বৃহস্পতিবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৫

মুজাহিদে মিল্লাত হজরত মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রহঃ; দেওবন্দী চেতনার উজ্জ্বল নক্ষত্র

ইসলামী শক্তিকে সুসংহত করণ, বাতিলের মোকাবেলায় আপোষহীন, সময়োপযোগী এবং সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্তের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে মুজাহিদে মিল্লাত মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রহঃ এর নাম৷ কিন্তু তার সেই অবদানের কথা কতোটুকু জানা আছে আমাদের?)
আমরা ফেসবুকে কতোকিছু নিয়েই তো লেখালেখি করি৷ লড়াই, অপরকে তীর্যক বাক্যবাণে বিদ্ধ করা, নিজের মত প্রতিষ্ঠায় ভিন্নমতকে হেন ভাষায় আক্রমণ, আরো কতো কি!!
যদিও বর্তমান বাংলাদেশে সামাজিক ও সাংগঠনিক তৎপরতার মাসআলায় ওলামায়ে কেরামের মাঝে বিস্তর মতপার্থক্য, সরকারের দমনপীড়নের মাঝেও নীরবে-নিভৃতে মউদুদীবাদের ব্যাপক বিস্তার, ইসলামের ছদ্মাবরণে আহলে হাদীস কিংবা মাযহাববিরোধীদের উল্লম্ফন সবগুলোই আমাদের জন্য অশনিসংকেত বহন করছে৷
স্বাধীনতাত্তোর সামগ্রীকভাবে গোটা দেশ, এবং বিশেষভাবে এদেশের আলেম-ওলামা ও ইসলামপ্রিয় জনতা এতোটা বিপর্যয় কিংবা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েছে কি না, সন্দেহ আছে৷
মানুষ কথা বলতে চায়, প্রতিবাদে সোচ্চার হতে চায়, গর্জে উঠতে চায় ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মহীন অপশক্তি, অবৈধ আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে৷
কিন্তু তথাকথিত গণতান্ত্রিক দলগুলোর উপর থেকে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তাদের ক্ষমতা দখলের নীতিহীন অপরাজনীতির কারণে৷ আন্দোলন ডেকে বিরোধীদলীয় নেতাদের পলায়নপর ও কাপুরুষোচিত মনোবৃত্তি সাধারণ মানুষকে তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করেছে৷
বর্তমানে জাতির সামনে সত্যিকার কান্ডারী হিসেবে আবির্ভূত হবার যাবতীয় সম্ভাবনা ওলামায়ে হকের সামনে বিদ্যমান৷ এর স্বপক্ষে জলজ্ব্যান্ত প্রমাণ হিসেবে আমরা অবিন্যস্ত, অগোছালো এবং শক্তিশালী ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলনের জন্য অপ্রস্তুত হেফাজতে ইসলামের ধুমকেতুর ন্যায় উত্থান এবং উল্কাপিন্ডের ন্যায় পতনের কথা বলতে পারি৷
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সীমাহীন লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, গুম, খুনসহ রাষ্ট্রিয় উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম দূরীকরণের নির্লজ্জ অপপ্রয়াসের কারণে
তৌহিদী জনতা যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গ, ওলামায়ে কেরামের অভিভাবক, খলীফায়ে মাদানী হজরতুল আল্লাম শাহ আহমদ শফী দাঃবাঃ নেতৃত্বাধীন হেফাজতে ইসলামের আহবানে বানের পানির মতো দু'কুল উপচে রাস্তায় নেমে আসে৷ হেফাজতের নজিরবিহীন জাগরণের ঢেউ বাংলাদেশের সীমান্ত ছাপিয়ে ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত এবং সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের বুকে কাঁপন ধরায়৷
আওয়ামী লীগ হেফাজতকে ম্যানেজের চেষ্টা চালায়৷ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে কিছু দাবী মেনে নেয়ার আভাস দেন৷ যদিও এটা ছিলো তার একটি অপকৌশলমাত্র৷
ওদিকে ক্ষমতার জন্য মরিয়া বিএনপি হেফাজতের আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে এমন অপরিপক্ক কৌশল নেয়, যা হেফাজতের জন্য বরং প্রতিবন্ধকতাই তৈরী করে৷ যুদ্ধাপরাধ ইস্যূ আড়ালের জন্য জামায়াত অনুপ্রবেশ করে হেফাজতের মাঝে৷ তারপরেরটুকু সবার জানা৷
এরকম চরম সংকটকালীন মুহুর্তে প্রয়োজন ছিলো বিচক্ষণ, দূরদর্শী, আপোসহীন ও সাহসী নেতৃত্বের৷ যিনি বা যারা অবস্থা বুঝে সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করবেন, পাল্টা হুংকারে তাগুতী অপশক্তিকে পিছু হটতে বাধ্য করবেন৷
কিন্তু নিতান্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, আমীরে হেফাজতের আশপাশে বিচরণকারী কিছু অতিউৎসাহী, অনভিজ্ঞ দিবাস্বপ্নদ্রষ্টা, কিংবা অলীক কল্পনাকারীরা তাকে প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই দেয়নি৷ ফলে সেই ৫ মে থেকে যে দুরবস্থার শুরু, দিনদিন তা প্রকট রূপ ধারন করেছে৷
আওয়ামী অক্টোপাসের কঠিন শৃংখলে আবদ্ধ আলেম-ওলামা ও ইসলামী নেতৃবৃন্দ নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগটুকুও পাচ্ছেন না৷ মাদরাসা, মসজিদে স্বস্তির সাথে খেদমত করতে পারছেন না৷
কোন পদ্ধতিতে তারা অগ্রসর হবেন? কিভাবে ইসলামী বিদ্বেষী অপশক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন? তার সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়ার মতো সাহসী, দূরদর্শী ও দৃঢ়চেতা নেতার সন্ধান পাচ্ছেন না৷
এরকম ক্রান্তিকালে প্রচন্ডভাবে অনুভূত হচ্ছে মুজাহিদে মিল্লাত, বাতিলের বিরুদ্ধে আপোসহীন মর্দে মুজাহিদ, দেওবন্দিয়ত,জমিয়ত ও মাদানিয়তের উজ্জ্বল নক্ষত্র, হজরত মাওলানা শামছুদ্দীন কাসেমী রহঃ এর ন্যায় একজন বজ্রহুংকারদাতা আলেমের৷ যিনি স্বাধীনতার পর ইসলামপন্থিদের উপর সেক্যুলার রক্তচক্ষুধারীদের হিংস্র দৃষ্টি উপেক্ষা করে পুনরায় জমিয়তের কার্যক্রম ও কওমী মাদরাসার বদ্ধ কপাট উন্মুক্তকরণে ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখেন৷
যিনি প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কাদিয়ানীদের সম্মেলনে যাবার সংবাদে তার সাথে দেখা করে সরাসরি হুমকি দেন, “আপনি কাদিয়ানীদের সম্মেলনে যাবার পূর্বেই আমরা জাতির সামনে প্রকাশ করে দিবো যে, আপনি মিথ্যা নবী অনুসারীদের খপ্পরে পড়েছেন"৷ এই হুমকির পর মরহুম জিয়াউর রহমান আর কাদিয়ানীদের সম্মেলনে যাননি৷
যিনি গুলিস্তানে সামরিক স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের নির্দেশে গোলাপ শাহ মসজিদ উচ্ছেদ করে মাজার নির্মাণ প্রতিরোধে নেতৃত্ব দিয়ে কারাবরণ করেন৷
উল্লেখ্য, পুলিশী নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গোলাপ শাহ মসজিদে জুমা আদায়ের সেই কর্মসূচীতে পুলিশ হামলা করলে জুমার খুতবা পাঠরত আমার মুহতারাম আব্বা কারী আব্দুল খালিক আসআদী সাহেব (হজরত কাসেমী রহঃ এর একান্ত ভাবশিষ্য) পুলিশের নির্মম বেয়নেট চার্জে গুরুতর অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন হাসপাতালে শয্যাশায়ী ছিলেন৷
মরহুম কাসেমী সাহেবের নেতৃত্বে পরিচালিত সেই আন্দোলনের কারণে এরশাদ সরকার মসজিদ পুনঃনির্মাণ করে৷
১৯৯৬ এর অক্টোবরে ইসলামের এই মহান খাদেমের মৃত্যু হয়৷
ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্বের আসনে তার সমসাময়িক ও পরবর্তী অনেকেই ছিলেন এবং আছেন৷ আমরা তাদের সবাইকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি৷ এদেশে ইসলামের প্রচার-প্রসারে তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে৷
কিন্তু সেই ছোট্টবেলায় বাবার মুখে ‘শামছুদ্দীন কাসেমী' নামটির চর্চা শুনতে শুনতে মনে ধারণা জন্মায় যে, তিনিই এদেশের সবচেয়ে বড় আলেম৷ আস্তে আস্তে সেই ধারণা বিশ্বাসে রূপ নিয়েছে৷ আর বর্তমানে তা বদ্ধমূল হয়েছে৷
ঠিক যেমন বর্তমানে আমার সন্তানদের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আলেম মুফতী মুহাম্মদ ওয়াক্কাস সাহেব৷ এটাও তাদের পিতা সূত্রে প্রাপ্ত বিশ্বাস৷ কারণ সন্তান তার পিতার চোখে পৃথিবী দেখে, পিতার কানে শোনে এবং পিতার মনে উপলব্ধি করে৷
১৯৭৫ সালে তিনি রাজধানীর মিরপুরে জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদের ছোট্ট পরিসরে যাবার পাঁচ বছরের মাথায় নিরন্তর ইখলাস, কোরবানী আর নিরবচ্ছিন্ন শ্রমের মাধ্যমে আরজাবাদকে দাওরায়ে হাদীস মাদরাসায় উন্নীত করেন৷ তার পরিশ্রম, একনিষ্ঠতা এবং যে কোনো দ্বীনি ও জাতীয় ইস্যূতে আপোসহীন ভূমিকা আরজাবাদকে নিছক একটি কওমী মাদরাসার পরিচয় ছাপিয়ে জমিয়ত ও মাদানিয়তের লালনক্ষেত্রের পাশাপাশি দ্বীন, ঈমান সংরক্ষণে একটি দুর্ভেদ্য জাতীয় মারকাজের পরিচিতি এনে দিয়েছে৷ আজ আরজাবাদ মাদরাসা ছাত্রদের নিবিড়ভাবে লেখাপড়া এবং শিক্ষকদের খেদমতে যে ঈর্ষণীয় ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ বিরাজ করছে, তারই ইখলাসের বদৌলতে৷ স্পষ্ট মনে আছে, খুব ছোট বেলায় এশার পরপর মসজিদের লাইট নিভিয়ে এবং দরজা, জানালা বন্ধ করে কান্নার রোল উঠতো৷ আমরা বুঝতাম, আজ রাতের খাবার রান্না হয়নি৷ তিনি ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে মাওলার দরবারে কান্নায় বুক ভাসাতেন৷ আপনি এখন আরজাবাদে গেলে ওসব গল্পের মতো মনে হবে৷ কিন্তু এটিই বাস্তব সত্য৷
একজন মহান ব্যক্তি যোগ্য ও আস্থাশীল সহকর্মী এবং উত্তরসূরী বানিয়ে প্রাণান্ত পরিশ্রমে একটি প্রতিষ্ঠানকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেয়ার পরম নিদর্শন হজরত কাসেমী সাহেব রহঃ৷
দ্বীনি কাজে সবাইকে উৎসাহ যোগাতেন তিনি৷ বিশেষত শিশুদেরকে আলাদা নজরে স্নেহ করতেন৷ তার নিকট বুখারী কিংবা অন্য কোনো হাদীস বা তাফসীর পড়ার সুযোগ না হলেও এবতেদায়ী জামাতের ছাত্র হিসেবে তিনি আমাদেরকে উর্দু কায়েদার সবক নিতেন৷ মাদরাসার মুহতামিম ও শায়খুল হাদীস, দেশের শীর্ষ আলেম রাজনীতিবিদের নিকট পড়ার ভীতির পাশাপাশি গর্ব হতো প্রচন্ড৷ যা এখনো আমাকে আলোড়িত করে৷
হক ও হক্কানিয়াতের পতাকাবাহী জমিয়তের অনেকগুলো গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন তিনি৷ প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক, এরপর বাংলাদেশ জমিয়তের সাধারণ সম্পাদক, সিনিয়র সহসভাপতির পর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত নির্বাহী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন সুচারুভাবে৷
খতমে নবুওয়াত আন্দোলন পরিষদ, দেশ বাচাও ঈমান বাচাও আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা, ইসলামী ঐক্যজোট, সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা৷ মওদুদীবাদ, শিয়াবাদ, কাদিয়ানী, বাহাই, খৃস্টান মিশনারী, রক্তচোষা এনজিও, নাস্তিক্যবাদসহ যাবতীয় বাতিলের মোকাবেলায় প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে তিনি ছিলেন সামনের সারিতে৷ কখনো তার আহবানে অন্যরা এসেছেন৷ আর অন্যরা না এলে তিনি একাই জমিয়তকে নিয়ে আপোসহীনভাবে কাজ করেছেন৷ আমরা যেনো তার রূহানী বরকতে ধন্য হই, রাব্বুল আলামীনের নিকট এই আরজ রাখছি৷
পরিশেষে তাকে নিয়ে দেখা আমার স্বপ্নের বর্ণনায় লেখাটি শেষ করবো৷ কয়েক বছর পূর্বে একদিন গভীর ঘুমে স্বপ্নে দেখি; আরজাবাদে মুহতামিম সাহেবের কামরার সামনে মরহুম কাসেমী সাহেব অযু করছেন৷ আমাকে দেখে তিনি বললেন, “সব ছাত্রকে বুখারী শরীফ নিয়ে বসতে বলো৷ আমি এখুনি বুখারীর সবক পড়াবো"৷
আমাদের সুদৃঢ় বিশ্বাস, তিনি মহান আল্লাহ একান্ত প্রিয় বান্দা হিসেবে জান্নাতে সুউচ্চ মর্যাদা লাভ করেছেন৷ আমরা যেনো তার আদর্শে নিজেদেরকে পরিচালিত করতে পারি, মহান রবের নিকট কায়মনোবাক্যে এই মিনতি জানাই৷
ওয়ালী উল্লাহ আরমান৷

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন