যখন আসমানী কিতাব তেলাওয়াত করা হয় এবং উম্মতে মুহাম্মাদিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব ও ফযিলতের কারণ তালাশ করা হয়, তখন জানা যায় যে, এই উম্মত কে একটি অতি উঁচু ও মহান কাজের দায়িত্ব দেওয়া হইয়াছিল যাহার কারণে তাহাদিগকে খাইরুল উমাম অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ উম্মতের সম্মানজনক খেতাব দেয়া হইয়াছে।
দুনিয়া সৃষ্টির আসল উদ্দেশ্য হইল, আল্লহ ওয়াহ্দাহু লা শারীকালাহুর যাত ও সিফাতের পরিচয় লাভ করা। আর ইহা ততক্ষন পর্যন্ত সম্ভব নয় যতক্ষন পর্যন্ত মানব জাতিকে সর্ব প্রকার খারাপি ও অপবিত্রতা হইতে পাক সাফ করিয়া যাবতীয় কল্যাণ ও গুণাবলীর দ্বারা সুসজ্জিত করা না হইবে। এই উদ্দেশেই হাজারো রসূল ও আম্বিয়ায়ে কেরাম আ’লাইহিমুস সালাম কে দুনিয়াতে পাঠানো হইয়াছে এবং সর্বশেষে এই উদ্দেশ্যের পূর্ণতা দানের জন্য সাইয়্যিদুল আম্বিয়া ওয়াল মুরসালীন মুহাম্মাদ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে পাঠানো হইয়াছে এবং এই সুসংবাদ শুনানো হইয়াছে–
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي
অর্থঃ আজ তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীন কে পরিপূর্ণ করিয়া দিলাম এবং তোমাদের প্রতি আমার নেয়ামত কে পূর্ণ করিয়া দিলাম। (সূরা মায়েদাহঃ৩)
এখন যেহেতু উদ্দেশ্য পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে, সর্ব প্রকার ভাল-মন্দ বিশদ ভাবে বর্ণনা করিয়া দেওয়া হইয়াছে, একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা দেওয়া হইয়াছে, কাজেই রিসালাত ও নবুওয়াতের ধারা বন্ধ করিয়া দেওয়া হইয়াছে এবং অতীতে কাজ নবী ও রসূলগণের দ্বারা লওয়া হইতে ছিল তা কিয়ামাত পর্যন্ত উম্মতে মুহাম্মাদীর উপরে ন্যাস্ত করা হইয়াছে।
كُنتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللَّـهِ
অর্থঃ হে উম্মতে মুহাম্মাদী! তোমরা শেষ্ঠ উম্মত। তোমাদিগকে মানুষের কল্যাণের জন্য পাঠানো হইয়াছে। তোমরা সৎ কাজসমূহকে মানুষের মাঝে প্রসার কর এবং অসৎ কাজ হইতে তাহাদিগকে ফিরাইয়া থাক এবং আল্লহ তায়া’লার উপর ঈমান রাখ। (আল-ইমরানঃ১১০)
وَلْتَكُن مِّنكُمْ أُمَّةٌ يَدْعُونَ إِلَى الْخَيْرِ وَيَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ ۚ وَأُولَـٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُونَ
অর্থঃ তোমাদের মধ্যে এমন জামাত থাকা চাই, যাহারা মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করে এবং ভাল কাজের হুকুম করে ও মন্দ কাজ হইতে নিষেধ করে–এই কাজ যাহারা করে একমাত্র তাহারাই কামিয়াব। (আল-ইমরানঃ১০৪)
প্রথম আয়াতে শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার কারণ বলা হইয়াছে যে, তোমরা সৎ কাজের প্রসার করিয়া থাক এবং অসৎ কাজ হতে ফিরাইয়া থাক। দ্বিতীয় আয়াতে নির্দিষ্ট করিয়া বলিয়া দিয়াছেন যে কামিয়াবী সফলতা একমাত্র ঐ সকল লোকদের জন্যই যাহারা এই কাজ করিতেছে।
আর শুধু এইটুকু বলিয়াই ক্ষান্ত হন নাই; বরং অন্য জায়গায় পরিষ্কার ভাবে বর্ণনা করিয়া দিয়াছেন যে এই কাজ না করা লানত ও অভিশাপের কারণ। এরশাদ হইতেছে–
لُعِنَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن بَنِي إِسْرَائِيلَ عَلَىٰ لِسَانِ دَاوُودَ وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ ۚ ذَٰلِكَ بِمَا عَصَوا وَّكَانُوا يَعْتَدُونَ ﴿٧٨﴾ كَانُوا لَا يَتَنَاهَوْنَ عَن مُّنكَرٍ فَعَلُوهُ ۚ لَبِئْسَ مَا كَانُوا يَفْعَلُونَ ﴿﴾٧٩
অর্থঃ বনী ইসরাইলের মধ্যে যাহারা কাফের ছিল তাহাদের উপর লানত করা হইয়াছিল দাউদ ও ঈসা ইবনে মারইয়ামের জবানে। আর এই লানত এই কারণের করা হইল যে, তাহারা হুকুমের বিরোধিতা করিয়াছে এবং সীমা লংঘন করিয়াছে। যে মন্দ কাজ তাহারা করিত, উহা হইতে বিরত হইত না। তাহাদের এই কাজ নিঃসন্দেহে মন্দ ছিল (সূরা মায়েদাহঃ৭৮-৭৯)
নিন্মোক্ত হাদীসসমূহ দ্বারাও উপরোক্ত শেষ আয়াতের ব্যাখ্যা আরও স্পষ্ট হইয়া যায়।
১) আ’ব্দুল্লহ ইবনে মাসঊ’দ রদিয়াল্লহু আ’নহু হইতে বর্ণিত, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতগনের মধ্যে যখন কোন ব্যক্তি গুনাহ করিত, তখন বাধা প্রদানকারী ব্যক্তি তাহাকে ধমকাইত এবং বলিত যে, আল্লহকে ভয় কর। কিন্তু পরের দিনই সে তাহার সহিত উঠাবসা ও খাওয়া দাওয়া করিত যেন গতকাল তাহাকে গুনাহ করিতে দেখেই নাই। যখন আল্লহ তায়া’লা তাহাদের এই আচরণ দেখিলেন তখন একের অন্তরকে অপরের সহিত মিলাইয়া দিলেন এবং তাহাদের নবী হযরত দাউদ আ’লাইহিস সালাম ও হযরত ঈসা আ’লাইহিস সালামের যবানে তাহাদের উপর লা’নত করিলেন। আর ইহা এই জন্য যে, তাহারা আল্লহ তায়া’লার নাফরমানী করিয়াছে এবং সীমা লংঘন করিয়াছে। ঐ পাক যাতের কসম, যাহার কুদরতের হাতে মুহাম্মাদের (সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম) জান! তোমরা অবশ্যই সৎ কাজের আদেশ কর এবং অসৎ কাজে নিষেধ কর এবং বেওকুফ ও মূর্খ লোকের হাত ধরিয়া হক কথা উপর তাহাকে বাধ্য কর। যদি এরূপ না কর তবে আল্লহ তায়া’লা তোমাদের অন্তরগুলিকেও একে অপরে সহিত মিলাইয়া দিবেন। ফলে তোমাদের উপরও লা’নত বর্ষিত হইবে যেমন পূর্ববর্তী উম্মতগণের উপর লা’নত বর্ষিত হইয়াছে।
২) হযরত জারীর রদিয়াল্লহু আ’নহু হইতে বর্ণিত রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যদি কোন দল বা কওমের মধ্যে কোন ব্যাক্তি গুনাহ করে এবং সেই কওম বা দলের লোকেরা শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাহাকে বাধা প্রদান করে না; তবে তাহাদের উপর মৃত্যুর পূর্বেই আল্লহ তায়া’লা আযাব পাঠাইয়া দেন অর্থাৎ দুনিয়াতেই তাহাদিগকে বিভিন্ন ধরনের মুসীবতের মধ্যে লিপ্ত করিয়া দেয়া হয়।
৩) হযরত আনাস রদিয়াল্লহু আ’নহু হতে বর্ণিত রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ ফরমাইয়াছেন, কালেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লহ তাহার পাঠকারীকে সর্বদা উপকার পৌঁছাতে থাকে এবং তাহার উপর হইতে আযাব ও বালা-মুসীবত দূর করিতে থাকে যতক্ষন সে উহার হক আদায় হইতে গাফেল ও উদাসীন না হয়। সাহাবাহ কেরাম রদিয়াল্লহু আ’নহুম আরজ করিলেন উহার হক আদায়ে উদাসীনতা কি? রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলিলেন, আল্লহ তায়া’লার নাফরমানী প্রকাশ্যে হইতে থাকা সত্ত্বেও উহাকে নিষেধ না করা এবং উহাকে বন্ধ করার চেষ্টা না করা।
৪) হযরত আ’য়েশা রদিয়াল্লহু আ’নহা বলেন, রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমার নিকট তাশরীফ আনিলেন। আমি তাঁহার নূরানী চেহারার উপর এক বিশেষ আলামত দেখিয়া অনুভব করিলাম যে, কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার দেখা দিয়াছে। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কাহারো সহিত কথা বলিলেন না এবং ওযু করিয়া মাসজিদে চলিয়া গেলেন। আমি মাসজিদের দেওয়াল ঘেঁষিয়া দাঁড়াইয়া গেলাম। যেন যাহা কিছু এরশাদ করেন শুনিতে পাই। রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম মিম্বরের উপর উপবেশন করিলেন এবং হা’মদ ও ছানার পর ফরমাইলেনঃ “হে লোক সকল! আল্লহ তায়া’লা বলিতেছেনঃ তোমরা সৎ কাজে আদেশ কর এবং অসৎ কাজ হইতে নিষেধ কর নতুবা ঐ সময় আসিয়া পড়িবে যে, তোমরা দোয়া করিবে আর আমি উহা কবুল করিব না, আর তোমরা আমার নিকট সওয়াল করিবে আর আমি উহা পুরণ করিব না আর তোমরা আমার নিকট সাহায্য চাহিবে আমি তোমাদের সাহায্য করিব না।”
রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম শুধু এই কয়টি কথা বলিলেন এবং মিম্বর হইতে নামিয়া আসিলেন।
৫) হযরত আবু হুরইরহ রদিয়াল্লহু আ’নহু হতে বর্ণিত রসুলুল্লহ সল্লাল্লহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করিয়াছেন, যখন আমার উম্মত দুনিয়াকে বড় ও মর্যাদার উপযুক্ত মনে করিতে লাগিবে তখন ইসলামের বড়ত্ব ও মর্যাদা তাহাদের অন্তর হইতে বাহির হইয়া যাইবে। আর যখন সৎ কাজে আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ ছড়িয়া দিবে তখন অহীর বরকত হইতে বঞ্চিত হইয়া যাইবে। আর যখন পরস্পর একে অপরকে গালিগালাজ শুরু করিবে তখন আল্লহ তায়া’লার দৃষ্টি হইতে পড়িয়া যাইবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন