বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০১৫

তাবলীগ জামাতের উপর কথিত আহলে হাদীসদের মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা

মুফতী রফীকুল ইসলাম মাদানী
সমগ্র বিশ্ব মুসলিমের প্রশংসিত ও সুপরিচিত তাবলীগ জামাআতও লা-মাযহাবীদের কাছে নিন্দিত।  তাবলীগ জামাআ’তের একান্ত নিষ্ঠা ও অক্লান্ত দাওয়াতী মেহনতে লাখ-লাখ বিধর্মী আজ মুসলমান হচ্ছে। জীবনে যারা মসজিদ দেখেনি তারাও মসজিদে গিয়ে নামায আদায় করছে। নবী রাসূলদের প্রতিনিধি  আল্লাহর পথে আহবানকারী এ নিষ্ঠাবান তাবলীগ জামাআতও লা-মাযহাবীদের অপপ্রচারের শিকার। রেহাই পায়নি এদের বিদ্বেষী আক্রমণ ও হিংসাত্মক উপহাস-বিদ্রƒপ  আর অবান্তর তিরস্কার-ভর্ৎসনা থেকে। এ পরিসরে অতি সংক্ষেপে কয়েকটি উদাহরণ পেশ করছি-
(ক)
আবু উসামা কর্তৃক প্রণীত তাবলীগ জামাআতের উপর আক্রমণাত্মক স্বতন্ত্র বই “জামাআতুত তাবলীগ” এর সপ্তম পৃষ্ঠা- কিতাবের ভূমিকায় লিখেছে-
(ھدفنا من تقدیم ھذا الکتاب ھو ان القاری علی علم بھذہ الطائفۃ وبما فیھا من الاوھام والخرافات)
“এই বই লেখার উদ্দেশ্য হল, পাঠককে তাবলীগ জামাআতের ভ্রান্ত মতবাদ ও কুসংস্কার সম্পর্কে অবহিত করা।”
একই পৃষ্ঠায় তাবলীগ জামাআতের পরিচিতি পেশ করতে গিয়ে লিখে- “ইসলামী ফিরক্বাসমূহের মধ্যে যারা আল্লাহর প্রতি শিরকজনিত ফিৎনামূলক আক্বীদার জালে আবদ্ধ হয়েছে তাদের মধ্যে তাবলীগ জামাআত এবং এ জামাআতের উলামা ও সাধারণ মানুষ।
উক্ত বইয়ের ৬১ পৃষ্ঠায় লিখেছে-
(جماعۃ التبلیغ مثل الشیعۃ والقادیانیین۔
“তাবলীগ জামাআত শিয়া ও ক্বাদিয়ানীদের মত”
৬৩ পৃষ্ঠায় লিখেছে-
(جماعۃ التبلیغ توالی الطاغوت)
“তাবলীগ জামাআত শয়তানের বন্ধু”
২৯৮ পৃষ্ঠায় লিখেছে-
(من الشرکیات التی ذکرت عن بعض المشایخ من التبلیغ)
“ তাবলীগ জামাআতের মুরব্বীদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে শিরক”।
জামাআতুত তাবলীগ লিখক-আবু উসামা সাইয়্যেদ তালিবুর রহমান , দারুল বয়ান পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশ-১৪১৯হি. ১৯৯৯ইং
(খ)
আদ-দেওবন্দীয়া কিতাবে লিখেছে-
(حسین احمد وغیرہ من مشائخ جماعۃ التبلیغ المخرفین)
তাবলীগ জামাআতের মুরুব্বী হুসাইন আহমদ ও অন্যান্যরা কুসংস্কারে লিপ্ত ছিল। পৃ.নং-২১১
(গ)
আহলে হাদীস তাবলীগে ইসলাম, বাংলাদেশের আমীর, শায়খ মুফতী মোহাম্মদ আ. রউফ প্রণীত জামাআতে তাবলীগের প্রতি তিরস্কারমূলক বই “ ইলিয়াসী তাবলীগ বনাম রাসূল (সা.) এর তাবলীগ” নাম যেমন , কাম তেমন। নামেই বুঝাচ্ছে বইয়ের অশ্লীলতার দৌরাত্ম। ৮ পৃষ্ঠা বইয়ের প্রত্যেকটি লাইনেই চরম অশ্লীলতার পরিচয় দিয়েছে। খারেযী, রাফেযী, ও শিয়াদের সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহের অপব্যাখ্যার মাধ্যমে জামাআতে তাবলীগের সবাইকে খারেযী, রাফেযী ও ভ্রান্ত শী’য়া প্রমাণ করার অপপ্রয়াস চালিয়েছে।
বইয়ের লিখক শায়খ মুফতী মুহাম্মদ আ. রউফ এম৪৮ খালিশপুর, হাউজিং এস্টেট খুলনা। প্রকাশনা মুহা. ইমতিয়াজ আমিন,৭৩ সি, এম, ব্লক সড়ক নং-১৬, খালিশপুর হাউজিং এস্টেট খুলনা।
পর্যালোচনা
তাবলীগ জামাতের উপর লা-মাযহাবীদের আক্রমণের ধরণটা উলামায়ে দেওবন্দের উপর আক্রমণের মতোই প্রায়। আর উলামায়ে দেওবন্দের উপর আক্রমণ বিষয়ক যেহেতু বিস্তারিত পর্যালোচনা পেশ করা হয়েছে ,তাই এ অধ্যায়ে বিশেষ কোন আলোচনার প্রয়োজন মনে করি না।
মোট কথা, ভুল ধরা, সমালোচনা করা, অপবাদ রটানো আর তিরস্কার-বিদ্রƒপ করা এ জগতে খুবই সহজ ব্যাপার। কিন্তু কাজ করাই মহা কঠিন। যারা কাজ করে তাদেরই ভুল হয়। যারা কাজ করে না তাদের ভুলও হয় না। বরং যারা কাজ করে না তারাই ভুল ধরায় ব্যস্ত থাকে। তাবলীগ করা বা আল্লাহর পথে আহবান করা আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত প্রেরিত সমস্ত নবী ও রাসূলের কাজ। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-
(ومن احسن قولا ممن دعا الی اللہ)
“যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার?” সুরা-ফুচ্ছিলাত-৩৩
অপর এক আয়াতে রাসূল (সা.) কে নির্দেশ করে বলেন-
(یا ایھا الرسول بلغ ما انزل الیک من ربک وان لم تفعل فما بلغت رسالتہ واللہ یعصمک من الناس ان اللہ لایھدی القوم الکافرین)
“হে রাসূল তাবলীগ করুন (পৌঁছে দিন আপনার প্রতিপালকের পক্ষ থেকে আপনার প্রতি যা অবতীর্ণ হয়েছে।) আর যদি আপনি এরূপ না করেন, তবে আপনি তাঁর পয়গাম  কিছুই পৌঁছালেন না। (তাবলীগ করতে গেলে মানুষ আপনাকে তিরস্কার করবে  এমতাবস্থায়) আল্লাহ আপনাকে মানুষের কাছ থেকে রক্ষা করবেন। নিশ্চয় আল্লাহ কাফির (সত্য গোপনকারী) দেরকে পথ প্রদর্শন করেন না। মাইদাহ-৬৭
প্রিয় পাঠকগণ! গভীরভাবে চিন্তা করলে এ আয়াতেই অভিযোগকারীদের সমস্ত তিরস্কারের দাঁতভাঙ্গা জবাব রয়েছে। মূলত তাবলীগ করা নবীদের কাজ। নবীদের অবর্তমানে আমরা  সবাই নবীদের প্রতিনিধি। তাই তাবলীগ করা সবার উপরেই জরুরী। সবার পক্ষ হতে আমাদেরই কিছু ভাই এ সুমহান দায়িত্বে আত্মনিবেদিত হয়েছেন। তাই আমাদের জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু একটি বিভ্রান্ত  দল এর বিপরীতে তাদেরকে তিরস্কার ও উপহাস-বিদ্রƒপের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। এ ধারা আজকের নতুন নয়। নবী মুহাম্মদ (সা.) কেও এ দ্বীনের তাবলীগ করার কারণে ঘর-বাড়ী ছাড়তে হয়েছে । সহ্য করতে হয়েছে বহু তিরস্কার আর ভর্ৎসনার ঝড়-তুফান। দান্দান শহীদ করতে হয়েছে ওহুদের প্রান্তরে, রক্ত ঝরাতে হয়েছে তায়েফের ময়দানে।
আল কুরআনে নূহ (আ.) , হুদ (আ.) , সালেহ (আ.) মুসা (আ.) ও অন্যান্য নবীদের ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। তারা স্ব-স্ব গোত্রে দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে তাবলীগ করার জন্য গেলে কেবল তারা প্রত্যাখ্যানই করেনি, বরং নবীদেরকে মিথ্যুক , যাদুকর, কাল্পনিক ও ভ্রান্ত ইত্যাদি অপবাদে আখ্যায়িত করেছে। দেখুন সুরা আরাফ আয়াত-৫৯ থেকে ৯৯ পর্যন্ত এবং আযযারিয়াত-৩৯ থেকে শেষ পর্যন্ত।
আল্লাহ পাক সূরায়ে আযযারিয়াতে কতিপয় নবী রাসূলের বিবরণ উল্লেখ করত, ইরশাদ করেন-
(ما اتی الذین من قبلھم من رسول الا قالوا ساحر او مجنون،
اَتَوَاصَوْابہ ج بل ھم قوم طاغون- فتول عنھم فما انت بملوم- وذکر فان الذکریٰ تنفع المؤمنین)
“ এমনিভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের কাছে যখন কোন রাসূল আগমন করেছেন, তারা বলেছে যাদুকর , না হয় উম্মাদ। তারা কি একে অপরকে এই উপদেশ দিয়ে গেছে? বস্তুত ওরা দুষ্ট সম্প্রদায়। অতএব আপনি ওদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন। এতে আপনি অপরাধী হবেন না। আর বুঝাতে থাকুন; কেননা বোঝানো মুমিনদের উপকারে আসবে।” আযযারিয়াত-৫২-৫৫
এদের সম্পর্কে আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন-
(فان اعرضوا فما ارسلناک علیھم حفیظا، ان علیک الا البلاغ)
“যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আপনাকে আমি তাদের রক্ষক করে পাঠাইনি। আপনার কর্তব্য কেবল তাবলীগ (প্রচার ) করা। আশ-শুরা-৪৮
১৯৯৯ ইংরেজীর কথা, আমি তখন মদীনা ইসলামী বিশ্ব বিদ্যালয়ে হাদীস বিভাগে ৪র্থ বর্ষের শ্রেণীকক্ষে। আমাদের উস্তাদ শায়খ আব্দুর রহমান বিন মুহিউদ্দীন নাইলুল আওতারের দরস দিচ্ছিলেন। এক পর্যায়ে প্রাসঙ্গিক আলোচনায় তিনি তাবলীগ জামাআতের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অনীহামূলক আলোচনায় মেতে উঠেন। সাথে সাথে আফ্রিকার এক ছাত্র হাত উঁচু করে বলে, শায়খ! তাবলীগ জামাআত মানে সংস্কারমূলক প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষ পর্যন্ত দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছার এক অভিনব পথ, যার বদৌলতে লাখ লাখ মুসলমান ইসলামের সাথে ঘনিষ্ট হচ্ছে এবং নিজেদের ব্যক্তি জীবনকে ইসলামী আদর্শের আলোকে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। এদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার ফলে অসংখ্য অমুসলিম ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নিচ্ছে । এ প্রক্রিয়ায় ইসলামের আলোকরশ্মি দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে।
শায়খ বলেন, আসলে তাবলীগ জামাআতের উদাহরণ হবে এমন যে, কোন ব্যক্তি মহাসমুদ্রে হাবু-ডুবু খাচ্ছে, এমতাবস্থায় তাবলীগ জামাআতের লোকেরা তাকে উদ্ধার করত সমুদ্র তীরে বিবস্ত্র অবস্থায় ছেড়ে দিয়েছে। তখন ছাত্রটি বলে, তাবলীগ জামাআতের লোকজন তো তাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়ে দিয়েছেন, এখন আপনারা যেয়ে অন্তত বস্ত্র পরিধানের কাজটা করেন। শায়খ গম্ভীর স্বরে বলেন – (أحسنت یابُنَیَّ)  বেটা তুমি খুবই সুন্দর বলেছো।”
বস্তুত তাবলীগ জামআত সম্পর্কে যারা কটুক্তি করে চলেছে তারাও অবুঝ ও অজ্ঞতা বশতই এমন করছে। ঐ শায়খের মতো সঠিক বুঝশক্তি ও হিদায়েতের অনুসন্ধান থাকলে আল্লাহ পাক তাদেরকেও সঠিক পথ প্রদর্শন করবেন। অতএব আমরা তাদেরকে কিছু না বলে তাদেরকে বুঝাই ও তাদের জন্য দু’আ করি এবং এ মর্মে আল্লাহ পাকের ইরশাদকে অবিস্মরণীয় মনে করি।
(وعباد الرحمن الذین یمشون علی الارض ھونا واذا خاطبھم الجاھلون قالوا سلاما)
“ রহমান এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদের সাথে যখন অজ্ঞরা কথা বলতে থাকে তখন তারা বলে, “ সালাম”। আল-ফুরকান-৬৩
তাবলীগ জামায়াতের ভূমিকা আজ সারা বিশ্বে স্বীকৃত। টংগীর তুরাগ নদীর তীরে প্রতি বছর তাবলীগ জামায়াতের “ বিশ্ব ইজতিমা” এর জ্বলন্ত সাক্ষ্য বহন করছে। কতিপয় বিভ্রান্ত লোকের সমালোচনায় এতে কিছু আসে যায় না। মহান আল্লাহ পাক তাবলীগের বদৌলতেই সারা দুনিয়ায় ইসলামী জাগরণ ক্বায়েম রাখবেন, ইনশাআল্লাহ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন