শনিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

ইলমে কালাম : খালদুনের চোখে

আধুনিক চিন্তার মৌলিক বৈশিষ্ট হল, জীবন, জগত ও সৃষ্টিকে মানুষের সূত্রে ব্যাখ্যা । মানুষ যা নিশ্চিত করতে পারে, যুক্তিতে প্রমাণ করতে পারে আধুনিক কালে তাই তথ্য ও তত্ত্ব আকারে মূল্যায়িত হয়। জ্ঞানের এই মানবিকরণের মাধ্যমে বিষয় ও সৃষ্টিকে যেমন ব্যাপকভাবে পাঠ করবার সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি মানুষ ও তার তার জ্ঞানের বিষয়ের মধ্যে নতুন সম্পর্কও সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ জ্ঞানের মাধ্যমে প্রভাবিত হচ্ছে, জ্ঞানও প্রভাবিত হচ্ছে মানুষের মাধ্যমে। এই দ্বিবিধ সম্পর্ককে বিচার না করে আধুনিক-জ্ঞানে নিশ্চিতি নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
আমরা জানি, প্রত্যেক চিন্তা ও বিশ্বাসের একটা পবিত্রতার দাবী করতে হয় সে যা বলে বা বলেছে, তার একটা সীমানা থাকে, যা বিশ্বাসী ও অধীনদের জন্য সে বাধ্যতামূলক আকারে হাজির করে। প্রতিষ্ঠিত প্রত্যেক চিন্তার মধ্যেই এই প্রবণতা থাকে_থাকতে হয়, নয়তো কোন চিন্তাই সাধারণ আকারে হাজির হতে পারেনা, বিশেষ থেকে যায় এবং বিশেষের মাধ্যমে কোন ব্যাখ্যা করা যায়না। মূলত অতীন্দ্রিয় ও অধিবিদ্যক অবস্থান বা অবস্থানহীনতার মাধ্যমে এই পবিত্রতার সৃষ্টি হয়।
জীবন, জগত ও সৃষ্টির অনেক কিছুই আমাদের সামনে হাজির নাই, স্থান ও কালের গতি-প্রকৃতিও সামগ্রিকভাবে আমাদের চিন্তায় হাজির হয়না। এখান থেকেই আসলে সঙ্কটটা শুরু হয়। আমার সামনে যা হাজির আছে, তা দিয়েই আমি গর-হাজিরকে বিচার করি এই যে আমাকে বিশ্বাস করতে হচ্ছে। বিশ্বাস ছাড়া অতীন্দ্রিয় বিষয় বা স্থানিক-কালিকতার সৃষ্ট দূরত্বের ইন্দ্রিয়জাত বিষয়কেও বিচার করা যায়না। এবং বিশ্বাস থেকেই পবিত্রতার সৃষ্টি হয়।
২) পবিত্রতা ও সার্বভৌমত্ব
পবিত্রতা ও বিশ্বাসকে, অতএব, মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায়না। মুশকিল হল, বিশ্বাস যদি স্থানিক বা কালিক হয় যাকে আমরা মানবিক ও ঐতিহাসিক বলতে পারি, তাহলে নির্দিষ্ট স্থান ও কালের বাইরে বাস্তবতার সাথে তার বিরোধ বাধে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটের সাথে মীমাংসা করে নতুন বিশ্বাস তৈরি করে নিতে হয়। এই হল, মানবিক চিন্তার প্রকৃতি। এর ব্যতিক্রম হলেই সংঘর্ষ বাধে।
ব্যতিক্রম মানে? বিশ্বাস যদি বাস্তবতাকে মানতে নারাজ হয় বা বাস্তবতা বিশ্বাসকে অস্বীকার করে বসে, তাহলে তাদের মধ্যে সার্বভৌমত্বের তর্ক শুরু হয়। আমি বিশ্বাস করছি বা বাস্তবতা আমার পক্ষে, ফলে তোমাকে আমি সুযোগ দিবনা এই যে আমিত্ব, একেই সার্বভৌমত্ব বলে। সার্বভৌমত্বে আবার রকমফের আছে।
প্রধানত ইচ্ছা ও চিন্তার মাধ্যমে মানুষের আমির সার্বভৌমত্ব হাজির হয়। যা কিছু ইচ্ছা আমি করতে পারি যদি আমার হাতে ক্ষমতা থাকে, তাহলে আমার ইচ্ছাই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে, বাস্তবতা বা বিশ্বাস যাই হোক, আমি তাকে ইচ্ছাইত করবো, আমার ইচ্ছা ছাড়া সব কিছুই নাকচ এই হল, ইচ্ছার সার্বভৌমত্ব। ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের সাথে চিন্তার সার্বভৌমত্বের মিল আছে শুধু ধরণে ফারাক। ইচ্ছা রাখঢাক মানেনা, সরাসরি অপরকে নাকচ করে এবং নিজেকে সত্য আকারে হাজির করে। অপরদিকে চিন্তার সার্বভৌমত্ব যদিও ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের প্রসারিত দিক যেখানে ইচ্ছা সরাসরি হাজির হতে পারেনা, সেখানে ইচ্ছা যুক্তি তৈয়ার করে, যে যুক্তি বুদ্ধি ও বিষয়ের নিজস্বতা রক্ষা করেনা।ফলে বিষয় ও বুদ্ধির নিজস্বতা নষ্ট হয়।   বুদ্ধি ও বিষয়ের দাবী যাই হোক, ইচ্ছা যুক্তির ভাষায় তাকে অস্বীকার করে। এভাবে চিন্তার মধ্যে “আমি” এর ইচ্ছাই হাজির হয়। এই আমি ও আমার ইচ্ছাই হল,সার্বভৌমত্বের সঙ্কট।
৩) বিশ্বাস, বিজ্ঞান ও দর্শন
আধুনিক চিন্তায় যেহেতু মানুষই কর্তা,সেই বিষয় পাঠ করে এবং মানুষের বিষয় আকারেই পাঠ করে, ফলে মানুষের বাইরের পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যায় । বিষয় যতই অতীন্দ্রিয় বা অধিবিদ্যক হোক, আধুনিক মানুষ তাকে মানবিক ও ঐতিহাসিক আকারেই পাঠ করে ফলে অতীন্দ্রিয় বা অধিবিদ্যক পবিত্রতা ভেঙ্গে যায় আবার যেহেতু কর্তা মানুষ, মানুষ বিশেষ স্থানে ও কালে বসে বিষয় পাঠ করছে, ফলে বিষয়ের মধ্যে সে একটা মানবিক পবিত্রতাও ঢুকিয়ে দেয়। এবং কর্তার ব্যক্তিআমিও অনেক সময় ইচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনা চিন্তায় সার্বভৌমত্বের সঙ্কট তৈরি হয়। মোটা দাগে আধুনিক চিন্তার এই হল প্রধান তিন সমস্যা ঐশী পবিত্রতা হরণ, মানবিক পবিত্রতাগ্রস্থকরণ এবং চিন্তায় ইচ্ছার সার্বভৌমত্বের দাবী।
আমরা দেখেছি, চিন্তায় ইচ্ছার সার্বভৌমত্ব বিষয় ও বুদ্ধির নিজস্বতা নষ্ট করে এবং পবিত্রতা বিষয়ে অসচেতনতা বিশ্বাসকে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানকে বিশ্বাসে পরিণত করে। ফলে বিশ্বাস, বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে অস্পষ্টতা তৈয়ার হয় বিরোধও। ফলে , স্বাভাবিকভাবেই, আধুনিক চিন্তায় নাকচ , ক্লান্তি , নৈরাশ্য, আত্মবিরোধ ও বৈপরীত্য সৃষ্টি হয় যাতে শুধু সে নিজেই আক্রান্ত হয়না, বরং অন্যকেও আক্রান্ত করে। আধুনিক চিন্তার মারেফাতের সন্ধান, নিজের ও অপরের বিশ্বাস ও সত্যের সাথে পরিচিত হওয়া জরুরি। এটা কীভাবে সম্ভব?
জটিল প্রশ্ন তবে ইসলামি ইতিহাসে কালামি চর্চার মাধ্যমে গ্রীক দার্শনিক চিন্তার একধরণের আত্মপরিচয় লাভ হয়েছে। গাজালি, ইবনে তাইমিয়া ও মাওলানা রুমির সূত্রে, নানা তরিকায়। এই বিভিন্নতাকে খালদুন খুব সংক্ষিপ্ত আকারে ধরতে চেষ্টা করেছেন। আমরা এই প্রবন্ধে খালদুনের কালামি চিন্তা পাঠ করতে চেষ্টা করবো।
৪) আলোচনার সীমা ও বিষয়
প্রথমেই, খালদুন ইলমে কালামের সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন। সাথেসাথেই তাওহিদের ধারণা নিয়ে আলোচনা করে, কারণতত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করেছেন কারণতত্ত্ব, কারণবিশ্বাস ও বোধ-বুদ্ধি-বর্ণনা। একটু অগ্রসর হয়ে তাওহিদ এবং তাওহিদের ইখলাস ও কামালিয়াত নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আকিদার আলোচ্য-বিষয় বর্ণনা করে বিদাত ও বিকারের আলাপ করেছেন। ইলমে কালামের উদ্ভব, বিকাশ ও তরিকার সংক্ষিপ্ত-বর্ণনা দিয়েছেন ।কালামের উদ্ভব, বিকাশ ও বিস্তার পর্বের কথা আলাদাভাবে আলাপ করেছেন। কালাম ও দর্শনের মিল-অমিল বয়ান করে সবশেষে ইলমে কালামের প্রায়োগিকতা বিষয়ে তার মন্তব্য দিয়ে শেষ করেছেন কালাম-অধ্যায়।
৫) ইলমে কালাম : কাকে বলে?
শুরুতেই একটা প্রশ্ন করি তর্ক ও যুক্তির ক্ষমতা কতদূর যুক্তি-তর্ক দিয়ে কি সত্য অর্জন করা যায়? যুক্তি পবিত্রতা ও সার্বভৌমত্বের সঙ্কট থেকে বেঁচে, আগেই যেমন বলেছি, সত্যের সাথে কীভাবে যোগাযোগ করে?
খালদুনের সংজ্ঞায় আমরা প্রশ্নটির মোকাবেলা করতে পারি ইলমে কালাম সত্য-বিশ্বাস বিষয়ে বৌদ্ধিক সূত্রের তর্ক ও সত্য-বিশ্বাসের বিকারের রোধ নিয়ে আলাপ করে।
( ৫০৬ পৃ) তর্ক, অতএব, খালদুনের প্রস্তাবে, সত্য-বিশ্বাস প্রমাণ ও তার বিকার রোধে কার্যকর।
এখানে আমরা দেখি, খালদুন তর্কে সত্য অর্জন হতে পারে কোন কোন মুতাকাল্লিমের এই অনুমান থেকে সরে এসেছেন। (দেখুন, শারহুল মাকাছেদ লিত তাফতাজানি, খণ্ড ১ পৃ ১৬৬ ও কাশশাফু ইসতেলাহাতিল ফুনুন লিত থানবি খণ্ড ১ পৃষ্ঠা ২৯) তর্ক কি তাহলে রক্ষা ও রোধেই সীমাবদ্ধ? খালদুন হয়তো এই অনুমানেও একমত নন। তিনি মনে করেন, একটা সীমা পর্যন্ত তর্ক সত্যের নিশানির খোঁজ দিতে পারে, তর্কে সরাসরি সত্য অর্জিত হয়না প্রমাণিত হয়। খালদুন তাহলে ফলপ্রসূ তর্কের একটা সীমা একে দিতে চাচ্ছেন। আলবাত, এ কারণেই শুরুতেই তিনি আলাপ করেছেন কারণতত্ত্ব বিষয়ে।
৬) তাওহিদ ও কারণতত্ত্ব
খালদুন মনে করেন, ইসলাম ধর্মের বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু হল তাওহিদ। এর সাথে কারণতত্ত্বের গভীর সম্পর্ক আছে। অতএব তিনি তাওহিদের, শুরুতেই, বুদ্ধিগ্রাহ্য প্রমাণ পেশ করেন,
“ জগতে যে কোন সৃষ্টি , চাই সে পৃথক সত্ত্বা হোক অথবা মানুষ বা প্রাণীর কর্ম, তার জন্য অগ্রবর্তী কার্যকারণের দরকার আছে যার মাধ্যমে সে অস্তিত্বে আসে এবং তার সৃষ্টি সম্পন্ন হয়। এবং এসব কার্যকারণও সৃষ্ট, ফলে এসব কার্যকারণের জন্য অন্য কার্যকারণের প্রয়োজন আছে। এভাবে কার্যকারণ অগ্রসর হতে থাকে শেষত মুসাব্বিবুল আসবাব, কার্যকারণের মূল স্রষ্টার কাছে পৌছে সুবহানাহু ও তাআলা”। এই যে একক স্রষ্টা, এই হল তাওহিদ।
কিন্তু প্রশ্ন হল, কার্যকারণ আল্লাহর কাছে পৌছে শেষ হয় কেন, সে তো অব্যাহতভাবে চলতে পারে? খালদুন এই আনুমানিক প্রশ্নের তরিকাগত উত্তর দেন,
“ কার্যকারণ অগ্রসর-পরম্পরায় বহুগুণে বৃদ্ধি পায় এবং দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সুবিশাল হয়ে দাড়ায়। তখন মানবিক বুদ্ধি তা ধরতে অক্ষম হয়ে যায় কেননা একমাত্র সর্বময় জ্ঞান ছাড়া তাকে আয়ত্ত করা সম্ভব নয়”।
খালদুন বলেন, আমরা যদি স্রেফ প্রাণীর কার্যাবলী নিয়ে ভাবি, তাহলে দেখব, প্রাণী-কার্যাবলী ইচ্ছার মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর ইচ্ছা মনস্তাত্ত্বিক বিষয়, অধিকাংশ সময় ইচ্ছা মনের অনুমানজাত হয়, সে অনুমান আবার হয়তো আরও কিছু অনুমান-পরম্পরাজাত। মনের অনুমানের কারণ অস্পষ্ট, কেননা কেউ মনের অনুমানের সূত্র ও পরম্পরা জানতে সক্ষম নয়। মানুষ মনের সূত্র ও পরম্পরা জানতে সক্ষম নয়। সে শুধু স্পষ্ট ও ধারাবাহিক কারণ জানতে সক্ষম। ধারাবাহিকতা ভেঙ্গে গেলে বা অস্পষ্টতা সৃষ্টি হলে সর্বময় জ্ঞান ছাড়া তাকে ধরা সম্ভব নয়_ এবং সর্বময় জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ এই হল তাওহিদের ধারণা এবং আমরা একই সাথে একে তাকদিরের ধারণাও বলতে পারি।
এ কারণেই ইসলামে কারণ-বিষয়ে জ্ঞান-উত্তর তত্ত্ব-তালাশ থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়। কেননা কার্যকারণ এমন এক উপত্যকা, যেখানে বুদ্ধি বিভ্রান্ত হয়, হাকিকত হাসেলে ব্যর্থ হয়। অনেক কার্যকারণ নির্ণয়ে পরম্পরা ঠিক রাখা যায়না ভুল করে বসে মানুষ, তার হাকিকতের তালাশে চ্যুতি ঘটে।
খালদুন আরও লেখেন,
“ মানুষ যখন কার্যকারণ তালাশ করতে থাকে,একসময় বাস্তবতা থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, সে সত্যকে অস্বীকার ও কুফুরি করে বসে। , , , , এ কারণেই ধর্ম আমাদেরকে কার্যকারণ-তালাশ থেকে বিরত থাকতে বলে এবং সামগ্রিক তাওহিদের নির্দেশ দেয়_ কুল হুয়াল্লাহু আহাদ , আল্লাহু , , , ,”
কারণ বিষয়ে খালদুনের মতামত নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে খুব স্বাভাবিকভাবে অভিজ্ঞতাবাদের জায়গা থেকে প্রশ্ন হবে। খালদুনের জায়গা থেকে তার উত্তরও দাড় করানো যায় বিস্তারিত ভাবে। খালদুন ইমাম রাজির মুহাসসেলু আফকারিল মুতাকাদ্দিমিন ওয়াল মুতাআখখিরিন বইয়ের সার-সংক্ষেপ লুবাবুল মুহাসসিল নামে লেখেছেন। তবুও, এখানে আমরা বিস্তারিত ব্যাখ্যায় যাচ্ছিনা খালদুনের বক্তব্যের কয়েকটা সূত্র বরং তোলে ধরছি, সতর্ক-পাঠক ধরতে পারবেন অভিজ্ঞতার বাইরে কারণের প্রামাণ্যতা, কারণের অব্যাহত-হওয়াকে নাকচ, কারণ-যাচাইয়ের সঙ্কট, কারণ-তাওহিদ। এই সূত্রে অভিজ্ঞতাবাদের প্রশ্নের উত্তর হতে পারে। ( কারণতত্ত্ব বিষয়ে বিস্তারিত দেখুন,জামেয়াতুল আজহারের বর্তমান প্রধান শায়খ আহমদ তৈয়বের মাবদাউল ইল্লিয়াহ : বাইনান নাফি ওয়াল ইছবাত)
খোলাসা বললে, খালদুনের চোখে, অতএব, স্পষ্টতা ও পরম্পরা রক্ষারশর্তে বুদ্ধি কারণ ধরতে পারে। এই সীমানা নির্ধারণে কি বুদ্ধি অমূল্যায়িত হচ্ছে?
৬ )বুদ্ধি, বোধ ও ধর্মীয়-বর্ণনা
কতদূর মানুষের বুঝাবুঝি সক্রিয় থাকে, এর সীমানা নির্ধারিত করা জরুরি। খালদুন লেখেন, “ আপনার মননশক্তি যদি এই ধারণা জন্মায় যে, সে সৃষ্টিজগত ও তার কার্যকারণ সম্পর্কে সামগ্রিকভাবে অবহিত হতে পারবে এবং অস্তিত্বের সমুদয় পর্যায় বিষয়ে জানতে পারবে, তাহলে তার উপর নির্ভর করবেননা। কেননা প্রত্যেক উপলব্ধিকারীর কাছে অস্তিত্ব তার বোধেই সীমাবদ্ধ, আদতে কিন্তু এ ঠিক নয়। লক্ষ্য করুন, বধিরের কাছে কীভাবে অস্তিত্ব চার ইন্দ্রিয়ে সীমাবদ্ধ যায় এবং সম্পূর্ণ ধ্বনি- অস্তিত্ব নাকচ হয়ে যায়”। এই সতর্কতা দিয়ে খালদুন বোধ ও বুদ্ধির আলোচনা শুরু করেন।
“আমাদের বোধ সৃষ্ট ও ঐতিহাসিক। আল্লাহর সৃষ্টি মানুষের চোখের সৃষ্টি অপেক্ষা বিস্তৃততর”। , , , , , বুদ্ধি শুদ্ধ নিক্তি তার সূত্রাবলিতে সন্দেহ নাই’’। খালদুনের পরামর্শ বরং সীমার অতিক্রম না করে বুদ্ধি-বিবেচনা করা। “বুদ্ধির একটা সীমা আছে, সেই সীমায় সে সক্রিয় হতে পারে এবং তা অতিক্রম করতে পারেনা”।
বুদ্ধির সূত্রাবলি শুদ্ধ এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে খালদুন বুদ্ধি শুধু ইন্দ্রিয়-অনুভূতিতে সীমাবদ্ধ,বুদ্ধির নিজস্ব কোন সূত্র নেই, এই অনুমানকে নাকচ করছেন। মানে বুদ্ধি শুধু ইন্দ্রিয় অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়জাত চিন্তার অনুভূতিতেই সীমাবদ্ধ কারণতত্ত্ব শুধু প্রথা ও অভ্যাসনির্ভর এই অনুমান তিনি মানেননা। অন্যদিকে বুদ্ধিকে পবিত্র ওসার্বভৌম   করে তোলা মানে বুদ্ধি পবিত্র চিন্তা নির্মাণ করতে সক্ষম, যে চিন্তা সাধারণ-বুদ্ধির দ্বারা বিচার্য নয় অথবা বস্তু ও অস্তিত্বের শর্ত ছাড়াই এককভাবে বুদ্ধি সামগ্রিক সত্য ধরতে সক্ষম, খালদুন এই অনুমানকেও নাকচ করেন। অতএব, খালদুনের কাছে বুদ্ধিইন্দ্রিয়-অনুভূতিতে সীমাবদ্ধ নয়, তার নিজস্ব সূত্র আছে, বুদ্ধি পবিত্র চিন্তা সৃষ্টি করতে পারেনা এবং বুদ্ধি সার্বভৌমভাবে চিন্তা করতেও সক্ষম নয়। আমরা বলেছিলাম, কারণতত্ত্ব ও বুদ্ধির ধারণার সাথে খালদুন তাওহিদের ধারণাকে সম্পৃক্ত করেন। কি অর্থে?
খালদুনের মুখেই শুনুন,
“ কার্যকারণ পরম্পরাগতভাবে ঊর্ধ্ব-গমনের মাধ্যমে হয়তো একসময় আমাদের অস্তিত্ব ও বোধকে অতিক্রম করে যায়, সে তখন আর বোধগম্য থাকেনা বুদ্ধি তখন তার অনুসন্ধানে খেয়ালের জগতে বিচরণ করে , ক্রমশ দিশাহারা ও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কাজেই তাওহিদ হল, কার্যকারণ ও তার পরম্পরাগত প্রভাবের চরম-উপলব্ধির অক্ষমতা প্রকাশ এবং কারণের স্রষ্টা ও সর্বময় জ্ঞানীর কাছে আত্মসমর্পণ”।
৭) তাওহিদের কামালিয়াত
এই পর্যন্ত খালদুন মুতাকাল্লিমিনদের তরিকা থেকে খুব বেশী সরে আসেননি তবে তাওহিদের কামালিয়াতের ধারণা যোগ করে খালদুন মুতাকাল্লিমিনদের থেকে তার স্বতন্ত্রতা প্রকাশ করেন। কেননা ধর্ম শুধু আন্তরিক বিশ্বাসেই সীমাবদ্ধ নয় ধর্ম এক সামগ্রিক ব্যবস্থা, যা বুদ্ধি, মন , দেহ ও ইন্দ্রিয়, সবকিছুকেই শামেল করে।
খালদুন লেখেন,
“ তাওহিদের ক্ষেত্রে শুধু ঈমান আনাই কাফি নয়, কারণ সে তো আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি মাত্র মনের বিষয়। বরং তাওহিদের কামালিয়াত হল, তাওহিদের গুণ অর্জন করা। তেমনি আমল ও ইবাদতের উদ্দেশ্য হল, আনুগত্যের যোগ্যতা সৃষ্টি করা এবং অন্তরকে আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছু থেকে মুক্ত করা যার মধ্য দিয়ে আল্লাহর পথের সালেক-পথিক রাব্বানিয়াত হাছেল করতে পারে। , , , বিশ্বাসের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও গুণান্বিতের মধ্যে ফারাক হল, কথা ও গুণান্বিতের মধ্যকার তফাতের মত। , , ,   অসংখ্যবার আমল ছাড়া শুধু তাওহিদের জ্ঞানে তাওহিদের গুণ অর্জিত হয়না। অসংখ্যবার আমলে তাওহিদি যোগ্যতা অর্জন হয় গুণ ও হাকিকত-সাধনা হাছেল হয়। এধরনের দ্বিতীয় পর্যায়ের জ্ঞান আখেরাতের সাপেক্ষে উপকারি। গুণ ও দশাহীন জ্ঞান কম উপকারি অবশ্য অধিকাংশ চিন্তকের জ্ঞান এ ধরণের। তবে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, চর্চায় গড়ে উঠা “হালি” জ্ঞান( তাওহিদের হালের গুণান্বিত জ্ঞান)’’।
এভাবেই খালদুন, বৌদ্ধিক যুক্তির মাধ্যমে তাওহিদ লাভকে প্রাথমিক পর্যায় মনে করলেও তিনি তাওহিদি গুণঅর্জনকেও জরুরি মনে করেন। তাওহিদে আমল-ইবাদতের গুণ, আবার আমল-ইবাদতে তাওহিদের গুণ, এই হল কামালিয়াত। জ্ঞান আকারে ঈমানে সবাই সমান, তবে গুণ আকারে ঈমানের বিভিন্ন স্তর আছে গুণঅর্জন ভেদে ঈমানে তফাত হয়ে যায়।
আমরা যখন তাওহিদ গ্রহণ করবো, বৌদ্ধিকভাবে ও চর্চাগতভাবে ধর্মপ্রবর্তক আমাদের জন্য কিছু বিষয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন, যাতে আমরা ঈমান আনবো ও মুখে স্বীকার করবো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সংক্ষিপ্তভাবে তা বর্ণনা করেছেন আন তু”মিনা বিল্লাহে ও মালাইকাতিহি ও কুতুবিহি ও রুসুলিহি ওয়াল ইয়াওমিল আখেরে ওয়ান তু”মিনা বিলকাদরি খাইরিহি ও শাররিহি!
মোটাদাগে এগুলোই ইলমে কালামের আলোচ্য বিষয় তরিকা, বর্ণনা ও ভাষাগত বৈচিত্র্যের সহযোগে।
৮) ইলমে কালামের আলোচ্যবিষয়
যেহেতু আমরা আল্লাহর তাওহিদে বিশ্বাস করেছি, স্পষ্ট ও পরাম্পরাগত কার্যকারণ থেকে তার মারেফাত লাভ করেছি, তাওহিদ ও মারেফাতের গুণ ও দশা অর্জন করতে আগ্রহী হয়েছি, ফলে সমস্ত বিষয় তার ক্ষমতায় ফেরানো এবং সমস্ত বিষয়ের সাথে তাকে সার্বভৌম করা আমাদের দায়িত্ব। আমরা জেনেছি, মৃত্যু হাজির হলে এই ঈমানেই আমাদের মুক্তি। তবে আমরা আল্লাহর জাত পাক ধরতে সক্ষম নই, তাঁর জাতে পাক আমাদের বোধের ঊর্ধ্বে। তাই তাওহিদ ও মারেফাত গ্রহণের ফলে আমাদের কিছু বিষয় বিশ্বাস করতে হয়।
প্রথমত, তাঁর জাতকে সৃষ্টির সাথে তুলনা থেকে পবিত্র রাখতে হবে সৃষ্টির মত হয়ে গেলে তাকে তো আর স্রষ্টা বলা যাচ্ছেনা। দ্বিতীয়ত, তাকে অসম্পূর্ণতার দোষ থেকে পবিত্র রাখতে হবে অন্যথায় তিনি সৃষ্টির মত হয়ে যাচ্ছেন। তৃতীয়ত, সৃষ্টির ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদের স্বীকৃতি দিতে হবে একাধিক স্রষ্টা থাকলে তো তাদের মধ্যকার বিরোধের কারণে সৃষ্টি পূর্ণ হবেনা। চতুর্থত, বিশ্বাস করতে হবে, তিনি জ্ঞানী ও কাদেরে মুতলাক( সার্বভৌম জ্ঞান ও ক্ষমতার অধিকারী) সার্বভৌম জ্ঞান ও ক্ষমতার মাধ্যমেই তো সৃষ্টিতে পূর্ণতা আসে। পঞ্চমত, বিশ্বাস করতে হবে, তিনি সামগ্রিক-ইচ্ছার অধিকারী অন্যথায় সৃষ্টি থেকে কীভাবে পার্থক্য করবেন? ষষ্টত, বিশ্বাস করতে হবে, তিনিই তাকদির-কর্তা ও নির্ধারক তাঁর নির্ধারণ ছাড়া তো মানুষের ইচ্ছা স্থানিক ও কালিক, চিরন্তন নয়, অথচ সত্যের নির্ধারণ তো চিরন্তন। সপ্তমত, বিশ্বাস করতে হবে, মৃত্যুর পর তিনি পুনরত্থিত করবেন অন্যথায় তাঁর সৃষ্টি অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। অষ্টমত, বিশ্বাস করতে হবে, চিরমুক্তির পয়গাম নিয়ে নবিরা আগমন করবেন, ভালো ও শুভর দাওয়াত দিবেন। নবমত, বিশ্বাস করতে হবে, জান্নাত পুরস্কার ও জাহান্নাম শাস্তির জন্য নির্মিত।
এই হল, ইলমে কালামের মূল আলোচ্য বিষয়, বৌদ্ধিক সূত্রে প্রমাণিত। কোরআন-হাদিসেই এর প্রচুর প্রমাণ আছে। এসব সূত্র থেকেই সালাফ আকিদাগ্রহণ করেছেন। ইমামগণ বিশ্লেষণ-বিবেচনা করেছেন। উলামাগণ মানুষকে দাওয়াত দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তীতে বিস্তারিত আকিদার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয় এর অধিকাংশই আয়াতুল মুতাশাবিহাত থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এবং অধিকতর নিশ্চিতির মামলা ও বিধর্মীদের সন্দেহ-প্রশ্নও উত্থাপিত হয়। ফলে তর্ক-পর্যালোচনা শুরু হয়, ধর্মীয় বর্ণনার পাশাপাশি বৌদ্ধিক যুক্তিও উপস্থাপিত হয়। এভাবেই বিষয় আকারে ইলমে কালাম দাড়িয়ে যায়।
৯) ইলমে কালাম : উদ্ভবপর্ব
খালদুন লেখেন, কোরআনে অনেক আয়াতে আল্লাহকে পবিত্র হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে সৃষ্টির সাথে মিল থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র হিসেবে। ব্যাখ্যাহীনভাবেই সে আয়াতগুলোর অর্থ স্পষ্ট। অতএব এর উপর ঈমান আনা জরুরি। নবীজি, সাহাবা ও তাবেইনরা স্পষ্ট অর্থেই এর ব্যাখ্যা করেছেন। তবে কোরআনের কিছু আয়াতে এমন কিছু শব্দ আছে, যাতে আল্লাহর সৃষ্টির মত হবার সন্দেহ সৃষ্টি করে এর কিছু আয়াত সত্ত্বা বিষয়ক আর কিছু ছিফাত বিষয়ক। সালাফে ছালেহিনরা পবিত্রতার আয়াতকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন পবিত্র বিষয়ক আয়াতের স্পষ্টতা ও সংখ্যাধিক্যতার কারণে। যেহেতু তারা নিশ্চিত জানতেন, আল্লাহর সৃষ্টির সাথে মিল অসম্ভব। এ কারণেই মিলের সন্দেহ সৃষ্টিকারী আয়াতের তারা বিশ্লেষণ-তালাশ করতেননা। বরং বলতেন, যা আছে, সেভাবেই পড়ো। তারা মনে করতেন, হয়তো এর মধ্যেই বন্দেগীর পরীক্ষা নিহিত আছে।
তবে সালাফের যুগেই একদল এ বিষয়ে বিকারের শিকার হয় মিলের সন্দেহ সৃষ্টিকারী আয়াতের ভিত্তিতে আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে বসে। আল্লাহর সত্ত্বার সাথে মুতাশাবিহ আয়াতের ভিত্তিতে হাত, পা, মুখ ইত্যাদি যুক্ত করে তারা তাজসিম বা সাকারবাদে আক্রান্ত হয়। অন্যদিকে আরেকদল আল্লাহর ছিফাতে তুলনা করে বসে। আল্লাহর সাথে দিক, স্থিতি, অবতরণ, আওয়াজ ইত্যাদি সম্বন্ধ করে । এবং তারা তুলনা থেকে বাঁচার জন্য বলে, আল্লাহর দেহ আছে বটে, তবে এ দেহ দেহের মত নয় এবং আল্লাহর দিক আছে বটে, তবে এ দিক দিকের মত নয়। স্পষ্টতই তাদের কথা বিরোধপূর্ণ।
পরবর্তীতে যখন জ্ঞানচর্চা বৃদ্ধি পায়, জ্ঞানের নানা শাখার সংকলন শুরু হয় মুতাকাল্লিমিনরা স্রষ্টাকে সৃষ্টির সাথে তুলনার বিরুদ্ধে আল্লাহর পবিত্রতা বিষয়ে লেখাজোখা শুরু করেন। এবং সে সময় মুতাজিলাদের উত্থান ঘটে তারা আল্লাহর সিফাত নাকচ করা শুরু করলো, এই অনুমানে যে, সিফাতের স্বীকৃতি দিলে আল্লাহর সত্ত্বায় বহুত্ব সৃষ্টি হয় অথচ আল্লাহ একজন! তাদের অনুমান ভুল, কেননা সিফাত   মূল সত্ত্বাও নয় আবার সত্ত্বার বাইরের কিছুও নয়, ফলে সিফাতের কারণে সত্ত্বায় বহুত্ব হচ্ছেনা। মুতাজেলারা শ্রবণ ও দর্শন সিফাতকেও নাকচ করলো, এই অনুমানে যে, শ্রবণ ও দর্শন দেহের বৈশিষ্ট্য। তাদের এই অনুমান ভুল, কেননা শ্রবণ ও দর্শনের জন্য দৈহিক কাঠামো জরুরি নয়। একই সাথে তারা কালাম-কথা সিফাতকেও অস্বীকার করলো। অথচ তারা খেয়াল করলো না, কালামের জন্য উচ্চারণ জরুরি নয়। কালাম-কথা উচ্চারণ ছাড়া স্বয়ম্ভুও হতে পারে, এটি তারা ধরতে পারেননি। তবে কালাম নাকচের ফিতনা অনেক প্রসার লাভ করে। এরই ভিত্তিতে মুতাজেলারা কোরআনকে সৃষ্টি বলে আখ্যায়িত করে। এই ফিতনার সাথে রাজনীতি জড়িয়ে যায়। মুতাজেলারা খলিফাকে পক্ষে নিয়ে উলামাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক নির্যাতন চালায়।
১০) ইলমে কালাম : বিকাশ পর্ব
মুতাজেলাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিদাত ও বিকার রোধে, অতএব, বৌদ্ধিক  প্রতিরোধ জরুরি হয়ে পড়েছিল এবং এই কাজ সম্পাদনের জন্য আবুল হাসান আশআরি অগ্রসর হন যাকে ইবনে খালদুন ইমামুল মুতাকাল্লিমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি মধ্যপন্থা অবলম্বন করেন সৃষ্টির সাথে তুলনাকে নাকচ করেন, সিফাতের স্বীকৃতি দেন, সালাফ আল্লাহ তাআলার সাথে যেভাবে পবিত্রতা সীমাবদ্ধ রাখতেন, তিনি সেভাবেই ব্যাখ্যা দেন ধর্মীয় ও বৌদ্ধিকভাবে। সেই সাথে আকিদা-আলোচনার ভূমিকা হিসেবে সালাহ,হাসান, কাবিহ বিষয়েও আলাপ করেন পুনরুত্থান, জান্নাত, জাহান্নাম, ছওয়াব-শাস্তির আলোচনাও করেন।
ইলমে কালামে ততদিনে ইমামতের তর্কও উঠেছিলো_যেহেতু কেউ কেউ ইমামতকে আকিদার অংশ বলে দাবী করত। এখানে, খালদুন মনে করে, ইমামত একটি সামাজিক বিষয়, আকিদার নয়। এ নিয়েও ইলমে কালামের মধ্যে আলোচনা হত এ সব মিলেই ইলমে কালাম।
ইলমে কালামকে ইলমে কালাম নামে নামকরণের কারণ কি? খালদুন আমাদেরকে এর দুইটি কারণ জানান। যেহেতু ইলমে কালাম শুধু কথা ও তর্কতেই সীমাবদ্ধ, কর্মগতভাবে কোন ভূমিকা রাখতে পারেনা অথবা যেহেতু ইলমে কালামের মধ্যে আল্লাহর স্বয়ম্ভু কালাম বা কালামে নাফসির প্রমাণ নিয়ে আলাপ হয়, তাই এই বিষয়কে কালাম নামে নামকরণ করা হয়েছে।
১১) ইলমে কালাম : প্রসার ও বিস্তার পর্ব
মুতাজেলাদের পরাজয়ের পর আশআরি মাজহাবের প্রসার শুরু হয় পরবর্তী যুগের আলেমরা ইলমে কালামের বিকাশ ও বিন্যাস করেন, যুক্তি ও প্রমাণের বৌদ্ধিক ভূমিকা শুরুতে সংযুক্ত করেন তাদের মধ্যে প্রশিদ্ধতম হলেন ইমাম বাকিল্লানি, যিনি পরমাণু,শুন্যতা, গুণ-অবস্থা একা কায়েম হতে পারেনা ও একাধিক সময়ে টিকে থাকেনা ইত্যাদি তত্ত্ব প্রমাণ করেন। খালদুন লেখেন, আমি এই কালামি-তরিকা পছন্দ করি এটি ধর্মীয় ও মানবিক দিকের বিচারে অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞান-শাখা আকারে গড়ে উঠে। তবে খালদুন এর দুর্বলতাও চিহ্নিত করেন, সরলতার কারণে অনেক সময়ে মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পারতোনা। যেহেতু তখনো যুক্তিবিদ্যার ব্যাপক চর্চা শুরু হয়নি বা শুরু হলেও, ধর্ম-বিরোধী দর্শনের সহযোগী হওয়াও তাঁরা যুক্তিবিদ্যা থেকে গ্রহণ করেননি।
বাকিল্লানির পর ইমামুল হারামাইন জুয়াইনির আগমন ঘটে তিনি আশ শামেল নামে সুবিস্তৃত বই রচনা করেন, পরে আল ইরশাদ নামে দিয়ে তাঁর একটা সংক্ষিপ্তসার রচনাও করে যান মানুষ ব্যাপকভাবে তাঁর চিন্তার অনুসরণ করতে থাকে।
যুক্তিবিদ্যার প্রসারের পর মুতাকাল্লিমিনরা দর্শনের সাথে তার ফারাক করেন। যুক্তিবিদ্যার সূত্রে ইলমে কালামের তরিকা যাচাইয়ে মনোযোগ দেন। দুর্বলতার কারণে কিছু বিষয় বাদও দেন, এভাবেই ইলমে কালামের নতুন তরিকা গড়ে উঠে, যাকে তারিকাতুল মুতাআখখিরিন বলা হয়। এই তরিকায় তাঁরা দার্শনিকদের ইসলাম বিরোধী অবস্থানকেও যাচাই করা শুরু করেন। এই তরিকায় সর্বপ্রথম লিখেছেন ইমাম গাজালি এবং পরবর্তীতে ইমাম রাজি। তাদের পরে মুতাকাল্লিমিন আলেমরা এই তরিকায় আরও বিস্তৃতভাবে আলোচনা শুরু করেন একপর্যায়ে, দর্শন থেকে তাকে ফারাক করাই অসম্ভব হয়ে যায় বিষয়বস্তু এক এই অনুমানে।
এখানে আমরা খালদুনের সাথে দ্বিমত করতে চাই, ইলমে কালামে দার্শনিক পর্যালোচনা আসলে গাজালি শুরু করেননি, মুতাজেলারাই শুরু করেছিল। তবে গাজালি আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যাপক অর্থে শুরু করেন।
১২) ইলমে কালাম : বিষয়বস্তু
ইলমে কালাম ও দর্শনের মধ্যে বিষয়বস্তুগত ফারাক কি? ইবনে খালদুন লেখেন, দার্শনিক প্রকৃতি ও ঈশ্বরতত্ত্ব যাচাইয়ের সময় দেহের দিকে তাকিয়ে তাঁর আচরণ ও সক্রিয়তা পর্যবেক্ষণ করেন। এর সাথে মুতাকাল্লিমদের দেখার ভিন্নতা আছে। মুতাকাল্লিম দেখেন, দেহ কর্তার সংবাদবাদী। ঈশ্বরতত্ত্বে দার্শনিক খোঁজেন সাধারণ অস্তিত্ব , মুতাকাল্লিম খোঁজেন অস্তিত্ব সৃষ্টিকারীকে।
তবে ইলমে কালামের মূল বিষয়বস্তু হল, ইসলামি আকিদা। শরীয়ত থেকে গ্রহণ করে তাকে বৌদ্ধিকভাবে যাচাই ও প্রমাণ করা যাতে সন্দেহ-শুবা ও বিদাত-বিকার দূর হয়ে যায়।
খালদুন লক্ষ্য করেন, বিষয়বস্তুগত ফারাক সত্ত্বেও মুতাআখখিরিন মুতাকাল্লিমিনদের তরিকায় দর্শন ও ইলমে কালামে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের এই চিন্তা থেকে গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
১৩) ইলমে কালাম : সামগ্রিক মন্তব্য
খালদুন মনে করেন, ইলমে কালামের গুরুত্ব চিন্তার বিদাত ও বিকারের সাথে সংশ্লিষ্ট। ঈমান যদি বিকার দ্বারা আক্রান্ত হয় অথবা বিকারের কারণে যদি কারো ঈমান-গ্রহণ বাধাগ্রস্থ হয়, তাহলে কালাম-চর্চা জরুরি এবং খালদুন লেখেন, মুতাকাল্লিমিনদের রচনায় সর্বযুগের জন্য বিকারের রোধের উপাদান বিদ্যমান। তবে খালদুনের যুগে যেহেতু চিন্তাগত বিকারের প্রভাব কম ছিল, তাই খালদুন তাঁর সময়ে কালামের ব্যাপক চর্চায় আগ্রহী করেননা। বরং প্রয়োজনহীন চর্চা ক্ষতি করতে পারে, খালদুন আমাদের এই বিষয়ে সতর্ক করেন। জুনাইদ রহঃ এর সূত্রে ক্ষতির প্রামাণ্যতা টানেন একদল লোককে তর্ক করতে দেখে তিনি জিজ্ঞেস করেন, তাঁরা কি করছে? কেউ একজন উত্তর দেন,যুক্তির মাধ্যমে আল্লাহর পবিত্রতা বয়ান করছেন। জুনায়েদ রহঃ বলে উঠেন, পবিত্রকে পবিত্র করার চেষ্টাও ত্রুটির বিষয়।
তবে বিকার থাকুক বা নাই থাকুক, খালদুন মনে করেন, কিছু মানুষের কালাম চর্চা জরুরি। স্থান ও কালের পরিবর্তনে বিকার ও বিদাত সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। ফলে খালদুন কালাম চর্চার ধারাবাহিকতাকেও জরুরি মনে করেন।
দোহাই
১) মুকাদ্দিমার দারুত তাওফিকিয়া সংস্করণ আমরা অনুসরণ করেছি।বাংলাদেশে এই সংস্করণ সহজলভ্য। মাকতাবাতুল আযহার বা মাকতাবাতুল ইসলামে খোঁজলেই আপনারা এর সন্ধান পেয়ে যাবেন।
২) অনুবাদে গোলাম সামদানি কোরায়শির অনুবাদ থেকে সাহায্য নেয়া হয়েছে। তবে সামদনির অনেক অনুবাদের সাথে আমি একমত নই। ফলে তার অনুবাদের সাথে বেশ পার্থক্যও লক্ষ্য করবেন।
৩) ডঃ হামেদ তাহেরের মাওকিফু ইবনে খালদুনের মিন ইলমিল কালাম প্রবন্ধ থেকে বেশ উপকৃত হয়েছি,আলোচনার শৈলী ও ধারাবাহিকতায়।শায়খ সাইদ ফুদার এক ছাত্রের লেখা মাওকিফু ইবনে খালদুনের মিন ইলমিল কালাম পুস্তিকায় পেয়েছি, অন্যান্য মুতাকাল্লিমিনদের সাথে খালদুনিয় চিন্তার তুলনামূলক আলোচনা। এ ছাড়াও খালদুনের কালামি চিন্তা বিষয়ে বেশ লেখাজোখা আছে, বড় গবেষণামূলক বইও আছে। যদিও আমরা সেগুলো আলোচনায় আনিনি, তবুও, ইশারা দিয়ে রাখি, খালদুনের তরিকা বিষয়ক আলোচনায় কালামি চিন্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা।
৪) ইলমে কালাম বিষয়ে খালদুনের একটা বই আছে,লুবাবুল মুহাসসেল। ডঃ আব্বাস সুলাইমানের পাঠ-তাহকিক ও ডঃ মোহাম্মদ আবু রাইয়ানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার যোগে আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়েছে। আগ্রহী পাঠক পড়ে দেখতে পারেন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন