বৃহস্পতিবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০১৫

তাতারিদের ইসলাম গ্রহণ!

হিজরী ষষ্ট শতাব্দীতে তাতারিরা তাদের দেশ অতিক্রম করে তুরস্ক থেকে আরম্ভ করে মধ্য এশিয়ার রুশ প্রজাতন্ত্র পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। তাতারি ছিল অত্যন্ত  হিংস্র ও ভয়ঙ্কর জাতি। সেই তাতারিরা অত্যন্ত নির্দয় ও নির্মমভাবে মুসলিম বিশ্বের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয় তিলোত্তমা মুসলিম নগরীগুলো। তৎকালের তাতারিরা ছিল প্রচন্ড প্রভাব ও প্রতিপত্তির অধিকারী। তাদের এত বেশী প্রভাব ছিল যে একজন সাধারণ তাতারিও যদি রাস্তায় কোন মুসলমানের সাক্ষাত পেত তাকে বলত, ‘তুমি অপেক্ষা কর। আমি ঘর থেকে অস্ত্র এনে তোমাকে হত্যা করব।’ মুসলমান ব্যক্তিটি  নীরব -নিশ্চল দাঁড়িয়ে থাকত। সামান্য নড়ানচা করার মতো সাহসটুকুও তার মধ্যে অবশিষ্ট থাকত না। খতীবে বাগদাদী লিখেছেন,এক এক জন তাতারি শত শত মুসলমানকে এভাবে গ্রেফতার করে নিয়ে যেত,রাখাল যেভাবে মেষ ইত্যাদি নিয়ে ঘরে ফেরে। একথা তখন প্রবাদ বাক্যের মতো প্রশিদ্ধ হয়ে পরেছিল যে,‘যদি তোমরা তাতারীদের পরাজিত হওয়ার সংবাদ শোন তবে তা বিশ্বাস করো না ’ কিন্তু পরবর্তীকালে,মুসলমানদের ঈমানী শক্তির কাছে  এই প্রবাদ ভ্রান্ত ও মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। তাতারীরা আলেম-উলামা,মুহাদ্দিস,মুফতীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালিয়েছে। তাদের নিজ নিজ ভিটেবাড়ি থেকে উৎখাত করেছিল। এই চরম নির্যাতিতদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য একজন বুজুর্য হচ্ছেন শায়েখ জামালুদ্দীন (র.)। এই আল্লাহভীরু মনীষী কাশগর থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে আকসুতে’  সফর রত ছিলেন। ঘটনাক্রমে ওইদিন তাতারী শাহাজাদা তোগলক তাইমুর খানও এখানে শিকারের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। তার নির্দেশ ছিল,ওই অঞ্চলের সব প্রজা যেন তার সাথে শিকারে অংশ নেয়। তার নির্দেশ মত এলাকার সব মানুষ তার সাথী হল। হটাৎ করে দৃষ্টি পড়ল দূরে বসা বিশ্রামরত জামালুদ্দীন ও তার এক সঙ্গীর উপর। তাইমুর তাদেরকে তার কাছে উপস্থিত করার নির্দেশ দিলেন। তাইমুর রাগান্বিত স্বরে বললেন ‘আমার নির্দেশ ছিল এলাকার সভ প্রজা আমার সঙ্গে শিকারে থাকবে। তোমরা আমার নির্দেশ অমান্য করলে কেন?’ উত্তরে শায়েখ বললেন,‘আমরা ভিন্ন অঞ্চলের এবং অপনার নির্দেশ সম্পর্কে আমরা মোটেও অবগত নই।’ উত্তর শুনে তাইমুর তাদের ক্ষমা করলেন বটে,কিন্তু তার একটি শিকারী কুকুর দেখিয়ে বললেন,আচ্ছা বুড়ো। বল দেখি,তুমি উত্তম,নাকি কুকুরটি তোমার চেয়ে উত্তম ? শায়েখ অত্যন্ত স্বাভাবিক ও  উত্তর দিলেন,আমার মধ্যে যদি ঈমানের সম্পদ থাকে,তবে আমি উত্তম,নতুবা কুকুরটি আমার চেয়ে উত্তম। উত্তর শুনে শাহজাদা তাইমুরের মনে প্রতিক্রিয়া হল। তিনি নির্দেশ দিলেন,এই লোকটিকে আমার তাঁবুতে নিয়ে আসা হোক। শায়েখকে তাঁবুতে আনার আগেই তাইমুর তাঁবুতে উপস্থিত হন। শায়েখের দিকে জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,সেটা কি ? যা মানুষকে কুকুরের চেয়ে উত্তম বানিয়ে দেয়। উত্তরে শায়েখ জামালুদ্দীন বললেন, ‘ইসলাম’। অতঃপর তিনি ইসলামের হাক্বীকত তুলে ধরলেন। তার আবেগপূর্ণ বর্ণনা শুনে শাহজাদ তাইমুরের দু’চোখ অশ্রুশিক্ত হয়ে উঠল। অতঃপর বললেন, ‘আমি এখন যুবরাজ সীমিত ক্ষমতার অধিকারী। আমি যখন শাহী সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হব,তখন আবশ্যই আপনি আমার কছে আসবেন তখন আমি ইসলাম গ্রহণ করব।
তাঁবু থেকে ফিরে এসে শায়েখ স্বীয় সুযোগ্য পুত্র আরশাদুদ্দীনকে উপরোক্ত ঘটনা পূর্ণ বিবরণ দিয়ে বললেন,যুবরাজ তাইমুর ক্ষমতাসীন হওয়ার আগে যদি আমার মৃত্যু হয়,তবে তুমি তাকে ইসলাম গ্রহণের ওয়াদার কথা অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দেবে। এই ওসিয়তের কিছুদিন পর শায়েখ জামালুদ্দীন ইন্তেকাল করেন। অন্যদিকে ১২৪৭ খিস্টাব্দে সর্বসম্মতিক্রমে তোগলোক তাইমুর খান মোঙ্গলিয়ার সম্রাট নিযুক্ত হন।আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানে মাধ্যমে তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। শায়েখ আরশাদুদ্দীন তাইমুরের ক্ষমতাসীন হওয়ার খবর পেয়েই ছুটলেন তার কৃত ওয়াদার কথা স্বরন করিয়ে দিতে। বেশ ক’দিন আপ্রাণ চেষ্টার করার পর সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাত করতে পারলেন না,কিন্তু তিনি নাছোড়বান্দা। এ গুরুদায়িত্ব যে তাকে পালন করতেই হবে।তাই তিনি প্রত্যেকদিন ফজরের সময় সম্রাটের প্রাসাদের কাছে উচ্চস্বরে আযান দিতে আরম্ভ করলেন। পরিশেষে একদিন আজানের শব্দে সম্রাটের ঘুম ভেঙ্গে যায়। অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে সম্রাট নির্দেশ দিলেন,এই লোকটাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এসো। প্রহরীরা শায়েখকে প্রসাদে আনার পর সম্রাট তার পরিচয় জানতে চাইলেন। জবাবে তিনি বললেন আমি সেই ব্যক্তির পুত্র,যাকে আপনি ইসলাম গ্রহণের ওয়াদা দিয়ে ছিলেন। আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন,আমি তার শেষ ইচ্ছানুযায়ী আপনার কৃতওয়াদা আপনাকে স্বরণ করিয়ে দিতে এসেছি। নিজের কৃত ওয়াদার কথা স্বরণ হতে দেরি হলোনা তাইমুরের। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাজদরবারে চলে এলেন। পরম শ্রদ্ধার সাথে শায়েখকে তার পাশে বসালেন। বললেন,আমি ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই অধীর আগ্রহে  আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি। এবার বলুন,আমাকে কি করতে হবে? শায়েখ তাকে পাক পবিত্র করে কালিমা পড়িয়ে ইসলামে দীক্ষিত করলেন। অতঃপর শায়েখের পরামর্শক্রমে সম্রাট ইসলামের দাওয়াতের কাজ আরম্ভ করলেন। একপর্যায়ে অনেক আমির ইসলামের সুশিতল ছায়াতলে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু জনৈক আমির এক বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণের পূর্বশর্ত হিসেবে বললেন , শায়েখ যদি আমর ব্যক্তিগত বীর ‘সাতগনী বকাকে’ পরাজিত করতে পারেন, তবে আমি ইসলাম গ্রহণ করব। সম্রাট শর্ত প্রত্যাহারের বারবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমির তার দাবীতে অটল। এমন অবস্থায় শায়েখ দাঁড়িয়ে বললেন,‘আমি আমিরের শর্ত গ্রহণ করলাম।’ শায়েখের কথা শুনে বৈঠকে নীরবতা ছেয়ে গেল। আমির আনন্দে আত্মহারা,পক্ষান্তরে সম্রাটের হৃদয় অজানা এক আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। আমিরের প্রস্তাবিত ‘সাতগনি বকা’ একজন শক্তিশালী এবং হিংস্র প্রকৃতির পালোয়ান। সম্রাট উব্দিগ্ন মনে ভাবলেন,শায়েখ এই বীর সম্পর্কে অবগত নন বিধায় চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছেন। তার মত একজন দূর্বল ব্যক্তি  এই শক্তিশালী পালোয়ানের সঙ্গে কিছুতেই  জয়ীহতে পারবেন না। তার পরাজয়ের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে ইসলামের পরাজয় হবে। রাজদরবারে শায়েখের চ্যালেঞ্জ গ্রহণের পর সম্রাটের অনুমতি দেয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিলনা। দেশব্যাপী বিখ্যাত সেই বীর এবং শায়েখের মধ্যেকার কুস্তির কথা তোড়জোড় করে প্রচার করা হল। আমির সাহেব এর প্রচারে সর্বশক্তি প্রয়োগ করলেন। কুস্তির জন্য নির্ধারিত হল বিশাল এক ময়দান। সব আমির- উমারা মন্ত্রী,এমপি কর্মকর্তা-কর্মচারী ময়দানে সমবেত। ওই আমীরও বীর সাতগনী বকাকে সঙ্গেনিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে,মঞ্চে উপস্থিহ হলেন। পর মুহূর্তে দেখা গেল আমিরের বীর বুক ফুলিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ময়দানে উপস্থিত। দেখতে যেন বিরাট এক হস্তী, অন্যপ্রান্ত থেকে এগিয়ে এলেন একজন দুর্বল শীর্ণকায় দরবেশ,দর্শকরা রুদ্ধশ্বাসে ময়দানে দিকে তাকিয়ে। উভয় যোদ্ধার মধ্যকার দূরত্ব
ক্রমেই কমে আসছে। চোখের পলকে শায়েখ আরশাদুদ্দীনের দেহ কিঞ্চিৎ আন্দোলিত হল। নিজের হাতদ্রুত প্রসারিত করে সাতগনী বকাকে একটি মাত্র চপেটাঘাত করলেন। এটাই ছিল মহাবীরের জন্য চুড়ান্ত ঔষধ তৎক্ষণাৎ বিশালদেহী এই বীর পুরুষ ধরাশয়ী হল। নও মুসলিমরা এই দৃশ্য দেখে গগনবিদারী স্লোগান আরম্ভ করলেন। কুফুর ও ইসলামের লড়াই মুহুর্তেই শেষ হল। ময়দানে দর্শক হিসেবে উপস্থিত মঙ্গোলীয় প্রজা শায়েখের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত করলেন। সন্ধ্যার আকাশের লালিমা মুছে যাওয়ার আগে একলাখ ষাট হাজার তাতারী ইসলাম গ্রহণ করে চিরদিনের তরে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে চলে এলেন। একজন মাত্র ব্যক্তির ঈমানীশক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে সমাধান হয়ে গেল ঐতিহাসিক বিরাট এক সমস্যা ,যে সমস্যা সমাধানে সব দৃশ্যমান মাধ্যম অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। তাতারীদের ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের সব চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র ইতি ঘটে। যে হিংস্র ও ভয়ানক তাতারীদের রুখতে পারেনি আব্বাসীয় খেলাফতের সামরিক শক্তি,তাদের পরাজিত করল একজন মরদে মু’মিনের ঈমানী শক্তি। বর্তমান বিশ্বমুসলিমের জন্য এ ঐতিহাসিক ঘটনায় রয়েছে বিরাট শিক্ষা। নিরস্ত্র,দুর্বল,শীর্ণকায় এক ঈমানদার ব্যক্তি বিশাল এক মহাবীরের বিরুদ্ধে জয়ী হয়ে,জয় করতে পারেন একটি সাম্রাজ্য;জন্ম দিতে পারেন একটি নতুন অজেয় জাতির।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন