মাওলানা ক্বমরুদ্দীন
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. এর শাসনামলে নানা প্রেক্ষাপটে ও বহুবিধ প্রয়োজনে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে জরুরী পরামর্শক্রমে হিজরী সনের গোড়াপত্তন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরতেরও ১৭ বছর পরে ৬৩৮ খৃস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে গণনা শুরু হয়ে অদ্যবধি হিজরী সন চলে আসছে। হিজরী সন প্রবর্তনের পূর্বে আরব জাহানের লোকেরা বিভিন্ন স্মরণীয় ঘটনার উপর নির্ভর করে দিন তারিখ গণনা করতো। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের ৪০ দিন পূর্বে ‘আসহাবুল ফীল’ (হস্তী বাহিনী) এর ঘটনা সংঘটিত হয়। আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংস করতে আসা হস্তী বাহিনী সদলবলে নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা দিন তারিখ গণনা করতো। কারণ, এটি একটি স্মরণীয় বিস্মকর ঘটনা।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করেন তখনকার মাসটি ছিল রবিউল আউয়াল মাস। মুহাররম মাস ছিল না। অথচ আমরা জানি যে, আরবী বা চান্দ্রমাসের প্রথম মাস হচ্ছে মুহাররম। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঁকিঝুকি মারছে।
এক. রবিউল আউয়াল থেকে মাসের গণনা শুরু হল না কেন? হিজরতকে স্মরণীয় করে রাখার নিমিত্তে হিজরতের মাস রবিউল আউয়ালকে বেছে নেয়া হল না কেন? যেভাবে সাইয়িদুনা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সেদিন থেকেই সৌরবর্ষ গণনা শুরু হয়েছিল।
এর উত্তরে বলা যায়, প্রাচীন কাল থেকেই বার মাসের নাম আরবে চালু ছিল। মাসসমূহের নাম ও তার ব্যবহার ছিল। দিন তারিখ ব্যবহৃত না হলেও মুহাররম, সফর, রবিউল আওয়াল, রবিউস সানী, জুমাদাল উলা, জুমাদাল উখরা, রজব, শা’বান, রমযান, শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ- এ নামগুলো আরবদের মুখে মুখে চালু ছিল। যার প্রমাণাদি কুরআনুল কারীমে, সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আসারে সাহাবায়ে কিরামে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে। العقد الدراية নামক কিতাবে পাওয়া যায় যে, খলীফা উমর রাযি. এর শাসনামলে তাঁর নিকট একটি চুক্তিপত্র উপস্থিত করা হলো। তাতে সন তারিখবিহীন শুধু শা’বান মাসের উল্লেখ ছিল। উমর রা. বললেন, এটা কি গত শা’বান না আগামী শা’বান? এমনিভাবে আমিরুল মুমিনীনের কাছ থেকেও যে সকল রাষ্ট্রীয় ফরমান বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের নিকট প্রেরিত হত তাতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা থাকলেও সন তারিখ না থাকায় এটা কোন দিনের আদেশনামা তা অবগত হওয়া যেত না, ফলে রাষ্ট্রীয় ফরমান জারী করতে ভীষণ জটিলতা ও বিড়ম্বনা দেখা দিত। তাই আবু মূসা আল আশআ’রী রাযি. খলীফা উমর রাযি.কে তাঁর বিড়ম্বনার কথা জানিয়ে পত্র পাঠালেন। হযরত উমর রাযি. পত্রের মর্মার্থ অনুধাবন করে কালবিলম্ব না করে উপস্থিত সাহাবাদের নিয়ে মজলিশে শূরা গঠনপূর্বক উক্ত বিষয়টি উপস্থাপন করলেন এবং বললেন, মুসলিম জাতির সুবিধার জন্য একটি ইসলামী সন তারিখ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
এ থেকে বুঝা যায়, মাসের গণনা বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ছিল না শুধু সন ও তারিখ। আল্লাহ পাক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই ১২ টি মাস গণনার বিধান চালু করে দেন। এর মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত ও মহিমান্বিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতে কারীমার চারটি মাস চিহ্নিত করেছেন হাদীসের মাধ্যমে বিদায় হজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে। তিনি বলেন, মাস চারটি হল, জুলকাদাহ, জুলহাজ্জাহ, মুহাররম ও রজব। এর মধ্যে রবিউল আউয়াল মাসের নাম নেই। এর চারটি মাস শান্তির মাস। যুদ্ধ-বিগ্রহ, ফিতনা-ফাসাদ, আত্মকলহ এসবই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
উক্ত চারটি মাসের কোন একটিকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারণ করতে গিয়ে দেখা যায় মুহাররম মাসটিই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত। এ মাসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, এই মাসটি সম্মানিত চার মাসের একটি। এ মাসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস। বিশেষত মুহাররামের ১০ তারিখ একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন হিসেবে অবিস্মরণীয় ও মহিমান্বিত। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পৃথিবীতে তাশরীফ আনয়ন পর্যন্ত বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই ১০ই মুহাররম। হাদীস শরীফে আছে এ দিনে ফেরাউন তার দলবলসহ ডুবে ধ্বংস হয়। মূসা আ. ও বনী ইসরাঈল ফেরআউনের জুলুম থেকে মুক্তি লাভ করে। একারণেই ইহুদীরা আশুরার দিন রোযা রাখে। নবীজী আরো বলেন, দশই মুহাররমের রোযা পূর্বের এক বছরের গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়। এসব ফযীলতের কারণেই মুহাররম থেকেই মাস গণনা শুরু হয়।
এ ছাড়াও মক্কা শরীফে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত শুরু করার পর থেকে মুশরিকদের পক্ষ থেকে নানাভাবে নির্যাতিত হন। তাঁর অনুসারীদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, রাস্তায় কাটা বিছিয়ে নির্যাতন, উত্তপ্ত বালিতে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা ইত্যাদি নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের-কে দু’ দু’বার হাবশায় দিকে হিজরত করার নির্দেশ দেন। কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা অধিক থেকে অধিকতর হতে থাকলে সাহাবীদেরকে তিনি মদীনা শরীফের দিকে হিজরতের নির্দেশ দেন। তখন প্রায় দেড়শ সাহাবী সাড়া দিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই নির্দেশ ও সাহাবীরা মদীনার প্রতি প্রথম হিজরত ছিল এই মুহাররম মাসেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করেন তখন রবিউল আউয়াল মাস ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাসের ধারাবাহিকতা ও অধিক সুবিধার কথা চিন্তা করে মুহাররমকেই হিজরী সনের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়।
দুই. আরেকটি প্রশ্নের উদ্রেক হয় এই প্রসঙ্গে। প্রশ্নটি হল, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে এমন সহ¯্রাধিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা অবশ্যই স্মরণীয় এবং অত্যন্ত বিস্ময়করও বটে। অলৌকিক ঘটনাসমৃদ্ধ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংঘটিত ঘটনাই উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য স্মরণীয় ও বরণীয়। সেই অসংখ্য স্মিয়কর ঘটনাবলি থেকে শুধুমাত্র হিজরতকেই স্মরণীয় করার লক্ষ্যে হিজরতকে সম্পৃক্ত করে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হলো কেন? বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কি কম? কম স্মরণীয়? বদরী সন অথবা মিরাজ কেন্দ্রিক মিরাজী সন কিংবা ঐ রাতে স্বচক্ষে বেহেশত অবলোকন করাকে কেন্দ্র করে বেহেশতী/জান্নাতী সন প্রর্বতন করা যেত। এধরনের হাজারো ঘটনাকে পিছনে ফেলে শুধু হিজরতকেই চান্দ্রবছরের নামকরণের কেন্দবিন্দু বা উৎসকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কেন?
জবাব একটিই, আর তা হলো–
হিজরতের অন্তর্নিহিতে রয়েছে মহাত্যাগ ও মহাবিসর্জন। আল্লাহর দ্বীনের হেফাজতের জন্য একস্থান থেকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে গমন করা এবং আল্লাহর নাফরমানী ত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্য করাকে বলা হয় হিজরত। হিজরতের মূল চেতনা ছিল আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নিরাপদ স্থানে গমন করা। যেখানে থাকবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব। যেখানের সমাজ ও দেশ পরিচালিত হবে একদল সুশিক্ষিত পরিশীলিত আল্লাহভীরু মানুষ দ্বারা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমনের পর পুরো মদীনা নগরীর সমাজচিত্র পাল্টে যায়। প্রতিটি মুসলিমের অন্তর সিক্ত হয় হিজরতের সুপ্রভাবে। দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায় মিশে যায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বত। সবাই এক কালেমার ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ভ্রাতৃত্ব ও সস্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। বিভক্তি রইল না আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে, স্থনীয় ও বহিরাগতদের মধ্যে। পার্থক্য রইল না জাতপাতের। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন,
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَۃٌ
মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সূরা হুজুরাত : ১০
অর্থাৎ আল্লাহ পাকের নিকট প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন হল ঈমান। তিনি আরো ঘোষণ করেন,
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَکَرٍ وَّ اُنْثٰی وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوْا ؕ اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰكُمْ
হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মাঝে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি অধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। সূরা হুজুরাত : ১৩
হিজরতের প্রভাব ছিল ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। সত্যের উপর অটল-অবিচল থাকার এক প্রাণান্তকর সংগ্রামের দৃষ্টান্ত হল হিজরত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওহীদ রিসালাত ও আখেরাতের প্রতি মানুষকে দাওয়াত প্রদানের দায়িত্ব থেকে এক মুহূর্ত বিরত থাকেননি। একমাত্র দ্বীনের প্রতিষ্ঠার খাতিরে প্রয়োজনে প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগেও কোন রকম কুণ্ঠা বোধ করেননি। আর তাই আল্লাহ পাকও তাঁর বান্দার বিনা নিঃসঙ্কোচে পরম প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগের পুরুস্কার ঘোষণা করে বলেছেন,
اِنَّ الَّذِیْ فَرَضَ عَلَیْکَ الْقُرْاٰنَ لَرَآدُّکَ اِلٰی مَعَادٍ
যিনি আপনার উপর কুরআনের আদেশ-নিষেধ ফরজ করেছেন তিনি আপনাকে অবশ্যই জন্মভূমিতে (মক্কায়) ফিরিয়ে আনবেন। সূরা ক্বাছাছ : ৮৫
মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের এই ওয়াদা পূর্ণ হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল সাহাবীকে মুহাররাম মাসে হিজরতে পাঠিয়ে রবিউল আউয়াল মাসে যখন তিনি স্বয়ং মদীনা অভিমুখে হিজরতের পথে তখন মদীনার চিত্র ছিল ভিন্ন। মদীনাবাসীগণ নতুন মহান মেহমান বরণ করার জন্য প্রচণ্ড ও প্রখর সূর্যের তাপ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন প্রতিটা দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনবার্তা শোনামাত্রই পুরো মদীনা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। বয়ে যায় খুশীর বন্যা। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে আসমান ও যমীন। আপনজনকে পেয়ে তাঁরা যেন আবেগাপ্লুত, অভিভূত। সাঙ্গ হল দুঃখ কষ্ট। শুরু হল নতুন অধ্যায়ের। হিজরতের মূল অধ্যায় এখান থেকেই শুরু। মক্কাবাসী মুহাজিরদের মত মদীনাবাসী আনসারগণও হিজরতের পুরো স্বাদ গ্রহণ করল।
মুসলমানদের অন্তরে হিজরতের আরো একটি প্রভাব ছিল যে, যারা আমাদের দ্বীনের জন্য কাজ করবে, ত্যাগ করবে, কুরবানী করবে এবং হিজরত করবে অবশ্যই আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন।
আল্লাহ পাক বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنْ تَنْصُرُوا اللهَ یَنْصُرْكُمْ وَ یُثَبِّتْ اَقْدَامَكُمْ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য কর আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করবেন। সূরা মুহাম্মাদ : ০৭
হিজরী সন বিশ্ব মুসলিমের ঐতিহ্য। হিজরী সনের তারিখ মনে রাখা, দৈনন্দিন জীবনে তা ব্যবহার করার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। কেননা, হিজরত ছিল মুসলমানদের গৌরবময় অভিযাত্রার এক বিপ্লবী অধ্যায়। হিজরতের সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এই হিজরতের পর থেকেই ইসলাম ধর্ম দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে সমগ্র আরব জাহান মুসলমানদের অধীনে আসে। তখনকার ইয়াসরিবে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর ইতিহাসকে নতুনভাবে প্রভাবান্বিত করেন। ইয়াসরিবাসীরা তাঁর সম্মানার্থে তাদের নগরীর নাম রাখেন মদীনাতুন্নবী বা নবীর নগরী। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমনের সাথে সাথেই মদীনার মান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের অপরিমেয় মান, খ্যাতি ধারাবাহিক সাফল্য ও বিজয় আনার কারণে সাহাবায়ে কেরাম বুঝেছিলেন এই হিজরতের মর্ম, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য। সুতরাং তাঁর এই ঐতিহাসিক হিজরতকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. হিজরী সনের প্রবর্তন করে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের শুভ সূচনা করেন।
এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, মুসলিম জাহানের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. এর শাসনামলে নানা প্রেক্ষাপটে ও বহুবিধ প্রয়োজনে সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে জরুরী পরামর্শক্রমে হিজরী সনের গোড়াপত্তন হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হিজরতেরও ১৭ বছর পরে ৬৩৮ খৃস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে গণনা শুরু হয়ে অদ্যবধি হিজরী সন চলে আসছে। হিজরী সন প্রবর্তনের পূর্বে আরব জাহানের লোকেরা বিভিন্ন স্মরণীয় ঘটনার উপর নির্ভর করে দিন তারিখ গণনা করতো। যেমন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জন্মের ৪০ দিন পূর্বে ‘আসহাবুল ফীল’ (হস্তী বাহিনী) এর ঘটনা সংঘটিত হয়। আবরাহা কর্তৃক কাবা ঘর ধ্বংস করতে আসা হস্তী বাহিনী সদলবলে নিজেরাই ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তারা দিন তারিখ গণনা করতো। কারণ, এটি একটি স্মরণীয় বিস্মকর ঘটনা।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করেন তখনকার মাসটি ছিল রবিউল আউয়াল মাস। মুহাররম মাস ছিল না। অথচ আমরা জানি যে, আরবী বা চান্দ্রমাসের প্রথম মাস হচ্ছে মুহাররম। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন উঁকিঝুকি মারছে।
এক. রবিউল আউয়াল থেকে মাসের গণনা শুরু হল না কেন? হিজরতকে স্মরণীয় করে রাখার নিমিত্তে হিজরতের মাস রবিউল আউয়ালকে বেছে নেয়া হল না কেন? যেভাবে সাইয়িদুনা হযরত ঈসা আলাইহিস সালামের জন্ম দিনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য সেদিন থেকেই সৌরবর্ষ গণনা শুরু হয়েছিল।
এর উত্তরে বলা যায়, প্রাচীন কাল থেকেই বার মাসের নাম আরবে চালু ছিল। মাসসমূহের নাম ও তার ব্যবহার ছিল। দিন তারিখ ব্যবহৃত না হলেও মুহাররম, সফর, রবিউল আওয়াল, রবিউস সানী, জুমাদাল উলা, জুমাদাল উখরা, রজব, শা’বান, রমযান, শাওয়াল, যিলক্বদ ও যিলহজ্জ- এ নামগুলো আরবদের মুখে মুখে চালু ছিল। যার প্রমাণাদি কুরআনুল কারীমে, সুন্নাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও আসারে সাহাবায়ে কিরামে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিদ্যমান রয়েছে। العقد الدراية নামক কিতাবে পাওয়া যায় যে, খলীফা উমর রাযি. এর শাসনামলে তাঁর নিকট একটি চুক্তিপত্র উপস্থিত করা হলো। তাতে সন তারিখবিহীন শুধু শা’বান মাসের উল্লেখ ছিল। উমর রা. বললেন, এটা কি গত শা’বান না আগামী শা’বান? এমনিভাবে আমিরুল মুমিনীনের কাছ থেকেও যে সকল রাষ্ট্রীয় ফরমান বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নরদের নিকট প্রেরিত হত তাতে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা থাকলেও সন তারিখ না থাকায় এটা কোন দিনের আদেশনামা তা অবগত হওয়া যেত না, ফলে রাষ্ট্রীয় ফরমান জারী করতে ভীষণ জটিলতা ও বিড়ম্বনা দেখা দিত। তাই আবু মূসা আল আশআ’রী রাযি. খলীফা উমর রাযি.কে তাঁর বিড়ম্বনার কথা জানিয়ে পত্র পাঠালেন। হযরত উমর রাযি. পত্রের মর্মার্থ অনুধাবন করে কালবিলম্ব না করে উপস্থিত সাহাবাদের নিয়ে মজলিশে শূরা গঠনপূর্বক উক্ত বিষয়টি উপস্থাপন করলেন এবং বললেন, মুসলিম জাতির সুবিধার জন্য একটি ইসলামী সন তারিখ নির্ধারণ করা প্রয়োজন।
এ থেকে বুঝা যায়, মাসের গণনা বহুকাল আগে থেকেই প্রচলিত ছিল। ছিল না শুধু সন ও তারিখ। আল্লাহ পাক রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমন ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই ১২ টি মাস গণনার বিধান চালু করে দেন। এর মধ্যে চারটি মাস অতি সম্মানিত ও মহিমান্বিত। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আয়াতে কারীমার চারটি মাস চিহ্নিত করেছেন হাদীসের মাধ্যমে বিদায় হজ্জের সময় মিনা প্রান্তরে। তিনি বলেন, মাস চারটি হল, জুলকাদাহ, জুলহাজ্জাহ, মুহাররম ও রজব। এর মধ্যে রবিউল আউয়াল মাসের নাম নেই। এর চারটি মাস শান্তির মাস। যুদ্ধ-বিগ্রহ, ফিতনা-ফাসাদ, আত্মকলহ এসবই কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
উক্ত চারটি মাসের কোন একটিকে বছরের প্রথম মাস হিসেবে নির্ধারণ করতে গিয়ে দেখা যায় মুহাররম মাসটিই সর্বাধিক যুক্তিযুক্ত। এ মাসের মাহাত্ম্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ, এই মাসটি সম্মানিত চার মাসের একটি। এ মাসকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস। বিশেষত মুহাররামের ১০ তারিখ একটি মর্যাদাপূর্ণ দিন হিসেবে অবিস্মরণীয় ও মহিমান্বিত। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পৃথিবীতে তাশরীফ আনয়ন পর্যন্ত বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই ১০ই মুহাররম। হাদীস শরীফে আছে এ দিনে ফেরাউন তার দলবলসহ ডুবে ধ্বংস হয়। মূসা আ. ও বনী ইসরাঈল ফেরআউনের জুলুম থেকে মুক্তি লাভ করে। একারণেই ইহুদীরা আশুরার দিন রোযা রাখে। নবীজী আরো বলেন, দশই মুহাররমের রোযা পূর্বের এক বছরের গোনাহের কাফফারা হয়ে যায়। এসব ফযীলতের কারণেই মুহাররম থেকেই মাস গণনা শুরু হয়।
এ ছাড়াও মক্কা শরীফে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলামের দাওয়াত শুরু করার পর থেকে মুশরিকদের পক্ষ থেকে নানাভাবে নির্যাতিত হন। তাঁর অনুসারীদের ঠাট্টা-বিদ্রুপ, রাস্তায় কাটা বিছিয়ে নির্যাতন, উত্তপ্ত বালিতে শুইয়ে বুকে পাথর চাপা ইত্যাদি নির্যাতন ও অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের-কে দু’ দু’বার হাবশায় দিকে হিজরত করার নির্দেশ দেন। কুরাইশদের নির্যাতনের মাত্রা অধিক থেকে অধিকতর হতে থাকলে সাহাবীদেরকে তিনি মদীনা শরীফের দিকে হিজরতের নির্দেশ দেন। তখন প্রায় দেড়শ সাহাবী সাড়া দিয়ে মক্কা থেকে মদীনায় হিজরত করেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর এই নির্দেশ ও সাহাবীরা মদীনার প্রতি প্রথম হিজরত ছিল এই মুহাররম মাসেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন হিজরত করেন তখন রবিউল আউয়াল মাস ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাসের ধারাবাহিকতা ও অধিক সুবিধার কথা চিন্তা করে মুহাররমকেই হিজরী সনের প্রথম মাস হিসেবে ধরা হয়।
দুই. আরেকটি প্রশ্নের উদ্রেক হয় এই প্রসঙ্গে। প্রশ্নটি হল, মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে এমন সহ¯্রাধিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে যা অবশ্যই স্মরণীয় এবং অত্যন্ত বিস্ময়করও বটে। অলৌকিক ঘটনাসমৃদ্ধ জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে সংঘটিত ঘটনাই উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য স্মরণীয় ও বরণীয়। সেই অসংখ্য স্মিয়কর ঘটনাবলি থেকে শুধুমাত্র হিজরতকেই স্মরণীয় করার লক্ষ্যে হিজরতকে সম্পৃক্ত করে হিজরী সনের প্রবর্তন করা হলো কেন? বদর যুদ্ধের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কি কম? কম স্মরণীয়? বদরী সন অথবা মিরাজ কেন্দ্রিক মিরাজী সন কিংবা ঐ রাতে স্বচক্ষে বেহেশত অবলোকন করাকে কেন্দ্র করে বেহেশতী/জান্নাতী সন প্রর্বতন করা যেত। এধরনের হাজারো ঘটনাকে পিছনে ফেলে শুধু হিজরতকেই চান্দ্রবছরের নামকরণের কেন্দবিন্দু বা উৎসকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে কেন?
জবাব একটিই, আর তা হলো–
হিজরতের অন্তর্নিহিতে রয়েছে মহাত্যাগ ও মহাবিসর্জন। আল্লাহর দ্বীনের হেফাজতের জন্য একস্থান থেকে অন্যত্র নিরাপদ স্থানে গমন করা এবং আল্লাহর নাফরমানী ত্যাগ করে আল্লাহর আনুগত্য করাকে বলা হয় হিজরত। হিজরতের মূল চেতনা ছিল আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে বিজয়ী করার লক্ষ্যে নিরাপদ স্থানে গমন করা। যেখানে থাকবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিরঙ্কুশ নেতৃত্ব। যেখানের সমাজ ও দেশ পরিচালিত হবে একদল সুশিক্ষিত পরিশীলিত আল্লাহভীরু মানুষ দ্বারা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমনের পর পুরো মদীনা নগরীর সমাজচিত্র পাল্টে যায়। প্রতিটি মুসলিমের অন্তর সিক্ত হয় হিজরতের সুপ্রভাবে। দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায় মিশে যায় মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মহব্বত। সবাই এক কালেমার ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করে ভ্রাতৃত্ব ও সস্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলো। বিভক্তি রইল না আনসার ও মুহাজিরদের মাঝে, স্থনীয় ও বহিরাগতদের মধ্যে। পার্থক্য রইল না জাতপাতের। আল্লাহ পাক ঘোষণা করেন,
اِنَّمَا الْمُؤْمِنُوْنَ اِخْوَۃٌ
মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই। সূরা হুজুরাত : ১০
অর্থাৎ আল্লাহ পাকের নিকট প্রকৃত ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন হল ঈমান। তিনি আরো ঘোষণ করেন,
یٰۤاَیُّهَا النَّاسُ اِنَّا خَلَقْنٰكُمْ مِّنْ ذَکَرٍ وَّ اُنْثٰی وَ جَعَلْنٰكُمْ شُعُوْبًا وَّ قَبَآئِلَ لِتَعَارَفُوْا ؕ اِنَّ اَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ اَتْقٰكُمْ
হে মানব জাতি! আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যাতে তোমরা একে অপরের সাথে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মাঝে আল্লাহর কাছে সে ব্যক্তি অধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। সূরা হুজুরাত : ১৩
হিজরতের প্রভাব ছিল ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে। সত্যের উপর অটল-অবিচল থাকার এক প্রাণান্তকর সংগ্রামের দৃষ্টান্ত হল হিজরত। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাওহীদ রিসালাত ও আখেরাতের প্রতি মানুষকে দাওয়াত প্রদানের দায়িত্ব থেকে এক মুহূর্ত বিরত থাকেননি। একমাত্র দ্বীনের প্রতিষ্ঠার খাতিরে প্রয়োজনে প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগেও কোন রকম কুণ্ঠা বোধ করেননি। আর তাই আল্লাহ পাকও তাঁর বান্দার বিনা নিঃসঙ্কোচে পরম প্রিয় মাতৃভূমি ত্যাগের পুরুস্কার ঘোষণা করে বলেছেন,
اِنَّ الَّذِیْ فَرَضَ عَلَیْکَ الْقُرْاٰنَ لَرَآدُّکَ اِلٰی مَعَادٍ
যিনি আপনার উপর কুরআনের আদেশ-নিষেধ ফরজ করেছেন তিনি আপনাকে অবশ্যই জন্মভূমিতে (মক্কায়) ফিরিয়ে আনবেন। সূরা ক্বাছাছ : ৮৫
মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে আল্লাহ পাকের এই ওয়াদা পূর্ণ হয়। নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদল সাহাবীকে মুহাররাম মাসে হিজরতে পাঠিয়ে রবিউল আউয়াল মাসে যখন তিনি স্বয়ং মদীনা অভিমুখে হিজরতের পথে তখন মদীনার চিত্র ছিল ভিন্ন। মদীনাবাসীগণ নতুন মহান মেহমান বরণ করার জন্য প্রচণ্ড ও প্রখর সূর্যের তাপ অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছা পর্যন্ত অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন প্রতিটা দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনবার্তা শোনামাত্রই পুরো মদীনা আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে। বয়ে যায় খুশীর বন্যা। আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে আসমান ও যমীন। আপনজনকে পেয়ে তাঁরা যেন আবেগাপ্লুত, অভিভূত। সাঙ্গ হল দুঃখ কষ্ট। শুরু হল নতুন অধ্যায়ের। হিজরতের মূল অধ্যায় এখান থেকেই শুরু। মক্কাবাসী মুহাজিরদের মত মদীনাবাসী আনসারগণও হিজরতের পুরো স্বাদ গ্রহণ করল।
মুসলমানদের অন্তরে হিজরতের আরো একটি প্রভাব ছিল যে, যারা আমাদের দ্বীনের জন্য কাজ করবে, ত্যাগ করবে, কুরবানী করবে এবং হিজরত করবে অবশ্যই আল্লাহ তাদের সাহায্য করবেন।
আল্লাহ পাক বলেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوْۤا اِنْ تَنْصُرُوا اللهَ یَنْصُرْكُمْ وَ یُثَبِّتْ اَقْدَامَكُمْ
হে ঈমানদারগণ! তোমরা যদি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য কর আল্লাহ তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের অবস্থান সুদৃঢ় করবেন। সূরা মুহাম্মাদ : ০৭
হিজরী সন বিশ্ব মুসলিমের ঐতিহ্য। হিজরী সনের তারিখ মনে রাখা, দৈনন্দিন জীবনে তা ব্যবহার করার সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। কেননা, হিজরত ছিল মুসলমানদের গৌরবময় অভিযাত্রার এক বিপ্লবী অধ্যায়। হিজরতের সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এই হিজরতের পর থেকেই ইসলাম ধর্ম দ্রুত গতিতে প্রসার লাভ করে এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে সমগ্র আরব জাহান মুসলমানদের অধীনে আসে। তখনকার ইয়াসরিবে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েম করে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পৃথিবীর ইতিহাসকে নতুনভাবে প্রভাবান্বিত করেন। ইয়াসরিবাসীরা তাঁর সম্মানার্থে তাদের নগরীর নাম রাখেন মদীনাতুন্নবী বা নবীর নগরী। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমনের সাথে সাথেই মদীনার মান মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের অপরিমেয় মান, খ্যাতি ধারাবাহিক সাফল্য ও বিজয় আনার কারণে সাহাবায়ে কেরাম বুঝেছিলেন এই হিজরতের মর্ম, গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য। সুতরাং তাঁর এই ঐতিহাসিক হিজরতকে চিরস্মরণীয় করে রাখার জন্য ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. হিজরী সনের প্রবর্তন করে ইসলামের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের শুভ সূচনা করেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন