শুক্রবার, ১৪ আগস্ট, ২০১৫

উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ওলামায়ে দেওবন্দ



মুসলমানদের হাত থেকে দিল্লির রাজমতা বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর মুসলমানদের সভ্যতা, দ্বীন ও ঈমানের ওপর ইংরেজদের আক্রমণ ছিল ভয়াবহ। ভূতপূর্ব মতাসীন জাতি হিসেবে তারা ছিল ইংরেজদের প্রধান প্রতিপ। তাই ইংরেজরা সুচতুর ব্রাক্ষ্মণ্যবাদী চক্র আকবরের ছত্রছায়ায় হিন্দু তন্ত্রের মাঝে লীন করে দিতে চাইল ইসলাম ও মুসলমানকে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-কলহ ঢুকিয়ে দিয়ে নিষ্পেষিত করার সম্ভাব্য সকল পন্থাঅবলম্বন করল তারা। মিশনারী তৎপরতা, স্কুল- কলেজ স্থাপন, হিন্দু আর্যসমাজীদেরকে উস্কানী দান, কাদিয়ানীদের উদ্ভব ঘটানো, বেরলভীদের চক্রান্তজাল সবই ছিল ইংরেজদের অবলম্বিত ষড়যন্ত্র। তা ছাড়া বিজিত পরিবেশে শিরক বিদআতের সম্প্রসারণ, হীনম্মন্যতার বৃদ্ধি তো আছেই। এমতাবস্থায় গোটা জাতির দ্বীন ও ঈমানের সংরণে দারুল উলূম ও উলামায়ে দারুল উলূম যে ত্যাগ ও অবদানের দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। বিশ্ব ইতিহাসে এর কোনো নজীর নেই। ব্রিটিশের যে কোনো ষড়যন্ত্রকে সহজেই উপলব্ধি করতে পরাধীন পরিবেশেতার উপযুক্ত প্রতিকার ও প্রতিরোধব্যবস্থা গ্রহণে উলামায়ে দেওবন্দ কখনোই পিছিয়ে ছিলেন না।খলিফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি এর খিলাফত কালেই হযরাত সাহাবায়ে কেরামের এক দল ইসলাম প্রচারের জন্য এ উপমহাদেশে আগমণ করেন। তাদের ইমানদ্বীপ্ত অকান্ত পরিশ্রমের ফলেই উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকায় মুসলিম শাসনের পথকে প্রশস্ত করে। এরই ধারাবাহিকতায় মুজাদ্দিদে আলফে সানি হযরত সায়্যিদ শায়খ আহমদ সারহিন্দি রাহ. সম্রাট আকবর কর্তৃক উদ্ভাবিত দ্বীন-ই এলাহী ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ দিকে যখন দেশে অরাজকতা ও নৈরাজ্য চরম শিখরে পৌঁছে যায়, তখন হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানির পথ ধরে তারই ভাবশিষ্য শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবী রাহ. এর বিপ্লবী চিন্তাধারা মুসলমান জাতির জন্য এক দিকদর্শনের কাজ করে। গড়ে উঠেন হযরত শাহ আবদুল আযীয, শাহ ইসমাইল শহীদ, সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শাহ আব্দুল হাই প্রমুখের নেতৃত্বে একটি বিপ্লবি জামায়াত।১৮০৩ সালে শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলবি রাহ. হিন্দুস্তানকে ‘দারুল হারব’ ঘোষণার মাধ্যমে এক বিপ্লবী ফতোয়া জারি করে ইংরেজ ও শিখদের বিরুদ্ধে জিহাদি আন্দোলন গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে এ ধারার এক মহান পুরুষ হাজি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি রাহ. নেতৃত্ব দেন ১৮৫৭ সালের সিপাহিবিদ্রোহ নামের প্রসিদ্ধ উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের । একে একে সুচিত হয় বালাকোট, সিতানা ও শামেলীর মতো রক্তয়ী সংগ্রাম।
স্বাধীনতা বিপ্লব চলাকালে হযরত হাজি সাহেবের নেতৃত্বে ওয়ালিউল্লাহি বাহিনী পুনঃপ্রস্তুতি গ্রহণ করে। থানাভনে তখন একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়। তাতে হযরত হাজি সাহেবকে আমীরুল মুমিনীন, হযরত নানুতবীকে সিপাহসালার, হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহিকে বিচারপতি নির্ধারণপূর্বক এই বাহিনী ‘বাগে শের আলী’ এবং শামেলীতে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। উভয় স্থানে মুজাহিদদের জয় লাভ হলেও ১৮৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর দিল্লির বাদশাহ ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পন করে বসে এবং ইংরেজরা দিল্লিকে পূনর্দখল করে নেয়। এরপর তারা থানাভনে প্রচণ্ড আক্রমণ চালালে হাজি সাহেবের পে এই জিহাদ চালানো সম্ভব হয়নি। ফলে হাজি সাহেব বাধ্য হয়ে মক্কা শরীফ হিজরত করেন। তখন থেকে আলেমদের ওপর নেমে আসে ইংরেজদের অত্যাচারের স্টীম রোলার। খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতকে ব্যাপক কুসংস্কার ও ক্রমাগত বস্তুতান্ত্রিক চিন্তা ও দর্শনের প্রতিরোধ হিসাবে হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ যে আমুল সংস্কার ও শিা বিস্তার আন্দোলন সূচনা করেন কালক্রমে সেটি শাহ আবদুল আযীযের আমলে সশস্ত্র যুদ্ধে অবতরণ পর্যন্তঅগ্রসর হয়। ১৮৫৭ সালে সংঘটিত বিপ্লব পর্যন্ত শাহ আবদুল আযীয কর্তৃক দিল্লির উপকণ্ঠে প্রতিষ্টিত মাদরাসাটি কেন্দ্রের ভুমিকা পালন করে চলে আসছিল। ফলত এখান থেকেই শাহ ইসহাক রাহ., শাহ আবদুল গনী রাহ.সহ অপরাপর মনীষী বিপ্লবের সামগ্রিক চেতনা লাভ করেন।হযরত সায়্যিদ আহমদ শহীদ রাহ. এর জিহাদী তৎপরতা এখান থোকেই সুচিত হয়েছিল। অবশেষে ১৮৫৭ সালে ইংরেজরাএই মারকাযকে ধ্বংস করে দিলে ওয়ালিউল্লাহী আন্দোলন দারুণভাবে তিগ্রস্ত হয়। ১৮৫৭ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের পর আগ্রাসী শক্তি বস্তুবাদী তাহযীব ও তামাদ্দুন, সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিস্তারের ব্যাপক পদপে গ্রহণ করলে যুগ উপযোগি প্রতিরোধ হিসাবে মুজাহিদগণ স্থানে স্থানে কওমি মাদরাসা স্থাপনের উদ্যোগ নেন। সেই সুত্রেই যুগস্রষ্টা মনীষী হযরত নানুতবী রাহ. প্রতিষ্ঠা করেন উম্মুল মাদারিস দারুল উলুম দেওবন্দ। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই দেওবন্দিধারার আলেমদের ভুমিকা ছিল খুবই জোরালো ও গুরুত্বপূর্ণ। বিজয়ী সম্প্রদায় সর্বদা বিজিতদের মন-মস্তিস্ক থেকে স্বাধীনতার চেতনা বিনষ্ট করার প্রয়াস চালায়। এ েেত্র ইংরেজদের দতার অন্ত ছিল না। অথচ দারুল উলূম পরাধীন পরিবেশে অবস্থান করেও জাতিরস্বাধীনতার চেতনাকে অুন্ন রাখতে কেবল চেষ্টাই করেনি; বরং পরাধীনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতরণের জন্য গঠনমূলক কাজও চালিয়েগিয়েছে। এর ফলে দারুল উলূম থেকে বহুদিন যাবৎ আযাদী সংগ্রামের নেতৃত্ব অব্যাহত থাকে। এই দারুল উলূমের শিাবিদগণই গোটা দেশের হিন্দু জাতিকে স্বাধীনতার জন্য উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। পরবর্তীকালে স্বাধীনতা অর্জন ও পাকিস্তান সৃষ্টির নেতৃত্ব দানে দারুল উলূমেরআকাবিরদের তথা দেওবন্দি ধারার আলেমসমাজের অবদান অসামান্য।এই দেওবন্দেরই প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা কাসিম নানুতবী রাহ. নিজের গোটা জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন ইংরেজদের বিরুদ্ধে। প্রসিদ্ধ শামেলীর যুদ্ধে তিনিই ছিলেন প্রধানসেনাধ্য।উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে হযরত হাজি সাহেবের সঙ্গে হযরত রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রাহ.’র নামওসাহসের সঙ্গে উচ্চারণ করা যায়। মুজাহিদ দলের গঠিত অস্থায়ী সরকারের তিনি ছিলেন প্রধান বিচারপতি। মুজাহিদদের প্রথম অভিযানটি পরিচালিত হয়েছিল শের আলীবাগান থেকে। এই অভিযাত্রী মুজাহিদ দলে তিনি ছিলেন সেনাধ্য। যুদ্ধশেষেব্রিটিশ সরকার হযরতকে কারারুদ্ধ করেন। ছয়, মতান্তরে নয় মাস পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।তৎকালীন অবস্থা ও পরিবেশের প্রোপটেশায়খুল হিন্দ রাহ. সর্বাত্মকভাবে আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য তিনটি প্রধান মুলনীতি নির্ধারণ করেন।এক. উপমহাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ।দুই. সর্বভারতীয় জাতীয়তাবাদ।তিন. প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীর জন্য নিজ নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতি রার পরিপূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা। এই তিনটি মুলনীতির ওপর আস্থা নিয়ে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আন্দোলনের প্রতি হযরতের নিষ্ঠা ও অবিচলতা এতো বেশি ছিল যে, তিনি বলতেন, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করাকে আমি আমার ঈমানের অংশ মনে করি।
শায়খুল হিন্দ সম্পর্কে জনৈক ইংরেজগর্ভণর স্যার স্পিনস্টন মন্তব্য করে বলেছিলেন যে, এই ব্যক্তিকে যদি পুড়ে ছাই করা হয়, তাহলে তার দগ্ধ ছাইগুলি পর্যন্ত এমন গলিতে যাবে না যেখানে কোন ইংরেজ বাস করে। রাজনৈতিক সচেতনতার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়, শায়খুল হিন্দ শুধু উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের স্বার্থেই বৃটিশের বিতাড়ন জরুরি মনে করতেন না; বরং তার চিন্তাধারা ছিল ভারতের বাণিজ্যমূলে বৃটিশ এশিয়াসহ গোটা বিশ্বের উপর শোষণ চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলতেন, “বৃটিশকে ভারতবর্ষ থেকে উৎখাত করা মানে গোটা বিশ্বকে বস্তুবাদের যাতাকল থেকে নিস্কৃতি প্রদান করা।’’ মাল্টা দ্বীপে বন্দী থাকাকালে তিনি কারারুদ্ধ আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দের মাঝেও এই যুক্তি ও প্রেরণা সম্প্রসারিত করেছিলেন। আন্দোলনকে কার্যকরি করার জন্য শায়খুল হিন্দ ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে এবং বহির্ভাগে উভয় দিক থেকে তৎপরতা পরিচালনা করেন ।বিশ্বে প্রথম মহাযুদ্ধ ঘোষিত হলে ইংরেজ সরকার তুর্কি খেলাফতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পরিস্থিতির বিচারে শায়খুল হিন্দ ভারতবর্ষে ইংরেজকে পর্যুদস্ত করার ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন। এ উপলে সীমান্ত থেকে তাৎণিক যুদ্ধ পরিচালনার প্রোগাম দিয়ে মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে প্রেরণ করা হয়। মাওলানা সিন্ধি প্রোগামসহ কাবুলের সর্দার নাসরুল্লাহ খান, আমীর হাবীবুল্লাহ খান, সর্দার এনায়েত উল্লাহ খান এবং তুর্কি ও জার্মান মিশনের সঙ্গে মিলিত হন। স্থানীয় ব্যাক্তিবর্গসহ রাজা মহেন্দ্র প্রতাপ ও লালাজিত প্রমুখের সমন্বয়ে তখন একটি স্বাধীন প্রবাসী সরকার প্রতিষ্ঠা ওপরিপূর্ণ একটি যুদ্ধ প্রোগ্রাম রচনা করা হয়। প্রবাসী সরকারের তরফ থেকে রাশিয়া জাপান ও তুরস্কে মিশন প্রেরণ করা হয়। এ সকল বিষয়ে মাওলানা সিন্ধি শরিক থাকেন এবং নিজে এর বাস্তবায়নের জন্য আফগান এলাকায় জুনুদুল্লাহ নামে একটি সামরিক সেবামুলক সংগঠনও কায়েম করেন।মাওলানা সিন্ধি কাবুল থেকে শায়খুলহিন্দকে তিন টুকরো হলুদ রেশমী কাপড়ে ইত্যাকার বিষয়ে যাবতীয় সংবাদ জানিয়ে চিঠি লিখেন। তারপর এই চিঠিগুলো শেখ আবদুর রহীম সিন্ধির নিকট পাঠিয়ে বলে দেন যে, তিনি যেন শীঘ্রই চিঠিগুলি হযরত শায়খুল হিন্দের নিকট পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। কিন্তু সেই চিঠি হযরত শায়খুল হিন্দের কাছে পৌঁছেনি। কতিপয় গাদ্দারের কারণে এগুলি পৌঁছে যায় পাঞ্জাবের গভর্নরমাইকেল ওডায়েরের হাতে। এভাবেই শায়খুল হিন্দের এতদিনের গোপন আন্দোলন ইংরেজদের কাছে ফাঁস হয়ে যায় । অবশেষে ইংরেজ গোয়েন্দারা এই সুত্র ধরে অতিরিক্ত তদন্ত চালাতে থাকে এবং বেশ ক’জন কর্মীর নামউদ্ধার করে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ চালায়।পরিণামে শায়খুল হিন্দ প্রমুখকে মক্কা শরীফ থেকে গ্রেফতার করা হয়। শায়খুল হিন্দ মাল্টা কারাগারে প্রায় চার বছর পর্যন্ত সমূহ নির্যাতন ভোগ করার পর অবশেষে ১৯২০ সালের ৮ জুন মুক্তি লাভ করেন।
১৮৫৭ সালের রেশমী রুমাল আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর উপমহাদেশের আলেমসমাজ সশস্ত্র আন্দোলনের পথ পরিহার করে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেন। এই ল্েয ১৯১৯ সালের ১৮ নভেম্বর দিল্লিতে অনুষ্ঠিত খেলাফত কনফারেন্স এর শেষ দিনে মাওলানা আব্দুল বারী গংদের নিয়ে দেওবন্দি আলেমগণের উদ্যোগে গঠিত হয় জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।শায়খুল হিন্দের পর ওলিউল্লাহি বাহিনীর মুজাহিদ আলেমগণ জমিয়তে উলামা এর মঞ্চ থেকে সংগ্রামী তৎপরতা অব্যাহত রাখেন। মুফতি কেফায়ত উল্লাহ রাহ., শায়খুল ইসলামমাদানি রাহ., মাওলানা হিফজুর রহমান রাহ., মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি রাহ. প্রমুখ আলেম তাদের নেতৃত্ব দেন। খেলাফত আন্দোলনে তাদের শক্তিশালী ভুমিকার কারণে ইংরেজরা তাদের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালায়।১৯২৩ সালে দেওবন্দিধারার আলেমদের সংগঠন জমিতুল উলামার মঞ্চ থেকেই সুস্পষ্ট ভাষায় কুকমাতার সম্মেলনে ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানানো হয়।বলাবাহুল্য, ১৮৮৫ সালে বাঙ্গালি উকিল উমেশচন্দ্র ও ইংরেজ অফিসার মি.হিউম এর নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস গঠন করা হয়েছিল এবং ১৯০৫ সালে ইংরেজদের পূর্ণ সহযোগিতায় স্যার সালিমুল্লাহ প্রমুখের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় মুসলিমলীগ গঠিত হয়। উভয় সংগঠনের কোনোটিই স্বাধীনতার মহান লকে নিজেদের ল ও উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেনি। শায়খুল হিন্দের হাতে প্রশিণপ্রাপ্ত নেতা গান্ধি যখন কংগ্রেসে প্রবেশ করলেন তখন কংগ্রেসইংরেজ বিরোধী ভুমিকার দিকে অগ্রসর হয় এবং ১৯৩০ সালে স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করে ইংরেজ পোষ্যতার নীতি পরিহার করে। লীগ সর্বদাই ইংরেজ তোষণ নীতিতে বিশ্বাস করে কখনিই স্বাধীনতার দাবি উত্থাপণ করেনি। ১৯৩০ সালে গান্ধি স্বাধীনতার দাবিতে অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করলে সংগ্রামী আলেমগণ তার পুর্ণ সহযোগিতা করেন। গান্ধিসহ মুফতি কেফায়তুল্লাহ, আব্দুল গফফার খান প্রমুখ পুনরায় বন্দি হন। ১৯৩১ সালে সংগ্রামী আলেমদের সমন্বয়ে পুনরায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। তখন মুফতি কেফাতুল্লাহ, সায়্যিদ আতাউল্লাহ সাহেব বুখারি ও ডা. আনসারি প্রমুখ নেতা কারারুদ্ধ হন ।২য় বিশ্বযুদ্ধের পর ইংরেজদের ভারতছেড়ে যাওয়া প্রায় নিশ্চিত হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরা দেশের স্বাধীনতাকামি শক্তিগুলোর সঙ্গে সন্ধি করলে যুদ্ধকালীন সময়ের জন্যআন্দোলন স্থগিত থাকে। যুদ্ধ সমাপ্তির পর ১৯৩৫ সালে ইন্ডিয়া এ্যাক্টের অধিনে সাধারণ নির্বাচন ঘোষিত হলে জমিয়তে উলামা কতকগুলি শর্তের ওপর লীগকে সমর্থন জানায়। বিজয়ের পর লীগ ওয়াদা ভঙ্গ করলে জমিয়ত সর্মথন প্রত্যাহার করে। ১৯৪২ সালে আলেমগণ ভারতের গণমানুষেরসঙ্গে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাজপথে ব্রিটিশবিরোধী মিছিল বের করলে মাওলানা হিফজুর রহমান, মাওলানা মাদানি প্রমুখ গ্রেফতার হন। স্বাধীনতা আন্দোলনের ব্যাপক সাড়া জাগলে লীগ পাকিস্তান প্রস্তাবের নামে দেশ বিভক্তির প্রস্তাব পেশ করলে জমিয়ত ও কংগ্রেসের কেউই এই প্রস্তাব সমর্থনকরেনি। আলেমগণ তখন এই প্রস্তাবের বিপরীতে আরেকটি ফর্মূলা পেশ করেন। ইতিহাসে এটি মাদানি ফর্মূলা নামে পরিচিত।
১৯৪২ সালে লাহোর সম্মেলনে পেশকৃত এই ফর্মূলায় অখণ্ড ভারতকে সমর্থন করে ভারতবর্ষের জন্য শাষণতান্ত্রিক নীতি সম্পর্কে প্রস্তাব করা হয় যে,১. ভারতবর্ষের পুর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।২. মাতৃভুমির পাশাপাশি ধর্মীয় সকল স্বাধীনতা থাকবে।৩. শাসন প্রণালির মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ট সম্প্রদায় সংখ্যালঘূর ওপর শোষণ চালাতে পারে এমন কোনো অবকাশ রাখা হবে না। কিন্তুতৎকালীন গণজোয়াড়ে আলেমদের এ সকল প্রস্তাব বন্যায় ভেসে গিয়েছিল।তখন স্বাধীনতার প্রশ্নে ভারতের রাজনৈতিক মহলে দেখা দেয় চরম মতানৈক্য। উপমহাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দু’বছর পূর্বে যৌক্তিক কারণেই আন্দোলনের দুই সিপাহসালার মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি ও মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানির (যিনি পরবর্তীতে লীগের নেতৃত্বপর্যায়ে পৌঁছেন ) মধ্যে পাকিস্তান সমর্থন করাকে কেন্দ্র করে বিভক্তির সূচনা হয় ।১৯৪০ সালে মুসলিম লীগের লাহের সম্মেলনে মুসলমানদের জন্যে পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরবর্তীতে সে আন্দোলন পাকিস্তান আন্দোলনে রূপ নেয়।১৯৪২ সালে মুফতী মাহমুদ স্বদেশ চলে আসেন। প্রাদেশিক জমিয়তের প্লাটফরম থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।১৯৪১ সাল। তখন বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল তুঙ্গে। ইংরেজ আমলের এই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা এটা ছিল হিন্দু মুসলমানদের সর্বশেষ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন। ব্রিটিশ বিরোধী এ আন্দোলনে কংগ্রেসের হিন্দুরা সর্বদাই ছিলেন সংশয়বাদী । কিন্তু ওলামায়ে দেওবন্দ সে সংশয়ের ধারে কাছেও যাননি কখনো। তাদের বীরদ্বীপ্ত ভূমিকার ফলেই আজ পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে পৃথিবীর মানচিত্রে তিন তিনটি স্বাধীন রাস্ট্র গঠিত হয়েছে। ১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট পাকিস্তান ও ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীনতা লাভ করেছে। পরবর্তীতে সঙ্গত কারণেই পাকিস্তান ভেঙ্গে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ।ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিপুরূষ হিসেবে খ্যাত, দারুল উলূম দেরবন্দের সূর্যসন্তান মাওলানা মাদানির ভুমিকা যে কত বলিষ্ঠ এবং তার অবদান যে কত বেশি ছিল, পাছে লেখার কলেবর বেড়ে যায় তাই সংপ্তি বিবরণ দিয়েই লেখার ইতি টানবো।মাওলানা মাদানি শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানের স্থলবর্তী হওয়ায় গোটা ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে তাকে ছুটেবেড়াতে হয়েছে বেগবান উল্কার মতো।আর তুর্যবাদকের মতো স্বাধীনতার অগ্নিময় বাণী প্রচার করে জাগিয়ে তুলতে হয়েছে চেতনাহারা স্বজাতির লোকজনকে। অনুসারিরা হযরত শায়খুুল হিন্দের পর তাকেই তাদের ধর্মীয় রাজনৈতিক মুরব্বীরূপে জ্ঞান করতো। তাই গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিবেশনগুলোতে তাকে সভাপতিত্ব করতে হতো।মাওলানা মাদানির কলকাতার শিকতার যুগেই তিনি কলকাতা থেকে মাওলানা মুহাম্মদ আলীর সভাপতিত্বে ৮ ও ৯ জুলাই ১৯২১ ইং তারিখে করাচিতে অনুষ্ঠিত খিলাফত সম্মেলনে যোগ দেন এবং ঐতিহাসিক প্রস্তাব পেশ করে সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ বিস্তারের অভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে ছ’বছর কারাভোগ করেন।১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে কোকনদে কংগ্রেস, খিলাফত আন্দোলন এবং জমিয়তে উলামার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসব সম্মেলনের সভাপতিত্ব করেনযথাক্রমে মাওলানা মুহাম্মদ আলী মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি । সভাপতির ভাষণে মাওলানা মাদানি সেখানে শুধু ভারতবর্ষের নয় গোটা এশিয়া মহাদেশের দেশ ও জাতিসমুহের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানান। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস এরূপ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেছিল তারও দীর্ঘ ছয় বছর পর ।
১৯২৭ সালে সর্বপ্রথম হযরত মাদানিই সাইমন কমিশনকে বর্জনের ডাক দেন। তারপরই কংগ্রেস ও অন্যরা তা বর্জন করেছে ১৯২৯ সালে। ১৯৩০ সালে জমিয়ত কংগ্রেসের সাথে সহযোগিতার নীতি গ্রহণ করে। কংগ্রেসের সাথে মিলে আইন অমান্য করতে গিয়ে ১৯৪২ সালের ২৫ জুন মুরাদাবাদ জেলার জমিয়তে উলামার সম্মেলনে মাওলানা মাদানির আগুনঝরা বক্তৃতার জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং নেনী জেলে বন্দি করে রাখা হয়। অবশেষে দু’বছর দু’মাস বন্দি রাখার পর ১৯৪৪ সালের ২৬আগষ্ট তারিখে তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি লাভের পর তিনি যখন দেওবন্দে এসে উপস্থিত হন তখন মাদরাসায় রমযানের ছুটি ছিল। দেওবন্দবাসীরা এত বিপুল সংখ্যায় সমবেত হয়ে তাকে এমন বীরোচিত সম্বর্ধনা প্রদান করেন যে, তা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলে। কারাগারে সেবারে ইংরেজরা তার প্রতিযে অমানুষিক অত্যাচার করে তাতে তার দেহের ওযন ৪০ পাউন্ড কমে গিয়েছিল।১৯৩২ ও ১৯৩৩ সাল ছিল মাওলানা মাদানির অত্যন্ত ব্যস্ততার দু’টি বছর। খিলাফত আন্দোলনের সমাপ্তিতে ভারতবর্ষের ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের রাজনৈতিক চেতনার েেত্র তখন অনেকটা হতাশার ভাব। এ মন্দাভাব কাটিয়ে মুসলমানদেরকে হিন্দুদের সমপর্যায়ে রাখার জন্য তার ব্যস্ততার অন্ত ছিল না। জমিয়তের পতাকা নিয়ে তিনি তখন সীমান্ত থেকে আসাম পর্যন্ত চষে বেড়ান। বৃটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তার অগ্নিগর্ভ বক্তৃতা শুনে ভারতবর্ষের মুসলমানদের মধ্যে নবচেতনার সঞ্চার হয়।১৯৩৫ সালের ভারত-শাসন আইনে স্বতন্ত্র নির্বাচনের নীতি গৃহীত হয়। ১৯৩৬ সালে দিল্লি প্রদেশ জমিয়তের সাংগঠনিক তৎপরতা মি. জিন্নাহ ও লীগ নেতারা নিকট থেকে প্রত্য করেছিলেন। তাই মুসলিমলীগের প থেকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার প্রস্তাব এল। “বৃটিশ-তোষা সামন্ত শ্রেণীর লোকদের প্রাধান্য দেয়া হবে না (মি. জিন্নাহর এ সুস্পষ্ট অঙ্গীকার) এবং ধর্মীয় যে কোনো ব্যাপারে জমিয়তে উলামার সিদ্ধান্তই হবে চুড়ান্ত’ এ শর্তে জমিয়ত মুসলিম লীগের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে সম্মত হয়।ফলে ৫৬ সদস্যবিশিষ্ট সম্মিলিত মুসলিম পার্লামেন্টারি পার্টি গঠিত হয়। এতে কেবল জমিয়তের ২০ জন সদস্য স্থান পেয়েছিলেন। অন্যান্য জাতীয়তাবাদী মুসলিম সদস্যরা ছিলেন তার অতিরিক্ত। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং নিখিল ভারত মুসলিম লীগের দৃষ্টিতেও মাওলানা মাদানি এবং তার পরিচালিত জমিয়তে উলামা যে কী বিরাট মর্যাদার অধিকারী ছিল এটাই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। মাওলানা মাদানি তখন দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে দু’মাসের ছুটি নিয়ে এক বিরামহীন সাংগঠনিক সফর ও তৎপরতায় লিপ্ত হন। ঐ সময় ভারতবাসীর চোখে হযরত মাদানি হয়ে ওঠেন ‘শায়খুল ইসলাম মাদানি’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুচনা হলে ভারতীয় কংগ্রেসে শর্ত সাপেে যুদ্ধে বৃটিশ সরকারের সাথে সহযোগিতার প্রস্তাব পাশ করে। কিন্তু মাওলানা মাদানির নেতৃত্বে ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ সালে মীরাঠে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবে জমিয়তে উলামা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে, জমিয়তে উলামা রাজনৈতিক বা ধর্মীয়দৃষ্টিকোণ থেকেই যুদ্ধে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতাকে বৈধ মনে করে না ।মোদ্দাকথা, ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য দেওবন্দিধারার আলেমগণ যে ত্যাগ-তিতিার ইতিহাস রচনা করে গেছেন, তার নজির নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। কত শত আলেম জেল-জুলুম নির্যাতন ভোগ করেছেন, কত মাওলানা যে শাহাদতের অমিয় সুধা পান করে শহীদি রক্তের আঁকরে লেখে গেছেন, ‘ভারত তুমি স্বাধীন’, আজ থেকে তুমি ‘স্বাধীন ভারত’।সে কথা আমরা ভুলিনি। ভবিষ্যত প্রজন্ম তা কখনোই ভুলবে না। ইতিহাসের সোনালী পাতায় অনন্তকাল ধরে লেখা থাকবে “ভারতের স্বাধীনতা ওওলামায়ে দেওবন্দ” ।মহান আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে দেওবন্দি চেতনার সঠিক উপলব্ধি দান করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন