রবার্ট মুগাবের আকস্মিক প্রস্থানে আবারও বিশ্ববাসী দেখল, ইতিহাসের পাঠ থেকে শিক্ষা না নিলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। উন্নয়নশীল দেশের মানুষ আরেকবার উনিশ শতকের ইংরেজ কবি রবার্ট ব্রাউনিংয়ের জনপ্রিয় ‘প্যাট্রিয়ট’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি ‘দাজ আই এন্টার্ড অ্যান্ড দাজ আই গো’ উচ্চারণ করবেন। কবি দেশপ্রেমিক নগরীতে পুষ্পবর্ষণের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু পরে কর্মদোষে তাঁকে ইষ্টক বর্ষণের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে যেতে হয়েছিল। জিম্বাবুয়ের ষাট ও সত্তর দশকের বর্ণাঢ্য স্বাধীনতাসংগ্রামের একদা নন্দিত নায়ক রবার্ট মুগাবে, যিনি ধীরে ধীরে নিজেকে স্বৈরশাসকে পরিণত করেছিলেন, তাঁর দুঃখজনক অথচ প্রত্যাশিত পতন ঘটেছে।
এটা দেখার বিষয় যে যথাসময়ে যথোচিত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে ব্যক্তি শুধু নয়, প্রতিষ্ঠান হিসেবে দলকেও লজ্জাজনক খেসারত দিতে হয়। জিম্বাবুয়ের ক্ষমতাসীন দল তাদেরই সৃষ্টি করা স্বৈরশাসককে সরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে অক্ষমতার পরিচয় দিয়েছিল। সেই ঘাটতি পূরণ করেছে সামরিক বাহিনী। মুগাবের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অভ্যুত্থানের পরই কেবল ক্ষমতাসীন দলটি তাদের তিন দশকের অবিসংবাদিত নেতাকে বহিষ্কার করেছে এবং পদত্যাগ না করলে তাঁকে অভিশংসনের হুমকি দিয়েছিল।
মুগাবের এই করুণ পরিণতি তাঁর সতীর্থ মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনতার কাছে নিশ্চয় একদিন অচিন্তনীয় ছিল। কিন্তু গণতন্ত্রের মাথা খেয়ে মুগাবে নিজেকে ‘অপরিহার্য’ তৈরি করেছিলেন। ক্ষমতার দর্পে ও নেশায় তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি তাঁর দলের লোকের স্তুতি ও চাটুকারিতায় আচ্ছন্ন ছিলেন। বুঝতেই পারেননি যে দলের কাছে কবে তিনি বোঝায় পরিণত হয়েছেন।
জীবনসায়াহ্নে মুগাবে ক্ষমতাভোগের উত্তরাধিকার একতরফাভাবে নির্দিষ্ট করতে গিয়ে অঙ্কে গরমিল করে ফেলেছিলেন। ৯৩ বছর বয়সী মুগাবের দৃশ্যত শেষ ভুল ছিল ক্ষমতার উত্তরাধিকার নির্বাচন। তিনি তাঁর স্ত্রী গ্রেসকে তাঁর স্থানে কল্পনা করেছিলেন। তাই দেশটির ভাইস প্রেসিডেন্ট এমারসন, যিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক প্রধান এবং সামরিক বাহিনীতে জনপ্রিয়, তাঁকে তিনি বহিষ্কার করেছিলেন। এই সিদ্ধান্তই তাঁর জন্য কাল হয়।
আমরা আশা করব, দেশটির সামরিক বাহিনী গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে ক্রান্তিকাল অতিক্রমে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবে। কারণ, নির্বাচিত স্বৈরশাসকের পরিবর্তে সামরিক স্বৈরশাসন কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানকার গণতন্ত্রকামী জনগণও তা বরদাশত করবে না। তবে মনে হচ্ছে দেশটিকে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে। কারণ, এমারসন কতটা কর্তৃত্বপরায়ণমুক্ত হবেন, তা পরিষ্কার নয়। তবে ইতিহাসের শিক্ষা বিবেচনায় নিয়ে গণতন্ত্র ও জনগণের ইচ্ছার প্রতি দেশটির নতুন শাসকগোষ্ঠী সম্মান দেখাবে, সেটাই প্রত্যাশিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন