বুধবার, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

‘মাকে জড়িয়ে ধরছিলাম বাঁচাতে পারিনি’


‘হঠাৎ মানুষ ছোটাছুটি শুরু করল। একজন আরেক জনের ওপর পড়তাছে। মাকে জড়িয়ে ধরছিলাম। কিন্তু লোকজনের ধাক্কায় ছুইটা গেল। পাড়া খাইয়া মা মারা গেল। বাঁচাতে পারিনি। তার লাশ কোথায়, তাও জানি না।’কথাগুলো মিনায় পদপিষ্ট হয়ে নিহত ফিরোজা খানমের ছেলে মাজহারুল ইসলামের। মায়ের সঙ্গে তিনিও হজ করতে যান। গতকাল বুধবার বেলা সোয়া দুইটায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন। ওই ফ্লাইটে ৪১৯ জন হাজি আসেন। এ ছাড়া গতকাল সৌদিয়া এয়ারলাইনসের দুটি ফ্লাইটে আরও প্রায় ৬০০ জন হাজি দেশে ফেরেন।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে মিনার দুর্ঘটনার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন জামালপুরের মাজহারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কী হইছে কিছু বুঝতে পারি নাই। পাথর মারতে যাওয়ার পথে হঠাৎ দৌড়াদৌড়ি শুরু হইল। শুনছি সৌদি বাদশার ছেলের জন্য রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে।’ তিনি বলেন, মায়ের মরদেহ খুঁজতে তাঁকে হজ এজেন্সি বা মুয়াল্লিম কোনো সাহায্য করেনি।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে একজন নারী হাজি কাঁদতে কাঁদতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বের হচ্ছিলেন। তিনি বিলাপ করছিলেন, ‘তোমারে বাঁচাইতে পারি নাই। তোমারে বাঁচাইতে পারি নাই।’ তাঁর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ওই নারী হাজির স্বামী গোলাম মোস্তফা মিনায় পদদলিত হয়ে মারা গেছেন।
গতকাল ফিরতি হজ ফ্লাইটে দেশে ফেরা হাজিদের মধ্যে মিনায় স্বজন হারানো আটজনের দেখা মেলে। তাঁরা ও তাঁদের নিতে আসা স্বজনদের কান্নায় বিমানবন্দরে আগমনী টার্মিনালের সামনে শোকাবহ পরিবেশ তৈরি হয়।
ফ্লাইটসূচি বিপর্যয়: বিমানের ফ্লাইটসূচি বিপর্যয়ের কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে ঢাকায় ফেরা হাজিদের। গতকাল অনেক হাজি অভিযোগ করেছেন, তাঁরা ঢাকায় নেমে দেখেন যে তাঁদের মালামাল ভর্তি লাগেজ আসেনি। পরে লাগেজ না নিয়েই তাঁরা বিমানবন্দর ত্যাগ করেছেন। তাঁদের লাগেজ পরে আসবে বলে জানানো হয়।
সাবেরা হক নামের একজন নারী হাজি বলেন, ‘ফ্লাইট ১২ ঘণ্টা লেট। খাবার নাই, পানি নাই। মুয়াল্লিম কন, এজেন্সি কন কেউ হেল্প করে নাই।’
হাজি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘জেদ্দা বিমানবন্দরে এখন হ-য-ব-র-ল অবস্থা। কিচ্ছু ঠিক নাই। কেউ আমাদের খোঁজ নেয়নি। আমাদের দুর্ভোগের জন্য বিমান কর্তৃপক্ষ দায়ী।’ সাইফুল আলম নামের আরেক হাজি একই অভিযোগ করেন।
এই বিষয়ে বাংলাদেশ বিমানের সহকারী ব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) তাছমিন আকতারের পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সৌদি কর্তৃপক্ষÿআরোপিত বিশেষ নিরাপত্তাজনিত ব্যবস্থার কারণে হাজিরা জেদ্দা বিমানবন্দরে বিলম্বে পৌঁছাচ্ছেন। জেদ্দা বিমানবন্দরের হজ টার্মিনালে বিভিন্ন দেশের হাজিদের অস্বাভাবিক চাপসহ সেখানকার বিরাজমান পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ বিমানসহ অন্যান্য এয়ারলাইনসের হজ ফ্লাইটগুলো বিলম্বিত হচ্ছে। এ অবস্থা আরও দু-তিন দিন চলতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে। গতকাল বিকেল পর্যন্ত বাংলাদেশ বিমানে প্রায় তিন হাজার হাজি দেশে ফিরেছেন বলে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
নিখোঁজদের তথ্য না পেয়ে ফিরতে হচ্ছে দেশে
মক্কা থেকে ফেরদৌস ফয়সাল জানান, হজের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাংলাদেশের হাজিরা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। অনেকের দেশে ফেরার সময় কাছে চলে এসেছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ২৬ জন হাজির নিহত হওয়ার কথা জানা গেছে। নিখোঁজ আছেন আরও অনেকে। এই নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজে তাঁদের উদ্বেগ বাড়ছে। পিরোজপুরের রফিকুল ইসলামের আগামী শনিবার দেশে ফেরার কথা থাকলেও ভাগনি ও ভাগনি-জামাইয়ের খবর নেওয়ার জন্য ফ্লাইট পিছিয়েছেন। বগুড়ার গোলাম মাওলা খুঁজছেন দাদিকে। দাদিকে না পেয়ে আজ বৃহস্পতিবার মদিনা যাচ্ছেন একা। মদিনা থেকে আর মক্কায় আসতে পারবেন না। বাংলাদেশ থেকে এবার যাঁরা হজে গেছেন তাঁদের অনেকের জন্য চিত্রটা এ রকম।
ফলে দেশে ফেরার আগে নিখোঁজ স্বজনদের সন্ধানে মক্কায় হজ কার্যালয়, হাসপাতাল আর মুয়াইসিমে (লাশ রাখার স্থান) দৌড়াচ্ছেন বাংলাদেশিরা। তাঁদের বেশির ভাগ এ ক্ষেত্রে আরবি ভাষা জানা প্রবাসীদের সাহায্য নিচ্ছেন। হাজিদের একটাই কথা, পুরোনো তালিকায় তো পেলাম না। নতুন তালিকা কি টানিয়েছে বা আসছে।
সৌদি মুয়াইসিমে প্রায় ১ হাজার ২০০ ছবি টানানো আছে। প্রতিদিন বাড়ছে ছবির সংখ্যা। মিনার সরাইয়া কবরস্থানের কাছে মুয়াইসিমে প্রথমে প্রবেশ কড়াকড়ি থাকলেও এখন যে কেউ যেতে পারেন। প্রতিটি ছবির সঙ্গে একটা নম্বর রয়েছে। মৃত ব্যক্তির স্বজন অথবা পরিচিত ব্যক্তিরা প্রথমে ছবি দেখে চেনার চেষ্টা করেন। তারপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য লাশ রাখা ফ্রিজের কাছে গিয়ে মুখ দেখতে পারেন। যেহেতু ঘটনা এক সপ্তাহ হয়েছে, তাই কর্তৃপক্ষ এখন লাশ দাফনে ব্যস্ত বেশি।
বাংলাদেশ হজ কার্যালয়ে নিখোঁজ স্বজনদের খুঁজতে এসেছেন অনেকে। ফ্লাইটের সময় হয়ে যাওয়ায় কেউ কেউ নিখোঁজদের তথ্য না জেনেই দেশে ফিরতে বাধ্য হচ্ছেন।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন