মক্কা মুকাররমা ও মদীনা মুনাওয়ারার সম্মানিত খতীবগণের জুমার দুটি খুতবার সারসংক্ষেপ এখানে তুলে ধরা হল। এতে হজ্ব শেষে হাজ্বী সাহেবদের করণীয় এবং নতুন হিজরী বছরের আগমন সম্পর্কে শরীয়তের বিভিন্ন দিকনির্দেশনা রয়েছে।
মাসিক আলকাউসার-এর জন্য খুতবাগুলোর সারসংক্ষেপ অনুবাদ করে পাঠিয়েছেন মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মাওলানা শাহাদাত হুসাইন
হজ্ব শেষে হাজ্বীদের উদ্দ্যেশে
ড.সাউদ আশশুরাইম
(১৩/১২/১৪৩৪ হি.)
ড.সাউদ আশশুরাইমের আলোচনার বিষয় ছিল, হজ্ব সমাপ্তিকালে হাজ্বী সাহেবদের জন্য কিছু অসিয়ত। এতে তিনি হজ্ব মৌসুমের সমাপ্তি ও হাজ্বীগণ নিজ পরিবার ও দেশে ফেরার পর তাদের করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করেন। যেমন-ইবাদতের পরিমাণ বাড়ানো, সবসময় তাওবায়ে নাসুহা বা খাঁটি মনে তাওবা করা, অধিকহারে কল্যাণের চেষ্টা করা ও মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকা। আল্লাহ্ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন, (তরজমা) ‘‘যখন তোমরা হজ্বের সকল কাজ পূর্ণ কর তখন তোমরা আল্লাহকে স্মরণ কর, যেভাবে তোমরা নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের স্মরণ করে থাক। বরং আল্লাহর স্মরণ তারচে অধিক হওয়া উচিৎ। সুতরাং কেউ কেউ এরূপ আছে যারা বলে হে আমাদের প্রভু! আমাদেরকে (যা কিছু দেবার) দুনিয়াতেই দিয়ে দিন, আর এরূপ লোক আখেরাতে কোন অংশ পাবে না। আর কিছু লোক এমন আছে যারা বলে হে আমাদের রব! আমদেরকে দুনিয়াতেও কল্যাণ দান করুন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দান করুন এবং আমাদেরকে দোযখের আযাব থেকে রক্ষা করুন! এমন লোকেরা তাদের এই আমলের দ্বারা বড় অংশ পাবে এবং আল্লাহ্ তাআলা সত্বরই তাদের হিসাব নিবেন।’’-সূরা বাকারা : ২০০-২০২
হাজ্বী সাহেবদের উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা এমন একটি ইবাদত সম্পাদন করেছেন যেটি ইসলামের পাঁচ রোকনের অন্যতম। যেটি আদায়ের পদ্ধতি ও ছুরত ব্যতিক্রম। এতে অর্থ ও শারীরিক পরিশ্রম এমনভাবে সমন্বয় হয় যা অন্য ইবাদতে হয় না। আপনারা এ সময়ে এক রূহানী আবহ ও ঈমানী পরিবেশে কাটিয়েছেন যা আপনাদের গোনাহ থেকে দূরে রেখে আল্লাহ্ তাআলার নিকটবর্তী করেছে। প্রকৃত ভ্রাতৃত্ববোধ, ন্যায় ও সাম্যের রূপ এখানে বিরাজমান ছিল। যেখানে পোষাক-পরিচ্ছদ, উকূফ, রমী, তাওয়াফ, মাবীত বা সায়ী কোথাও ধনী দরিদ্রের বৈষম্য ছিল না। সকলেই ইবাদতের ক্ষেত্রে ছিল বরাবর। তিনিই আল্লাহর বেশি নিকটবর্তী যিনি বেশি তাকওয়াবান। সুতরাং তাদের মাঝে যার বাহন অগ্রবর্তী হয়েছে সে-ই অগ্রবর্তী এমন নয় বরং প্রকৃত অগ্রবর্তী হল, যে তার ঈমান, আমল ও কল্যাণ দিয়ে এগিয়ে গেছে। (তরজমা) ‘‘আল্লাহ্ তাআলা পরহেজগারদের আমলই কবুল করে থাকেন’’-সূরা মায়িদা, আয়াত:২৭
এরপর আপনাদের কী করণীয়? হজ্বের পর বাকি জীবন খাঁটি মনে তাওবা, ভাল আমল ও আল্লাহর আনুগত্যে অবিচল থাকাই কি মূল লক্ষ্য হবে নাকি অনৈক্য, একে অন্যের বিরোধিতা ও আল্লাহর হক আদায়ে শিথিলতা করবেন? উদারতা, সহজতা, একতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের যে নমুনা এখানে প্রত্যক্ষ করেছেন প্রত্যেক হাজ্বী তা জীবনে গ্রহণ করবেন। এটা কি হতে পারে না যে প্রত্যেক হাজ্বী এই নমুনা তার পরিবার-পরিজন ও সমাজে বাস্তবে রূপ দিবেন?! অবশ্যই প্রত্যেক হাজ্বীর কর্তব্য হচ্ছে এই গুণগুলো ধারণ করা, যখন তিনি স্বদেশে ফিরে যাবেন তার মনে থাকবে ঐক্য-চিন্তা, উম্মাহর আজ যেটা খুব প্রয়োজন! ইসলামী সমাজসমূহের ঐক্য কোনো রং, ভাষা বা অর্থের উপর ভিত্তি করে হয় না বরং সেটা তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন উৎস হয় এক অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলার কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নত। ‘‘নিশ্চয়ই এ কুরআন এমন পথের সন্ধান দেয় যা সবচে সোজা, আর সে সমস্ত ঈমানদারদেরকে-যারা নেক কাজ করে-এ সুসংবাদ দেয় যে, তারা বড় পুরস্কার পাবে।’’-সূরা ইসরা : ৯
নতুন বছরের আগমন ও পুরনো বছরের বিদায়
ড.আব্দুর রহমান আসসুদাইস
(২৭/১২/১৪৩৪)
ড.আব্দুর রহমান আসসুদাইস-এর খুতবার বিষয় ছিল-একটি বছরের বিদায় ও আরেকটি নতুন বছরের আগমন। এতে তিনি মানব জীবনে অতীতের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, বান্দার নিজের ও বিগত সময়ের ভাল-মন্দের উপর হিসাব নেওয়া আবশ্যক। এছাড়া তিনি সৎ কাজের দিকে ছুটে যাওয়া, অসৎ ও খারাপ কাজ পরিহার করতে উদ্বুদ্ধ করেন। ‘‘আল্লাহ্ রাত ও দিনকে পরিবর্তন করেন, এতে জ্ঞানবানদের জন্য (তাওহীদের) প্রমাণ রয়েছে।’’ -সূরা নূর : ৪৪
দিন ও মাসের পরিক্রমায় একটি বছরের ইতি হল। সে সাথে আমলের খাতাও জমা হয়ে গেল। সুতরাং যিনি ভাল কাজ করেছেন তার জন্য সুখবর আর যিনি জুলুম ও অন্যায় করেছেন তার জন্য আফসোস! ‘‘অতএব পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে প্রতারিত না করে। আর ঐ প্রতারক (শয়তানও) যেন তোমাদেরকে (আল্লাহ্ হতে) প্রতারিত করতে না পারে!’’ -সূরা লোকমান : ৩৩
হযরত ইবনে উমর রাযি. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার উভয় কাঁধ ধরলেন তারপর বললেন, তুমি দুনিয়াতে এমনভাবে থাক যেন তুমি মুসাফির বা পথিক! সহীহ বুখারী, হাদীস:৬৪১৬; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৩৩৩
তিনি বলেন, কৃত্রিমতা ও ধোঁকার এই জগতে ডুবে যাওয়া থেকে খুব সতর্ক থাকতে হবে, আপনি তো এখানে শুধুই পথ অতিক্রম করছেন, অবশ্যই এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে! সুতরাং হে গাফেল ও দিবা-স্বপ্নে বিভোর! এক বছরের পর আরেক বছর -এভাবে জীবন কিন্তু অবিরাম বয়ে যাচ্ছে। আপনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছেন! কত মাস ও বছর অবহেলায় নষ্ট করেছেন, কত সময় আপনি খেল-তামাশায় কাটিয়েছেন! কত আন্যায়ে আপনি লিপ্ত হয়েছেন, আর কত ওয়াজিব ছেড়ে দিয়েছেন! হে মুসলিম ভাই! আর কোন্ সময়ের জন্য আপনি তাওবাকে বিলম্ব করছেন ? আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে আর কোন্ ক্ষণের জন্য আপনার অপেক্ষা?! ‘‘আর আল্লাহ্ কাউকে কখনো অবকাশ দেন না যখন তার নির্দিষ্ট সময় এসে পড়ে; এবং আল্লাহ্ তোমাদের সমস্ত কার্যাবলী সম্বন্ধে পূর্ণ অবহিত আছেন।’’-সূরা মুনাফিকুন : ১১
‘‘যেদিন প্রত্যেকেই নিজ নেক কাজসমূহ সামনে উপস্থিত পাবে এবং নিজ মন্দ কাজসমূহ(-ও), (সেদিন) এ কামনা করবে যে, কি চমৎকার হত! যদি এই ব্যক্তি ও সেই দিনের মাঝে সুদূর ব্যবধান থাকত; আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে নিজ সত্তার ভয় দেখাচ্ছেন এবং আল্লাহ্ বান্দাদের প্রতি খুব দয়াশীল।’’-সূরা আল ইমরান, আয়াত:৩০
একটি বছর শেষ হয়ে আরেকটি নতুন বছরের আগমন ঘটছে। এখন একনিষ্ঠ মনে তাওবা করার সময়; গভীরভাবে নিজের সাথে হিসাব করার সময়। একই সাথে বিদায়ী বছরটি কীভাবে এবং কী করে অতিবাহিত হল সেটাও বিশ্লেষণ করা উচিৎ, যাতে আগত সময়ে অতীতের ভুল শুধরে নেয়া যায়! আল্লাহর কসম! নিশ্চয়ই সে বুদ্ধিমান যে তার প্রতিটি মুহূর্ত ও নড়াচড়ার হিসাব-নিকাশ করে তারপর ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি. থেকে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘‘কিয়ামতের দিন কোন বান্দা তার পা হটাতে পারবে না যতক্ষণ না তাকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হয়, তার জীবন কীভাবে কাটিয়েছে? তার যৌবন কোথায় ব্যয় করেছে? কোন পথে সম্পদ অর্জন করেছে? কীভাবে তা খরচ করেছে? এবং ইলম অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে?-জামে তিরমীযী, হাদীস:২৪১৬
হিজরি বর্ষের মাঝে সুপ্ত ইসলামের ইতিহাসে শাশ্বত ও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাটি হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মোবারক হিজরতের ঘটনা। নিশ্চয়ই সেটি ছিল এক মহান ঘটনা এবং আশা ও কল্যাণের দ্বার উন্মোচনে অবিস্মরণীয় দিক। সে ঘটনায় ছিল আল্লাহ্ তাআলার রহমত ও নুসরতের আশা সেটা যতই বিলম্বিত হোক না কেন!
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন