বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

একটি মাযহাব মানা ও অন্য মাযহাবের দলীল শক্তিশালী মনে হলে মানা যাবে না কেন?

প্রশ্ন
আসসালামু আলাইকুম।
আমি শুআইব
হাফেজ+মেডিকেল স্টুডেন্ট।
চট্রগ্রাম
আমার কাছে এক ভাই নিচের প্রশ্নদ্বয় করেছিল কিন্তু আমি দলিল পারি নাই তাই আপনার নিকট প্রশ্ন করলাম।
১)একজন লোকের জন্য কি যে কোন একটি মাজহাব মানা আবশ্যক?
২)মনে করেন আমি হানাফির অনুসারি, একজন শাফেয়ীর অনুসারির সাথে আমার বিষেশ একটি বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছে। এখন আমি তাকে দলিল প্রমান সহকারে বুঝিয়ে দিলাম যে, হানাফির মতামতটা অধিক সুদ্ধ। এবং এই বিষয়ে ইমাম শাফেয়ীর চেয়ে ইমাম আবু হানিফার মতামতটি অধিক যুক্তি যুক্ত। এখন, এই বিষয়ে লোকটি কি আগের মত শাফেয়ীর মতটা গ্রহন করবে?
নাকি হানাফি মতটা গ্রহন করবে? তদ্রুপ উল্টভাবে চিন্তা করলে, সে যদি শাফেয়ির মতামতের
পক্ষে হানাফির চেয়ে শক্ত দলিল দিতে পারে, তাহলে আমি কি করব? এই বিষয়ে আমি কি আগের মত হানাফি মতের অনুসরন করব? নাকি শাফেয়ী মত অনুসরন করব? কেউ ভুল বুঝবেন না। আমি কিন্তু মাজহাব চেইন্জ করার কথা বলিনি, শুধু যে বিষয়টা নিয়ে আমরা দুজনের মধ্যে কথা হচ্ছে,ঐ বিষয়টার ক্ষেত্রে কার মতামত গ্রহন করা উচিত। যার দলিল অধিক শক্ত তার? নাকি আমি অন্য সব বিষয়ে যাকে অনুসরন করি তার?
উত্তর
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
১ম প্রশ্নের জবাব
দ্বীন সম্পর্কে মানুষ দুই ধরণের হয়ে থাকে। যথা-
১-কুরআন, হাদীস, ইজমা কিয়াস, উসূলে হাদীস, হাদীসের জরাহ তাদীল, শানে নুজুল, শানে ওরূদ, আরবী নাহু সরফ, আরবী বালাগত, ফাসাহাত ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাজ্ঞ ব্যক্তিগণ। যাদের  বলা হয় মুজতাহিদ। আর মুজতাহিদগণ গবেষণা করে কুরআন, সুন্নাহ ভিত্তিক যে মাসআলা একত্র করে গেছেন, আমলীভাবে চালু হয়েছে তার নামই মাযহাব।
২-যাদের এমন জ্ঞান নেই।
এ উভয় শ্রেণীর ক্ষেত্রেই কুরআনে নির্দেশনা এসেছে।
প্রথম শ্রেণীর ক্ষেত্রে এসেছে-
فَإِن تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللَّهِ وَالرَّسُولِ إِن كُنتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ۚ ذَٰلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا [٤:٥٩]
তারপর যদি তোমরা কোন বিষয়ে বিবাদে প্রবৃত্ত হয়ে পড়,তাহলে তা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের প্রতি প্রত্যর্পণ কর। {সূরা নিসা-৫৯}
অর্থাৎ মুজতাহিদগণ সরাসরি কুরআন ও হাদীস থেকে সরাসরি মাসআলা বের করতে মেহনত মুজাহাদা করবেন।
অন্য আরেক আয়াতে এসেছে-
فَاعْتَبِرُوا يَا أُولِي الْأَبْصَارِ [٥٩:٢]
হে বিদ্বান ব্যক্তিগণ,তোমরা কিয়াস কর। {সূরা হাশর-২}
দেখুন-তাফসীরে কাবীর-২৯/২৮১, ২৮২,তাফসীরে বায়যাবী-৫/৩১৭}
আর তাদের এ প্রচেষ্টাকে সওয়াবের কারণ উল্লেখ করে রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন-
عَنْ عَمْرِو بْنِ العَاصِ، أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِذَا حَكَمَ الحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ
হযরত আমর বিন আস রাঃ থেকে বর্ণিত। রাসূল সাঃ ইরশাদ করেছেন, যখন কোন ফায়সালাকারী ফায়সালা করার মুহুর্তে ইজতিহাদ করে, আর সে তার ইজতিহাদ দ্বারা সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়, তাহলে তার জন্য রয়েছে দু’টি সওয়াব। আর যদি ইজতিহাদ করে ভুল করে, তাহলে একটি সওয়াব পাবে। {বুখারী, হাদীস নং-৭৩৫২, ৬৯১৯}
অর্থাৎ মুজতাহিদের কোন কাজই সওয়াব থেকে খালি নেই। মাসআলা সমাধানে যে অবস্থানেই থাকুক সে সওয়াব পেতে থাকে।
এবার দেখতে হবে দ্বিতীয় প্রকারের ব্যক্তিদের অবস্থান। অর্থাৎ যারা উপরোক্ত জ্ঞানে সমৃদ্ধ নয়। তারা কী করবে?
পবিত্র কুরআনে তাদের বিষয়ে নির্দেশনা এসেছে-
فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِن كُنتُمْ لَا تَعْلَمُونَ [٢١:٧
অতএব তোমরা যদি না জান তবে যারা জানে তাদেরকে জিজ্ঞেস কর। {সূরা আম্বিয়া-৭}
এ আয়াত বুঝাচ্ছে, যাদের কুরআন ও হাদীস সম্পর্কে পূর্ণ প্রাজ্ঞতা নেই, তারা বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসা করে তাদের অনুসরণে আল্লাহর শরীয়ত অনুসরণ করবে।
এখন প্রশ্ন হল, সারা বিশ্বব্যাপীতো অসংখ্য মুজতাহিদ-বিশেষজ্ঞ থাকতে পারে। তো সাধারণ মুসলমানগণ কোন ব্যক্তির অনুসরণে আল্লাহর শরীয়ত অনুসরণ করবে? কার মতানুসারে ইসলামী শরীয়ত মানবে?
এরও জবাব আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে দিয়ে দিয়েছেন-
وَمَا كَانَ الْمُؤْمِنُونَ لِيَنفِرُوا كَافَّةً ۚ فَلَوْلَا نَفَرَ مِن كُلِّ فِرْقَةٍ مِّنْهُمْ طَائِفَةٌ لِّيَتَفَقَّهُوا فِي الدِّينِ وَلِيُنذِرُوا قَوْمَهُمْ إِذَا رَجَعُوا إِلَيْهِمْ لَعَلَّهُمْ يَحْذَرُونَ [٩:١٢٢]
আর সমস্ত মুমিনের অভিযানে বের হওয়া সঙ্গত নয়। তাই তাদের প্রত্যেক দলের একটি অংশ কেন বের হলো না,যাতে তারা দ্বীনের ক্ষেত্রে ফক্বীহ হতে পারে, এবং [ফক্বীহ হবার পর] সতর্ক করে স্বজাতিকে,যখন তারা তাদের কাছে প্রত্যাবর্তন করবে,যেন তারা বাঁচতে পারে।  {সূরা তওবা-১২২}
উক্ত আয়াতে দেখুন পরিস্কার বলা হচ্ছে ফক্বীহ হবার পর স্বজাতিকে সতর্ক করবে। আর লোকেরা তাদের স্বজাতির ফক্বীহের কথা শুনে আখেরাতের বিষয়ে সতর্ক হবে।
এ আয়াত দ্বারা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছে যে এলাকায় যে ফক্বীহ আছেন, তার বলা ফাতওয়া অনুপাতে তারা দ্বীন পালন করবে। এটাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন উক্ত আয়াতে পরিস্কার জানিয়ে দিলেন।
সেই হিসেবে আমরা বলি যে এলাকায় যে ফক্বীহের কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক উদ্ভাবনী মাসায়েল পৌঁছেছে, সেই এলাকায় সেই ফক্বীহের অনুসরণ করবে। অন্য এলাকায় ফক্বীহের ফাতওয়া নয়।
যেহেতু ভারতীয় উপমহাদেশে হানাফী ফক্বীহদের অনুসারীরা দ্বীন এনেছেন। তাদের মাধ্যমেই দ্বীন ছড়েছে। আর ইসলাম আসার পর থেকে এ এদেশ সমূহে এভাবেই দ্বীন পালন করা হচ্ছে। তাই এ এলাকায় কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক এ মাযহাবই অনুসরণ করবে। শ্রীলংকায় শাফেয়ীদের মাধ্যমে দ্বীন প্রচার হয়েছে, মক্কায় হাম্বলী ও মদীনায় মালেকী মাযহাব অনুপাতে দ্বীন পালন করা হয়, তাই সেখানে সেভাবেই দ্বীন মানবে। ভিন্ন মাযহাবের অনুসরণ করে ফিতনা করবে না।
সেই হিসেবে যে এলাকায় যে মাযহাবের মাধ্যমে দ্বীন এসেছে, যে মাযহাব অনুপাতে ইসলাম আসার পর থেকে আমল চলে আসছে। সেই মাযহাব অনুপাতেই দ্বীন পালন করবে। সূরা তওবার ১২২ নং আয়াত একথাই বর্ণিত হয়েছে।

২য় প্রশ্নের জবাব

এ প্রশ্নটি করা হয় সাধারণত ইসলামী ফিক্বহ ও সাধারণ বোধবুদ্ধি কম থাকার কারণে।
দুইজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের প্রেশক্রিপশন একজন সাধারণ রোগী নিজেদের স্বল্প জ্ঞান দিয়ে বিবেচনা করে একটিকে প্রাধান্য দেয়া কতটা হাস্যকর তা নিশ্চয় সবার জানা। দুইজন ইঞ্জিনিয়ার দু’টি থিউরী দিলেন। এখন একজন সাধারণ লোক, যে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের “ই” পর্যন্ত জানে না, সে যদি দুই ইঞ্জিনিয়ারের থিউরীকে নিজের স্বল্প জ্ঞান দিয়ে প্রাধান্য দিতে চায়, তাহলে এটি হাস্যকর বিষয় হবে না?

ঠিক তেমনি ইমাম শাফেয়ী রহঃ, ইমাম মালিক রহঃ, ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল রহঃ ও ইমাম আবু হানীফা রহঃ হলেন পৃথিবী বিখ্যাত সর্বজন স্বীকৃত মুজতাহিদ। এখন যারা ইজতিহাদের “ই” পর্যন্ত জানে না, তারা যদি দুইজন মিলি বিচার বিশ্লেষণ করে একটিকে প্রাধান্য দেবার হাস্যকর প্রচেষ্টা করে তা কতটা বোকামী তা আশা করি আর বলতে হবে না।
তাই এরকম হাস্যকর কাজ না করে, যে এলাকায় যে মাযহাব হিসেবে দ্বীন এসেছে, যে অনুপাতে ইসলাম আসার পর থেকে কুরআন সুন্নাহ ভিত্তিক আমল চালু আছে, সে এলাকায় সেভাবেই আমল করবে। রোগী হয়ে পিএইচডি করা ডাক্তারের থিউরীর ভুল ধরতে যাওয়ার মত হাস্যকর কাজে নিয়োজিত হওয়া যাবে না।
আরো জানতে পড়ুন-
والله اعلم بالصواب
উত্তর লিখনে
লুৎফুর রহমান ফরায়েজী
পরিচালক-তালীমুল ইসলাম ইনষ্টিটিউট এন্ড রিসার্চ সেন্টার ঢাকা।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন