মোফাজ্জল করিম
সেই ছেলেবেলা থেকে যে বিস্ময়ের ঘোর লেগেছিল
আমার মধ্যে, বিশ্বাস করুন, আজও তা কাটেনি। একটু ভেবে দেখলে দেখবেন, আপনার মধ্যেও কিছুটা হলেও আছে সেই বিস্ময়ের ঘোর। আমি একবাক্যে রায় দিই, এর মধ্যে নিশ্চয়ই আছে অলৌকিকত্ব।
বলছিলাম কুরআনে হাফিযদের কথা। এঁদের অনেকেই দেশের প্রচলিত
সাধারণ শিক্ষায় হয়তো মোটেই শিক্ষিত নন, তবে বেশির ভাগই কমবেশি মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত। তাও সবাই যে ফাজিল-কামিল
ডিগ্রিধারী বিরাট মাওলানা তা নয়। তাঁদের বড় পরিচয় তাঁরা কুরআনে হাফিয। 'হাফিয সাহেব' বলেই সাধারণত তাঁদের সম্বোধন করা হয়। সারা বাংলাদেশে শহর-বন্দর-গ্রামে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাফিয সাহেবদের সংখ্যা শুনেছি পাঁচ-ছয় লাখের কম নয়। এঁদের কারো
কারো নামধাম-ঠিকানা হয়তো ইসলামিক ফাউন্ডেশন বা সরকারের অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে
নিবন্ধিত আছে; তবে লোকচক্ষুর অন্তরালে গ্রামেগঞ্জে নীরবে
নিভৃতে সমাজের এক বিরাট ধর্মীয় চাহিদা পূরণ করে যাচ্ছেন যেসব 'অনিবন্ধিত' হাফিয সাহেব, তাঁদের সংখ্যাই বেশি।
এঁদের সবাই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করেছেন কোনো না কোনো 'হেফয্খানা' বা মাদ্রাসার 'হিফয্' বিভাগে দক্ষ
উস্তাদদের কাছে। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা, শৃঙ্খলা, সংযম ও ধৈর্য সেই শিক্ষাপদ্ধতির মূল কথা। এ
যে কতটুকু কঠিন ও শ্রমসাধ্য কাজ তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। রাত তিনটা-সাড়ে
তিনটায় শয্যাত্যাগ করে শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীরা সারিবদ্ধভাবে বসে মাথা দুলিয়ে
দুলিয়ে মুখস্থ করে 'সবক'। অতঃপর
তাহাজ্জুদ, ফযর শেষ করে সামান্য নাশতাপানি খেয়ে কয়েক
ঘণ্টা গভীর ঘুম। এই সঞ্জীবনী নিদ্রার পর আবার সারা দিন রুটিন করে কুরআন শরিফ
মুখস্থ করা, সময়মতো গোসল-খাওয়া-নামায এবং সর্বশেষে এশার
নামাযের পর দ্রুত ঘুমাতে যাওয়া। ঘুম মানে সব শিক্ষার্থী গাদাগাদি-ঠাসাঠাসি করে এক
কামরায়,
কোথাও হয়তো শক্ত মেঝের ওপর চাটাই বিছিয়ে, মশা তাড়াতে তাড়াতে গরমের মধ্যে সিদ্ধ হওয়া। এ সব কিছুই চলে
ঘড়ির কাঁটা ধরে। এর কোনো কিছুতেই পান থেকে চুন খসার জো নেই। কোনো শিক্ষার্থী এর
বরখেলাপ করলে বা শৃঙ্খলাবিরোধী কিছু করলে সঙ্গে সঙ্গে কঠোর শাস্তি। শিক্ষার্থীর তো
প্রশ্নই ওঠে না, এমনকি তার অভিভাবকেরও এই শাসনব্যবস্থার
বিরুদ্ধে মৃদু প্রতিবাদ করারও সুযোগ নেই। শৃঙ্খলার নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা একটি
শিশুর এই জীবনকে বাইরের লোকের কাছে মনে হতে পারে 'অমানবিক', শাস্তিদান পদ্ধতিকে কেউ বলতে
পারেন 'মধ্যযুগীয়'; কিন্তু হেফয্খানায়
এটাই নিয়ম। এই নিয়ম চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। এবং শুধু বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র উপমহাদেশে, তথা পৃথিবীর সর্বত্র 'হাফিযি' শিক্ষাদান করা হয় এ রকম কঠোর শিক্ষাদান পদ্ধতিতে। এভাবেই পাঁচ-ছয় বা ১০-১২
বছরের একটি শিশুকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস
দিবারাত্রি একই 'ড্রিলের' মধ্যে রেখে তার সমগ্র সত্তাকে 'কন্ডিশনড্' বা নিয়ন্ত্রিত করে ফেলা হয়। এলাকার সবচেয়ে দুষ্টু বালকটিও
তখন ধীরে ধীরে হেফয্খানার নিয়মকানুনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন তার সম্পূর্ণ মনঃসংযোগ, সমস্ত ধ্যানধারণা চলে যায় একদিকে : কুরআন শরিফ মুখস্থ করতে
হবে। আর যেহেতু মুখস্থ করার কাজটি হয় গ্রুপ পদ্ধতিতে, তাই এক ধরনের প্রতিযোগিতা চলতে থাকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। ও
পারল,
আর পারল বলে উস্তাদজি সবার সামনে তার প্রশংসা
করলেন,
আদর করলেন তাকে, আর পারলাম না বলে আমাকে শাস্তি পেতে হলো, তা হতে পারে না। আমাকেও পারতে হবে। দুষ্টু ছেলেটি তখন
দুষ্টুমি বাদ দিয়ে তার মেধা ও মননকে নিয়োজিত করে সূরা মুখস্থ করার কঠোর সাধনায়। আর
এই আত্মনিবেদন, এই সার্বক্ষণিক কঠোর পরিশ্রমই সম্ভব করে তোলে
অসম্ভবকে। একদিন সে কুরআনে হাফিয হয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হয় অনেক বড় বড়
আলিম-উলামা ও প্রখ্যাত হাফিযদের সম্মুখে। সেই পরীক্ষায় পাস করার পর ওই কিশোর
হাফিযকে পরিয়ে দেওয়া হয় সম্মানসূচক আমামা বা পাগড়ি। তবে অমন আনুষ্ঠানিকতা সবার
ভাগ্যে জোটে না। শহরের বড় বড় মাদ্রাসা বা হেফয্খানাতে যারা শিক্ষালাভ করে, তাদের জন্য হয়তো ঘটা করে সনদ প্রদান, পাগড়ি পরানো ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়; কিন্তু গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিনিয়ত যে অসংখ্য
শিক্ষার্থী খেয়ে না-খেয়ে হাফিযি পাঠ সমাপ্ত করে, তাদের জন্য কোনো আচার-অনুষ্ঠান হয় না। গ্রামের কোনো রইস ব্যক্তি যদি দয়া করে
তাদের একটি পাঞ্জাবি বা একটি লুঙ্গি ইনামস্বরূপ দান করেন, তবে তা-ই তারা 'গনিমত' মনে করে।
যারা হেফয্খানায় থেকে হাফিযি শিক্ষা গ্রহণ করে তারা কারা? এটা একটা খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। শুধু প্রাসঙ্গিক প্রশ্নই
নয়,
সমাজবিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের গবেষণার জন্য
এটা একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও বটে। আমাদের দেশে হেফয্খানা তথা মাদ্রাসার
শতকরা ৯০ জন শিক্ষার্থী আসে গরীব অসহায় পরিবার থেকে। এদের বেশির ভাগের বাড়িতে দুই
বেলা আহার জোটে না। অনেকেই এতিম। কারো হয়তো বাপ-মা কেউ নেই। গ্রামের প্রাইমারি
স্কুলে পড়তে যাওয়ার সংগতিটুকুও নেই অনেকের। এ রকম একটি শিশুকে একরকম বাধ্য হয়ে
পাঠিয়ে দেওয়া হয় এতিমখানা বা হেফয্খানায়। এই দুই জায়গাতেই তার আহার-বাসস্থান, পোশাক-পরিচ্ছদ, পুঁথিপুস্তক ফ্রি। হ্যাঁ, খাবারদাবার বা
কাপড়চোপড়ের মান হয়তো অতি সাধারণ ঠিকই, তবুও পরিবারের নিরন্ন-নিবস্ত্র অবস্থা থেকে তো ভালো। এসব অন্নবস্ত্রের সংস্থান
হয় দানখয়রাত থেকে। প্রায় সব কটি হাফিযিয়া মাদ্রাসা ও হেফয্খানা সরকারি
অনুদানবঞ্চিত। অন্যের দান বা লিল্লাহ্র ওপর চলে বলে এসব ছাত্রাবাসকে বলা হয়
লিল্লাহ্ বোর্ডিং। ফলে রীতিমতো অর্থকষ্টের ভেতর দিয়ে চলতে হয় তাদের। অবশ্য বড় বড়
মসজিদসংলগ্ন ও সরকারি সাহায্যপুষ্টদের কথা ভিন্ন।
হেফয্খানা বা মাদ্রাসার হেফয্ বিভাগ থেকে হাফিয হয়ে বের
হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কোনো না কোনো গ্রাম বা শহরের মসজিদে নামমাত্র বেতনে
ইমামতির চাকরি পেয়ে যান অনেকেই। প্রথমে সে চাকরি হবে বড় ইমাম বা খতিব সাহেবের
সহকারী হিসেবে, পরে হয়তো গ্রামগঞ্জের কোনো মসজিদের একমাত্র
ইমাম পদে নিয়োগ পাওয়া যায়। সচরাচর মোটামুটি অল্প বয়সেই হাফিয সাহেবদের এ ধরনের
চাকরি জুটে যায়। আমি একজন প্রসিদ্ধ মাওলানাকে জানি, যিনি মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে হাফিয হয়ে মসজিদে ইমামতি শুরু করেন। পরে অবশ্য
তিনি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারসি বিভাগের স্নাতকোত্তর
পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান লাভ করেন। আমার এক এতিম আত্মীয় মাত্র ১৫-১৬
বছর বয়স থেকে মসজিদে ইমামতি করে বিধবা মা ও ভাইবোনের সংসার চালাচ্ছে। সে হাফিয
হয়েছিল ১২-১৩ বছর বয়সে।
তবে সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে যখন দেখি ৮-১০ বছরের শিশুরা পুরো
কুরআন শরিফ অতি অল্প সময়ে মুখস্থ করে ফেলেছে। এদের মধ্যে অনেক মেয়ে হাফিযও আছে।
তবে সবচেয়ে বেশি অবাক লাগে জন্মান্ধ হাফিয সাহেবদের ব্যুৎপত্তি দেখে। এনটিভিতে
কেরাত প্রতিযোগিতায় সেদিন অংশগ্রহণ করেছিল এক 'ক্ষুদে
কেরাতরাজ', যার বয়স মাত্র ১২-১৩ বছর। সে
জন্মান্ধ। আর মাত্র দুই মাসে নাকি সে সমগ্র কুরআন শরিফ কণ্ঠস্থ করে ফেলে। এ রকম
অন্ধ হাফিযের সাক্ষাৎ প্রায়শই পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমাদের দেশের হাফিযি শিক্ষাকেন্দ্রগুলোতে মাত্র ৯-১০ মাসেই
বেশির ভাগ শিক্ষার্থী পুরো কুরআন শরিফ হেফয্ করে ফেলে। পরে আরো বছরখানেক বা বছর
দুয়েক ওই হেফয্খানাতেই তাদের থাকতে হয় অধীত বিদ্যা ঝালাই করে নেওয়ার জন্য।
এই যে অতি অল্প বয়সে কুরআনে হাফিয হওয়ার বিষয়টা, এটা আমার কাছে চিরকাল একটা বিস্ময়কর কৃতিত্ব বলে মনে হয়।
পবিত্র কুরআন মজিদে সূরা আছে ১১৪টি এবং আয়াতের সংখ্যা ৬,৬৬৬টি। আরবি ভাষায় অবতীর্ণ এই বিশাল গ্রন্থ কোনো ছন্দোবদ্ধ
মহাকাব্য বা তাল-লয়সমৃদ্ধ দীর্ঘ সংগীতমালা নয় যে সহজে মুখস্থ হয়ে যায়। বিশেষ করে
যাদের মাতৃভাষা আরবি নয়- যেমন বাংলাদেশের মানুষ- তাদের জন্য এটা তো অবশ্যই একটা
বিরাট চ্যালেঞ্জ। তার ওপর যদি একটি শিশু জন্মের পর বিদ্যাশিক্ষার কোনো
প্রাতিষ্ঠানিক সুযোগ না পায় বা ধর্মীয় সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল থেকে উঠে না আসে, তবে তার পক্ষে তো এটা আরো দুরূহ হওয়ার কথা। কিন্তু দেখা যায়
ওই শিশুটিই, মাশাআল্লাহ, অতিদ্রুত প্রতিটি আয়াত শুদ্ধভাবে কণ্ঠস্থ করে ফেলছে। শুদ্ধভাবে কথাটা খুবই
গুরুত্বপূর্ণ। ভাষাগত বৈচিত্র্যের কারণে আরবি ভাষায় স্বরনিক্ষেপণে সামান্য ত্রুটির
ফলে শব্দের অর্থ সম্পূর্ণ ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। সে কারণে কুরআন তেলাওয়াতের সময়
কোথায় কোন শব্দটির উচ্চারণ দীর্ঘ হবে, কোথায় হ্রস্ব হবে, বাক্যের মধ্যে কোথায় বিরতি হবে, কোথায় বিরতি হওয়া দূষণীয় ইত্যাদি বিষয় খুব সতর্কতার সঙ্গে খেয়াল
রাখতে হয়। অন্যথায় ভুল উচ্চারণের কারণে তেলাওয়াতকারীর সমূহ গুনাহ হওয়ার আশঙ্কা
আছে।
তা এত কিছু ঠিকঠাকভাবে ধাতস্থ করে সম্পূর্ণ অপরিচিত একটি
ভাষার সাত-আট শ পৃষ্ঠার বিশাল একটি গ্রন্থ কী করে মুখস্থ করে ফেলেন একজন হাফিয? তা-ও একটুও ভুলচুক না করে। আমি মনে করি, এটা অবশ্যই আল্লাহপাকের অশেষ কৃপায়ই সম্ভব হয়। এটা তাঁরই
কুদরত এবং তাঁর তরফ থেকে এক বিরাট নিয়ামত। আল্লাহপাক এই অক্ষয় অমর গ্রন্থের
সুরক্ষার দায়িত্ব নিজেই নিয়েছেন। কুরআনপাকে তিনি বলছেন : 'ইন্না নাহনু নায্যালনায্যিকরা ওয়া ইন্না লাহু লাহাফিযুন', যার বাংলা তরজমা এরূপ হতে পারে : আমিই কুরআন নাযিল
(অবতীর্ণ) করেছি এবং আমি অবশ্যই তা হেফাযত (সংরক্ষণ) করব। আর আল্লাহপাক এই 'হেফাযত' বা সুরক্ষার
দায়িত্ব পালন করাচ্ছেন কুরআনে হাফিযদের দ্বারা। এ যে কত বড় দায়িত্ব তা বলার
অপেক্ষা রাখে না।
অথচ কুরআন শরিফের এই হেফাযতকারীদের প্রতি আমরা, দুঃখজনক হলেও সত্যি, দারুণ উদাসীন। একজন হাফিয সাহেবের সামাজিক মর্যাদা, সম্মান, সমাজে তাঁর অবস্থান
যেরূপ হওয়া উচিত, সেরূপ নিশ্চয়ই নেই। হাফিয সাহেবদের প্রায়
সবাই আর্থিকভাবে অনগ্রসর। সে কারণেই আধুনিক বস্তুবাদী সমাজব্যবস্থায় আমাদের কাছ
থেকে তাঁরা যোগ্য সম্মানটুকু তো পানই না; বরং অনেক সময় তাঁরা হন অবহেলা ও অসম্মানের পাত্র। আমাদের কাছে তাঁরা
স্বল্পশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত, সামাজিকভাবে অনুল্লেখ্য এক শ্রেণির মানুষ। সমাজে তাঁদের সঠিক মূল্যায়ন হয় না
কখনোই। তাঁদের কদর বাড়ে শুধু রমযান মাসে। তখন মসজিদে মসজিদে খতম তারাবি পড়ানোর
জন্য কুরআনে হাফিযদের প্রয়োজন হয়। আর ওই সময়ে তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন
সুচারুরূপে, পরম নিষ্ঠায়। ভাবতে অবাক লাগে, একটুও ভুলভ্রান্তি না করে নিরলসভাবে তাঁরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা
অতিদ্রুত পাঠ করে যাচ্ছেন কালামে পাক। যেহেতু পহেলা রমযানে শুরু করে ২৬ রমযান
দিবাগত রাত্রির (যে রাত্রিকে মনে করা হয় শবেকদরের রাত্রি) আগেই কুরআন তেলাওয়াত খতম
করতে হয়, সে জন্য এই দ্রুতপঠন। আর তাঁদের পেছনে
দাঁড়িয়ে যেসব মুসল্লি তা শ্রবণ করছেন, তাঁরা দাবিদার হচ্ছেন আল্লাহর অশেষ রহমতের। তারপর রমযান মাস শেষ তো হাফিয
সাহেবদের প্রয়োজনও শেষ। তখন এঁদের বেশির ভাগই হয়ে পড়েন বেকার। এঁরা তখন ব্যস্ত
থাকেন বেঁচে থাকার সংগ্রামে।
এই 'নীরব' কর্মীদের সম্পর্কে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উল্লেখ করতে চাই। বাংলাদেশের
হাফিযরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের শত শত মসজিদে খতিবের
দায়িত্ব পালন করছেন। ওই সব দেশে অন্যান্য মুসলিম দেশের প্রার্থীদের সঙ্গে
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তাঁরা চাকরি লাভ করে থাকেন। তবে সবচেয়ে আনন্দ ও গৌরবের বিষয়
বোধ করি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কেরাত প্রতিযোগিতায় আমাদের হাফিয ও কারিদের বিজয়
অর্জন। সৌদি আরবসহ পৃথিবীর সব আরবি ভাষাভাষী দেশ ও অন্যান্য মুসলিম দেশের
প্রতিযোগীদের পরাজিত করে প্রায় প্রতিবছর বাংলাদেশের প্রতিযোগীরা ৪০-৫০ লাখ রিয়াল
বা দিরহামের প্রথম/দ্বিতীয়/তৃতীয় পুরস্কার লাভ করতে সমর্থ হচ্ছেন। সর্বশেষ এই
সেদিনও এমনি এক প্রতিযোগিতায় আমাদের এক প্রতিযোগী প্রথম স্থান লাভ করেছেন। এতে করে
মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান যে কতটুকু বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা দরকার মনে করি। আমাদের হাফিয
সাহেবরা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে পিছিয়ে থাকার ও আর্থিকভাবে অসচ্ছল হওয়ার প্রধান কারণ
হচ্ছে,
হাফিযি পড়ার সময় তাঁরা অন্য কোনো বিষয় শেখার
বা জানার সুযোগ না-পাওয়া। আগেই উল্লেখ করেছি, কুরআনে হাফিয হয়ে যাওয়ার পর অন্তত এক বছর তাঁদের 'ইন্টার্নি' অবস্থায় এক ধরনের
মোটামুটি চাপমুক্ত সময় কাটাতে হয় হেফয্খানা বা মাদ্রাসাতে। তখন তাঁরা হাফিযি
বিদ্যার 'রিভিশন' দেন। ওই সময়টুকুতে তাঁদের নানা ধরনের বৃত্তিমূলক কাজকর্ম শেখার ব্যবস্থা করা
যেতে পারে। যেমন : মোটর ড্রাইভিং, টেইলারিং, হাঁসমুরগি পালন, মৎস্য চাষ, মোবাইল ফোন মেরামত, আরবি ভাষায় কিছু কিছু কথোপকথন ইত্যাদি। এতে করে তাঁদের
জীবিকার্জনের একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, হাফিয সাহেবদের সাধারণ শিক্ষার ব্যাপারে অজ্ঞতা। শৈশবকাল থেকে কুরআন শরিফ
হেফয্ করা ব্যতীত অন্য কোনো বিষয় অধ্যয়ন না করার ফলে তাঁদের অনেকেই বাংলা ভাষাটাও
ভালো করে লিখতে-পড়তে পারেন না। আমি মনে করি, হাফিযি শিক্ষার কঠিন কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রাথমিক পর্যায়ের বাংলা ভাষা ও
গণিত শিক্ষাটাও থাকা দরকার। এ জন্য যদি শিক্ষাকাল কিছুটা দীর্ঘায়িত হয় তবুও তা হবে
ফলপ্রসূ। এতে একটা বড় সুফল হবে এই যে হাফিয সাহেবরা আরবি ভাষায় মূল কুরআন শরিফ
মুখস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা অনুবাদ পাঠ করে প্রতিটি আয়াতের অর্থ বুঝতে পারবেন।
এখন তাঁরা সুললিত কণ্ঠে কুরআন শরিফের আয়াত আবৃত্তি করেন ঠিকই, তবে তা করেন অর্থ না জেনেই। অনেকটা আমাদের দেশের আপামর
তেলাওয়াতকারীর মতো, যাঁরা কুরআন শরিফ পাঠ করেন অর্থ না জেনে। এ
যেন নাসারন্ধ্রে স্কচটেপ লাগিয়ে গোলাপ বাগানে বিচরণ!
পাদটীকা : আজকের লেখাটি সম্পর্কে একটি সবিনয় নিবেদন পেশ
করতে চাই। ধর্মীয় বিষয়াদি সম্পর্কে, কবুল করছি, আমি রীতিমতো বকলম। তবে সব ধর্মের যাঁরা
সত্যিকারের কাণ্ডারি তাঁদের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে, এটা জোর দিয়ে বলতে পারি। আর কুরআনে হাফিয সাহেবদের সম্পর্কে
আমার অপার বিস্ময় সেই ছোটবেলা থেকে। সেই বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধার অনুভূতি থেকে এবং
প্রতিটি রমযানে এসব নিবেদিতপ্রাণ সহজ-সরল মানুষের সনিষ্ঠ দায়িত্ব পালন লক্ষ করে
আজকের এই স্বল্প পরিসরের লেখাটি লিখতে প্রবৃত্ত হয়েছি। উদ্দেশ্য, আমাদের ব্যস্ত মানুষেরা যদি একটু ভাবেন এঁদের নিয়ে- আর কোনো
উদ্দেশ্য-বিধেয় নেই এই লেখার। আশা করি, কেউ আবার কোনো মতলব-টতলবের গন্ধ খুঁজতে লেগে যাবেন না আমার হঠাৎ এই ব্যতিক্রমী
বিচরণের মধ্যে।
লেখক : সাবেক সচিব, কবি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন