বৃহস্পতিবার, ২৫ জুন, ২০১৫

আত্মজ্ঞান ও সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী


হারায় গরিমা, সম্মান—জাতি
আকাশ খিলান তলায়
হারায় যখন সে আত্মজ্ঞান
ধর্মে কাব্যকলায়। — ইকবাল
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী (১৮৮০-১৯৩১) তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে বাঙালি মুসলিম সমাজের আত্মজ্ঞান জাগ্রত করার সাধনায় নিমজ্জিত ছিলেন। ধর্ম ও কাব্যকলায় শুধু নয়, সমাজ-সংস্কার আন্দোলনে তাঁর বহুমাত্রিক অবদান ইতিহাস-স্বীকৃত। ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে তিনি দু’-দু’বার কারাবরণ করেছেন। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে তিনি ছিলেন স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব। তার বিরুদ্ধে কখনও এমন অভিযোগ উঠতে দেখা যায়নি যে, তিনি পরধর্মে বিদ্বেষ পোষণ করেন। যদিও ব্রিটিশদের আদালতে তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে অভিযোগে বলা হয়েছে, তাঁর ‘অনলপ্রবাহ’ গ্রন্থটি রাজদ্রোহ প্রচার করছে। গ্রন্থটি সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিচ্ছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। কিন্তু এ গ্রন্থটির বিরুদ্ধে হিন্দু সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে সাম্প্রদায়িক উস্কানির কোনো অভিযোগ ওঠেনি। বরং স্বাধীনতাকামী হিন্দু সম্প্রদায় এ গ্রন্থটির জন্য শিরাজীর প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই প্রকাশ করেছেন।
সম্প্রতি হোসেন মাহমুদের সম্পাদনায় জ্ঞান বিতরণী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর ‘প্রবন্ধসমগ্র’। প্রায় আশি থেকে একশ’ বছর আগে এসব প্রবন্ধ লেখা হয়েছে। হোসেন মাহমুদ যথেষ্ট শ্রম স্বীকার করে শিরাজীর এসব মূল্যবান প্রবন্ধ খুঁজে বের করেছেন। সম্প্রতি বইটি সম্পাদকের তরফ থেকে হাতে পেয়েছি। মূল্যবান এ বইটি হাতে পেয়েই আগ্রহের সঙ্গে পড়তে শুরু করি। সম্পাদকের কথা পড়তে গিয়ে একটি ঘটনা জেনে যারপরনাই বিস্মিত হই। ধারণা করছি, এ ঘটনাটি অধিকাংশ পাঠককে আমার মতোই বিস্মিত করবে। সম্পাদকের ভাষায় ঘটনাটি তুলে ধরছি—‘এ গ্রন্থটি প্রকাশের প্রক্রিয়ায় কিছু তিক্ত ও দুঃখজনক অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। সহৃদয় পাঠকদের বোধহয় তা জানানো যেতে পারে। ২০০৭ সালে এ পাণ্ডুলিপিটি প্রকাশের জন্য ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগে জমা দেই। চার বছর সময় ক্ষেপণের পর তারা এ গ্রন্থটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশ করা সম্ভব নয় জানিয়ে ফেরত দেন। দেখা গেল, ফাউন্ডেশনের প্রকাশনা বিভাগ বইটি ছাপা যায় কিনা সে বিষয়ে মতামত দেয়ার জন্য তাদের এক প্রাক্তন কর্মকর্তা ও লেখক মুহাম্মদ গোলাম মোস্তফা (মুস্তফা মাসুদ)-এর কাছে পাণ্ডুলিপিটি পাঠায়। তিনি পৃথক কোনো কাগজ ব্যবহার না করে ওই পাণ্ডুলিপিতেই ফাঁকা স্থানে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লাল কালিতে প্রায় সব প্রবন্ধ সম্পর্কেই তাঁর সম্পূর্ণ নেতিবাচক মতামত লিপিবদ্ধ করেন (অননুমোদিত পাণ্ডুলিপি লেখককে ফেরত দেয়া হয় এবং তিনি তা দেখবেন জেনেও)। তিনি তাঁর এসব মন্তব্যের কোনোটিতে বলেছেন যে, এ প্রবন্ধ বর্তমানে প্রাসঙ্গিক নয় (১৯২৩ সালের কোন লেখা বা ক’টি লেখা ২০১২ সালে এসে প্রাসঙ্গিক থাকে?), কোনোটিতে বলেছেন সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে উস্কে দেবে, কোনোটিতে বলেছেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর ইত্যাদি। শিরাজী আজ বেঁচে থাকলে এসব মন্তব্য দেখে নিশ্চিতই বড় লজ্জা পেতেন।’
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী লজ্জা পেতেন নাকি মুস্তফা মাসুদকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতেন, সে ব্যাপারে আমি অবশ্য নিশ্চিত নই। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে, বাংলাদেশ ও ভারতে যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে কাজ করেন তাদের অধিকাংশই (হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে) মুস্তফা মাসুদের মন্তব্যের নিন্দা না করে পারবেন না।
শিরাজীর যেসব প্রবন্ধ এ বইতে স্থান পেয়েছে, সেগুলো হচ্ছে—স্বাধীন চিন্তাশীলতা, সুলতান মাহমুদ, মাতৃভাষা ও জাতীয় উন্নতি, বোগদাদ চিত্র, প্রাথমিক মুসলমানদিগের জ্ঞানচর্চা ও মুসলমান, সিসিলি দ্বীপে মুসলমানদিগের জ্ঞানচর্চা, মুসলমান জাতি ও হিন্দু লেখক, আত্মশক্তি ও প্রতিষ্ঠা, আদর্শ সতী বিবি রহিমা, তুর্কী নারী জীবন, নব্য তুর্কী, সিরিয়া পরিভ্রমণ, ইসলাম ও ঐক্যশক্তি, শক্তির প্রতিযোগিতা, হিন্দু-মুসলমান, উচ্চশিক্ষার ফল, বাঙ্গালা সাহিত্য ও হিন্দু-মুসলমান, আত্মত্যাগ ও জাতীয় উন্নতি, সাহিত্যের প্রভাব ও প্রেরণা, শিক্ষার পরিণাম, জাতীয় জীবনে স্বাধীনতার প্রয়োজন, ভারতের বর্তমান অবস্থা ও মুসলমানদের কর্তব্য, বঙ্গীয় মুসলমান সমাজ, স্বজাতি প্রেম, বাঙ্গালী মুসলমানের আত্মপরিচয়, শিল্প সংগঠন ও জাতীয় জীবন, ইতিহাস চর্চার আবশ্যকতা, স্বরাজ ও হিন্দু-মুসলমান, বেদনা, ইসলাম ও ধনবল, আত্মবিশ্বাস, জাতীয় প্রতিষ্ঠা, মর্মবাণী, আহ্বান, নবনূর ও জেহাদ।
এসব প্রবন্ধের শিরোনাম থেকেই অনুধাবন করা যায়, অধিকাংশ রচনাই মুসলিম ও ইসলাম বিষয়ক। বঙ্গীয় মুসলমান সমাজের প্রতিনিধি কিংবা সদস্য হিসেবে এটাই তো শিরাজী-প্রতিভার স্বাভাবিক প্রতিফলন হওয়ার কথা এবং হয়েছেও তাই। ইসমাইল হোসেন শিরাজী তাঁর নিজের সমাজকে আত্মপরিচয়, আত্মজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করেছেন, তাদের অন্ধকার জীবনকে আলোতে আনার সাধনা করেছেন। বাঙালি মুসলিম সমাজের জন্য শিরাজীর জীবন এতটাই তাত্পর্যপূর্ণ যে, এ সমাজের রথী-মহারথীরা সিরাজীকে পিতৃতুল্য, অভিভাবকতুল্য সম্মান দিয়ে আসছেন। শিরাজী ছিলেন প্রতিবেশী হিন্দু-সম্প্রদায়েরও কল্যাণকামী ব্যক্তিত্ব। সংস্কৃত ভাষায় তিনি অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন। কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত শিরাজী online slots এমনকি বঙ্গভঙ্গেরও বিরোধী ছিলেন। অবশ্য বঙ্গভঙ্গ বিরোধিতার ক্ষেত্রে শিরাজীর চিন্তাধারা ও কলকাতার হিন্দু এলিট সমাজের চিন্তাধারা এক খাতে best-horoscope.com can?t bend a freedom-loving Aquarius in his will. প্রবাহিত ছিল না। সদ্য প্রকাশিত ‘প্রবন্ধসমগ্র’ গ্রন্থের ৩৫টি প্রবন্ধ পাঠ করে ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্য ক্ষতিকর’ কিংবা ‘সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে উস্কে দেবে’ এমন ধরনের কোনো রচনা কিংবা কোনো বাক্যের অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যাবে না। পক্ষান্তরে এ গ্রন্থে পাওয়া যাবে বাঙালি মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান, আত্মজ্ঞানে তাদের উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস। সেই সঙ্গে পাওয়া যাবে প্রতিবেশী হিন্দু-সমাজ সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় এবং সে পরিচয় অত্যন্ত উদার। যেখানে তিনি কোনো অভিযোগ পেশ করেছেন সেখানে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ভাষায় তথ্য-উপাত্ত সহকারেই সেসব অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানোর যে প্রকাশ্য তত্পরতা সে আমলে পরিচালিত হয়েছে, সেসবের বিরুদ্ধেও তিনি তার কলমকে প্রবলভাবে ধারণ করেছেন—এটা তো তার আত্মপরিচয় ও আত্মজ্ঞানেরই উদ্বোধন।
আমরা যদি ধরে নিই যে, মুস্তফা মাসুদ সত্য কথাই বলেছেন তাহলে একটি অনিবার্য প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। প্রশ্নটি হচ্ছে—রবীন্দ্রনাথের ‘শিবাজী-উত্সব’ কবিতাটি বাদ দিয়ে কি তাহলে রবীন্দ্র-সমগ্র প্রকাশিত হবে? তাহলে কি বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসসমগ্র থেকে সেসব উপন্যাস বাদ দেয়া হবে যেসব উপন্যাসে সুস্পষ্টভাবে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেয়ার অভিযোগ রয়েছে? অথচ শিরাজীর একটি রচনার বিরুদ্ধেও এরকম অভিযোগের কোনো অবকাশ নেই।
এখানে একথা বলার সুযোগ নেই যে, শিরাজীর সব রচনা অকাট্যভাবে নির্ভুল কিংবা বিশুদ্ধ; কিন্তু এ কথা বলা যায় যে, শিরাজী আত্মপরিচয়-সন্ধানী এবং আত্মজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ হয়ে যেসব বক্তব্য পেশ করেছেন সেসব বক্তব্যে নিহিত আছে বাঙালি সমাজের চিন্তা ও সৃজনের দলিল, আছে বাঙালি মুসলিম সমাজের সেকালের অবস্থা ও অবস্থান সম্পর্কে তাঁর মতামত ও পর্যবেক্ষণ—যা কিনা ইতিহাস ও নৃ-তত্ত্বের আওতাভুক্ত। বাঙালি মুসলমানের চিন্তার ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও শিরাজীর চিন্তাধারায় রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ সব উপাদান। এসব দিক বিচার করলেও শিরাজীর ‘প্রবন্ধসমগ্র’ গ্রন্থটি অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ। এই তাত্পর্যের কারণেও বইটি অনিবার্যভাবে প্রকাশযোগ্য। কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও মুস্তফা মাসুদ যে ভূমিকা রেখেছেন পাণ্ডুলিপির ব্যাপারে, সে ভূমিকা নিয়ে সহসাই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির বিষয়ে যে বক্তব্য এসেছে, আমাদের সন্দেহ এ বক্তব্য উদ্ভট ধর্মহীন সেকুলারিজমের অবস্থান থেকেই কেবল আসতে পারে। অতএব আমাদের বিস্মিত হওয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে।
এ আলোচনার শুরুতেই আমরা বিশ্বকবি ইকবালের একটি কাব্যাংশ উদ্ধৃত করেছি। ওই বক্তব্যে ইকবাল বলছেন, কোনো জাতি যদি ধর্ম ও কাব্যকলায় তাদের আত্মজ্ঞান হারিয়ে ফেলে, তাহলে আকাশের নিচে জমিনের উপরে সে জাতি সম্মানজনক অবস্থান ধরে রাখতে পারে না এবং ধর্ম ও কাব্যকলায় আত্মজ্ঞান অর্জন করতে না পারলে কোনো জাতি সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিতও হতে পারে না। আমরা শিরাজীকে পর্যালোচনা করে দেখতে পাই ধর্ম ও কাব্যকলায় বাঙালি মুসলমানের আত্মজ্ঞান জাগ্রত করার সাধনায় নিমজ্জিত এক সাধককে। অথচ তার জাতিরই একজন ইন্তেকালের ৮০ বছর পর তার রচনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপন করেছেন, সে অভিযোগ কেবল এ কারণেই উত্থাপিত হতে পারে যে, শিরাজী ছিলেন আত্মজ্ঞানের অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন