মুহাম্মদ নোমান
কায়রো, মিসর
মিসরে চলছে তখন শক্তিশালী অটোমান গভর্নর মুহাম্মাদ আলী পাশার শাসন। ১৮১১ ইংরেজির ১লা মার্চের রাত। কায়রোর সালাহুদ্দীন আইয়ুবীর কেল্লায় জড়ো হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ মামলুক আমীর। তাঁরা এসেছেন দক্ষিন মিসরের সায়ীদ অঞ্চল থেকে স্বয়ং গভর্নর মুহাম্মাদ আলী পাশার দাওয়াতে। হেজাজের ওয়াহাবী বিদ্রোহ দমন করার জন্য অটোমান সুলতানের পক্ষ থেকে মুহাম্মাদ আলীর প্রতি কড়া নির্দেশ আসে। তাই তিনি তাঁর ছেলে ইব্রাহীম পাশার নেতৃত্বে একটি বিশাল সেনাবাহিনী পাঠাচ্ছেন হেজাজ অভিমুখে ওয়াহাবীদেরকে শায়েস্তা করার জন্য। তখন তৎকালীন রীতি অনুযায়ী সেনাবিহিনিকে বিদায় জানানোর জন্য একটি বিশাল নৈশভোজ এবং পরামর্শ সভার আয়োজন করা হয়। নৈশভোজের অন্যতম অথিতি হয়ে এসেছেন মামলুক আমিরগণ। ভোজনপর্ব শেষ হওয়ার সাথে সাথে হঠাত কেল্লার সবগুলো ফটক বন্ধ হয়ে যায়। মশালগুলো সব ধপ করে নিভে যায়। কেল্লার চারিদিক থেকে বিশালকায় কামানগুলো সব এক সাথে গর্জে উঠে। আমীরদের লক্ষ্য করে চলে একনাগাড়ে কামানের অগ্নিবর্ষণ। কামানের গর্জন যখন বন্ধ হয় তখন সেখানে নড়াচড়া করার মতো কোন আমীর তখন আর অবশিষ্ট ছিল না। ৪০০ থেকে ৫০০ মামলুক আমীরকে চোখের পলকে হত্যা করা হয়। ইতিহাসে এই ঘটনা “মাজবাহাতুল কিলআ” বা “কেল্লার গণহত্যা” নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
কেন মুহাম্মাদ আলী এমন নির্দয় কাজটি করলেন এবং তাঁর এই কাজটি কি ঠিক হয়েছে, না হয়নি? – এ ব্যাপারে ঐতিহাসিক বিতর্ক কখনোই শেষ হয়নি। সংক্ষেপে যেটা বলা যায় সেটা হচ্ছে-
১২৫০ ইং থেকে নিয়ে ১৫১৭ ইং পর্যন্ত ২৬৭ বছর মামলুকরা মিশর শাসন করে। ইসলামের ইতিহাসে মামলুকদের অবদান দু কলমে লিখে শেষ করা যাবেনা। আইনজালুতের যুদ্ধে মোঙ্গলদেরকে পরাজিত করে ইসলামী সালতানাতকে রক্ষা করা, ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে বাইবারস-কালাউনের আমরণ লড়াই এবং কালাউন-পুত্র সুলতান আল আশরাফ কর্তৃক আক্কা বিজয়ের মাধ্যমে শাম থেকে ক্রুসেডারদেরকে তাদের সর্বশেষ ঘাঁটি থেকে বিতাড়ন করে ২০০ বছরের অভিশপ্ত ক্রুসেড-যুদ্ধের ইতি টানা সহ অসংখ্য মহৎ কাজের জন্য তাঁরা ইসলামের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু অন্যান্য সালতানাতের মতোই মামলুক সালতানাত শেষের দিকে এসে তার আগের জৌলুস ধরে রাখতে পারেনি। দুর্নীতি, আত্মকলহ, বুজদিলীসহ পতনের যাবতীয় উপসর্গ ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে। মামলুকদের এই দুর্বলতার সুযোগ নিতে চায় পর্তুগিজ আর ইরানের সাফাবীরা। পর্তুগীজদের হাতে যেকোনো সময় মিসরের পতন হতে পারে এমন সম্ভাবনা দেখা দেয়। তখন বাধ্য হয়ে অটোমান সুলতান প্রথম সেলিম মামলুকদের হাত থেকে শাম, হেজাজ এবং মিসর দখল করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৫১৬ ইং তে আলেপ্পোর নিকটবর্তি “মারাজ দাবেক” এলাকায় মামলুক এবং অটোমানদের মধ্যে বিশাল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এটি “মারাজ দাবেক”এর যুদ্ধ নামে ইতিহাসে প্রিসিদ্ধি লাভ করে। যুদ্ধে মামলুকরা পরাজিত হয়। স্বয়ং মামলুক সুলতান আল-ঘুরী নিহত হন। এর পর ১৫১৭ ইং তে কায়রোর আব্বাসিয়া এলাকায় “রিদানিয়া”র যুদ্ধে মামলুকদেরকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে সুলতান সেলিম মিসর বিজয় করেন।
অটোমানদের হাতে মামলুক সালতানাতের পতন হওয়ার কারণে অটোমানরা মামলুকদের চিরশত্রু হয়ে উঠে। যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মামলুক আমীর ওমরাগন দক্ষিন মিসরে পালিয়ে যায় এবং সেখান থেকে অটোমানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ অব্যাহত রাখে। অটোমানরাও খুব শক্ত হাতে তাদের সকল বিদ্রুহ দমন করতো। কিন্তু তারা তাতে ক্ষ্যান্ত হতো না। পুনরায় বিদ্রোহ করে বসতো। এমনকি এক পর্যায়ে মামলুকদের এসব বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে ১৭৯৮ ইং তে নেপোলিয়ান মিসর দখল করে বসে। পরে অবশ্য এংলো-অটোমান শক্তির হাতে পরাস্ত হয়ে ১৮০১ সালে নেপলিয়ানকে মিসর ছাড়তে হয়। এর পর মিসরের ক্ষমতায় আসে অটোমান গভর্নর মুহাম্মাদ আলী পাশা। তিনি ক্ষমতায় এসেই মামলুকদের ঝামেলা থেকে চিরতরে মিসরকে মুক্ত করার পরিকল্পনা করতে থাকেন। হেজাজে সেনাবাহিনী প্রেরণের ঘটনা তাঁর জন্য সেই সুযোগ বয়ে আনে। নেতৃত্বস্থানীয় সকল মামলুক ওমারাকে নিমন্ত্রন করে নিয়ে এসে এক সাথে হত্যা করে। এই ঘটনার পক্ষে এবং বিপক্ষে দুদিকেই যুক্তি আছে। কেউ বলে- এটি একটি গণহত্যা এবং ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বেইমানী। আবার কেউ বলে- এই একটি গণহত্যা মিসরকে পরবর্তী ১০০ বছর পর্যন্ত স্থিতিশীল রাখে।
#দুই.
গতরাতে এ ধরণের আরেকটি ঘটনা ঘটে সৌদী রাজপরিবারে। যা ঘটেছে তাকে রাজনৈতিক সুনামিই বলতে হয়। হঠাৎ এক রাজকীয় নির্দেশে সৌদি আরবে গ্রেফতার করা হয় এক বর্ণনামতে ১১ জন, সৌদি আরবের জনপ্রিয় টুইটার এডমিন ‘মুজতাহিদে’র তথ্যমতে ১৮ জন আমীরকে। গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে আছেন ৩৮ জনের মতো বর্তমান এবং সাবেক মন্ত্রী-আমলা, ব্যাবসায়ী এবং কয়েকটি প্রভাবশালী টিভি চ্যানেলের মালিক। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হচ্ছে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে ওয়ালীদ বিন তালাল, তুর্কি বিন আব্দুল্লাহ, মুত’ইব বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ তুয়াইজিরীসহ সৌদি রাজ পরিবারের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী আমীর। সরকারীভাবে যেটা ঘোষণা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে- দুর্নীতি, জালিয়াতি, আত্মসাৎ ইত্যাদি কারণে এদেরকে গ্রাফতার করা হয়েছে। স্বৈরতান্ত্রিক সরকারগুলোর হাতে তো এসব অভিযোগের লিস্ট আগে থেকেই তৈরি থাকে। বাকী থাকে শুধু অভিযুক্ত ব্যাক্তির নামটা বসিয়ে দেয়া। এজন্য কেউ সৌদি আরবের সরকারী বক্তব্যকে কানে তুলছেনা।
তাহলে এতবড় একটি সিদ্ধান্ত নেয়ার কারন কি হতে পারে? সম্ভাব্য কারণগুলোর মধ্যে থাকতে পারে-
১. সৌদি আরবে চলছে এখন মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট। তেলের মূল্যহ্রাস, ইয়েমেন যুদ্ধ, আমেরিকার সাথে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি, কাতারের সাথে অপ্রয়োজনীয় ঝামেলায় জড়ানো- এসব কারণে সৌদি অর্থনীতি এখন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। দেশটির রিজার্ভ ফান্ড দ্রুত সঙ্কুচিত হচ্ছে। নতুন যুবরাজ নিজেকে সুপারম্যান প্রমাণ করতে গিয়ে দেশটাকে আরও খাদের কিনারায় নিয়ে গেছেন। এই সংকট থেকে মুক্তি লাভের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন- যা বর্তমানে সৌদি রিজার্ভ ফান্ডে নাই। অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা করাই “গ্রেফতার অভিযানটি”র অন্যতম লক্ষ্য হতে পারে। হাফিংটন পোষ্টের তথ্যমতে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে প্রায় ২ ট্রিলিয়ন সৌদী রিয়াল।
২. বাদশা সালমান ক্ষমতায় আসার পর সকল মতের মানুষের মধ্যে একটি আশা জেগেছিল। হয়তো তিনি পূর্ববর্তী শাসকগণের আত্মঘাতী কাজগুলোর অন্তত পুনরাবৃত্তি করবেন না। কিন্তু তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ সবাইকে হতাশ করে। স্বৈরাচারী মনোভাবের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে নজিরবিহীনভাবে একের পর এক ক্রাউন প্রিন্সদেরকে বরখাস্ত করে নিজের অনভিজ্ঞ সন্তানকে ক্রাউন প্রিন্স নিয়োগ দেন। নামে ক্রাউন প্রিন্স হলেও তার হাতেই রাষ্ট্রের গোটা নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দেন। এসব কারণে সৌদি রাজপরিবারে শুরু হয় চরম অসন্তোষ। চাপা ক্ষোভ। মুহাম্মাদ বিন নায়েফকে বরখাস্ত করে চরমভাবে অপমানিত করে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। উইকিলিক্সের ফাঁস করা তথ্য মতে প্রিন্স ওয়ালীদ বিন তালাল মুহাম্মাদ বিন নায়েফকে মুক্তি না দিলে চরম ব্যাবস্থা নিবেন বলে হুমকি দেন। মুত’ইব এবং তুওয়াইজিরী তো সালমানের হাতে ক্ষমতা না দেয়ার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিল। সে হিসেবে তাদের প্রতি আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল। জাতীয় নিরাপত্তাবাহিনীর প্রধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় সাবেক বাদশাহ আব্দুল্লাহ-পুত্র মুত’ইবকে রেখে সালমান এবং তাঁর পুত্রের ঘুম না আসারই কথা। তো সব মিলিয়ে এটি একটি প্রাসদ ক্যু হতে পারে। সম্ভাব্য ক্যু ঠেকানোর জন্য আগাম আক্রমণ হিসেবে ধরে নেয়া যায়।
৩. স্বৈরচারী, ব্যর্থ এবং ক্রিড়নক শাসকদের চরিত্র হচ্ছে তারা সবসময় ২ টি কাজ করে। ১. নামসর্বস্ব দেশ প্রেমের নামে জাতির মধ্যে চরম উম্মাদনা সৃষ্টি করে এবং লোকদেখানো বিজয়কীর্তি প্রচার করে নিজেদেরকে জাতির সামনে একক এবং বিকল্পহীন নেতা হিসেবে তুলে ধরে। সালমানের এবং তাঁর পুত্রের ইয়েমেন যুদ্ধ, কাতার অবরোধ, পরিকল্পিত শিল্পনগরী “নিউম” গড়ার ঘোষণা- এসব এই ক্যাটাগরিতে পড়ে। ২. তাদের টিকে থাকার জন্য সবসময় একজন প্রতিপক্ষের দরকার হয়। আসল প্রতিপক্ষকে তো বহু আগেই সরিয়ে দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে কিছু টিকে থাকার তাগিদে নিজেরাই কিছু কাগুজে বাঘ তৈরি করে এবং এগুলোর বিরুদ্ধে অবিরাম যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। উদ্দেশ্য একটাই- জাতির দৃষ্টিকে তাদের প্রকৃত সমস্যা থেকে ফিরিয়ে এসব ফলস চ্যালাঞ্জের দিকে ঘুরিয়ে দেয়া এবং নিজেদেরকে এই কল্পিত শত্রুর মোকাবেলায় বীর বাহাদুর হিসেবে প্রচার করে মসনদ টিকিয়ে রাখা। ইরানের জুজুর ভয় দেখানো, হোথীদের বিরুদ্ধে লড়াই এই ক্যাটাগরির মধ্যে পড়ে। গতকালের গ্রেফতার অভিযান এই নীতির আরেকটি স্পষ্ট বাস্তবায়ন। উদ্দ্যেশ্য একটাই- সৌদি জনগণকে এই ম্যাসেজ দেয়া যে, আমি আর আমার ছেলে তো জান-জীবন দিয়ে তোমাদের জন্য লড়াই করছি। কিন্তু রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সংকট, বেকার সমস্যা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি- এগুলোর জন্য এই দুর্নীতিবাজরাই দায়ী। তাই তোমাদের স্বার্থে আমরা এদের বিচার করতেছি। তারপর দেখবেন সৌদি আরবের মিডিয়া নামক গোলামী-সংস্কৃতির প্রচারমাধ্যমগুলোতে একটি বানীই প্রচার হচ্ছে- “দুর্নীতি নিপাত যাক! বাদশাহ সালমান দীর্ঘজীবী হোক!” এবং টুইটারে হ্যাশট্যাগের বন্যা বয়ে যাচ্ছে- “ #সালমান_আলহাজম”।
মুহাম্মাদ আলী পাশা তো টিকে গিয়েছিলেন তাঁর জুয়াতে। কেল্লার গণহত্যার বদৌলতে তাঁর খান্দানরা এরপর ১৫০ বছর মিসর শাসন করতে পেরেছিল। সালমান কি তাঁর এই জুয়াতে সফল হবেন? “রিয়াদের গণহত্যা” (রুপক অর্থে) কি তাঁর সন্তানের পথকে শত্রুমুক্ত করতে পারবে? উত্তর সময়ের হাতেই।
.
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন