লেখকঃ মুহাম্মদ আমীন সফদর রহঃ
অনুবাদ– লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
প্রিয় পাঠকেরা! এই দুনিয়ার মাঝে অনেক ধর্ম পাওয়া যায়, কিন্তু এর মাঝে সত্য ধর্ম শুধু ইসলামই। আল্লাহ তায়ালা বলেন-নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালার কাছে মনোনিত ধর্ম হল ইসলাম (সূরা আলে ইমরান-১৯) “
.
আর যারা ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম চায় তা কখনো গ্রহণীয় হবেনা। আর সে আখেরাতে হবে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত”। (সূরা বাকারা-৮৫)
.
এমনিভাবে মুসলমানদের মাঝে বেশ কিছু ফিরক্বা পাওয়া যায়। কিন্তু তাদের মাঝে নাজাত পাবে শুধু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত।
.
রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-“নাজাতপ্রাপ্ত হবে তারা, যারা আমার এবং সাহাবাদের মত ও পথে থাকবে” ( তিরমীজী শরীফ, হাদিস নং-২৬৪১)
.
তিনি আরো বলেন-“আমার এবং আমার খুলাফায়ে রাশেদীনদের সুন্নত অবশ্যই আঁকড়ে ধর” (তিরমিজী শরীফ)
.
নবীজী আরো ইরশাদ করেন-“যে আমার সুন্নাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল সে আমার থেকে নয়” (বুখারী শরীফ-হাদিস নং-৪৭৭৬)
.
আর এক বর্ণনায় নবীজী সাঃ তার সুন্নাত পরিত্যাগকারীকে বলেছেন অভিশপ্ত (মিশকাত শরীফ) আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ছাড়া বাকি দলকে জাহান্নামী বলেছেন নবীজী সাঃ (তিরমীজী শরীফ, হাদিস নং-২৬৪১)
.
হযরত আবু সাঈদ খুদরী রাঃ বলেন-যখন নবীজী সাঃ এর কাছে আয়াতে কারীমা- ﻳﻮﻡ ﺗﺒﻴﺾ ﻭﺟﻮﻩ এর তাফসীর জিজ্ঞেস করা হল, তখন নবীজী সা. ইরশাদ করেন-“যাদের চেহারা কিয়ামতের দিন আলোকিত হবে তারা হল “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত”। আর আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাঃ ও এরকম ইরশাদ করেছেন (আদ দুররুল মানসুর-২/৬৩)
.
নবীজী সাঃ আরো বলেন- “হাসান রাঃ এবং হুসাইন রাঃ আহলে সুন্নাতের চোখের শীতলতা”।(আল কামিল লি ইবনে আছীর-৪/৬২)
.
ব্যাখ্যা
.
নবীজী সাঃ বলেন-আমার উম্মতের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। এ দু’টিকে মজবুতভাবে আঁকড়ে রাখলে তোমরা পথভ্রষ্ট হবেনা, আল্লাহ তায়ালার কিতাব, এবং আমার সুন্নাত (মুয়াত্তা মালিক-হাদিস নং-৭০২)
.
কুরআনে কারীম আল্লাহ তায়ালার সর্বশেষ এবং পূর্ণাঙ্গ কিতাব। যা সর্ব প্রকার সন্দেহ থেকে পবিত্র। তা শাব্দীক ইলহাম তথা ওহীয়ে মাতলু’।
.
আর নবীজী সা. এই কিতাবের উপর খোদ আল্লাহ তায়ালার বুঝানো হিসেবে তিনি যে আমলী নমুনা আমাদের সামনে পেশ করেছেন তাই হল সুন্নাত। আর এতে আহলে সুন্নাত এর অর্থটাও বুঝে এসে গেল। অর্থাৎ যারা কুরআন পাকের উপর নিজের সিদ্ধান্ত নয় বরং রাসূল সা. এর আমলী নমুনা সামনে রেখে আমল করে তাদেরকেই বলা হয় “আহলে সুন্নাত”। কেননা শব্দটা কুরআনের আর আমলের নমুনা হল নবীজী সা. এর। আর এইতো সুন্নাত!
.
ওয়াল জামা’আত
.
যেমন কুরআনে কারীম সহীহভাবে বুঝার জন্য কেবল আরবী ভাষাই যথেষ্ট নয়। বরং নবীজী সা. এর আমলী জীবনই হল এর সহীহ তাফসীর।
রাসূল সা. আগত উম্মতদের জন্য সাহাবায়ে কিরামের একটি বিরাট দল তৈরী করলেন, যারা তাঁর তত্বাবধানে তাঁরই সুন্নাতের আমল করেছেন। আর পরবর্তী আগত উম্মতের জন্য তারা সুন্নাতের আমলী নমুনা হলেন। তারা শুধু নবীর নিগারানীতেই তৈরী হননি, বরং আল্লাহ তায়ালাও তাদের পূর্ণাঙ্গ তত্বাবধায়ন করেছেন। সাথে সাথে ﺭﺿﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻨﻬﻢ ﻭﺭﺿﻮ ﻋﻨﻪ (আল্লাহ তায়ালা তাদের উপর সন্তুষ্ট এবং তারাও আল্লাহ তায়ালার উপর সন্তুষ্ট।) সার্টিফিকেটও আল্লাহ তায়ালা দিলেন।
.
নবীজী সা. তাগীদের সাথে হুকুম করেছেন-ﻋﻠﻴﻜﻢ ﺑﺎﻟﺠﻤﺎﻋﺔ
.
এই জামাআতকে দৃঢ়তার সাথে আঁকড়ে ধর। নবীজী সা. জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিকে শয়তানের লোকমা বলেছেন। আর ঐ বকরীর সাথে তুলনা করেছেন- যে রাখালের নিয়ন্ত্রণ এবং বকরীর পাল থেকে বেরিয়ে কোন নেকড়ের শিকারে পরিণত হয়েছে। (মুসনাদে আহমাদ)
.
শায়েখ ইবনে তাইমিয়া র. বলেন-
.
ﻓﺎﻫﻞ ﺍﻟﺴﻨﺔ ﻭﺍﻟﺠﻤﺎﻋﺔ ﻫﻢ ﺍﻟﻤﺘﺒﻌﻮﻥ ﻟﻠﻨﺺ ﻭﺍﻹﺟﻤﺎﻉ
.
অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হল ঐ সকল লোক-যারা কুরআন সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মতের অনুসরণ করে (আল মানহাজুস সুন্নাহ-৩/২৭২)
.
দ্বীন পূর্ণাঙ্গকরণ
.
আল্লাহ তায়ালা তাঁর শেষ এবং এবং পূর্ণাঙ্গ কিতাবের মাঝে দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতার ঘোষণা দিয়েছেন-
.
ﺍﻟْﻴَﻮْﻡَ ﺃَﻛْﻤَﻠْﺖُ ﻟَﻜُﻢْ ﺩِﻳﻨَﻜُﻢْ ﻭَﺃَﺗْﻤَﻤْﺖُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢْ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻲ ﻭَﺭَﺿِﻴﺖُ ﻟَﻜُﻢُ ﺍﻹِﺳْﻼﻡَ ﺩِﻳﻨﺎً [ ﺍﻟﻤﺎﺋﺪﺓ 3: ]
.
অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, আর তোমাদের উপর আমার নিয়ামতকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম। আর তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে নির্বাচিত করলাম ইসলামকে।(সূরা মায়িদা-৩)
.
দ্বীন শক্তিশালীকরণ
.
রাসূল সাঃ যেই পূর্ণাঙ্গ দ্বীনে ইসলাম নিয়ে এসেছেন গোটা পৃথিবীর জন্য। আরবে তা নবীজী সা. এর জীবদ্দশায়ই পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে। বাকি অনারবে নবীজীর সাহাবা যারা নবীজীর সুন্নাতের নমুনা ছিলেন তাদের দ্বারা তা বিকাশ লাভ করে। একথার সুসংবাদতো খোদ কুরআনে কারীমেই বিদ্যমান-“আল্লাহ তায়ালা ওয়াদা করেছেন ঐ সকল লোকদের জন্য যারা তোমাদের মাঝে ঈমান আনে এবং সৎকর্ম করে, তাদের পৃথিবীতে খলীফা বানাবো, যেমন তাদের পূর্ববর্তীদের বানিয়েছি। এবং তাদের জন্য নির্বাচিত দ্বীনকে তাদের জন্য দৃঢ় করে দিব। আর তাদের জন্য ভীতিকে নিরাপত্তা দিয়ে পাল্টে দিব। তারা আমার ইবাদত করবে। আমার সাথে কারো শরীক করবেনা। তারপরও যারা কুফরী করবে তারাই নাফরমান”। (সূরা নূর-৫৫)
.
সুতরাং যেই দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা হুজুর সা. উপর হয়েছিল তা সাহাবায়ে কিরামের মেহনত এবং চেষ্টায় দুনিয়ায় মজবুতির সাথে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটাই পবিত্র জামাআত, যাদের সুন্দর উল্লেখ্যতা আমাদের নামের মাঝে জামাআত নামে চলে এসেছে। আহলে সুন্নাত ছাড়া কোন আহলে বিদআতের নাম না ওয়াল জামাআত, না এর দ্বারা সাহাবাদের জামাআত উদ্দেশ্য।
.
দ্বীনি বিষয় সংকলন
.
কুরআনে কারীমের পূর্ণাঙ্গ আমলী ব্যাখ্যা সুন্নাত। এই সুন্নাতের পূর্ণাঙ্গ আমলী নমুনা সাহাবায়ে কিরাম ছিলেন, যারা নবীজী সা. এর তত্বাবধানে তৈরী হয়েছিলেন। তাদের মাধ্যমে নবীজী সা. এর সুন্নাত দুনিয়ায় বিকাশ লাভ করেছে। নবীজী সা. হেদায়াতের সূর্য ছিলেন। আর তাঁর সাহাবারা রা. ছিলেন তারকার মত। তাদের মাধ্যমে দুনিয়াজুড়ে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে। এই সকল পবিত্রাত্মাদের জীবন জিহাদে অতিবাহিত হয়েছে। তাদের এই সুযোগ ছিলনা যে, তারা নবীজীর সুন্নাতকে সাজানো গোছানোভাবে সন্নিবিষ্ট করবেন। কিন্তু এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, যে দ্বীন কিয়ামত পর্যন্তের জন্য এল। তার সহজ এবং সাধারণ্যের বুঝার অনুকূল করে সাজিয়ে পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যাসহ একত্রিত করে দেয়া হবে। যেন কিয়ামত পর্যন্ত মুসলমানরা এ থেকে তাদের প্রিয় নবীজী সা. এর সুন্নাতের উপর সহজে আমল করতে পারে। এই কারণে এই মহান কর্ম সাহাবায়ে কিরামের শেষ জমানায় শুরু হয়। আর সংকলনের প্রথম পদক্ষেপ সাইয়্যিদুনা ইমামে আজম নু’মান বিন সাবেত আবু হানীফা কুফী রহ. গ্রহণ করেন। এটির সুসংবাদও কুরআনে কারীম এবং হাদিসে বিদ্যমান।
.
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন-“তোমরা শুন! তোমাদের আল্লাহর পথে খরচ করার জন্য আহবান করা হচ্ছে, তোমাদের মাঝে কিছু লোক এমন আছে যারা কৃপণতা করে, আর যারা কৃপণতা করে, তারা মূলত নিজের সাথেই কৃপণতা করে। আল্লাহ তায়ালাতো অমুখাপেক্ষি, তোমরাই মুখাপেক্ষি, সুতরাং তোমরা যদি মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহলে তোমাদের বদলে অন্য এক জাতিকে নিয়ে আসবেন। তারা তোমাদের মত হবেনা”। (সূরা মুহাম্মদ-৩৮)
.
আল্লামা উসমানী রহ বলেন-“অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালা যেই হিকমত এবং উপকারিতার জন্য বান্দাদের খরচ করার হুকুম দিয়েছেন তা অর্জিত হওয়া তোমাদের উপর নির্ভরশীল নয়। যদি এমন হয় যে, তোমরা কৃপণতা করবে, আর তার আদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তাহলে তিনি তোমাদের স্থানে অন্য এক জাতিকে দাঁড় করিয়ে দিবেন, যারা তোমাদের মত কৃপণ হবেনা। বরং অনেক আনন্দের সাথেই আল্লাহ তায়ালার আদেশ পালন করবে। আর তার রাস্তায় খরচ করবে। যেভাবেই হোক আল্লাহ তায়ালার হিকমত এবং উপকারিতাতো পূর্ণ হবেই কিন্তু এই সৌভাগ্য থেকে তোমরা হবে বঞ্চিত।
.
হাদিসের মধ্যে এসেছে সাহাবায়ে কিরাম প্রশ্ন করলেন-“হে আল্লাহর রাসূল! দ্বিতীয় জাতি কারা হবে...? যাদের দিকে ইঙ্গিত করা হল...?” নবীজী সা. হযরত সালমান ফারসী রা. এর উপর হাত রেখে বললেন-“ তাঁর জাতি” আর বললেন-“আল্লাহর কসম! যদি ঈমান সুরাইয়া নক্ষত্র পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে তাহলে পারস্যের লোকেরা তা সেখান থেকেও নামিয়ে নিয়ে আসবে”। (বুখারী শরীফ-হাদিস নং-৪৩১৫ মুসলিম শরীফ-হাদিস নং-৬৬৬২)
.
আলহামদুলিল্লাহ! সাহাবায়ে কিরাম এরকম নজীরবিহীন কর্মতৎপরতা আর ঈমানের জোশ দেখিয়েছেন যে, তাদের স্থলে অন্যদের রাখার সুযোগই হয়নি। এমনকি পারস্যবাসী ইসলামে প্রবিষ্ট হয়ে ইলম ও ঈমানের শানদার প্রকাশ করেছেন। আর এমন জবরদস্ত দ্বীনী খিদমাত করেছেন যে, যা দেখে যে কেউ চিন্তা ছাড়াই স্বীকার করবে যে, নিশ্চয় হুজুর সা. এর ভবিষ্যতবাণীর তারাই ছিলেন উদ্দেশ্য। যারা প্রয়োজনের সময় আরবের স্থলাভিষিক্ত হতে পারতেন। হাজারো উলামায়ে কিরাম ও আইয়িম্মায়ে কিরামের দিকে না তাকিয়েও শুধু ইমাম আবু হানীফা রহ. এর বিদ্যমানতাই এই ভবিষ্যতবাণীর সত্যতার জন্য যথেষ্ঠ। বরং মহান ভবিষ্যতবাণীর পূর্ণাঙ্গ এবং প্রথম মিসদাক হযরত আবু হানীফা রহ.।
.
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা স্বাক্ষ্যরতাহীন (আহলে আরব) ব্যক্তিদের উল্লেখের পর ইরশাদ করেন-“আর নবীকে পাঠানো হয়েছে দ্বিতীয় আরেকটি জাতির জন্য যারা এখনো তার সাথে একত্র হয়নি, তিনিই পরাক্রমশালী ও হিকমতওয়ালা। এসব আল্লাহ তায়ার করুণা, আল্লাহ তায়ালা যাকে ইচ্ছে দান করেন। আল্লাহ তায়ালা বড়ই করুণাকারী” (সূরা জুমআ-৩-৪)
.
আল্লামা উসমানী রহ. বলেন-“হযরত শাহ সাহেব রহ. লিখেন যে,-আল্লাহ তায়ালা আরবদের সৃষ্টি করেছেন এই দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার জন্য যাদের পিছনে রয়েছে অনারবী কামেল লোকেরা”।
.
হাদিসের মধ্যে এসেছে-“যখন নবীজী সা. কে এই আয়াত
.
ﺁﺧﺮﻭﻥ ﻣﻨﻬﻢ ﻟﻤﺎ ﻳﻠﺤﻘﻮﺍ ﺑﻬﻤﻮ
.
এর ব্যাপারে প্রশ্ন করা হল তখন নবীজী সা. হযরত সালমান ফারসী রা. এর কাঁধে হাত রেখে বললেন-“যদি ইলম বা দ্বীন “সুরাইয়া” পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছে তাহলে তাঁর জাতি পারস্যের লোকেরা সেখান থেকেও তা নিয়ে আসবে। শায়েখ জালালুদ্দীন সুয়ুতী রহ. প্রমুখগণ একথা স্বীকার করেছেন যে, এই ভবিষ্যতবাণীর বড় মিসদাক (লক্ষ্য) হল ইমামে আজম আবু হানীফা রহ.”। (তাফসীরে উসমানী হাশিয়া নং-৭)
.
সুতরাং এই ভবিষ্যতবাণী অনুযায়ী সাইয়্যিদুনা ইমাম আজম আবু হানীফা রহ. দ্বীন সংকলন করেছেন। যেহেতু কুরআনে কারীমের দ্বিতীয় নাম “লুকায়িত দ্বীন”। যার পূর্ণাঙ্গতা নবীজী সা. এর উপর, শক্তিশালীত্ব সাহাবায়ে কিরামের দ্বারা, আর সংকলনের মহান দায়িত্বে প্রথম হবার সৌভাগ্য হযরত ইমাম আবু হানীফা রহ. এর হয়েছে। আর একারণেই সর্বসম্মতভাবে তার উপাধী আবু হানীফা নির্ধারিত হয়েছে, অর্থাৎ দ্বীনে হানীফের প্রথম সংকলক।
.
ইমাম আবু হানীফা রহ. এর মূল নাম নু’মান।
.
ইবনে হাজার মক্কী রহ. নু’মান এর তিনটি অর্থ লিখেছেন-
.
১. “নিয়ামত থেকে ইসমে মুবালাগা”, আল্লাহ তায়ালা কুরআনে কারীমে দ্বীনের পূর্ণাঙ্গতা পূর্ণ হবার ঘোষণা দিয়েছেন। তাহলে সবচে’ বড় নিয়ামতের সংকলন যার হাতে হয়েছে তিনি অবশ্যই নামের সাথে মিলে নু’মান।
.
২. “নু’মান” এক ঘাসের নাম। যার খুশবো বহুদূর পর্যন্ত পাওয়া যায়। বিশ্বনবী সা. এর সার্বজনীন সুন্নাতের খুশবো বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছেন হযরত নুমান বিন সাবেত রাহ.। অন্য কোন ইমামের মাজহাব তার চারপাশেই ছড়েনি। এ জন্যই তিনি নামের সাথে মিলে “নু’মান”।
.
৩.... “নু’মান” ঐ রক্তকে বলে যার উপর জীবন নির্ভরশীল। যা শরীরের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে পৌঁছে। তিনি প্রিয় নবীজীর প্রিয় সুন্নাতকে এরকম ব্যাখ্যা করেছেন যে, মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের ছোট বড় প্রায় সকল মাসআলার সমাধান সুন্নাত থেকে অনুসন্ধান করে নিয়েছেন। এই অর্থেও তিনি “নুমান”। এছাড়া তার ফিক্বহ পরবর্তীদের জন্য মূল ভিত্তির কাজ দেয়।
.
ইমাম মালিক রহ. ইমাম শাফেয়ী রহ. এবং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহ. সবাই তার থেকে উপকৃত হয়েছেন। তাই এই অর্থেও তিনি নামের সাথে মিলে ‘নুমান”।
.
তার উপাধী “ইমামে আজম” কারণ নবীজী সা. বলেছেন- ﺃﻋﻈﻢ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﻧﺼﻴﺒﺎ ﻓﻲ ﺍﻹﺳﻼﻡ ﺃﻫﻞ ﻓﺎﺭﺱ অর্থাৎ ইসলামে বড় অংশ পারস্যবাসীর!
.
(কানযুল উম্মাল ফি সুনানিল আক্বওয়াল-হাদিস নং-৩৪১২৬)
.
বিষয়টি সুষ্পষ্ট। যাদের ইসলামে বড় (আজম) অংশ হবে, তাদের ইমামও বড় (আজম) হবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই ইমাম আবু হানীফা রহ. এর উপাধী “ইমামে আজম”। সাহাবায়ে কিরামের পর তাঁকেই মানুষ আজম মেনেছেন। আর দুনিয়ার মাঝে এক বিশাল জামাআত এখনো তার মুকাল্লিদ বা অনুসারী।
.
মোদ্দাকথা হল-রাসূল সা. হিদায়াতের সূর্য। সাহাবায়ে কিরাম হিদায়াতের তারকা। আর সুরাইয়া তারকা পর্যন্ত পৌঁছাকারী ব্যক্তিত্ব হযরত ইমামে আজম রহ.। আহলে সুন্নাতের মাঝে আমাদের নিসবত হিদায়াতের সূর্য পর্যন্ত গিয়ে মিশেছে। ওয়াল জামাআতের মাঝে আমাদের নিসবত হিদায়াতের তারকাপুঞ্জ পর্যন্ত সুরাইয়া তারকায় পৌঁছাকারী হানাফী ইমামের সাথে।
.
রাসূল সা. দ্বীন আনয়নকারী। সাহাবায়ে কিরাম দ্বীনকে প্রসারকারী। আর চার মাজহাবের ইমাম দ্বীনকে লিখাকারী।
.
সাহাবায়ে কিরাম সুনিশ্চিতভাবে ঐ দ্বীনই প্রসার করেছেন যা নবী সা. এনেছেন। আর আইয়িম্মায়ে কিরাম ঐ দ্বীনই লিখেছেন যা সাহাবায়ে কিরাম প্রসার করেছেন। আমাদের এই নাম “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত হানাফী’ আমাদের মাজহাবের নিরবচ্ছিন্ন সনদ। যা নিরবচ্ছিন্ন সূত্র পরম্পরার আমলের উপর নির্ভরশীল। নবী কারীম সা. এর সুন্নাত সাহাবায়ে কিরাম স্বচক্ষে দেখেছেন। আর এর উপরই নিরবচ্ছিন্নভাবে আমল প্রচলন হয়েছে। আর ইমাম সাহেব রহ. সাহাবীদের দেখেছেন। তাদের নিরবচ্ছিন্ন আমল দেখেছেন। তাদের নিরবচ্ছিন্ন আমলকে কিতাবে সংকলন করেছেন। আর আমল হিসেবে পূর্ণ দুনিয়ায় তা নিরবচ্ছিন্নতায় ছড়িয়ে দিয়েছেন। প্রত্যেক স্থানে সুন্নাতের উপর আমল প্রচলন হয়ে গেছে।
.
যেমনিভাবে আমাদের এই নাম নবীজী সা. পর্যন্ত মিলিত। এমনিভাবে এই নামে পূর্ণাঙ্গতাও রয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআত ধারাবাহিকতার সাথে চার দলিলে শারইয়্যাহকে মানেন। কিতাবুল্লাহ, সন্নাতে রাসূল, ইজমায়ে উম্মাত, কিয়াস। এই নামের মাঝে চারটি দলিলেরই সমাবেশ আছে।
.
সুন্নাতে রয়েছে কুরআনের শব্দ আর নবীজী সা. এর আমলী নমুনা। ওয়াল জামাআতের মাঝে ইজমা এবং হানাফী কিয়াস অন্তর্ভূক্ত।
ফিক্বহে হানাফীর চার আসাস(ভিত্তি)
কিতাব, সুন্নাত, ইজমা, কিয়াস
এখন এই বিস্তারিত এবং সনদপূর্ণ মত ও পথের উল্টো কথিত আহলে হাদিসদের পর্যালোচনাও জেনে নিন।
.
প্রফেসর আব্দুল্লাহ ভাগলপুরী নিজের কিতাবে লিখেন-“কতটা আফসোসের ব্যাপার যে, খৃষ্টান, আর মির্যায়ীরা যে কাফের। তারাতো তাদের নিসবত তাদের নবীর দিকে করে ঈসায়ী এবং আহমদী বলে। আর তোমরা মুসলমান হয়ে নিজ নবী ছেড়ে নিজের ইমামের দিকে করে হানাফী বলো। মির্যায়ী এবং ঈসায়ীরা কি ভাল না....? যারা নিজেদের নিসবত অন্তত তাদের নবীর দিকে করে যারা তাদের নিসবত তাদের ইমামের দিকে করে তাদের তুলনায়?” (আসলী আহলে সুন্নাত-৩)
.
তিনি আরো বলেন-“আসল বাপ রেখে অন্য কারো দিকে নিসবত করা কোন শরীয়তের মাসআলা...? যখন নবীজী সা. আমাদের রুহানী পিতা। তো পিতাকে ছেড়ে অন্য কারো দিকে নিসবত করার অর্থ হল যে, হয়তো নবীজী তাদের পিতা নয়!!!! নতুবা তারা ভুলে আছে। রাসূল সা. বলেছেন-“যেই ব্যাক্তি তার পিতা থেকে নিজের নিসবত ভেঙ্গে দেয় সে কুফরী করল। সাথে সাথে তার জন্য জান্নাত হারাম”।(আসলী আহলে সুন্নাত-৪)
.
সম্মানিত পাঠক/পাঠিকাগণ! আপনারা আহলে হাদিসদের মৌলিকত্ব দেখেন-সমস্ত হানাফী মালেকী, শাফেয়ী, হাম্বলী, মুহাদ্দিসীন, ফুক্বাহা, মুফাসসিরীন, ওয়ালী আল্লাহরা সবাই নবীকে ছেড়ে দিয়েছেন। তারা ঈসায়ী আর মির্যায়ী থেকেও জঘন্য। তাদের মাঝে কেউই নিজেরে বাপ থেকে নয়। তারা সবাই কাফের! তাদের উপর জান্নাত হারাম!! এরকম আহলে হাদিসের জন্য জীবন উৎস্বর্গ হোক!
.
কয়েক লাইন পরেই তিনি লিখেন-ইসলামের কোন সংস্করণ কিংবা কোন প্রকার যেমন সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র নয়, তেমনি শাফেয়িয়্যাত এবং হানাফিয়্যাত ও ইসলামের কোন প্রকার নয়। সোস্যালিজম হোক বা গণতন্ত্র হোক বা হানাফিয়্যাত বা শাফিয়ীয়্যাত কিংবা দেওবন্দীয়্যাত হোক অথবা বেরলবীয়্যাত হোক, এসব কিছুই ইসলামের মাঝে অতিরঞ্জন। যা ইসলামে একেবারেই নেই। (আসলী আহলে সুন্নাত-১৩)
.
প্রিয় পাঠকবৃন্দ! কথিত আহলে হাদিসদের হাদিসের উপর আমলের পরিণাম দেখুন! দুনিয়াতে কোথাও মুসলমান পাওয়া যায়...??
.
ইখতিলাফ এবং স্বাতন্ত্রতা
.
সাহাবায়ে কিরামের মাঝে এ ব্যাপারে ঐক্যমত্ব ছিল যে, হযরত আবু বকর সিদ্দীক রা. সবচে’ উত্তম ছিলেন। এজন্য কাউকে আবু বকরী বলা হয়না। তারপর হযরত ওমর রা. এর ব্যাপারেও কোন মতভেদ ছিলনা। এজন্য কাউকে ওমরী বলা হয়না। হযরত উসমান রা. এবং হযরত আলী রা. এর ব্যাপারে কিছু ইখতিলাফ ছিল।
.
জমহুর সাহাবীরা হযরত উসমান রা. কে হযরত আলী রা. থেকে উত্তম বলতেন। স্বাতন্ত্রতার জন্য হযরত উসমানকে উত্তম বর্ণানাকারীদের উসমানী বলা হয়। আর আলী রা. কে উত্তম বর্ণনাকারীদের আলিয়ী বলা হয়।
.
কিছু তাবেয়ীকে উসমানী এবং আলিয়ী বলার বর্ণনা বুখারী শরীফের ১ নং খন্ডের ৪৩৩ নং পৃষ্টায় আছে।
.
কুরআনে পাকের ক্বিরাতের মাঝে যখন ইখতিলাফ হয় তখন স্বাতন্ত্রতার জন্য ক্বারী আসেম রহ. এর ক্বিরাত এবং ইমাম হামযাহ রাহ. এর ক্বিরাত রাখা হল। এটাকে কেউতো এই উদ্দেশ্য নেয়নি যে, এটা আল্লাহর কুরআন নয়, বরং ক্বারী আসেমের বানানো! হাদিসের মাঝে মতভেদ হলে বলা হয় এটা আবু দাউদের হাদিস আর এটা বুখারীর হাদিস। এই কথার উপরও কেউ কুফরীর নিসবত করেনাতো!
.
ঠিক এমনি হাল ফিক্বহী বিষয়ে মতভেদের সময় ‘হানাফী” আর “শাফেয়ী” বলাটা। আমরা ঈসায়ীদের বিপরীতে নিজেকে মুসলমান বলি। আহলে বিদআতি খারেজী মুতাজিলীদের বিপরীতে নিজেদের আহলে সুন্নাত বলি। আর শাফেয়ীদের বিপরীতে নিজেদের হানাফী বলি।
.
যেমন আমরা ভারতীদের বিপরীতে নিজেদের পাকিস্তানী বলি। (আমরা বলি বাংলাদেশী-অনুবাদক) জাতিভেদের বিপরীতে বলি আমরা পাঞ্জাবী, লাহোরীদের বিপরীতে এসে বলি ওকারওয়ী। ওকারওয়ী পাঞ্জাবী, পাকিস্তানিকে মেনে বলা হয়। ছেড়ে নয়। বেচারা প্রফেসর সাহেবের এই অবস্থা হল যে, “নাকি” শব্দের ব্যবহারও সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানেননা। এই শব্দটি একই প্রকারের ক্ষেত্রে আসে।
.
যেমন আজ শনিবার নাকি রবিবার...? আজ নভেম্বর নাকি ডিসেম্বর...? সুতরাং প্রশ্ন হবে-“তুমি মুহাম্মদী না ঈসায়ী...? তুমি হানাফী না শাফেয়ী...?” কিন্তু একথা বলা ভুল এবং হাস্যকর যে, “তুমি পাকিস্তানী না পাঞ্জাবী..? আজ নভেম্বর না শনিবার...? তুমি হানাফী না মুহাম্মদী...?”
.
যে লোক উর্দুর একটি শব্দের সঠিকভাবে ব্যবহার করতে জানেনা সে কুরআন হাদিস ঘোড়ার ডিম বুঝবে!
.
.
.
আল্লাহ তায়ালা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতকে সকল প্রকার সন্দেহ থেকে হিফাযত করুন। আমীন হে রাব্বুল আলামীন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন