর ডাগর চোখ, লম্বা ঘন চুল, গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর। উঁচু ঘাড়, সুরমাযুক্ত চোখ, চিকন ও জোড়া ভ্রু, কালো কোকড়ানো চুল, নীরব গাম্ভীর্য, আন্তরিক, দূর থেকে দেখলে সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক। নিকট থেকে দেখলে অত্যন্ত মিষ্ট ও সুন্দর। মিষ্টভাষী, স্পষ্টভাষী, নি¯প্রয়োজন শব্দের ছড়াছড়ি থেকে মুক্ত। সমস্ত কথাবার্তা মুক্তার হারের মত পরস্পরের সাথে মিলিত, মধ্যম ধরনের লম্বা, ফলে কেউ তাকে ঘৃণাও করে না, তাচ্ছিল্যও করে না। সুদর্শন, তরুণ, সর্বক্ষণ সাহচর্য দানকারীদের প্রিয়জন। যখন তিনি কিছু বলেন সবাই নীরবে তা শুনে, যখন তিনি কোন নির্দেশ দেন, তৎক্ষণাত সবাই তা পালন করতে ছুটে যায়। সেবা ও আনুগত্যপ্রিয়, প্রয়োজনের চেয়ে স্বল্পভাষীও নয় অমিতভাষীও নয়”। (যাদুল মা‘আদ, ১ম খন্ড পৃঃ - ৩০৭)

রাসূল সা. এর পোশাকঃ পোশাক দ্বারাও মানুষের ব্যক্তিত্ব প্রস্ফুটিত হয়। পোশাকের সাইজ, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, রং, পরিচ্ছন্নতা এবং অনুরূপ অন্যান্য বিশেষত্বের পোশাক তার উন্নত চরিত্র ও মানসিকতার পরিচায়ক। রাসূল সা. এর পোশাক সম্পর্কে তাঁর সাহাবীগণ যে তথ্য দিয়েছেন, তা থেকে রাসূল সা. এর রুচি ও মানসিকতা অনেকটা প্রকাশ পায়। রাসূল সা. আসলে পোষাক সম্পর্কে নিম্নোক্ত আয়াতের বাস্তব ব্যাখ্যা পেশ করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ 
يا بني آدم قد أنزلنا عليكم لباسا يواري سوآتكم وريشا ولباس التقوى وذلك خير. (أعراف: ২৬)
অর্থঃ “ হে আদম সন্তান, আমি তোমাদের জন্য তোমাদের লজ্জা স্থান আবৃতকারী এবং তোমাদের সৌন্দর্য উৎপন্নকারী পোশাক নির্ধারণ করেছি। তবে আল্লাহভীতির পোশাকই উত্তম। (আ‘রাফ-২৬)
তিনি আরো বলেনঃ سرابيل تقيكم الحروسرابيل تقيكم بأسكم অর্থঃ তিনি তোমাদেরকে গরম থেকে বাঁচানো ও যুদ্ধে নিরাপদ রাখার জন্য জামা ও বর্ম সরবরাহ করেছেন। (আন-নাহ্ল)
সুতরাং রাসূল সা. এর পোশাকের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল এইযে, তা লজ্জা নিবারক ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী ছিল এবং তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি ও সততার পোষাক ছিল। এতে প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা ছিল, চারিত্রিক নীতিমালার নিশ্চয়তা এবং ভদ্রজনোচিত রুচির প্রতিলনও ছিল। রাসূল সা. দাম্ভিকতা, জাঁকযমক, বিলাসিতা ও লোক দেখানোর মানসিকতা কঠোরভাবে এড়িয়ে চলতেন। তিনি বলেনঃ “ আমি আল্লাহর একজন দাস মাত্র এবং বান্দাদের উপযোগী পোশাকই পরি”। (আল- মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়া-১ম খন্ড, পৃঃ ৩২৮)
¤মুল মু‘মিনীন উম্মে সালামা (রাঃ) বলেন ঃ 
وسلم يلبسه القميص. (شمائل ترمذي-৫৫/৩) كان أحب الثياب إلى رسول الله صلى الله عليه 
অর্থঃ নবী কারীম সা. যেসব কাপড় পরিধান করতেন তন্মধ্যে জামা তাঁর নিকট সর্বাধিক পছন্দনীয় ছিল।
এছাড়াও রাসূল সা. সাদা পোশাককে বেশি পছন্দ করতেন। সামুরা বিন জুনদুব (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছে, রাসূল সা.বলেনঃ
ألبسوا من ثيابكم البياض، فإنها من خير ثيابكم، وكفنوا فيها موتاكم .(أبوداود)
অর্থঃ তোমরা সাদা পোশাক পরিধান করো, কেননা তোমাদের পোশাকসমূহের মধ্যে সাদা পোশাকই উত্তম। তোমাদের মৃতদেরকে সাদা কাপড় দ্বারা কাফনের ব্যবস্থা কর। (আবু দাউদ)
তিনি তখনো টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করেননি এবং তাঁর উম্মতদেরকে এ থেকে সতর্ক করেছেন। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে রয়েছেঃ 
لا ينظر الله يوم القيامة إلى من جرّ إزاره بطرا. (متفق عليه) 
অর্থঃ যে অহংকারবশত টাখনুর নিচে কাপড় পরিধান করে, আল্লাহ্ কিয়ামতের দিন তার দিকে ফিরেও তাকাবেন না। (বুখারী ও মুসলিম) 
অপর বর্ণনায় রাসূল সা. আরো বলেনঃ ما أسفل من الكعبين من الإزار ففي النار. (بخاري)
অর্থঃ টাখনুর নিচে যতটুকু কাপড় পরিধান করবে তা জাহান্নামের আগুনে জ্বলবে। (বুখারী)
রাসূল সা.পুরুষদেরকে রেশম ও সিল্ক এর পোশাক পরিধান করতে নিষেধ করতেন। তিনি বলেনঃ 
لا تلبسوا الحرير؛ فإن من لبسه في الدنيا لم يلبسه في الآخرة. ( متفق عليه)
অর্থঃ তোমরা রেশমের পোশাক পরিধান করো না। কেননা যে দুনিয়াতে তা পরিধান করবে; তাকে পরকালে তা পরিধান করানো হবে না। (বুখারী ও মুসলিম) 

* রাসূল সা. এর ব্যক্তিগত জীবনঃ রাসূল সা. এর ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন ছিল একই রকম। এক ব্যক্তি উ¤মুল মু‘মিনীন আয়েশা (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলো, রাসূল সা. ঘরোয়া জীবনে কী কী করতেন? তিনি জবাবে বললেনঃ রাসূল সা. সাধারণ মানুষের মতই ছিলেন। নিজের কাপড় চোপড়ের তদারকী নিজেই করতেন। ছাগলের দুধ নিজেই দোহাতেন এবং নিজের প্রয়োজনীয় কাজগুলো নিজেই করতেন। কাপড়ে তালি লাগাতে হলে নিজেই লাগাতেন, জুতো মেরামত করতেন। বোঝা বহন করতেন, পশুকে খাদ্য দিতেন। কোন ভৃত্য থাকলে তার কাজে অংশ নিতেন। যেমন- তার সাথে আটা পিষতেন, কখনো একাই পরিশ্রম করতেন, বাজারে যেতে কখনো লজ্জা বোধ করতেন না। নিজেই বাজার সদাই করে আনতেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সাধারণত একখানা কাপড়ে বেধে আনতেন। তিনি সব চেয়ে বিনম্র স্বভাবের, হাসিমুখে প্রফুল্ল আচরণ করতেন। কেমন বিনম্র স্বভাবের ছিলেন তা বুঝা যায় এ উক্তি দ্বারা যে, কখনো কোন ভৃত্যকে ধমক পর্যন্ত দেননি। একবার হযরত হুসাইন (রাঃ) এর এক প্রশ্নের জবাবে হযরত আলী (রাঃ) বলেনঃ “ রাসূল সা. বাড়ীতে থাকাকালে তিন ধরনের সময় কাটাতেন। কিছু সময় কাটাতেন আল্লাহর ইবাদতে, কিছু সময় দিতেন পরিবার পরিজনক এবং কিছু সময় ব্যয় করতেন বিশ্রামে। এই তিন সময় থেকেই একটা অংশ সাক্ষাত প্রার্থীদের জন্য বের করতেন। মসজিদের সাধারণ বৈঠক ছাড়াও যদি কোন বন্ধু বান্ধব একান্ত সাক্ষাতে মিলিত হতে চাইত কিংবা যদি কোন অতিথি আসতো, অথবা যদি কেউ কোন অভাব অভিযোগ জানাতে আসতো, তবে তাদেরকে তাঁর বিশ্রামের সময় থেকে কিছু সময় দিতেন। এতে করে দেখা যায় যে, তাঁর বিশ্রামের জন্য খুব কম সময় অবশিষ্ট থাকতো। (সামায়েলে তিরমিযী) 

* রাসূল সা. এর পানাহারঃ রাসূল সা. পানাহার রুচিটা ছিল অত্যন্ত ছিমছাম ও ভদ্রজনোচিত। তিনি গোশতের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন পিঠ, উরুও ঘাড়ের গোশত। পাশের হাড়ও তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল। গোশতের ঝোলের মধ্যে রুটি টুকরো টুকরো করে ভিজিয়ে রেখে ‘ছারীদ’ নামক যে, উপাদেয় আরবীয় খাবার তৈরী করা হতো, সেটাও তিনি খুবই পছন্দ করতেন। অন্যান্য প্রিয় খাবারের মধ্যে মধু, সির্কা ও মাখন ছিল অন্যতম। দুধের সাথে খেজুর খেতেও ভালোবাসতেন। তিনি প্রায়ই জবের ছাতু খেতেন। একবার বাদামের ছাতু খেতে দেয়া হলে তিনি এই বলে তা প্রত্যাখ্যান করলেন যে, এটা বিত্তশালীদের খাদ্য। বাড়ীতে তরকারী রান্না হলে প্রতিবেশীর জন্য একটু বেশী করে তৈরী করতে বলতেন। পানীয় দ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জিনিস ছিল মিষ্টি পানি এবং তা বিশেষ যতেœর সাথে দু‘দিনের দূরত্ব থেকে আনানো হতো। পানি মেশানো দুধ এবং মধুর শরবতও সাগ্রহে পান করতেন। এত তীব্র রুচিবোধের পাশাপাশি বেশীর ভাগ সময় ক্ষুধা ও দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত থাকতেন। 

* রাসূল সা. এর রসিকতাঃ রাসূলুল্লাহ্ সা. সদা হাসিমুখ ছিলেন। তিনি বলেনঃ ‘তোমার ভাই-এর দিকে মুচকি হাসি নিয়ে তাকানোটাও একটা সৎ কাজ’। রাসূল সা. এর সম্পর্কে এ কথাও বর্ণিত আছে যে, তিনি অত্যন্ত হাসিমুখ ও সদাপ্রফুল্ল ছিলেন। তিনি এমন অকৃত্রিম রসিকতা করতেন যে, তাঁর সাথীদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি গভীর ভালোবাসা বদ্ধমূল হয়ে যেত। তিনি হাস্য কৌতুকের মাধ্যমে মজলিশে আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলতেন। তবে সব সময় ভারসাম্য বজায় থাকতো। কথাবার্তায় রসিকতার মাত্রা থাকতো। তাঁর কথাবার্তায় রসিকতার মার্তা থাকতো খাদ্যে লবনের মাত্রার সমান। তাতে কোন অন্যায় অসত্য কথাও আসতোনা। এখানে আমরা রাসূল সা. এর রসিকতার কিছু নমুনা তুলে ধরছি। 
জনৈক ভিক্ষুক তাঁর কাছে একটা বাহন তথা উট চাইল। রাসূল সা. বললেনঃ আমি তোমাকে একটা উটনীর বাচ্চা দেবো। ভিক্ষুক অবাক হয়ে বললোঃ আমি ওটা দিয়ে কি করবো? রাসূল সা. বললেনঃ প্রত্যেক উটই কোন না কোন উটনীর বাচ্চা হয়ে থাকে। 
এক বুড়ি এসে বললোঃ আমার জন্য দো‘আ করুন যেন আল্লাহ্ আমাকে জান্নাত দান করেন। রাসূল সা. রসিকতা করে বললেনঃ কোন বুড়ি জান্নাতে যেতে পারবে না। বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে চলে যেতে উদ্যত হলো। রাসূল সা. উপস্থিত লোকদের বললেনঃ ওকে বলো যে, আল্লাহ্ ওকে বুড়ি অবস্থায় নয় বরং যুবতী বানিয়ে জান্নাতে নেবেন। 
একবার এক মজলিসে খেজুর খাওয়া হলো। রাসূল সা.রসিকতা করে খেজুরের আটি বের করে হযরত আলী (রাঃ) এর সামনে রাখতে লাগলেন। অবশেষে আটির স্তুপ দেখিয়ে রাসূল সা. বললেনঃ তুমি অনেক খেজুর খেয়েছ দেখছি। আলী (রাঃ) বললেনঃ আমি আটিসহ খেজুর খাইনি। 

* রাসূল সা. এর বিনোদনঃ ভারসাম্যপূর্ণ জীবনের একটা অবিচ্ছেদ্য অংগ হলো (বৈধ সীমার মধ্যে) বিনোদন। রসিকতার ন্যায় এ অংশটাও যদি বিলুপ্ত হয়ে যায়, তাহলে জীবন একটা বোঝা হয়ে উঠবে। কেননা যে জীবন ব্যবস্থায় বিনোদনের স্থান নেই, তা কোন সমাজ বেশি দিন বহন করতে পারে না। রাসূল সা. কিছু কিছু বিনোদন ভালোবাসতেন। 

* রাসূল সা. এর স্বভাব চরিত্র ঃ রাসূল সা. এর আখলাক বা স্বভাব চরিত্র ও নৈতিকতার বিবরণ কোন উপশিরোনামে দেয়া সম্ভব নয়। কেননা তাঁর গোটা জীবনটাই তো সৎ চরিত্রের নামান্তর। উম্মুল মু‘মিনীন আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ كان خلقه القرآن অর্থঃ পবিত্র কোরআনই হল রাসূল সা. এর চরিত্র। তাঁর সৎ চরিত্রে কিছু বৈশিষ্ট নিম্নে তুলে ধরা হলো। শামায়েলে তিরমিযীতে আয়েশা (রাঃ) বলেনঃ 
ما ضرب رسول الله صلى الله عليه وسلم بيده شيئا قط إلا أن يجاهد في سبيل الله ولا يضرب خادما ولا امرأة.
অর্থঃ রাসূল সা. আল্লাহর পথে জেহাদ ব্যাতীত কখনও কাউকে প্রহার করেন নি। কোন খাদেমকেও নয় এবং কোন স্ত্রীকেও নয়। (শামায়েলে তিরমিযী) 
তিনি আরো বলেনঃ নবী কারীম সা. কে কখনও ব্যক্তিগত কারণে কারো থেকে কোন জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করতে দেখিনি। হ্যাঁ, যখন আল্লাহর নিষিদ্ধ কাজ থেকে কোন কাজ করা হতো তখন তাঁর চেয়ে রাগান্বিত আর কাউকে দেখা যেতোনা। নাবী কারীম সা. কে যখন দুটি বিষয়ের মাঝে এখতিয়ার দেয়া হতো তখন যতক্ষণ না গুনাহের পর্যায়ে পৌঁছতো তন্মধ্যে সহজতর বিষয়টিই গ্রহণ করতেন।(শামায়েলে তিরমিযী, হাদীস-৩৩৩/৬) 

রাসূল সা. এর মোহরে নবুয়্যাত ঃ মোহরে নবুয়্যাত রাসূল সা. এর জন্মলগ্ন থেকেই বিদ্যমান ছিল। সে মোহরে নবুয়্যাত ছিল রাসূল সা. এর দুই কাঁধের মাঝখানে। তাতে লিখা ছিল محمد الرسول الله মুহান্মদ সা. আল্লাহর প্রেরিত রাসূল। কারো কারো মতে তাতে লিখা ছিল- سرفأنت المنصور আপনি যেখানেই থাকুন না কেন আপনাকে সাহায্য করা হবে। সামায়েলে তিরমিযীতে ইমাম তিরমিযী (রঃ) আটটি হাদীস নিয়ে এসেছেন। তার মধ্য থেকে এখানে একটি তুলে ধরা হল।হযরত জাবের ইবনে সামুরা (রাঃ) বলেনঃ
رأيت الخاتم بين كتفي رسول الله صلى الله عليه وسلم غدّةً حمراء مثل بيضة الحمامة. (شمائل ترمذي)
অর্থঃ আমি নবী কারীম সা. এর দু‘কাঁধের মাঝখানে মোহরে নবুয়্যাত দেখতে পেয়েছি যা লাল বর্ণের টিউমারের ন্যায় ছিল। আর পরিমানে কবুতরের ডিমের ন্যায় বড় ছিল। (শামায়েলে তিরমিযী)
রাসূল সা. এর খতমে নবুয়্যাত ঃ মুহাম্মদ সা. সর্বশেষ নবী ও রাসূল, তাঁর পরে আর কোন নবী-রাসূল এর আগমন ঘটবেনা। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ
ولــكن رسول الله وخاتم النبيين وكان الله بكل شيء عليما. (أحزاب-৪০)
অর্থঃ বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আল্লাহ্ সকল বিষয়ে জ্ঞাত।(আহযাব-৪০)
জাবের (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. বলেনঃ 
مثلي ومثل الأنبياء كمثل رجل بني دارا فأتمها وأكملها إلا موضع اللبنة فجعل الناس يدخلونها ويتعجبون منها ويقولون لولا موضع اللبنة-قال رسول الله صلى الله عليه وسلم- فأنا موضع اللبنة جئت فخمت الأنبياء. (مسلم)
অর্থঃ আমি ও আমার (পূর্বের) নবীদের দৃষ্টান্ত হচ্ছে ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে একটি ঘর তৈরী করল এবং তা পরিপূর্ণ করল। কিন্তু একটি ইটের যায়গা খালি রয়ে গেল। লোকজন ঐ ঘরে প্রবেশ করে আশ্চর্য হয়ে বলতে লাগল, যদি এ ইটের যায়গাটা খালি না হত, তাহলে তা পরিপূর্ণ হতো। রাসূল সা. বলেনঃ আমি হলাম ঐ বিল্ডিং এর খালি ইটের মত। আমার দ্বারা নবুয়্যাতের পরিসমাপ্তি ঘটানো হয়েছে। (মুসলিম) 

রাসূল সা.এর মো‘জেযাঃ মো‘জেযা শব্দের অর্থ হচ্ছে অলৌকিক ঘটনা, বিস্ময়কর বস্তু, অসম্ভব বস্ত ইত্যাদি। যা আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীন প্রত্যেক নবী ও রাসূলকে নবুয়্যাতের প্রমাণ স্বরূফ দান করেছেন। রাসূল এর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়। তাঁর নবুয়্যাতী জেন্দেগীতে একশতটিরও বেশি মো‘জেযা সংঘঠিত হয়েছে। 

খতমে নবুওয়াত
আরবী শব্দ ‘খাতামুন্ নাবিয়্যীন’ এর অর্থঃ নবীগণের শেষ, নবুওয়াতের সিলসিলার পরিসমাপ্তি ঘোষণা। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ্ সা. এর পর আর কোন নবী বা রাসূল আসবেন না। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন ঃ 
مَا كَانَ مُحَمَّدٌ أَبَاءَ أَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَلـكِنْ رَّسُوْلُ اللهٍ وَخَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ. وَكَانَ اللهُ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمًا. (أحزاب : ৪০) 
অর্থ ঃ মুহাম্মদ সা. তোমাদের পুরুষদের কারো পিতা নয় কিন্তু সে আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী। আর আল্লাহ্ সকল বিষয়ের খবর রাখেন। (আহযাব ঃ ৪০) 
সকল অভিধান বিশারদ ও তাফসীরকারকগণ ‘খাতামুন নাবিয়্যীন’ শব্দের অর্থ নিয়েছেন, আখেরুন নাবিয়্যীন অর্থাৎ নবীদের শেষ। রাসূল সা. বলেন ঃ 
كَانَتْ بَنُوْ إِسْرَائِيْلَ تَسَوِّسُهُمْ الْأَنْبِيَاءُ- كُلَّمَا هَلَكَ نَبِيٌّ خَلَفَهُ نَبِيٌّ ، وَإِنَّه لاَ نَبِيَّ بَعْدِيْ وَسَيَكُوْنَ خُلَفَاءَ.(بخاري،كتاب المناقب)
অর্থ ঃ বনী ইসরাঈলের নেতৃত্ব দিতেন আল্লাহর রাসূলগণ। যখন কোন নবী ইন্তেকাল করতেন, তখন অন্য নবী তাঁর স্থলাবিষিক্ত হতেন। কিন্তু আমার পরে কোন নবী হবে না, শুধু খলীফা হবে। (বুখারী)

রাসূল সা. এর ইবাদাত 
*নামাযঃ রাসূল সা. ফরয নামায যথাযথভাবে আদায় করার পাশাপাশি নফল নামায অধিক ও দীর্ঘ সময় নিয়ে পড়তেন। উ¤মুল মু‘মিনীন আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত একটি হাদীস থেকে তাঁর নামায সম্পর্কে অবগত হতে পারি। তিনি বলেনঃ 
كان يقوم من الليل حتى تتفطّر قدماه فقلت له : لم تصنع هذا يا رسول الله ، وقد غفر لك ما تقدم من ذنبك وما تأخر؟ قال : أفلا أحب أن أكون عبدا شكورا. (متفق عليه) 
অর্থঃ তিনি রাতে এত বেশি নামাযে দন্ডায়মান থাকতেন যে, তাঁর পাঁ দু‘টি ফেটে যেত। তখন আমি তাঁকে বলতাম হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কেন এত কষ্ট করেন, অথচ আল্লাহ্ আপনার পূর্বাপর সকল গুনা মাফ করে দিয়েছেন। উত্তরে রাসূল সা.বলেন, আমি কি আমার রবের কৃতজ্ঞ বান্দা হওয়া পছন্দ করবো না।(বোখারী ও মুসলিম) 
* রোযাঃ রাসূল সা. বিভিন্ন নিয়মে রোযা রেখেছেন। তিনি প্রতি সোমবার ও বৃহঃপতিবার এবং প্রতি মাসের ১২ ১৩, ১৪ তারিখে রোযা রাখতেন। কখনও কখনও একটানা কয়েকদিন রোযা রাখতেন। তিনি বিশেষ কারণে বিশেষ তারিখে রোযা রাখতেন। আবার কখনো একটানা কয়েক দিন চলে যেত তিনি রোযা রাখতেন না। রোযা রাখার ব্যাপারে রাসূল সা. এর নিয়ম কি ছিল তার নমুনা উ¤মুল মু‘মিনীন আয়েশা (রাঃ) এভাবে বর্ণনা করেনঃ 
عن عبد الله بن شقيق قال سألت عائشة رضي الله عنها عن صيام رسول الله صلى الله عليه وسلم قالت : كان يصوم حتى نقول قد صام ويفطر حتى نقول قد أفطر قالت : وما صام رسول الله صلى الله عليه وسلم شهرا كاملا منذ قدم المدينة إلا رمضان. (شمائل ترمذي) 
অর্থঃ আবদুল্লাহ্ বিন শাকীক বর্ণনা করেন, আমি হযরত আয়েশা (রাঃ) এর নিকট রাসূল সা. এর রোযার নিয়ম জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেনঃ নবী কারীম সা. কখনও অবিরাম রোযা রাখতেন। আমরা মনে করতাম এ মাসে তিনি আর রোযা ছাড়বেন না। আবার কখনও একটানা রোযা রাখা থেকে বিরত থাকতেন। আমরা মনে করতাম এ মাসে তিনি আর রোযা রাখবেন না। তিনি আরো বলেনঃ রাসূল সা. রমযান মাস ব্যতীত পূর্ণ এক মাস রোযা কখনো রাখেন নি। (শামায়েলে তিরমিযী)

* রাসূল সা. এর তাওবা-এস্তেগফার ঃ রাসূল সা. এর পূর্বাপর ছোট-বড় সমস্ত গুনাহ ও ত্রুটি-বিচ্যুতি আল্লাহ্ ক্ষমা করে দিয়েছেন। এর পরও রসূল সা. এত বেশি তাওবা এসতেগফার করতেন, যা আমরা নিম্নোক্ত হাদীস থেকে জানতে পারি। হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসার আল মুযানি (রাঃ) থেকে হাদীসে রাসূল সা. বলেনঃ ياأيها الناس توبوا إلى الله واستغفروه فإني أتوب في اليوم مائة مرة. (مسلم) 
অর্থঃ হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা এবং তাওবা কর, কেননা আমি দৈনিক একশত বার তাওবা করি। (মুসলিম) 
তাহলে আমরা এ হাদীস থেকে শিক্ষা নিতে পারি যে, রাসূল সা. এর পূর্বপর সকল গুনাহ মাফ করে দেয়ার পরও তাঁর নামায, রোযাসহ অন্যান্য সকল ইবাদাতের পরিমান যদি এরূপ হয় এবং তাওবা এস্তেগফার যদি এত বেশি হয়, আমাদের কি করনীয় ? অথচ আমরা কত অন্যায় অপরাধে লিপ্ত রয়েছি আমাদের কি পরিমান ইবাদাত বন্দেগী ও তাওবা এস্তেগফার করা উচিত ? কিন্তু আমরা উদাসিন হয়ে আমাদের জাগতিক জীবনকাল অতিবাহিত করছি। 

তাওহীদ প্রতিষ্ঠা ও শিরক থেকে বিরত রাখাই রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য ঃ আদম (আঃ) থেকে মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে- মানুষকে তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত করা এবং সকল প্রকারের শিরক ও ত্বাগুত থেকে বিরত রাখা। তাই সকল আম্বিয়া (আ) তাঁদের স্ব স্ব জাতিকে তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং শিরক ও ত্বাগুত থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেছেন। যারা নবী-রাসূলগণের দাওয়াতকে গ্রহণ করেছেন তারা সফলকাম হয়েছেন। আর যারা এ দাওয়াতকে প্রত্যাখ্যান করেছে তারা ব্যর্থ ও অভিশপ্ত হয়েছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন ঃ 
ولقد بعثنا في كل أمة رسولا أن اعبدوا الله واجتنبوا الطاغوت.
অর্থ ঃ আমি প্রত্যেক জনপদে রাসূল প্রেরণ করেছি এ দাওয়াত সহকারে যে, তোমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর এবং তাগুত থেকে বিরত থাক।
সকল নবী রাসূলগণের দাওয়াত ছিল এক ও অভিন্ন। তাঁরা সকলে স্ব স্ব জাতিকে যে দাওয়াত দিয়েছে তা হচ্ছে - يا قوم اعبدوا الله ما لكم من إله غيره অর্থ ঃ হে আমার সম্প্রদায় তোমরা একমাত্র আল্লাহরই ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের আর কোন মা‘বুদ নেই।

আমাদের করনীয় বিষয়াবলী
*তাঁকে ভাল বাসা ও তাঁর আনুগত্য করাঃ রাসূল সা. কে ভালবাসা ঈমানের অন্যতম অংশ। তাঁর ভাল বাসা ব্যতীত কেউ সত্যিকারের প্রিয় উম্মত হতে পারবে না। তাঁর ভালবাসা আল্লাহর ভালবাসা লাভ ও তার গুনাহ মাফের মাধ্যম। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ 
قل إن كنتم تحبون الله فاتبعوني يحببكم الله ويغفرلكم ذنوبكم والله غفور رحيم . قل أطيعوا الله والرسول فإن تولو فإن الله لا يحب الكافرين . (آل عمران -৩১-৩২)
অর্থঃ বলুন! তোমরা যদি আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ-অনুকরণ কর, আল্লাহ তোমাদিগকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন। আল্লাহ্ অত্যান্ত ক্ষমাশীল, করুণাময়। বলুন! তোমরা আল্লাহ্ ও রাসূলের অনুগত হও। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রাখুন আল্লাহ্ কাফেরদেরকে পছন্দ করেন না। (আলে ইমরান-৩১-৩২) 
রাসূল সা. বলেনঃ 
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين. (بخاري وسلم)
অর্থঃ তোমাদের কেউ ততক্ষণ পরিপূর্ণ মু‘মিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে আমাকে তার পিতা, সন্তান ও সকল মানুষের চেয়ে বেশি ভালবাসবে। (বোখারী ও মুসলিম) 

ভালবাসার নামে বাড়াবাড়ি না করা ঃ কোরআন ও হাদীসে প্রত্যেকটি বিষয় যেভাবে এসেছে এবং রাসূল সা.ও সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে আমল করেছেন বা বলেছেন সেভাবে করা বা মেনে নেয়ার নামই হল ইবাদত। তাতে কোন ধরণের বাড়াবাড়ি করাকে শরীয়ত সমর্থন করে না। এমনিভাবে রাসূল সা. এর ভালবাসার ব্যাপারেও, তিনি যেভাবে ভালবাসতে বলেছেন বা সাহাবায়ে কেরামগণ যেভাবে তাঁকে ভালবাসা দেখিয়েছেন সেভাবে ভালবাসাই হল ইবাদত। এতে কোন ধরণের বাড়াবাড়িকে শরীয়ত সমর্থন করে না। তাঁকে ভালবাসার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করতে রাসূল সা. নিষেধও করেছেন। তিনি বলেনঃ
لا تطروني كما أطرت النصارى ابن مريم إنما أنا عبده فقولوا عبد الله ورسوله. (متفق عليه)
অর্থঃ খৃষ্টানরা যেমনভাবে ঈসা ইবনে মারয়ামের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা তেমনিভাবে আমার ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আমি আল্লাহর বান্দা। অতএব তোমরা বল আল্লাহর বান্দা এবং তাঁর রাসূল। (বুখারী ও মুসলিম)
এক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করার অর্থ হলো রাসূল সা. এর মর্যাদা ও বৈশিষ্টাবলীর ক্ষেত্রে অতিরঞ্জন ও সীমালঙ্ঘন করা। যেমন রাসূল সা. কে হাযির-নাযির, তিনি জাতি নূরের তৈরী, তিনি গায়েব জানেন, তাঁর নামে কসম খাওয়া, তাঁর নামে মান্নত করা, তাঁর নিকট দোয়া আশ্রয় প্রার্থনা করা ইত্যাদি আল্লাহর গুণ সমূহে গুণান্বিত করা। সুতরাং রাসূল সা. এর সৌজন্যে এ ধরণের কার্যকলাপ শরীয়তে গর্হিত। তাই এ ধরণের কাজ থেকে বিরত থাকব। 

তাঁর সুন্নাতকে তথা জীবনাদর্শকে আঁকড়িয়ে ধরাঃ জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাসূল সা. এর জীবনাদর্শ আঁকড়িয়ে ধরা সকল উম্মতের উপর অবশ্যই কর্তব্য। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেনঃ 
لقد كان لكم في رسول الله أسوة حسنة لمن كان يرجوا الله واليوم الآخر وذكر الله كثيرا. (الأحزاب -২১)
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ্ ও আখেরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ্ সা. এর মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। (আহযাব-২১)
আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেনঃ وما آتاكم الرسول فخذوه وما نهاكم عنه فانتهوا (الحشر-৭) 
অর্থঃ রাসূল সা. তোমাদেরকে যা দেন তা তোমরা গ্রহণ কর এবং যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করেন তা থেকে তোমরা বিরত থাক। (হাশর-৭)
জীবনের সকল ক্ষেত্রে রাসূলের আনুগত্য যে করবে সেই তাঁর উম্মত এবং সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. বলেন ঃ 
كل أمتي يدخلون الجنة إلا من أبى، قيل: ومن يأبى يارسول الله؟ قال: من أطاعني دخل الجنة ومن عصاني قد أبى. 
অর্থঃ আমার প্রত্যেকটি উম্মতই জান্নাতে প্রবেশ করবে। কিন্তু যারা আমাকে অস্বীকার করে তারা ব্যতীত। জিজ্ঞেস করা হলো হে আল্লাহর রাসূল! কে আপনাকে অস্বীকার করে? উত্তরে তিনি বলেনঃ যে আমার (জীবনাদর্শের অনুসরণ অনুকরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যে তা করবে না সেই আমাকে অস্বীকার করল। (বোখারী) 

* রাসূল সা. এর প্রতি দুরূদ পাঠ করাঃ রাসূল সা. বলেন ঃ যে আমার প্রতি একবার দুরূদ পাঠ করল, আল্লাহ্ তার উপর দশটা রহমত নাযিল করেন। সর্বোচ্চ দরূদ হচ্ছে যে দরূদ আমারা নামাযে পাঠ করি। অর্থাৎ দুরূদে ইবরাহীম। দরূদ পাঠের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে রাসূল সা. বলেনঃ 
إن من أفضل أيامكم يوم الجمعة فيه خلق آدم عليه السلام وفيه قبض وفيه النفخة وفيه الصعقة فأكثروا من الصلاة فإن صلاتكم معروضة عليّ قالوا يارسول الله ! وكيف تعرض صلاتنا عليك وقد أرمت أي يقولون قد بليت قال إن الله عزّ وجلّ قد حرّم على الأرض أن تأكل أجسام الأنبياء عليهم السلام. (ابن ماجة)
অর্থঃ নিশ্চয়ই দিন সমূহের মাঝে জুমুআর দিন হচ্ছে শ্রেষ্ঠ দিন। এ দিন আদম (আ) কে সৃষ্টি করা হয়েছে, আবার এ দিনেই তিনি ইন্তেকাল করেছেন। এ দিনেই সিঙ্গায় ফুৎকার দেয়া হবে এবং কেয়ামত সংঘঠিত হবে। অতএব তোমরা এ দিনে আমার উপর বেশি বেশি দুরূদ পাঠ কর। কেননা তোমাদের দুরূদ আমার নিকট পেশ করা হবে। সাহাবাগণ জিজ্ঞেস করলেন হে আল্লাহর রাসূল! কিভাবে আমাদের দুরূদ আপনার নিকট পেশ করা হবে অথচ আপনি মাটির সাথে মিশে যাবেন বা মাটি আপনাকে খেয়ে ফেলবে? রাসূল সা. উত্তরে বলেনঃ আল্লাহ তা‘আলা নবীগণের দেহ ভক্ষণ করাকে মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন। 

আলোচনার সার কথা
মহানবী মুহাম্মদ (সা) এর ভালবাসা ঈমানে প্রাণ শক্তি, এ ছাড়া আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় না। ভালবাসার অর্থ হলো তার চাল-চলন, কথা-বার্তা, উঠা-বসা, শয়ন-স্বপন, নিদ্রা-জাগরণ,পানাহার ইত্যাদি সকল ইবাদত ও কাজে রাসূল (সা) এর অনুকরণের মাধ্যমে নিজ জীবনকে প্রতিষ্ঠিত করা। 
উপরোক্ত আলোচনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের প্রত্যেককে সত্যিকারের রাসূল প্রেমিক ও তাঁর অনুগত উম্মত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন! 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন