বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। জন্মের পরে ডান কানে আজান ও বাম কানে ইকামতের
পরেই যে ভাষা শ্রবণ করি তা হলো, বাংলা ভাষা। তাই শিশুকালে
মায়ের মুখ থেকে শুনে শুনে একটি দুটি করে বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে শিখেছি। এ জন্য
আমরা বাংলা ভাষাকে মায়ের ভাষা বলি।
পৃথিবীতে বহু ভাষা
রয়েছে। আল্লাহতায়ালা মানুষকে ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। এ
প্রসঙ্গে তিনি কোরআনে কারিমে ইরশাদ করেন, ‘আর মহান
আল্লাহর নিদর্শসমূহের হতে (একটি নিদর্শন হলো) আসমান ও জমিন সৃষ্টি এবং মানুষের
ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা। এর মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য উপদেশ রয়েছে।’ -সূরা আর
রূম : ২২
বর্ণিত আয়াতে
আল্লাহতায়ালা পৃথিবীর মানুষের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতাকে তার একটি নিদর্শন বলে
আখ্যায়িত করেছেন। ভাষার জ্ঞান ও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনায় বক্তব্য উপস্থাপন করার যোগ্যতা
ও দক্ষতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুন্দর ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপন ও উত্তম বাচন
ভঙ্গিতে কথা বলতে অপারগতার কারণে হজরত মুসা (আ.) দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে ফেরাউনের
কাছে যাওয়ার সময় সুন্দর ভাষা ও হৃদয়গ্রাহী কথা-বার্তায় পারঙ্গম স্বীয় ভাই হজরত
হারুনকে (আ.) নিজের সঙ্গি করার জন্য আল্লাহর নিকট আবেদন জনিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার ভাই হারূন, তিনি আমার থেকে অনেক বেশি
প্রাঞ্জল ভাষী। তাই আপনি তাকে আমার সহযোগী করে প্রেরণ করুন; যাতে সে আমাকে (দাওয়াতের ক্ষেত্রে তার প্রাঞ্জল ভাষার
দ্বারা) সত্যায়িত করে। কেননা আমি আশঙ্কা করছি (আমার বক্তব্য সত্য হওয়া সত্বেও)
তারা আমাকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করবে।’ -সূরা কাসাস : ৩৪
মানুষের হেদায়েতের
জন্য আল্লাহতায়ালা পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন, তাদের প্রত্যেককেই তাদের মাতৃভাষায় বা স্বগোত্রীয় ভাষায়
প্রেরণ করেছেন। যাতে তারা তাদের জাতিকে সুস্পষ্ট ভাষায় আল্লাহর হুকুম বা বিধান
বুঝাতে পারেন এবং মানুষও নবী-রাসূলের ভাষা বুঝে আমল করতে পারে। এ জন্য
আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক নবীর কিতাবকে তার ভাষাতেই অবতীর্ণ করেছেন। যেমন, হজরত মুসা (আ.)-এর ওপর তাওরাত অবতীর্ণ করেছেন হিব্রু ভাষায়, হজরত দাউদ (আ.)-এর ওপর যবুর অবতীর্ণ করেছেন ইউনানি ভাষায়, আর হজরত ঈসা (আ.)-এর ওপর ইঞ্জিল অবতীর্ণ করেছেন সুরিয়ানি
ভাষায়।
সমগ্র জাতির
হেদায়েতের পথপ্রদর্শক শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)। তার প্রদর্শিত পথেই রয়েছে
দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় কল্যাণ। তার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ
গ্রন্থ কোরআনে কারিম। আর এ কোরআনের ভাষাও আরবি। এ প্রসঙ্গে কোরআনে কারিমে ইরশাদ
হয়েছে, ‘আমি প্রত্যেক নবীকেই তার নিজ নিজ জাতির
ভাষায় প্রেরণ করেছি; যেন তিনি তাদেরকে
সুস্পষ্টভাবে বুঝাতে পারেন।’ -সূরা ইবরাহিম : ০৪
বাংলাকে মাতৃভাষা
করার দাবীতে এদেশের সাহসী যুবকেরা রক্ত ঝরিয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে আর কোনো জাতি
ভাষার জন্য প্রাণ দেয়নি।
একদিকে
কোরআন-হাদিসের মাধ্যমে মাতৃভাষার গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে, অন্যদিকে জব্বার, রফিক, সালাম ও বরকতের মতো সাহসি মানুষের আত্মত্যাগের মাধ্যমে
বাংলা ভাষার আলোকোজ্জ্বল সূর্য পৃথিবীর আকাশে উদিত হয়েছে।
রক্ত দিয়ে কেনা এই
বাংলা ভাষা কিন্তু তার কাঙ্খিত গন্তব্যে যেতে পারেনি। বর্তমান সময়ের বাংলা চর্চা ও
ব্যবহারের করুণ অবস্থা দেখলে এর সত্যতা মেলে। প্রাণের ভাষা বাংলার সঙ্গে ভিনদেশি
ভাষার সংমিশ্রণের আধিক্য দিন দিন শুধু বাড়ছে। যা প্রত্যাশিত নয়। বিষয়টির প্রতি
যথাযথ দায়িত্বশীলরা নজর দিবেন বলে আশা রইল।
লেখক : প্রিন্সিপাল ও মুহাদ্দিস, জামিআ রশীদিয়া এনায়েতুল উলুম, দক্ষিণখান, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন