বুধবার, ১৫ জুলাই, ২০১৫

জাকাত-ফিতরা আদায় প্রসঙ্গে কিছু কথা

ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
রমজান মাস কুরআন নাজিলের মাস। হজ ছাড়া প্রায় সব ইবাদতই করা হয় এ মহান মোবারকময় মাসে। এ মাসে জাকাত ও সাদকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা হয়ে থাকে। জাকাত বছরের যেকোনো সময় ফরজ হতে পারে। কেননা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যক্তি মালিকানায় এক বছর থাকলে তার ওপর জাকাত ফরজ হয়। এ বছরপূর্তি বছরের যেকোনো দিন হতে পারে। রমজানে বেশি পুণ্যের আশায় দানের হিড়িক পড়ে। দান-সাদকাকে উত্তম সাদকা বলা হয়েছে, তাই সাধারণত রমজানেই জাকাত আদায় করা হয়। অনেকের ধারণা রমজানেই জাকাত আদায় করতে হয়, অন্য সময় জাকাত আদায় করা যায় না। এ ধারণাটি একেবারে ভুল। রমজান ছাড়াও জাকাত আদায় করা যায়। আমাদের এ কথা মনে রাখতে হবে যে, নামাজ-রোজা যেমন ফরজ, তেমনি জাকাতও একটি ফরজ ইবাদত। এটাকে ছাড় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে যাদের ওপর জাকাত ফরজ, তারা অনেকেই ঠিকমতো জাকাত আদায় করেন না। আবার যারা জাকাত আদায় করেন, তাদের মধ্যে এমনও অনেকে আছেন, যাদের মানসিকতায় শ্রেণিবৈষম্যের মনোভাব বিদ্যমান। মনে রাখতে হবে, জাকাত কোনো করুণা বা দয়া নয়। এটা অবশ্য কর্তব্য দায়িত্ব। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ধনীদের সম্পদে যাচ্ঞাকারী ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। সুতরাং জাকাত হচ্ছে দরিদ্র শ্রেণীর অধিকার। আমরা প্রায় প্রতি বছরই মর্মান্তিক ও অমানবিক দৃশ্য দেখি যে, জাকাত দেয়ার নাম করে মাইকিং করে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে ডেকে নিয়ে এসে লাশের সারি তৈরি করা হয়। এবারো ময়মনসিংহে জাকাত নিতে গিয়ে পদদলিত হয়ে ২৭ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এটা একদম অনুচিত। এটা ইসলামের আদর্শ নয়। ইসলাম এভাবে জাকাত প্রদান করতে বলেনি। বরং উচিত হচ্ছে দরিদ্র জনগোষ্ঠী, যারা জাকাতের হকদার প্রাপক, তাদের দ্বারে গিয়ে জাকাত পৌঁছে দেয়া। সমাজে বহু দরিদ্র লোক রয়েছেন, যারা আত্মসম্মানে লাজ-লজ্জায় নিজেদের অভাবের কথা কাউকে বলেন না। কারো কাছে হাত পাতেন না। কারো দুয়ারে যান না। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামিন এ ধরনের দরিদ্র শ্রেণীর লোককে খুঁজে খুঁজে তাদেরকে জাকাত পৌঁছে দিতে বলেছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের সূরা বাকারার ২৭৩ নং আয়াতে বলেন, (দান খয়রাত করো) ওই সব গরিব লোকদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে, জীবিকার সন্ধানে অন্যত্র ঘোরাফেরা করতে সক্ষম নয়। অজ্ঞ লোকেরা যাচ্ঞা না করার কারণে তাদেরকে অভাবমুক্ত মনে করে। তোমরা তাদেরকে তাদের লক্ষণ দ্বারা চিনবে। তারা মানুষের কাছে কাকুতি-মিনতি করে ভিক্ষা চায় না।
আগেই বলা হয়েছে যে, জাকাত একটি ফরজ ইবাদত। সুতরাং দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে তুচ্ছ ভেবে অবহেলা করে যেনতেনভাবে জাকাত আদায় মোটেই কাম্য নয়। জাকাত আদায়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতা অর্জন। বস্তুভিত্তিক ও আধ্যাত্মিক সব ধরনের পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতাই এখানে উদ্দেশ্য। জাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে দরিদ্রগোষ্ঠীর প্রতি তুচ্ছ মনোভাব প্রকাশ করা, তাদের প্রতি শ্রেণিগত বৈষম্য আচরণ প্রকাশ করা আধ্যাত্মিক পবিত্রতা ও পরিশুদ্ধতার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। বাজারের ‘জাকাতের লুঙ্গি-শাড়ি-পাঞ্জাবি’ দিয়ে জাকাত আদায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রতি অবহেলা ও তুচ্ছ মনোভাব প্রকাশের নামান্তর। বাজারে ‘জাকাতের লুঙ্গি-শাড়ি-পাঞ্জাবি’ নামে যা বিক্রয় করা হয়, তা কি পরিধানযোগ্য বস্ত্র? যদি পরিধানযোগ্য বস্ত্র হয়, তাহলে আমরা নিজেদের জন্য, নিজেদের পরিবারের জন্য কখনো এ ধরনের বস্ত্র ক্রয় করি কি? বাজারের সিলমারা ‘জাকাতের লুঙ্গি-শাড়ি-পাঞ্জাবি’, যে কাপড় নিজেরা পরি না, সে কাপড় দিয়ে আর জাকাত নয়। দশজনকে নিম্নমানের কাপড় না দিয়ে পাঁচজনকে ভালো মানের কাপড় দেয়া অনেক উত্তম।
এবার আসি সাদকাতুল ফিতর বা ফিতরা বিষয়ের দিকে। এটা আদায় করতে হয় ঈদুল ফিতরের দিন। যেহেতু রমজানে সওয়াব বেশি তাই এটা রমজানেই আদায় করা হয়। মদিনায় সাদকাতুল ফিতর দেয়া হয়েছে যব, খেজুর, কিশমিশ, গম ও পনিরের মাধ্যমে। আলোচ্য খাদ্যদ্রব্যগুলোর মধ্যে গম ছাড়া অন্যগুলো দ্বারা আদায় করলে পূর্ণ এক ‘সা’ আদায় করতে হয়। শুধু গমের ক্ষেত্রে অর্ধ ‘সা’। আমাদের দেশে সাধারণভাবে ফিতরার যে পরিমাণ ঘোষণা করা হয়, তা অর্ধ ‘সা’ গম বা আটার মূল্যমান। সে হিসেবে এ বছর সারা দেশে ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা জনপ্রতি ফিতরা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর যদি উন্নতমানের (আজওয়া) খেজুরের মূল্যে ফিতরা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে ফিতরার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৪,৩২৩ টাকা। (১৩০০ টাকা কেজি হিসেবে ৩.৩২৫ কেজির মূল্য। বাজারদর কমবেশি হিসেবে পরিমাণ কমবেশি হতে পারে) ঘোষিত পরিমাণে ফিতরা আদায় করলে ফিতরা আদায় হবে। তবে সমাজের প্রত্যেকেই যদি স্বীয় সামর্থ্য অনুযায়ী (কেউ খেজুর, কেউ পনির, কেউ কিশমিশ মূল্যমানের) ফিতরা আদায় করেন, তাহলে অধিক পরিমাণে আদায় করার কারণে দরিদ্র শ্রেণী বেশি লাভবান হবেন। আজ পর্যন্ত কেউ এ কথা বলেননি, গম ছাড়া অন্যান্য বস্তুকে মাপকাঠি বানিয়ে সাদকাতুল ফিতর নির্ধারণ মানসুখ বা রহিত হয়ে গেছে। যেহেতু তা রহিত হয়নি, তাই যারা সামর্থ্যবান তাদের উচিত উচ্চপরিমাণে সাদকাতুল ফিতর আদায় করা। এটা ইনসাফের কথা। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, এই ঈদে যিনি ঈদের বাজার করছেন লক্ষাধিক টাকার তিনিও দেবেন ৬০ টাকা হারে সাদকাতুল ফিতর, আর যিনি মাত্র কয়েক হাজার টাকার বাজার করছেন তিনিও দেবেন ৬০ টাকা হারে সাদকাতুল ফিতর- এটা ইনসাফ হলো না। এটা কোনোক্রমেই বিবেকগ্রাহ্য হতে পারে না। বিষয়টি নিয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ভাবতে হবে। সাহাবায়ে কেরাম রা: গম দ্বারা এ জন্যই সাদকাতুল ফিতর আদায় করতেন যে, তখন এর মূল্য সবচেয়ে বেশি ছিল। পাঁচ প্রকারের খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে বর্তমানে গমের মূল্য সবচেয়ে কম। তাহলে এ যুগে সবার জন্য বিশেষ করে বিত্তবানদের জন্যও শুধুই গম বা তার মূল্য দ্বারা সাদকাতুল ফিতর আদায় করা কী করে সমীচীন হতে পারে? বিষয়টা নিয়ে আমাদের অবশ্যই ভাবতে হবে, নতুবা হাদিসের আমল অনাদায় থাকার কারণে কিয়ামতের ময়দানে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। 
লেখক : গবেষক ও অনুবাদক

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন