বৃহস্পতিবার, ২০ আগস্ট, ২০১৫

কা’বার গেলাফ ও তার ইতিহাস


রহমান রহীম আল্লাহ্‌ তায়ালার নামে-

কা’বার গেলাফের ইতিহাস স্বয়ং কা’বার ইতিহাস থেকে আলাদা নয়। কা’বার গিলাফের গুরুত্ব, মুসলিমদের নিকট তার পবিত্রতা ও উচ্চ মর্যাদা প্রকাশিত।

 রাসুল (সাঃ) এর পূর্বে কাবার গেলাফঃ

ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইসহাক বলেন, ‘একাধিক আলেমের কথা থেকে জানতে পারি যে সর্বপ্রথম “তুব্বা” আসাদ আল-হেমইয়ারী কা’বার গেলাফ লাগান। তিনি স্বপ্নে দেখেন যে তিনি কা’বা ঘরের গেলাফ লাগাচ্ছেন। সেই জন্য তিনি চামড়ার গেলাফ চড়ান। এর পরও তাকে স্বপ্নে আরও গেলাফ লাগানোর কথা বলা হচ্ছে। তাই তিনি ইয়েমেনের তৈরি লাল কাপড়ের গেলাফ লাগান’[আখবারে মক্কা-আযরুকী]। এরপর জাহেলী যুগে অনেকে নিজ নিজ যুগে গেলাফ লাগিয়েছেন। কারণ এটিকে তারা দ্বীনের অপরিহার্য কর্ম মনে করত; যে যখন ইচ্ছা করত তখন যে কোন প্রকারের গেলাফ লাগাতে পারত। (তৎকালীন সমহ ও প্রকারের কোন শর্ত ছিল না)। কা’বায় হরেক রকম গেলাফ লাগান হত। যেমনঃ চামড়ার, মাআফির (ইয়েমেনের হামদান গ্রামের তৈরি কৃত কাপড়ের গেলাফ), ইয়েমেনের তৈরি লাল পাড়ের গেলাফ, পাতলা ও হালকা কাপড়ের গেলাফ এবং ইয়েমেনের কারুকাজ করা কাপড়ের গেলাফ।
তখন কা’বায় গেলাফের উপর গেলাফ লাগান হত। যখন বেশী ভারী হয়ে যেত অথবা কোন গেলাফ পুরাতন হয়ে যেত তখন সেটিকে তুলে নিয়ে বরকত হাসিলের জন্য বণ্টন করা হত অথবা মাটিতে দাফন করা হত।
জাহেলী যুগে কুরাইশরা আপোষে সহযোগিতার মাধ্যমে গেলাফ তৈরি করত। আর্থিক অবস্থার প্রেক্ষিতে প্রতি গোত্রের টাকার পরিমান নির্ধারণ করা হত। ‘কুসসীর’ যুগেও এই পদ্ধতি চালু ছিল। তবে যখন রাবীআ ‘মুগীরা বিন মাখযুমীর যুগ আসে তখন তিনি ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইয়েমেন যাওয়া আসা করতেন। তিনি অতি ধনী ছিলেন। তিনি ঘোষণা করেন আমি এক বছর একাই গেলাফ দিব। আর এক বছর কুরাইশরা সকলে মিলে দিবে। তার মৃত্যুকাল পর্যন্ত একাই এই কাজ করতে থাকেন। তিনি ইয়েমেনের জানাদ শহর থেকে সুন্দর সুন্দর কাপড় আনতেন এবং গেলাফ তৈরি করে লাগাতেন। কুরাইশরা তার উপাধি দেয় ‘আদল’ কারণ তিনি একাই সমস্ত কুরাইশদের সমান কাজ করেছেন। তার সন্তানদের উপাধি দেয় ‘বানু আদল’। আরবী ভাষায় ‘আদল’ এর অরথ সমতুল্য। কা’বায় সর্বপ্রথম রেশমের গেলাফ লাগান একজন আরব মহিলা, যিনি ছিলেন আব্বাস (রাঃ) এর মা ‘নুতাইলা বিনতে জানাব’।

 ইসলামী যুগে কাবার গেলাফঃ

রাসুল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাগন মক্কা বিজয়ের পূর্বে কা’বায় গেলাফ চড়াননি। কেননা কুফফাররা এ কাজে অনুমতি দিত না। মক্কা বিজয়ের পরও রাসুল (সাঃ) কা’বার গেলাফ পরিবর্তন করেননি। তবে জনৈক মহিলা কা’বায় ধুপ দিতে গেলে তাতে (গেলাফে) আগুন লেগে যায় এবং পুড়ে যায়। তারপর রাসুল (সাঃ) ইয়েমেনী কাপড়ের গেলাফ চড়ান। এরপর আবু বকর (রাঃ), উমর (রাঃ), এবং উসমান (রাঃ) “কিবাতী” কাপড়ের গেলাফ চড়ান।
একথা প্রমানিত আছে যে, মুআবিয়া বিন আবী সুফিয়ান বছরে দু’বার কা’বায় গেলাফ চড়াতেন। আশুরার দিনে রেশমের এবং রমজানের শেষে কিবতী কাপড়ের গেলাফ লাগাতেন। এরপর ইয়াযীদ বিন মু’আবিয়া, ইবনে যুবায়ের আব্দুল্ল মালেক বিন মারওয়ান রেশমের গেলাফ চড়িয়েছেন।
কা’বায় প্রতি বছর দুটি গেলাফ চড়ানো হতঃ একটি রেশমের অপরতি কিবাতী কাপড়ের। রেশমি গেলাফের উপরের অংশ (যাকে কাসীস বলা হয়)জুলহিজ্জা মাসের ৮ তারিখে চড়ানো হত হাজীদের ফিরে যাওয়ার পর। যাতে তাদের হাত লেগে তা নষ্ট না হয়। রেশমের গেলাফ রামাদানের ২৭ তারিখ পর্যন্ত থাকতো এবং ঈদুল ফিতরের জন্য কিবাতী কাপড়ের গেলাফ চড়ানো হত।
বাদশাহ মামুনের যুগে কা’বাকে তিনটি গেলাফ পড়ানো হত। জুলহিজ্জার ৮ তারিখে লাল রেশমি গেলাফ, রজবের প্রথম তারিখে কিবাতী এবং রামাদানের ২৭ তারিখে শ্বেত রেশমি গেলাফ। বাদশাহ মামুন যখন জানতে পারেন যে, সাদা রেশমি গেলাম হজ্জ্বের মৌসুমে নষ্ট হয়ে যাবে তখন আরও একটি সাদা গেলাফের ব্যবস্থা করেন। এরপর নাসের আব্বাসী সবুজ রঙের গেলাফ তারপর কালো রঙের গেলাফ চড়ান। সেই সময় থেকে আজও কালো গেলাফ চড়ানো হচ্ছে।
আব্বাসী খেলাফত পতনের পর ৬৫৯ হিজরিতে সর্বপ্রথম ইয়েমেনী বাদশাহ ‘মুজাফফর’ কা’বা ঘরের গেলাফ লাগান। তিনি বেশ কয়েক বছর মিশরী বাদশাহর সঙ্গে পালাক্রমে গেলাফ চড়ানোর কাজ চালু রাখেন। ৬৬১ হিজরিতে আব্বাসীদের পর যে মিশরী শাসক সর্বপ্রথম গেলাফ চড়ানোর চেষ্টা করেন তিনি হচ্ছেন বাদশাহ যাহের বাইবেরাস বন্দুকধারী। ৭৫১ হিজরিতে মিশরের বাদশাহ ইসমাইল বিন নাসের বিন মুহাম্মাদ বিন কালাউন কা’বার গেলাফের জন্য বিশেষ ওয়াকফের ব্যবস্থা করেন। তিনি কা’বার জন্য প্রতি বছর কালো গেলাফ ও প্রতি পাঁচ বছর পর মদীনায় রাসুল (সাঃ) এর রওজার জন্য সবুজ রঙের গেলাফ পাঠাতেন। কিন্তু ‘আল-খাদীউবী মুহাম্মাদ আলী’ হিজরির ১৩ শতাব্দীতে ওয়াকফ বন্ধ করেন এব্বং সরকারী খরচে গেলাফ তৈরি হতে আরম্ভ করে। তুর্কির উসমানী খলীফাগণ কা’বার ভিতরের গিলাফ নিজেদের জন্য খাস করে নেন। ৮১০ হিজরিতে কা’বার দরজার জন্য নকশাদার চাদর তৈরি করা হয়; যাকে ‘বুরকা’ বলা হয়। অতঃপর ৮১৬ – ৮১৮ হিজরি পর্যন্ত স্থগিত হয়ে যায় এবং পুনরায় ৮১৯ হিজরিতে আরম্ভ হয় যা আজও গেলাফের সাথে তৈরি করা হচ্ছে।

 সৌদি যুগের গেলাফঃ

বাদশাহ আব্দুল আযীয বিন আব্দুর রহমান আলে সউদ মক্কা মদীনায় অবস্থিত দু’হারামের খেদমতের খুব গুরুত্ব দেন। এই গুরুত্বের ভিত্তিতে বাদশাহ সউদ বিন আব্দুল আযীয পবিত্র মক্কায় কা’বার গেলাফ তৈরি করার জন্য বিশেষ এক কারখানা তৈরি করার আদেশ দেন এবং তাতে গেলাফ তৈরির যাবতীয় সরঞ্জাম মওজুদ করা হয়। ১৩৮২ হিজরিতে বাদশাহ ফয়সাল নতুন করে কারখানা তৈরি করার আদেশ দেন, যাতে উত্তম ও মজবুত গেলাফ প্রস্তুত করা সম্ভব হয় এবং কা’বা যেমন শানদার ঘর, তাঁর শানের উপযোগী  হয়। ১৩৯৭ হিজরিতে মক্কায় ‘উম্মুল জুদ’ নামক স্থানে নতুন বিল্ডিং এর উদ্ভোধন করা হয়। তাতে গেলাফ তৈরির জন্য আধুনিক সরঞ্জাম সংযোজিত হয়। সেখানে মেশিনের সাহায্যে গেলাফ তৈরির ব্যবস্থার সাথে সাথে হাতের কাজের যে কারুকার্য তা বজায় রাখা হয়েছে। কারণ শিল্প জগতে তার উচ্চ মূল্য রয়েছে। এই কারখানা ধারাবাহিক ভাবে উন্নতি শাধনের পথে রয়েছে এবিং হাতের কারুকার্য বহাল রেখেছে, যাতে কা’বাকে অতি আকর্ষণীও গেলাফ উপহার দেওয়া সম্ভব হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন