মঙ্গলবার, ৯ জুন, ২০১৫

বন্দে আলী মিয়া রাজপুত্তুর কবি এক সংগ্রামী চেচেন নেতা জওহর দুদায়েভ

বন্দে আলী মিয়া

তোমাদেরকে এখন এমন এক ব্যক্তিত্বের কথা বলব যিনি তাঁর সিংহভাগ সময় এবং শ্রম তোমাদের জন্যই ব্যয় করেছেন। তিনি হলেন কবি বন্দে আলী মিয়া। জানি এ নামটি তোমাদের পরিচিত ও প্রিয়। বন্দে আলী মিয়া ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারী পাবনা শহরের শহরতলীর রাধানগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম মুনসী উমেদ আলী মিয়া এবং মাতার নাম নেকজান নেছা। সাহিত্যে প্রায় সকল বিষয়ে-ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, নাটক, জীবনী, রহস্য-রোমান্স, রূপকথা, উপকথা ইত্যাদি নিয়ে তিনি লিখেছেন। এসব বিষয়ে তিনি বড়দের জন্য যেমন লিখেছেন, ছোটদের জন্য লিখেছেন তার ঢের বেশি। তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে একজন স্বার্থক শিশু সাহিত্যিক।

কবি বন্দে আলী মিয়ার শিক্ষা জীবন শুরু হওয়ার পূর্বেই তাঁর স্নেহময়ী পিতা ইন্তিকাল করেন। মা নেকজান নেছা ইয়াতীম শিশুপুত্রকে গ্রামের মজুমদার একাডেমীতে ভর্তি করে দেন এবং এখান হতেই ১৯২৩ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ছবি আঁকতে কবি খুব ভালবাসতেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাসের পর তিনি কলকাতার বৌ বাজারে অবস্থিত ইন্ডিয়ান আর্ট একাডেমীতে ভর্তি হন এবং ১৯২৭ সালে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এরপর বিখ্যাত সাহিত্যিক প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহীম খাঁর উৎসাহে তিনি টাঙ্গাইলের করটিয়া সাদত কলেজে আই.এ ভর্তি হন। কিন্তু কলকাতা ছেড়ে মফস্বলের কলেজ ভাল না লাগায় ১৯২৯ সালে কলেজ ত্যাগ করেন ও তাঁর আর পড়াশোনা সম্ভব হয়ে ওঠে নি। এরপরই বন্দে আলী মিয়া মায়ের একান্ত আগ্রহে বগুড়া শহরের বৃন্দাবন পাড়া নিবাসী রাবেয়া নামের এক সুন্দরী রমনীকে বিয়ে করে সংসারী হয়ে ওঠেন।
কবি বন্দে আলী মিয়া ১৯৩০ সালে কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরি গ্রহণ করেন এবং একটানা কুড়ি বছর এ চাকরিতে বহাল ছিলেন। এই শিক্ষকতার জীবনেই তিনি শিশুদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ভালভাবে শিশুমনকে জানার সুযোগ পান। তিনি নিজেও ব্যক্তিগত জীবনে শিশুদের মতই সহজ সরল ছিলেন। তাঁর মুখে সব সময় হাসির একটা মিষ্টি ঝিলিক ছড়িয়ে পড়তো। দেখামাত্রই ছোটদেরকে কাছে টানার তাঁর চমৎকার সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল। শিশুদের কাছে তিনি কবি দাদু হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। তিনি ঐ সময়ে ‘ছেলে ঘুমানো’ নামক শিশু অনুষ্ঠানের জন্য প্রতিদিন শিশু উপযোগী গল্প গান ইত্যাদি লিখে দিতেন।
কবি নবম শ্রেণীর ছাত্র থাকাকালে ‘বেঙ্গল গেজেট’ পত্রিকায় তাঁর ‘ছিন্নমূল’ কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯২৭ সালে কবির শিশু কিশোরদের উপযোগী প্রথম বই ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হয়। এ বইয়ের ছবিগুলি কবির নিজের হাতে আঁকা। ‘চোর জামাই’ প্রকাশিত হওয়ার পর কবি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ছবি এঁকেও কবি ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেছিলেন। দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর আঁকা মোনাজাতের ছবিটি ব্যাপক প্রচার ও প্রশংসা লাভ করে।
কবি বন্দে আলী মিয়ার তোমাদের জন্য লেখা অনেক মনগড়া কবিতা রয়েছে।
যেমন-
আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই।
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান
আলো দিয়ে, বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দিঘী,
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি। (আমাদের গ্রাম)।
কি চমৎকার কবিতা, তাই না? কবিতাটি ভিতর কোন যুক্তাক্ষর নেই। কারণ কবি শিশু মন বুঝতেন, তাঁদের কষ্টের কথা বুঝতেন। তাই তিনি যতদূর সম্ভব সহজ সরল অথচ সুন্দর ভাষায় লিখেছেন।
তিনি লিখেছেন-
আয় আয় পিস পিস,
দেখ ভাই ময়না,
চুপ চুপ, গোলমাল
কথা আর কয় না। (আফরোজার পুষি)।
ব্যাঙের বিয়ে ছড়াতে লিখেছেন-
ছোট কোলা ব্যাং
ডাকে গ্যাং গ্যাং।
তার নাকি বিয়ে
টুপি মাথায় দিয়ে।
কবি বন্দে আলী মিয়ার প্রায় পৌণে দুইশত বই এর মাঝে ১২৫ খানা বই-ই ছোটদের উপযোগী। এর মধ্যে ইতিহাস আশ্রয়ী বই, যেমন-ছোটদের বিষাদ সিন্ধু, তাজমহল, কোহিনূর, কারবালার কাহিনী ইত্যাদি। তিনি কোরআন ও হাদীসের কাহিনী নিয়েও গল্প লিখেছেন, আবার গুলিস্তাঁর গল্প, ঈশপের গল্প, দেশ-বিদেশের গল্প, শাহনামার গল্প। তিনি অনেকগুলি জীবনী লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- আমাদের নবী, হযরত আবূ বকর, হযরত ওমর ফারুক, হযরত খাদিজা, হযরত আয়েশা সিদ্দিকা, হযরত ফাতিমা, হযরত মূসা, তাপসী রাবেয়া, সিরাজউদ্দৌলা, হাজী মহসিন, ছোটদের নজরুল ইত্যাদি।
এসব লেখার মধ্য দিয়ে তিনি আগামী দিনের নাগরিক শিশু কিশোরদের চরিত্র গড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। তিনি ভাল করেই জানতেন-
‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা
 সব শিশুরই অন্তরে।’
ইসলামের সুমহান আদর্শ শিশুদের কাছে পরিষ্কার করে তুলে ধরার জন্য পবিত্র কুরআনের ১৫টি কাহিনী নিয়ে তিনি ১৫টি গল্প লিখেছেন। হৃদয়-গ্রাহী ভাষায় লেখা এ গল্পগুলি হল-আদি মানব ও আজাযিল, স্বর্গচ্যুতি, হাবিল ও কাবিল, মহাপ্লাবন, আদ জাতির ধ্বংস, ছামুদ জাতির ধ্বংস, বলদর্পী নমরুদ, হাজেরার নির্বাসন, কোরবানী, কাবা গৃহের প্রতিষ্ঠা, ইউসুফ ও জুলেখা, সাদ্দাদের বেহেশত, পাপাচারী জমজম, কৃপণ কারুন, ফেরাউন ও মূসা ইত্যাদি।
পবিত্র হাদীস হতে ১৪টি কাহিনী নিয়ে তিনি লিখেছেন ১৪টি গল্প। বইয়ের নাম দিয়েছেন-‘হাদীসের গল্প’। এ বইয়ের গল্পগুলি এ রকম-দীন জনে দয়া করো, সত্য নিষ্ঠার পুরস্কার, ক্ষুধাতুরে খাদ্য দাও, স্বল্প কথা, খোড়া শয়তানের বাহাদুরী ইত্যাদি।
তাঁর গল্প লেখার নমুনা এরকম-‘এক দেশের এক রাজা। রাজার হাতীশালে হাতী, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রাজকোষে হীরামানিক, তবু রাজার মনে সুখ নেই। রাজার কোন ছেলে পুলে নেই। একটি মেয়েও যদি হতো তবু রাজা-রাণীর মনে সুখ থাকতো।’
অন্যত্র লিখেছেন-
বাঘঃ হালুম-খক খক খেঁকশিয়াল সাহেব। আদাব।
খেঁকশিয়ালঃ মাননীয় বাঘ বাহাদুর যে, আসুন, আসুন, আদাব। আপনি বনের বাদশা, শত কাজ ফেলে সময় করে যে আমার পুত্রের বিবাহে আসতে পেরেছেন-আমার নসিব। আপনার পলাশ ডাংগায় সবাইকে যে দাওয়াত করেছিলুম, তারা এখনো এসে পৌছুলেন না।
বাঘঃ আমি না আসলে তো কউ আগে আসতে পারেন না। ঐ যে আসছেন সবাই। কি হে পন্ডিত এত দেরী যে?
শৃগালঃ ক্যাহুয়া, ক্যাহুয়া। একটু দেরী হুয়া। আসবার পথে একটা রামছাগলের বাচ্চা পেলুম। নাশতাটা না সেরে আসি কি করে? জানিতো বিয়ে বাড়িতে কখন বরাতে জুটবে বলা যায় না। (বিড়ালের প্রবেশ)।
বাঘঃ পন্ডিত রসিক লোক, নাশতা হয়েছে ভালই হয়েছে। এই যে সরকার সাহেব, আদাব।
বিড়ালঃ আদাব, খেঁকশিয়াল সাহেব। আপনার পুত্রকে এই ইদুরের মুক্তা মালা ছড়া আমার আশীর্বাদ দেবেন।
খেঁকশিয়ালঃ এসব আবার কেন? নিমন্ত্রণ পত্রে তো উল্লেখ ছিল, ‘লৌকিকতার পরিবর্তে আশীর্বাদ প্রার্থনীয়’। তা মালাছড়া যখন এনেছেন-(কুমীরের প্রবেশ)
‘খেঁক শিয়ালের দাওয়াত’ (টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার)।
কার না ভাল লাগে পশুদের এমন চমৎকার সংলাপ? কবি বন্দে আলী মিয়া শিশু কিশোর উপযোগী জীবনী গ্রন্থগুলো রচনা করেছেন অসম্ভব হৃদয়গ্রাহী ও আকর্ষণীয় করে। তিনি ‘আমাদের নবী’ গ্রন্থে মহানবী(সা) সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘আকাশে শুক্লা দ্বাদশীর চাঁদ। সেই চাঁদের আলোকে চারিদিক পুলকিত। বিবি আমিনা এক ঘরে ছটফট করেছেন। প্রহরের পর প্রহর কাটতে থাকে। নিখিল বিশ্ব স্তব্ধ নীরব। রাতের শেষ প্রহর, চাঁদ আকাশের গায়ে হেলে পড়েছে। বিবি আমিনার আঁধার ঘর আলোকিত করে একটি ফুটফুটে সুন্দর শিশু ভূমিষ্ট হলেন।
………..বাতাস ছুটে এসে খর্জুর বীথি আর আঙ্গুর গুচ্ছকে খোশ আমদেদ জানিয়ে গেল। জাফরানের খুশবু এই খবর নিয়ে ছুটলো মরু আরবের দিগ দিগন্তে।
এসেছে দীনের নবী
 মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা
তাঁহারি রওশানিতে
 জাহান হলো উজ্জ্বালা।।
এ প্রাণস্পর্শী বর্ণনা নিঃসন্দেহে বড়দেরও হৃদয় না কেড়ে পারে না।
কবি বন্দে আলী মিয়ার লেখার প্রশংসা করেছেন বাংলা সাহিত্যের বড় বড় দিকপালেরা। এর মধ্যে রয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাকবি কায়কোবাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গোলাম মোস্তফা, কবি জসীম উদ্দীন, কবি সমালোচক আবদুল কাদির প্রমুখ। আর ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর ওপর জ্ঞানগর্ভ একটি পুরো প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা ব্যাপড় সাড়া ফেলেছিল। কবির কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমী তাঁকে শিশু সাহিত্যে পুরস্কার প্রদান করে। আর ১৯৬৫ সালে তাঁকে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য দেয়া হয় প্রেসিডেন্ট পুরস্কার।
এই নিরলস শিশু সাহিত্যিক বন্দে আলী মিয়া ২৮ জুন, ১৯৭৯ সালে সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৪ বছর। আমাদের জানামতে তাঁর ২৫ টা অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে যা বাংলা একাডেমী ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মত প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে প্রকাশ করা উচিত বলে মনে করি। তাঁর রচনাবলীও প্রকাশ হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

রাজপুত্তুর কবি

এই হিং নেবে হিং, কিসমিস, খুবানি, আঙুর, পেস্তা, বাদাম, আখরোটঃ নে-বে। লম্বা পিরহানের জেবে কলসী ভাঙা চাড়া, কড়ি এসব ভরে ঝুমুর ঝুমুর শব্দ তুলে দরাজ গলায় হেঁকে চলেছে এক কিশোর। বড় বড় উজ্জ্বল দুটি চোখ। যেন সে দুটি চোখ দিয়ে ঠিকরে পড়ছে সত্যের দ্যুতি। লম্বা বাঁকানো বাঁশির মত নাক, প্রশস্ক কপাল, ঘাড় অবধি নেমে যাওয়া ঝাঁকড়া চুল-সব মিলিয়ে এক অপরূপ রাজপুত্তুর। কাবুলিওয়ালা সাজার ইচ্ছায় যে রাজপুত্তুর বেশ হাঁক-ডাক করতো।
রাজপুত্তুরটির যেমন ছিল দরাজ গলা, আগুনঝরা চোখ, বাবরীদোলানো চুল, তেমনি ছিল দুরন্ত সাহস। ভয় কখনো তাঁর দিলে বাসা বাঁধেনি। যা সত্য, যা সুন্দর তা সে আজীবনই মেনে চলেছে, সমাজেও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে।
তোমরা হয়ত ভাবছ, সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারের কোন কথা বলছি। না, আসলে তা নয়। এর রাজপুত্তুরটি রাজমহল আমাদের দেশের এক গন্ডগ্রামে। অতীতকালে তাঁর এলাকাটা শাসন করেছে রাজা প্রতাপাদিত্য, রাজা বিক্রমাদিত্য, খান জাহান আলীর মত রাজা বাদশাহরা। হ্যাঁ, দেশটির নাম যশোরাদ্য দেশ। পরে এটা যশোর জেলা নামে পরিচিত হয়। এ জেলারই মাগুরা মহকুমার আওতাধীন মাঝাইল গ্রামে সে রাজমহল। রাজপুত্তুরটির নাম ফররুখ। পুরো নাম সৈয়দ ফররুখ আহমদ।
১৯১৮ সালের ১০ই জুন ফররুখ আহমদ এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন এক জাঁদরেল পুলিশ অফিসার। মায়ের নাম বেগম রওশন আখতার। মা-বাবার দ্বিতীয় সন্তান তিনি।
গ্রামের স্কুলেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। এরপর কলকাতার তালতলি মডেল স্কুলে, বালিগঞ্জ হাইস্কুলে, খুলনা জেলা স্কুলে পড়াশুনা করেন। খুলনা জেলা স্কুল হতে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। বালিগঞ্জ হাই স্কুলে পড়াকালে কবি গোলাম মোস্তফাকে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান। আর খুলনা জেলা স্কুলে পান কবি আবুল হাশিম ও অধ্যাপক আবুল ফজলকে শিক্ষক হিসেবে। কলকাতার রিপন কলেজ হতে ১৯৩৯ সালে তিনি আইএ পাশ করেন। পরে দর্শনে অনার্স নিয়ে বিএ ভর্তি হন। আরো পরে ইংরেজিতে অনার্স নেন। ‍কিন্তু ঐ পর্য্ন্ত যে কোন কারণেই হোক তাঁর আর অনার্স পরীক্ষা দেওয়া হয় নি।
হ্যাঁ, রাজপুত্তুরটি ছিলেন সত্যি সত্যিই রাজপুত্তুরের মত। যখন হাঁটতেন মনে হত কেশর দুলিয়ে সিংহের বাচ্চা হেঁটে যাচ্ছে। হাঙর কুমিরকে থোড়াই কেয়ার করে দলবল নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। তিনি বলতেন, ‘হাঙর কুমির যদি থাকে, আমার ভয়েই তারা পালিয়ে যাবে।’ সারা জীবন এমনই তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন, কারো কাছে কোনদিন কোন কারণে মাথা নত করেন নি।
রাজপুত্তুরটি ছিলেন খুবই ভাবুক প্রকৃতির। রাতের বেলা যখন আকাশে চাঁদ হেসে উঠতো তখন বিছানা ছেড়ে চলে যেতেন ডাহুক ডাকা বাঁশঝাড়টার কাছে। চুপচাপ শুনতেন ডাহুকের ডাক আর কবিতা লিখেতেন-
রাত্রিভর ডাহুকের ডাক……
এখানে ঘুমের পাড়া, স্তব্ধ দীঘি অতল সুপ্তির
দীর্ঘ রাত্রি একা জেগে আছি।
ছলনার পাশা খেলা আজ পড়ে থাক
ঘুমাক বিশ্রান্ত শাখে দিনের মৌমাছি
কানপেতে শোনো আজ ডাহুকের ডাক।
আবার-
          তারার বন্দর ছেড়ে চাঁদ চলে রাত্রির সাগরে
          ক্রমাগত ভেসে আসে পালক মেঘের অন্তরালে
          অশ্রান্ত ডুবুরি যেন ক্রমাগত ডুব দিয়ে তোলে
          স্বপ্নের প্রবাল।
মাঝে মাঝে তিনি বাড়ির পুচকে পুচকে পাইক বরকন্দাজ নিয়ে বেড়াতে বের হতেন্, যেন রাজপুত্তুরের হরিণ শিকার। হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন মধুমতির তীরে। পলকহীনভাবে দেখতেন নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার জাহাজের আনাগোনা। শুনতেন মাঝি-মাল্লার দাঁড় ফেলার শব্দ, হাঁক-ডাক। এসব দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে যেতেন। সাথীদেরকে এসময় দিতেন ভূগোলের জ্ঞান। বলতেন, “পাহাড় হতে এসেছে এই নদী। তারপর চলে গেছে দক্ষিণে, সেখানে আছে বঙ্গোপসাগর, তারপর আরব সাগর। নৌকা চড়ে ভেসে যেতে কোনো বাধা নেই, কোনো মানা নেই। কিন্তু সাবধান, হুঁশিয়ার। আসবে ঝড়, উঠবে তুফান, বড় বড় কুমীর আর হাঙর মাতামাতি করবে। আল্লাহ আল্লাহ করে নৌকা ছাড়লে আর কোন ভয় নেই।”
কবি ফররুখ আহমদ চেয়েছিলেন এই ঘূনে ধরা সমাজটাকে ভেঙ্গে একটা সুন্দর সমাজ গড়তে।
তাঁর কথায়-
          আল্লাহর দেওয়া বিশ্ববিধান
          ইসলামী শরীয়ত
          যে বিধানে মোরা গড়িয়া তুলিব
          এই পাক হুকুমত।।
          তৌহিদে রাখিয়া দৃঢ় বিশ্বাস
          আমরা সৃজিব নয়া ইতিহাস
          দেবো আশ্বাস দুনিয়ার বুকে
          দেখাব নতুন পথ।।
          সারা ‍মুসলিম দুনিয়াকে বেঁধে
          একতার জিনজিরে
          ফিরায়ে আনাব হারানো সুদিন
          নয়া জামানার তীরে।।
          আলী, উসমান, উমরের দান
          নেব তুলে মোরা জেহাদী নিশান
          নেব ফেরা মোর আবূ বকরের
          সত্য সে খেলাফত।
কবির দৃঢ় বিশ্বাস আগের দিনে যারা জাতির নেতৃত্ব দিয়েছে, তাঁদের ত্রুটির কারণেই আজ মুসলিম জাতি এই খারাপ অবস্থায় পৌছেছে। যেমন-
              শুধু গাফলাতে, শুধু খেয়ালের ভুলে
              দরিয়া অথই ভ্রান্তি নিয়াছে তুলে
              আমাদেরই ভুলে পানির কিনারে,
              মুসাফির দল বসি,
              দেখেছে সভয়ে অস্ত গিয়াছে তাদের,
              সেতারা শশী।
              মোদের খেলাধূলায় লুটায়ে পড়ি
              কেঁদেছে তাদের দুর্ভাগ্যের বিস্বাদ শর্ববরী। (পাঞ্জেরী)।
সারা দুনিয়ায় আবার নতুন করে মুসলিম জাগরণ শুরু হয়েছে। আবার যেন নতুন সূর্য্ ওঠার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সেদিকে ইঙ্গিত করে তিনি লিখেছেন-
              কেটেছে রঙ্গিন মখমল দিন, নতুন
              সফর আজ,
              শুনছি আবার নোনা দরিয়ার ডাক,……….
              …………………………………………
              নতুন পানিতে সফর এবার এ
              মাঝি সিন্দাবাদ। (সিন্দাবাদ)।
কিন্তু আমাদের জাতির নেতারা যখন হতাশ, সাহসহারা তখনো রাজপুত্তুর তার সাহসে ভর দিয়ে বলেছেন-
              আজকে তোমায় পাল ওঠাতেই হবে,
              ছেঁড়া পালে আজ জুড়তেই হবে তালি,
              ভাঙ্গা মাস্তুল দেখে দিক করতালি,
              তবুও জাহাজ আজ ওঠাতেই হবে। (সাত সাগরের মাঝি)।
কবির রাজপুত্তুরটি তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এই দৃঢ় প্রত্যয়ী রাজপুত্তুরটি তার জীবনেও ইসলামী অনুশাসন অক্ষরে অক্ষরে পালন করে গেছেন। কোন ঝড়, কোন বিপদ তাঁকে এপথ হতে চুল পরিমাণও সরাতে পারে নি।
তিনি বিপদ মুসিবতের সময় ভেঙ্গে পড়াকে ঘৃণা করতেন। এই সময় আল্লাহ ছাড়া আর কারো কাছে সাহায্য চাওয়াটাও মোটেই পছন্দ করতেন না। কবি লিখেছেন-
          তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া
পরের ওপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া।
এমনিভাবে তিনি তাঁর লেখার মাধ্যমে দেশ জাতির মঙ্গল কামনা করেছেন। তিনি তোমাদের জন্য অনেক ভাল ভাল বই লিখেছেন। যেমন-‘পাখির বাসা’, ‘হরফের ছড়া’, ‘নতুন লেখা’, ‘ছড়ার আসর’, ‘নয়া জামাত’, ‘চিড়িয়াখানা’ ইত্যাদি। ‘পাখির বাসা’ বইটির জন্য তিনি ১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও কবি পেয়েছেন-বাংলা একাডেমী পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার ও ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার।

এক সংগ্রামী চেচেন নেতা জওহর দুদায়েভ


সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার এক মুসলিম জনপদের নাম রাশিয়া। সত্যি কথা বলতে কি ১৯৯১ সালের ১লা নভেম্বরের আগে বাংলাদেশের মানুষ জানতো না এই মুসলিম অধ্যুষিত জনপদ চেচনিয়ার কথা। এমনকি পশ্চিমা বিশ্বের সাধারণ জনগণও এই জনপদটির খবর রাখত না। ১৯৯১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর যখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া ১৫টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে তখন চেচনিয়া স্বাধীনতার ডাক দেয়। রাশিয়ার পনেরটি প্রজাতন্ত্রের বাইরে নব্বইটি স্বায়ত্ত্বশাসিত অঙ্গ প্রজাতন্ত্র এবং অঞ্চলগুলোর মধ্যে চেচনিয়া একটি।
৬০০০ বর্গমাইল আয়তনের এ ক্ষুদ্র জনপদের লোকসংখ্যা ১৯৯০ সালের ১লা জানুয়ারী পর্যন্ত ছিল ১২ লাখ ৮৯ হাজার ৭০০ জন। চেচনিয়ার রাজধানীর নাম গ্রোজনী যার লোকসংখ্যা ছিল ৪ লাখের ওপরে। গ্রোজনী শব্দের অর্থ দুর্দম্য, দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ, জাদরেল ইত্যাদি।
বর্তমানে যুদ্ধের কারণে সমগ্র চেচনিয়াতে মাত্র ৪ লাখের মত লোক অবস্থান করছে, বাকীরা পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধে প্রায় ২ লাখের মত চেচেন মারা গিয়েছে বলে জানা যায়। এর আগে ১৯৪৪ সালে স্টালিন সরকার গণহত্যার মাধ্যমে ‘মুসলিম সমস্যা’ সমাধানের লক্ষ্যে জোরপূর্বক ১২ লক্ষ (ঐ সময় চেচনিয়ায় ১২ লক্ষ মুসলমান ছিল) চেচেন মুসলিমকে কাজাখাস্তানে নির্বাসনে পাঠায়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এই ১২ লক্ষ চেচেন মুসলিমদের মধ্যে ৩ লক্ষ পথেই মারা যায়।
ইতিহাস হতে জানা যায়, চেচনিয়ার পার্শ্ববর্তী দাগাস্থানের দ্বারবন্ধ শহরে ৬৪৩ সালে ইসলামের পতাকা উত্তোলিত হয়। এর আগে ৬৩৯ সালে আরবরা আজরাবাইজান দখল করে নেয়। অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে পুরো দ্বারবন্ধ এলাকায় ইসলাম প্রসার লাভ করে। কিন্তু পার্শ্ববর্তী চেচনিয়াতে ইসলাম প্রবেশ করতে সময় লাগে। পন্ডিতদের মতে, ত্রয়োদশ চতুর্দশ শতকে চেচনিয়ায় ইসলাম প্রবেশ করে। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে এসে চেচেন মুসলমানদের ওপর রুশ বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। ১৫৯৪ সালে মুসলিম বনাম রুশ বাহিনী উত্তর দাগাস্থানের পুলাক নদীর তীরে রুশ বাহিনীর মুখোমুখি হয়। হঠে যায় রুশ বাহিনী। ১৬০৪ সালে রুশ বাহিনী মুসলিম বাহিনীর ওপর আঘাত হেনে আবার শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। সত্যিকার অর্থে মুসলমানরা রুশ খৃস্টানদের বিরুদ্ধে প্রথম যুদ্ধেই বিরাট বিজয় ছিনিয়ে আনে। প্রকৃত পক্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে রুশ বাহিনীর সেই যুদ্ধের শুরু।
জাতীয়তার দিক হতে চেচেনরা আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। অধিকাংশ জনসংখ্যা তুর্কী বংশোদ্ভুত মুসলমান। জার শাসন ও পরবর্তীকালে সত্তর বছরে কমউনিস্ট শাসনামলে চেচেন মুসলমানদের চেতনাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে তা সম্ভব হয় নি। ইতিহাস সাক্ষী চেচনিয়া কোন কালেই রাশিয়ার অংশ ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীতে চেচনিয়াকে জোরপূর্বক রুশ সাম্রাজ্যভুক্ত করা হয়। বহুকাল ধরে রুশরা বারবার চেচেনদের ওপর হামলা চালিয়েছে কিন্তু চেচেন মুসলমানরা কোনকালেই এই অন্যায় আধিপত্য মেনে নেয় নি। বরং তাদের বিরুদ্ধে ইমাম শেখ মসুর উশুরমা(১৭৩২), শেখ মোহাম্মদ, গাজী মোহাম্মদ, গামজাতবেক, শে হাজী ইসমাঈল, মোল্লা মোহাম্মদ, জামাল উদ্দীন ও ইমাম শামিলরা আপোসহীন জিহাদ পরিচালনা করেছেন। ১৮৫৯ সালের ২৫ শে অগাস্ট ইমাম শামীল রুশ বাহিনীর কাছে সম্মানজনক আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। গুনিব গ্রামের এ যুদ্ধে ইমাম শামিলের সর্বশেষ ৪০০ মুরীদের প্রায় সবাই শহীদ হন। তারপরও ১৮৫৯-৬৪ সালে পর্যন্ত চেচেনরা ককেশাসের দুর্গম পাহাড়ী অঞ্চলে আশ্রয় নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে চেচেনরা জার্মানকে সমর্থন দেয়ায় স্ট্যালিন লক্ষ লক্ষ চেচেনকে অত্যন্ত অমানবিকভাবে কাজাখস্থানে নির্বাসন দন্ড প্রদান করে। এই নির্বাসন চলাকালে ১৯৪৪ সালের ১৫ এপ্রিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ পিয়ার ভোমায়াস্কা এলাকার ইয়ালখের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আব্বা ছিলেন মূসা এবং মাতার নাম ছিল আলেপতিনা কেদোরভনা দুদায়েভ। দুদায়েভের আব্বা ছিলেন জাতিতে চেচেন এবং মা ছিলেন রুশ। মোট ৭ ভাই বোনের মাঝে দুদায়েভ ছিলেন সবার ছোট। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়ায় তাঁর আব্বা ও বড় ভাইকে শহীদ করে দেয় স্টালিনবাহিনী।
দুদায়েভ রাডিকাফ কাজে ইলেক্ট্রনিক্স্রের ওপর দু’বছর পড়াশোনার পর সামরিক বাহিনীতে যোগদান করেন। ১৯৬২ সালের রাশিয়ার তাম্বর শহরের বৈমানিক প্রশিক্ষণ কেনেদ্র তাঁর সামরিক শিক্ষা শুরু হয়। জাতিগতভাবেই রুশরা অন্তর থেকেই চেচেনদের ঘৃণা করে। এরপরও জওহর দুদায়েভ আপন প্রতিভা বলে সমস্ত প্রকার বাধা অতিক্রম করে রাশিয়ার সেরা সামরিক স্কুল ইউরি গ্যাগারিন এয়ারফোর্স একাডেমী, মস্কোতে শিক্ষা লাভের সুযোগ পান। সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার গতানুগতিক নিয়মে দুদায়েভ ১৯৬৮ সাল হতে ১৯৯১ সাল পর্য্ন্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬-৭৯ পর্যন্ত দুদায়েভ রাশিয়ার এয়ারফোর্স রেজিমেন্ট এর চীফ অব স্টাফ, ১৯৭৯-৯০ কমান্ডার অব ডিভিশন এবং ১৯৯০ সালে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। এরপর দুদায়েভ ১৯৯০-৯১ সেশনের জন্য চেচেন জাতির মহাসম্মেলনের নির্বাহী কমিটির প্রধান ছিলেন। ১৯৯১ সালে তিনি চেচনিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ১৯৯২ সালে প্রধানমন্ত্রীর পদ ও অলঙ্কৃত করেন।
জওহর দুদায়েভ আল্লা নাম্নী এক রুশ মহিলাকে বিয়ে করেন এবং তাদের ২ ছেলে ও ১ মেয়ে ছিল।
দুদায়েভ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর মাঝে জাতীয় চেতনা ও অতীত ঐতিহ্যের পরিপূর্ণ বিকাশ দেখতে পাওয়া যায়। ফলে চেচেত জাতির ভেতর তাঁদের পূর্ণ মুসলিমসত্ত্বা জাগ্রত হয়ে ওঠে। তারা সে বছরেই দুদায়েভের নেতৃত্বে চেচনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করে, যে স্বাধীনতা ছিল চেচেন জাতির আবহমানকালের লালিত স্বপ্ন। ১৯৯৪ সালের ১১ই ডিসেম্বর রুশ প্রেসিডেন্ট ইয়েলৎসিন যখন তার তিন ডিভিশন সৈন্যকে চেচনিয়া আক্রমণের নির্দেশ দেন তখন দুদায়েভ চেচেন জাতির আকাঙ্খার প্রতীক হয়ে ওঠেন। চিরসংগ্রামী চেচেন জনগণ তাঁর নেতৃত্বে সুশিক্ষিত বিশাল রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যে মরনপণ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তা যে কোন স্বাধীনতাকামী জাতির জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
১৯৯৫ সালে দুদায়েভের বড় ছেলে রুশদের অস্ত্রে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে শহীদ হন এবং ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে তাঁর জামাতা সালমান রাদুয়েভও শহীদ হন।
দুদায়েভের প্রিয় শখ ছিল কারাতে ও সঙ্গীত। তিনি পুশকিন ও লের মগুভের কবিতা পড়তে ভালবাসতেন। কারণ ছিল এ দু’জন কবি ককেশাসকে অত্যন্ত ভালবেসেছিলেন এবং ককেশাসের উপর তাদের অত্যন্ত জনপ্রিয় কবিতা আছে।
দুদায়েভ কুরআন তিলাওয়াত করতে ও শুনতে ভালবাসতেন। তিনি খুব ফুল প্রিয় লোক ছিলেন। যে কারণে ফুলের বাগান পর্যন্ত করেছেন। দৈহিকভাবে ছোটখাট এ মানুষটি ছিলেন প্রাণোচ্ছ্বল জীবন্ত এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। এখনকার কিংবদন্তী।
চেচনিয়াকে নিয়ে ছিল তার সীমাহীন স্বপ্ন। তিনি চেয়েছিলেন চেচনিয়ায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি চেচনিয়ার মানুষের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। চেচনিয়াকে তিনি ১৯৯১-১৯৯৪ পর্যন্ত তিন বছরের কিছু বেশি সময় স্বাধীন রাখতে পেরেছিলেন। সত্যি কথা বলতে কি এক দুদায়েভই ছিলেন চেচেন জাতির স্বাধীনতার প্রতীক। দুর্ধর্ষ ককেশীয় চেচেন জাতির প্রাচীন ঐতিহ্যের সার্থক উত্তরাধিকারী।
আজাদী পাগল চেচেনরা পাহাড়ী অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান ঠিক করে বিশাল রুশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ২১শে এপৃল ১৯৯৬ তারিখে চেচনিয়ার স্বাধীনতা আন্দোলনের অকুতোভয় মহানায়ক, চেচেনদের নয়নের মনি, চিরসংগ্রামী নেতা জওহর দুদায়েভ স্যাটেলাইট ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গ্রোজনী হতে ৩০ কিমি দূরে জেখেসু গ্রামের একটি মাঠে শাহাদাতবরণ করেন। এ সময় তিনি চেচেন সংকট নিরসনের জন্য মধ্যস্থতার ব্যাপারে স্যাটেলাইট টেলিফোনে আলাপ করছিলেন। জানা যায়, কাপুরুষ ইয়েলৎসিন বাহিনী কৌশলে স্যাটেলাইট টেলিফোনের অবস্থান জেনে নিয়ে রুশ বিমান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। ইতিহাস বলে চেচেন মুসলমানরা আজাদী পাগল এক যোদ্ধা জাতি। সত্যিই তারা হাসিমুখে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে পারে। আর যারা মৃত্যুকে ভয় পায় না, বিজয় তাদের অনিবার্য। হতে পারে সেটা সময় সাপেক্ষ। প্রেসিডেন্ট জওহর দুদায়েভ শহীদ হলেও চেচনিয়ার ঘরে ঘরে হাজার হাজার দুদায়েভ এখন তৈরী হবে, জন্ম নেবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন