বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৫

৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধে কওমী ওলামাদের অবদান

৭১ স্বাধীনতা যুদ্ধে কওমী ওলামাদের অবদান
ছপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের এই দেশ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হয় এবং বাংলার হৃদপিন্ডে টকটক লাল স্বাধীনতার সুর্য উদ্ভাসিত হয়। সবুজ-শ্যামল স্বাধীন দেশ হিসাবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেয়েছে হিজল তমাল,তরুলতা আর সবুজ শ্যামলতায় ঘেরা রুপসী রাংলাদেশ। বিশ্বেও দরবারে আমাদের আত্ম পরিচয় ঘটেছে স্বাধীন জাতি হিসাবে। স্বাধীনতা প্রতিটি জাতির গৌরব ও অহংকারে বিষয়।
৭১’ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মাজলুমের। পাকিস্তানীরা ছিল জালিম আর এদেশের নিরীহ মানূষ ছিল মাজলুম। সুস্থ-বিবেক সম্পন্ন কোন মানুষ কখনো জালেমের পক্ষাবলম্বন করতে পারেনা। মাজলুমকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে কথা বলা এটাই মনুষত্বের পরিচয় এবং ঈমানী দায়িত্ব। আর সে জন্যই এদেশের আলেম সমাজ এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানী জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। পাকিস্তানীহানাদার বাহিনীর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রাজপথে যুদ্ধে করেছেন। কাজ করেছেন দেশ-প্রেমিক হয়ে। অসংখ্য উলামায়ে কেরামগণ তাদের জান-মাল ,সব শক্তি-সামর্থ্য দিয়ে এ দেশের মাজলুম জনগণের স্বাার্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে উলামায়ে কেরামদের অবদান অনস্বীকার্য। নিম্নে উলামায়ে কেরামগণের নাম ও তাদের অবদানের কথা খুবই সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হল।
৭১’ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে উলামায়ে কেরামরা-ই ছিলেন মুক্তিকামী মানুষের সিপাহসালার। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুযুর্গ আল্লামা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.) সে সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন,“এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়,এটা হল জালেম আর মাজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানীরা জালেম আর এ দেশের বাঙ্গালীরা মাজলুম। তাই সামর্থ্যরে আলোকে সকলকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করতে হবে এবং এটাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতে হবে”।
এ দেশের শ্রেষ্ট বুজুর্গ ফেদায়ে মিল্লাত আল্লামা হযরত হোসাইন আহমদ মাদানী (রাহ.)এর বিশিষ্ট খলিফা,আধ্যাত্মিক রাহবার আল্লামা লুৎফুর রহমান বর্র্র্ণভী ছিলেন একজন দূরদশী সিপাহসালার। তিনি তখন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন এবং বিপদগ্রস্থ বাঙ্গালী মানুষদেরকে সাহায্য-সহযোগীতা করেছিলেন। তৎকালিন সময়ে একবার তিনি আ্ল্লামা আশরাফ আলী ধরমপুরী (রাহ.) কে বলেছিলেন,“ আমি সুর্যের মত ¯পষ্ট দেখতে পাচ্ছি যে,্কয়েক দিনের ভিতরেই এ দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে এবং পাকিস্তানী হানাদারের জুলুমের কবল থেকে এ দেশের জনগন মুক্তি লাভ করবে”।
আড়াইহাজার থানার কমান্ডার মরহুম শামসুল হকের অধিনে আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রাহ.) মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিলেন। তিনি বলেন ১৯৭১ সালে যখন আমি লালবাগ মাদরাসার ছাত্র তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ শুরু হলে আমার মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি হাফেজ্জি হুজুর ( রাহ.) কে প্রশ্ন করলাম; হুজুর এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা বা কর্তব্য কি? তখন হুজুর আমাকে বললেন পাকিস্তানী জালিম হানাদার বাহিনীর জুলুম থেকে এ দেশের মানুষকে রক্ষা করা অবশ্যই তোমার আমার সকলের কর্তব্য। তাই বসে থাকার আর সময় নেই ,জালিমদের কবল থেকে মাজলুমদেরকে বাচাঁনোর জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন কর। এ দেশের নিরীহ জনগনকে সহযেগিীতা করা আমাদের ইমানী দায়িত্ব।
আর সেই সময় হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.) বলেছিলেন,“হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ঈমান” অর্থাৎ ‘দেশ প্রেম ঈমানেরে অঙ্গ’। তাঁর এ কথার উত্তর শুনে আমি বেশ অনুপ্রাণীত হলাম এবং আর বসে থাকতে পারলাম না। আমিও মুক্তিযুদ্ধে শরীক হয়ে গেলাম।
হযরত মাওলানা মুফতি মাহমুদ (রাহ) ও বাঙ্গালী মুসলমানদের পক্ষে ছিল। তার বক্তব্য ছিল বাঙ্গালীদের পক্ষে। মাওলানা আব্দুস সালাম তিনি বলেন ৭১’সালে আমি করাচি ইউসুফ বিন নুরী মাদরাসার ছাত্র একদিন মুফতি মাহমুদ সাহেব মাদরাসায় এলে তাকে এক নেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেছিল শেখ মুজিব গাদ্দার কে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। তাকে এখনই হত্যা করা হবে তখন মুফতি সাহেব হুজর রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন শেখ মুজিব গাদ্দার নন; তিনি একজন দেশ প্রেমিক মুসলমান।
মুফতি মাহমুদ (রা.) ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে পরিস্কার ভাষায় পাকিস্তানের ইয়াহইয়াা খানের ভুট্রোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর আহব্বান জানান।
ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে গিয়ে জানা যায় যে,স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগঠক হিসেবে এবং এদেশের মানুষকে মুক্তি যুদ্ধে উৎসাহ ও সহযোগীতায় আলেম সমাজের ভুমিকাই সবচয়ে বেশী। কারন সক্রীয়ভাবে মুক্তি যুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন অসংখ্য কওমী উলাময়ে কেরাম ও পীর-মাশায়েখগণ। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর ( রাহ.)আল্লামা লুৎফুর রহমান বরুণী (রা.),আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্ল্যাহ ( রাহ.) আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রাহ.),আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী ( রাহ.) ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, প্রমুখ।
স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের অবিসাংবাদিত মুসলিম নেতা বিশ্বের প্রখ্য্যাত আলেম আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আসয়াদ আল মাদানী ( রা.) এর ভূমিকা অবিস্মরনীয়। যখন পাকিস্তানী বাহিনী এ দেশের নিরীহ মানুষের উপর বর্বোরোচিত হামলা চালালো তাৎক্ষনিক তিনি পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেন এবং নিরীহ বাঙ্গালীদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে উলামায়ে কেরামদের ভুমিকা তথা অবদান দেখে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিল হযরত হাফেজ্জি হুজুর (রাহ )এর হাতে বাইয়াত তথা মুরিদ হয়ে গেলেন। তিনি বায়ইয়াত হওয়ার পর তাকে তাঁর ভক্তও শীষ্যরা প্রশ্ন করল আপনি একজন মুক্তিযুদ্ধা হয়ে কিভাবে হাফেজ্জী হুজুরের মতো রাজাকার এক ব্যক্তির কাছে মুরিদ হলেন, জবাবে তিনি বলেছিলেন হযরত হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.) কোন রাজাকার নন,তিনি শ্রেষ্ট আলেম এবং সত্যিকার একজন দেশপ্রেমিক।
কিন্ত আফসোস ! আজ হাফেজ্জি হুজর এর অনুসারী তথা কওমী পড়–য়া আলেমদেরকেই বর্তমানে রাজাকার উপাধী দেয়া অসম্মানী করা হচ্ছে। ঐতিহাসিক বাস্তব সত্য যে, ১৯৭১ সালের এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে উলামায়ে কেরামগণের অবদানই সবচেয়ে বেশী ছিল। মূলত যারা রাজাকার,আলবদর, আল শামস, তারাই কেবল নিজেদের কে ঢাকার জন্য আলেম সমাজের উপর এ উপাধী গুলো চাপিয়ে দিচ্ছে। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার এবং সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন