শুক্রবার, ২৬ জুন, ২০১৫

কুরআনে হাকীম এবং মাহে রমজান

           মাওলানা ইয়াহইয়া ইউসুফ নদভী
-------------------------------------------------------------
রমজান আর কুরআন একে অপরের বন্ধু। সম্পর্ক তাদের
গভীর ও নিবিড়।
রমজান ভালোবাসে কুরআনকে আর
কুরআনও ভালোবাসে রমজানকে।
যে ভালোবাসা অমর।
অবিচ্ছিন্ন।
চির অটুট।
রমজানের সাথে কুরআনের এই চির
বন্ধুত্বের ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ-
ﺷَﻬْﺮُ ﺭَﻣَﻀَﺎﻥَ ﺍﻟَّﺬِﻱ ﺃُﻧْﺰِﻝَ ﻓِﻴﻪِ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥُ ﻫُﺪﻯً ﻟِﻠﻨَّﺎﺱِ ﻭَﺑَﻴِّﻨَﺎﺕٍ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻬُﺪَﻯ ﻭَﺍﻟْﻔُﺮْﻗَﺎﻥِ
'রমজান মাস, যাতে অবতীর্ণ হয়েছে কুরআন, মানুষের
পথ প্রদর্শক সৎ পথের সুস্পষ্ট নিদর্শন এবং সত্য-মিথ্যার
মাঝে পার্থক্য নির্ণয়কারী হিসাবে।'
রমজান মাসেই 'লওহে মাহফুজ' (সংরক্ষিত ফলক) থেকে
কুরআন নাযিল হয়েছে দুনিয়ার আসমানে।
কুরআনের অবতারণায় মহিমান্বিত হয়েছে রমজান। আমরা
আগেই বলে এসেছি যে, রমজানে হযরত জিবরিল
আমীন
চলে আসতেন নবীজীর সাথে কুরআন 'দাওর' করার
জন্যে। তখন নবীজীর কুরআন চর্চা অনেক বেড়ে
যেতো।
তিনি কুরআন তিলাওয়াত করতেন। শুনতেন। শোনাতেন।
কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা ও গবেষণায় ডুবে
যেতেন।
রোযাদার এবং কুরআন—
এক বৃন্তের দু'টি শাখা।
রমজানে গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠে তার কুরআনের
সাথে।
কুরআনই তার ধ্যান-জ্ঞান।
কুরআনই তার চিন্তা-চেতনা।
কুরআনই তার সূচনা-সমাপ্তি।
কুরআনই তার চাওয়া-পাওয়া।
কুরআন কী? কেনো? ..
এ সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে রোযাদার হারিয়ে যায়
চিন্তা ও গবেষণার অথৈ সমুদ্রে! সেখানে চলতে থাকে
তার ডুবুরিময় আহরণ-অভিযান! চলতে থাকে 'সেই
তলদেশ' থেকে মণি-মানিক্য-হীরা-জহরত কুড়ানোর
বিস্ময়কর অভিযান! তারপর? তারপর অবশ্যই চলতে থাকে
নিবিষ্ট মনে তার মালা গাঁথা!
রোজাদারের এই যে অনুসন্ধিৎসু তিলাওয়াত ও
মর্মোদ্ধার অভিযান- তার কি কোনো তুলনা হয়?
ﻛِﺘَﺎﺏٌ ﺃَﻧْﺰَﻟْﻨَﺎﻩُ ﺇِﻟَﻴْﻚَ ﻣُﺒَﺎﺭَﻙٌ ﻟِﻴَﺪَّﺑَّﺮُﻭﺍ ﺁﻳَﺎﺗِﻪِ ﻭَﻟِﻴَﺘَﺬَﻛَّﺮَ ﺃُﻭﻟُﻮ ﺍﻟْﺄَﻟْﺒَﺎﺏِ
'এক কল্যাণময় কিতাব, যা আমি আপনার প্রতি অবতীর্ণ
করেছি। যাতে মানুষ তার আয়াতসমূহ অনুধাবন করে এবং
বোধশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তিগণ গ্রহণ করে উপদেশ।'
ﺃَﻓَﻼ ﻳَﺘَﺪَﺑَّﺮُﻭﻥَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﺃَﻡْ ﻋَﻠَﻰ ﻗُﻠُﻮﺏٍ ﺃَﻗْﻔَﺎﻟُﻬَﺎ
'তাহলে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর করে ভাবে না? নাকি
হৃদয় তাদের তালাবদ্ধ?'
ﺃَﻓَﻼ ﻳَﺘَﺪَﺑَّﺮُﻭﻥَ ﺍﻟْﻘُﺮْﺁﻥَ ﻭَﻟَﻮْ ﻛَﺎﻥَ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﻏَﻴْﺮِ ﺍﻟﻠَّﻪِ ﻟَﻮَﺟَﺪُﻭﺍ ﻓِﻴﻪِ ﺍﺧْﺘِﻼﻓﺎً ﻛَﺜِﻴﺮﺍً
'তারা কি কুরআন নিয়ে অভিনিবেশ সহকারে ভাবে না?
প্রকৃতই যদি তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো পক্ষ থেকে
(অবতীর্ন) হতো, তাহলে তারা তাতে অনেক অসঙ্গতি
দেখতে পেতো।'
রমজান মাসে রয়েছে কুরআনের ভিন্ন স্বাদ ও মজা।
তখন কুরআন যেনো রোজাদারের কানে কানে কথা
বলে— ফিসফিস করে। তাকে শোনায় রমজানের রহমত
বরকত ও মাগফিরাতের কথা।
জান্নাতের নায-নেয়ামতের কথা।
হাউজে কাউসারের পাড়ে নবীজীর হাতে আবে
কাউসার পানের দুর্লভ সম্মানের কথা!
মাঝে মধ্যে রোযাদার কুরআন তিলাওয়াতে ডুবে গিয়ে
অনুভব করে—
সে যেনো বসে আছে শিশিরস্নাত একটা ফুলেল
উদ্যানে!
গোলাপের সৌরভঝরা একটা কাননে!
বুলবুলির গানে মুখরিত একটা ছায়া সুনিবিড় স্বর্গীয় আবহে!
তখন তার অনুভব-অনুভূতিতে স্নিগ্ধ একটা ঝড় বয়ে যায়!
সে ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায় পেছনে, হাজার বছর
পেছনে!
ইসলামের পুণ্য যুগে।
মনের আকাশে উড়তে থাকে হাজার হাজার স্মৃতি, নবী
যুগের ঝাঁকে ঝাঁকে স্মৃতি!
তার মনে হয়— এ যুগের কোলে বসে তিলাওয়াত
করলেও— ইথারে ভাসতে ভাসতে তার তিলাওয়াত চলে
যাচ্ছে দূর
অতীতে! সেই পুণ্য যুগে!
একেবারে নবীজীর যুগে!
ঐ তো হযরত জিবরিল নবীজীকে কুরআন
শোনাচ্ছেন! নবীজীও জিবরিলকে কুরআন
শোনাচ্ছেন!
এই রমজানিক যোগ-সূত্রের রেখা ধরে সেও
যেনো গিয়ে মিশে গেছে তাঁদের মজলিসে!
তার কানে বরং হৃদয়ের গভীরে আলোড়ন তুলছে
নবীজীর তিলাওয়াত!
জিবরিলের তিলাওয়াত!
আহা! কী মজা!
তার তারাবী? সেও যেনো নববীর তারাবী!
তার ইফতার ক্ষণটি? সেও যেনো তাঁদেরই ক্ষণ!
মসজিদে নববীর বারান্দায়!
আসহাবে সুফফার মুবারক মজলিসের ক্ষণ!!
খেজুর যমযম সামনে নিয়ে ঐ তো বসে আছেন
সাহাবীরা!
নবীজীর পরশে সোনা হয়ে গিয়েছিলেন
যাঁরা!!
প্রকৃত রোযাদার যারা, এমন পুণ্য অনুভূতিতে ধন্য হতেই
পারেন তারা!
সুতরাং বিস্ময়বোধের কোনো কারণ দেখছি না!
পাঠক! তুমি যদি সালফে সালেহিনের ইতিহাস পড়ো,
তাহলে খুঁজে পাবে তার অনেক নমুনা!
পড়েছো কি? না কি তুমি এখনো অনেক ছোট?
আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:
ﺍﻗﺮﺅﻭﺍ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻓﺎﻧﻪ ﻳﺄﺗﻲ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ ﺷﻔﻴﻌﺎ ﻷﺻﺤﺎﺑﻪ
'তোমরা কুরআন পড়ো। কেননা কুরআন কেয়ামতের
দিন তিলাওয়াতকারীর জন্যে সুপারিশ করবে।'
ﺧﻴﺮﻛﻢ ﻣﻦ ﺗﻌﻠﻢ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻭﻋﻠﻤﻪ
'তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি হলো তারা যারা
কুরআন শিখে এবং শেখায়।'
ﺍﻗﺮﺀﻭﺍ ﺍﻟﺰﻫﺮﺍﻭﻳﻦ ، ﺳﻮﺭﺓ ﺍﻟﺒﻘﺮﺓ ﻭﺁﻝ ﻋﻤﺮﺍﻥ ، ﻓﺎﻧﻬﻤﺎ ﺗﺄﺗﻴﺎﻥ ﻛﻐﻤﺎﻣﺘﻴﻦ ﺃﻭ ﻏﻴﺎﺑﺘﻴﻦ
، ﺃﻭ ﻛﻔﺮﺍﻥ ﻣﻦ ﻃﻴﺮ ﺻﻮﺍﻑ ﺗﻈﻼﻥ ﺻﺎﺣﺒﻬﻤﺎ ﻳﻮﻡ ﺍﻟﻘﻴﺎﻣﺔ
'তোমরা যাহবাওয়ান অর্থাৎ সূরা বাকারা ও আলে ইমরান
পড়ো। মেঘমালার মতো কিংবা ঝাঁকবাঁধা পাখির মতো তা
কেয়ামতের দিন তার তিলাওয়াতকারীকে ছায়া দেবে।'
ﺍﻟﺬﻱ ﻳﻘﺮﺃ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ ﻭﻫﻮ ﻣﺎﻫﺮ ﺑﻪ ﻣﻊ ﺍﻟﺴﻔﺮﺓ ﺍﻟﻜﺮﺍﻡ ﺍﻟﺒﺮﺭﺓ ، ﻭﺍﻟﺬﻱ ﻗﺮﺃ ﺍﻟﻘﺮﺁﻥ
ﻭﻫﻮ ﻳﺘﻌﺘﻊ ﻓﻴﻪ ﻟﻪ ﺃﺟﺮﺍﻥ
'যে কুরআন পড়ে আর আর তাতে দক্ষ হয়ে উঠে,
সে থাকবে পূত-পবিত্র ফেরেশতাদের সাথে। আর
যে কুরআন পড়ে আর তোতলায়, সে পাবে দিগুণ
সওয়াব।'
কুরআনের ভালোবাসায় আকুল হয়ে তাই এক আরব কবি
বলে উঠেছেন:
ﺳﻤــــﻌﺘﻚ ﻳﺎ ﻗﺮﺍﻥ ﻭﺍﻟﻠﻴﻞ ﻏﺎﻓﻞ + ﺳﺮﻳﺖ ﺗﻬﺰ ﺍﻟﻘﻠﺐ ﺳﺒﺤﺎﻥ ﻣﻦ ﺃﺳﺮﻯ
ﻓﺘﺤﻨﺎ ﺑﻚ ﺍﻟﺪﻧﻴﺎ ﻓﺎﺷﺮﻕ ﺻـــﺒﺤﻬﺎ + ﻭﻃﻔﻨﺎ ﺭﺑﻮﻉ ﺍﻟــﻜﻮﻥ ﻧﻤﻠﺆﻫﺎ ﺃﺟﺮﺍ
'হে কুরআন! তখনো আমি তোমায় শুনেছি, রাতের
বেলায় বসেছে যখন অলস মেলা। রাত নিশিথে হৃদয়ে
তুলেছো তুমিই ঢেউ। মহিমান্বিত সেই সত্ত্বা, যিনি
তোমাকে সেই নিশিথেও ছড়িয়ে দিয়েছেন!
আমরা বিজয় করেছি দুনিয়া- সে তো তোমারই
শক্তিতে! তোমার আলোয় কী অপরূপ পৃথিবীর
সকাল বেলা!
আমরা মন্থন করেছি বিশ্বময়- ভরিয়ে দিতে
পৃথিবীকে তোমার পুণ্যের পূর্ণতায়!'
আমাদের পূর্বসুরীদের কাহিনী শুনবে?
রমজান এলে তাঁরা কুরআনময় হয়ে যেতেন! কুরআনের
সাথে গড়ে তুলতেন গভীর সখ্যতা।
কুরআনই হয়ে যেতো তাঁদের জীবনসঙ্গী।
কুরআনই হয়ে যেতো তাঁদের সফরসঙ্গী।
কুরআনই হয়ে যেতো তাঁদের জাগার সঙ্গী।
কুরআনই হয়ে যেতো তাঁদের ঘুমসঙ্গী।
কুরআনই হয়ে যেতো তাঁদের সকল বেলার নিত্য
সঙ্গী।
ইমাম মালিক রহ. রমজানে সব ধরনের ব্যস্ততা থেকে
ফারেগ হয়ে শুধুমাত্র কুরআন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে
পড়তেন। তখন তিনি হালকায় (শিক্ষাদানের মজলিসে)
বসতেন না। ফতোয়া দিতেন না। মানুষের সাথেও
মিশতেন না। বলতেন- 'এখন তো কুরআনের মাস!'
রমজান এলে আমাদের পূর্বসুরীরা এভাবেই বদলে
যেতেন!
কুরআনময় হয়ে যেতেন!
তাঁদের মজলিস থেকে ভেসে আসতো
কুরআনের মধুর গুঞ্জরন!
যেনো মৌমাছির 'সঙ্গীত'!
অথবা তাঁদের মজলিস যেনো আলোর ফোয়ারা।
কীভাবে তাঁরা কুরআন পড়তেন?
তাঁরা কুরআন পড়তের বিশুদ্ধভাবে,
ধীরে ধীরে, থেমে থেমে, ভেবে ভেবে!
আল্লাহ্র কুদরতের বর্ণনা আছে—
এমন আয়াতে এসে তাঁর থেমে পড়তেন!
তাঁর কুদরতের শান ও মহিমা নিয়ে ভাবতেন!
তাঁর মহিমা গাইতেন!
আযাবের আলোচনা আছে যেখানে—
সেখানে ভয়ে কেঁদে ফেলতেন!
কেঁদে কেঁদে জারজার হতেন!
জান্নাতের নায-নেয়ামতের কথা আছে যেখানে—
সেখানে খুশিতে কেঁদে ফেলতেন! যেনো শিশুর
অনাবিল হাসি!
পাশাপাশি কুরআনে আল্লাহ যা করতে বলেছেন, তা
করতে বলেছেন এবং যা ছাড়তে বলেছেন, তা
থেকে বিরত থাকতে সংকল্পবদ্ধ হতেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. একবার নবীজীকে
সূরা নিসা শোনাচ্ছিলেন। পড়তে পড়তে যখন তিনি এই
আয়াত পর্যন্ত চলে এলেন-
ﻓَﻜَﻴْﻒَ ﺇِﺫَﺍ ﺟِﺌْﻨَﺎ ﻣِﻦْ ﻛُﻞِّ ﺃُﻣَّﺔٍ ﺑِﺸَﻬِﻴﺪٍ ﻭَﺟِﺌْﻨَﺎ ﺑِﻚَ ﻋَﻠَﻰ ﻫَﺆُﻻﺀِ ﺷَﻬِﻴﺪﺍً
'যখন প্রত্যেক উম্মত থেকে একজন সাক্ষি উপস্থিত
করবো এবং আপনাকে এদের বিরুদ্ধে সাক্ষিরূপে
উপস্থিত করবো, তখন কী অবস্থা হবে?'
তখন নবীজী বললেন- 'আর নয়, থামো!'
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. বলেন- 'আমি মাথা
উঠিয়ে দেখলাম, তাঁর দু'চোখে অশ্রু!'
তিনি তো কাঁদবেনই!
তিনি যে শুনছেন তাঁর প্রেমাষ্পদের বাণী!
প্রেমিক হয়ে তাহলে কেনো তিনি কাঁদবেন না?!
এই কবিও বুঝি চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছিলেন এই
বলে—
ﺇﺫﺍ ﺍﺷﺘﺒﻜﺖ ﺩﻣﻮﻉ ﻓﻲ ﺧﺪﻭﺩ + ﺗﺒﻴﻦ ﻣﻦ ﺑﻜﻰ ﻣﻤﻦ ﺗﺒﺎﻛﻰ
ﻓﺄﻣﺎ ﻣﻦ ﺑﻜﻰ ﻓﻴﺬﻭﺏ ﻭﺟﺪﺍ + ﻻﻥ ﺑﻪ ﻣﻦ ﺍﻟﺘﻘﻮﻯ ﺣﺮﺍﻛﺎ
'অশ্রুতে যখন ভেসে যায় গণ্ডদেশ, তখন বেশ
বোঝা যায়- কে কাঁদছে হৃদয়ের কান্না আর কে কাঁদছে
চোখের কান্না!
যে কাঁদে হৃদয়ের চোখে, আবেগ অনুরাগ তার গলে
গলে পড়ে! কেননা তাকওয়া ও আল্লাহভীতি তার
প্রেরণা-উৎস!
একদিন আল্লাহ্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রিয়
সাহাবী আবু মূসা আশ'আরী রা.কে বললেন:
" ﻟﻮ ﺭﺃﻳﺘﻨﻲ ﻭﺃﻧﺎ ﺍﺳﺘﻤﻊ ﺇﻟﻰ ﻗﺮﺍﺀﺗﻚ ﺍﻟﺒﺎﺭﺣﺔ ، ﻟﻘﺪ ﺃﻭﺗﻴﺖ ﻣﺰﻣﺎﺭﺍ ﻣﻦ ﻣﺰﺍﻣﻴﺮ ﺁﻝ
ﺩﺍﻭﺩ " ﻓﻘﺎﻝ ﺃﺑﻮ ﻣﻮﺳﻰ : ﻟﻮ ﻋﻠﻤﺖ ﻳﺎ ﺭﺳﻮﻝ ﺍﻟﻠﻪ ﺃﻧﻚ ﺗﺴﺘﻤﻊ ﻟﻲ ﻟﺤﺒﺮﺗﻪ ﻟﻚ
ﺗﺤﺒﻴﺮﺍ
'তুমি যদি আমাকে দেখতে! গতরাতে আমি তোমার
তিলাওয়াত শুনছিলাম। তোমাকে দান করা হয়েছে দাউদী
কণ্ঠ!' এ কথা শুনে হযরত আবু মূসা আশ'আরী রা. বলে
উঠলেন- 'হে আল্লাহ্র রাসূল! আমি যদি বুঝতে পারতাম
যে আপনি আমার পড়া শুনছেন, তাহলে আরো বেশী
সুন্দর করে পড়তাম!'
হযরত উমর রা. সাহাবায়ে কেরামের মজলিসে এই মহান
সাহাবীকে লক্ষ্য করে বলতেন- 'আবু মূসা!
আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দাও আমাদের রব-এর কথা!'
তখন তিনি তিলাওয়াত করতেন। সবাই শুনতেন আর
কাঁদতেন!
ধন্য তুমি কবি! কতো সুন্দর বলেছো তুমি-
ﻭﺇﻧﻲ ﻟﻴﺒﻜﻴﻨﻲ ﺳﻤﺎﻉ ﻛﻼﻣﻪ + ﻓﻜﻴﻒ ﺑﻌﻴﻨﻲ ﻟﻮ ﺭﺃﺕ ﺷﺨﺼﻪ ﺑﺪﺍ
ﻭﺗﻼ ﺫﻛﺮﻩ ﻓﺤﻦ ﺣﻨﻴﻨﻪ + ﻭﺷﻮﻕ ﻗﻠﻮﺏ ﺍﻟﻌﺎﺭﻓﻴﻦ ﺗﺠﺪﺩﺍ
'অঝরে কেঁদেছি আমি- শুধু শুনে তাঁর
বাণী!
হায়! যদি নসীব হতো তাঁর দিদার কী
ঘটতো মম আঁখির?
শুরু হলেই তাঁর বাণীর তিলাওয়াত, ঝড় উঠে হৃদয়ে
ব্যাকুলতার! আকাশের ঝড়-তাণ্ডবে প্রকৃতি হয় বিরান আর এ
'ঝড়-তাণ্ডবে' আল্লাহ্র ওয়ালাদের হৃদয়ে নামে সজীব
বসন্ত!
বর্তমানে সঙ্কটঘেরা মুসলিম উম্মাহর ব্যক্তি জীবন,
পারিবারিক জীবন, সমাজ জীবন ও রাষ্ট্রীয় জীবন। এ
সঙ্কটের অন্তরালে কী কারণ লুকিয়ে আছে— আমরা
কি কখনো তা খুঁজে বের করতে প্রয়াসী হয়েছি?
কারণ আর কিছুই না! কারণ হলো আমরা কুরআন থেকে
দূরে সরে পড়েছি। আমাদের জীবনে কুরআনের
তিলাওয়াত নেই। আমাদের জীবনে কুরআনের হুকুম-
আহকামের বাস্তবায়ন নেই।
আমাদের জীবনে কুরআন নিয়ে চর্চা ও গবেষণা
তো দূরের কথা, কুরআনের ভাষা—আরবী ভাষাটাকে
শেখার এবং
শেখানোর কোনো গুরুত্ব নেই। এখন কি আগের
মতো ফজর শেষে ঘরে ঘরে শোনা যায় কুরআন
তিলাওয়াতের আওয়াজ? সরকার নিয়ন্ত্রিত হাজার প্রাথমিক
বিদ্যালয়ে আছে কি কুরআন শেখানোর কোনো
ব্যবস্থা? নেই!
আমার দেশের কোমলমতি লাখ লাখ
মুসলিম শিশু অ আ শিখছে, অ ই পড়ছে, ১ ২ গুনছে, কিন্তু
আলিফ বা তা পড়ছে না। কেনো? না পড়তে পারার
জন্যে কারা দায়ী?
ঐ যে বেসরকারী হাজার হাজার
প্রাতঃকালীন পাঠশালা ও কিন্ডারগার্টেন, এখানেও তো
নেই কুরআন শেখার এবং তিলাওয়াতের কোনো
ব্যবস্থা? অথচ সাত সকালেই এ সব প্রতিষ্ঠানে হাজির
হতে বাধ্য করা হয় শিশুদেরকে! একটি মুসলিম দেশের
শিক্ষাচিত্র যদি এমন কুরআনবিমুখ হয়, তাহলে কী করে
আশা করা যায়— রহমত মাগফিরাত এবং ক্ষমা ও মুক্তি?
অনেকেই বলতে পারেন, কেনো মক্তব তো
আছে? মক্তব আছে! কিন্তু মক্তবের ছাত্র? ওদের
নিয়ে কেনো কুরআন শেখার সকাল বেলায় টানাটানি
কাড়াকাড়ি?
তা ছাড়া এ সব মক্তবও এখন প্রাণহীন ও নিষ্ক্রিয় হয়ে
যাচ্ছে। কোথাও কোথাও অদক্ষ শিক্ষকদের ভারে
ন্যুব্জ। অনুপস্থিতির হারে ক্লান্ত। কে নজর দেবে এ
দিকটিতে?
লক্ষ লক্ষ শিশু কিশোরকে
কুরআন-বঞ্চিত করার অপপ্রয়াসকে কে রুখে
দাঁড়াবে?
এই রমজানে শপথ নেবে কি কেউ?
মূল কথা হলো, বর্তমানে কুরআনের সাথে আমাদের
বিস্তর ফারাক ও দূরত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণেই নতুন প্রজন্ম
আদর্শবান হয়ে গড়ে উঠছে না। তাদের মাঝে উন্নত
নৈতিকতা ও সুকুমারবৃত্তির প্রকাশ ঘটছে না। ইসলাম ও কুরআন
তাদের কাছে 'জীবন বিচ্ছিন্ন' একটি 'ধর্মীয়' বিষয়ে
পরিণত হচ্ছে। পরিস্কার ভাষায় বলতে চাই— কুরআন বাদ
দিয়ে যদি অন্য কোথাও সমস্যার সমাধান খোঁজা হয়,
তাহলে ফাসাদ বিশৃঙ্খলা কমবে না— আরো বাড়বে।
বিপদ-আপদ দূর হবে না— আরো বিস্তৃতি লাভ করবে।
নতুন প্রজন্মের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তা-চেতনা ঠিক হবে না—
আরো বাঁকা হবে।
দেশ জাতি সমাজকে সামনে অগ্রসর করার সকল প্রয়াস
মুখ থুবড়ে পড়বে। এ বাস্তবতা অস্বীকার করার
কোনো উপায় নেই। কোনো সুযোগ নেই।
কেননা কুরআন হলো—
মানুষকে সরল সোজা পথের উপর পরিচালিত করার একমাত্র
পথ নির্দেশিকা।
কুরআন হলো আলো।
হৃদয়ের সব ধরনের বক্রতা ও ব্যাধির আরোগ্য।
কুরআন জ্ঞান বিজ্ঞান শিক্ষা গবেষণা ও সভ্যতা-সংস্কৃতির
একমাত্র উৎস।
কুরআন ছাড়া জীবন মানে মরণ।
কুরআন ছাড়া সঙ্কট উত্তরনের পখ খোঁজা মানে বিভ্রান্ত
হওয়া।
কুরআনের বাইরে আনন্দের কিংবা সৌভাগ্যের সন্ধান
খোঁজা মানে এক রাশ বেদনা ও অপ্রাপ্তি।
জীবনভর অশান্তি ও অস্বস্তি।
কুরআন বিহীন জীবন মানে পরকালের দেওলিয়াত্ব।
জান্নাত ও তার নায-নেয়ামত থেকে চির বঞ্চনা।
কে চায় এমন জীবন?
বিবেকহীন ছাড়া?
মূর্খ ছাড়া?
জালিম ছাড়া?
বিধর্মী কাফের মুশরিক ছাড়া?
কুরআনী শিক্ষা ও কুরআনী জীবনের কী মজা, তা
বুঝতে ও জানতে হলে ছুটে যেতে হবে
কুরআনীদের কাছে।
উলামায়ে কেরামের কাছে।
মাদরাসার কুরআনী পরিবেশে।
অনেকে মনে করে কুরআন শুধু মসজিদ-মাদরাসাকে
ন্দ্রিক।
রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনীতির সাথে এর কোনো সম্পর্ক
নেই। ভুল চিন্তা। শতভাগ ভুল।
কুরআন মানব জীবনের চিরকালের
চিরন্তন সংবিধান। এ সংবিধানের লঙ্ঘন— সমূহ বিপর্যয়
ডেকে আনে।
ইহজীবনে এবং পরজীবনে।
এ সংবিধানের বাইরে মানবরচিত সংবিধান মানা হবে যে
দেশে, যে সমাজে, সে দেশে সে সমাজে শান্তিু
ও স্থিতি অকল্পনীয়। অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি সুদূর পরাহত।
এই চির সত্যটা না বুঝলে এক মুসলিম হিসাবে ইহকালীন ও
পরকালীন ক্ষতি থেকে বাঁচার কোনো উপায় নেই।
এ জন্যে ইসলামের দুশমনরা আমাদেরকে
কুরআন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্যে নিরন্তর
ষড়যন্ত্র করে করে যাচ্ছে। আমরা কি দুশমনের এ
ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সচেতন?
সুতরাং কুরআনের সাথে 'নিত্য বসবাস' গড়ে তোলার
জন্যে, কুরআনকে একমাত্র জীবন ব্যবস্থা হিসাবে
মেনে নেয়ার জন্যে,
কুরআনের মর্যাদা ও মাহাত্ম্য হৃদয়ে সদা লালন করার
জন্যে—
আমরা কি নতুন করে আমাদের ঈমান তাজা করতে পারি না?
শপথ নিতে পারি না?
সংকল্পবদ্ধ হতে পারি না?
বিশেষত কুরআন নাযিলের মাস—এই রমজানে?
কুরআন নাযিলের মাসে কেনো আমরা গড়ে তুলবো
না কুরআনের সাথে ভালোবাসা?
এ ছাড়া জীবন সাজাবার আর কোনো পথ কি তোমার
জানা আছে?
আল্লাহ! তুমি তাওফিক দাও! তুমিই একমাত্র তাওফিকদাতা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন