বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০১৫

ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজি

ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বঙ্গ বিজয় নিয়ে বাঙলার হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের একটা অস্বস্তি আর উল্লাসের জটাজাল আছে। হিন্দুরা অস্বস্তি বোধ করে এটাকে হিন্দু শক্তির পরাজয় মনে করে আর মুসলিমরা মনে করে এটা ইসলামের বিজয় আর শৌর্যের প্রতীক। বর্তমান কালে ইতিহাসের এই ঘটনায় এতো বেশী ধুলো কালি ফেলা হয়েছে যে পরিচ্ছন্ন ইতিহাস পাওয়া দুস্কর হয়ে গেছে। এই বঙ্গ বিজয় নিয়ে আমারো একটা বিশাল ধাঁধাঁ ছিল। ধাঁধাটা হচ্ছে যত বড় বীরই হোক না কেন, ১৮ জন যোদ্ধা নিয়ে একটা রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে জিতে যাওয়া একটা অবিশ্বাস্য বিষয়। যতই বলা হোক বাকি যোদ্ধারা পিছনে ছিল, নদিয়ার রাজপ্রাসাদ আসলে বৃদ্ধ রাজার গঙ্গাআবাস ছিল তাই সৈন্য বিশেষ ছিলনা, লক্ষণ সেনের সৈন্যরা অপ্রস্তুত ছিল। মোদ্দা কথা হচ্ছে সেই ১৮ জন সেনা যার মধ্যে বখতিয়ার খলজিও একজন তাঁরাই বিজয় সম্পন্ন করেছিলেন। ইতিহাসের নানা বই ঘাটতে ঘাটতে এটা আবিষ্কার করেছি যে লক্ষণ সেনের সৈন্যরা কোন বাধাই দেয়নি বখতিয়ার খলজিকে। কিন্তু কেন?
এই ধাঁধাঁ বুঝতে হলে ইতিহাসের আরো বিষয় জানতে হবে। প্রয়োজন হবে ঘটনাটিকে ধর্মের আর সাহিত্যের ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে পাঠ করার।
হিন্দুদের দশ অবতারের শেষ অবতার কল্কি অবতার (গাঁজার কল্কি নয়)) “কল্কিন” শব্দটা এসেছে “কর্কিন” থেকে, মানে “কর্ক” (সাদা ঘোড়া চড়েন যিনি)। তাহলে কল্কি শব্দটার মানে হচ্ছে “সাদা ঘোড়ায় আরোহী বীর”। ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে এই “কল্কিন” ধর্মঠাকুরের এক বিশেষ প্রকাশ বলে গণ্য হয়েছে। ধর্মঠাকুরের গাজন- অনুষ্ঠানের ছড়ায় আছে।
“হাঁসা ঘোড়া খাসা জোড়া পায়ে দিয়া মোজা
অবশেষে বোলইলে গৌড়ের রাজা।“
সেই সময় ঘোড়ায় চড়া যোদ্ধার বেশে বিষ্ণুর গল্প খুব ছড়িয়ে পড়েছিল। বখতিয়ার জামানার অনেক পরের একটি লৌকিক ধর্মানুষ্ঠানের ছড়ায় আছে যে, “ব্রাহ্মণদের অত্যাচার দেখে স্বয়ং পরমেশ্বর তাঁর দলবল নিয়ে মুসলমান সেজে হানা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।“
বখতিয়ার এসেছিলেন সাদা ঘোড়ায় চেপে; তাই বখতিয়ারের অশ্বারোহী বাহিনীকে সাক্ষাৎ অবতার মনে করেই লক্ষণ সেনের সেনারা বাধা দেয়নি, এটা নিশ্চিত।
বখতিয়ারের নদিয়া বিজয়ের পরেও হিন্দু কবিরাও বখতিয়ারের প্রশস্তি গেয়েছেন। উমাপতিধরের এই কবিতায় ম্লেচ্ছ যোদ্ধার শৌর্য প্রশংসা দেখতে পাই।
“সাধু ম্লেচ্ছনরেন্দ্র সাধু মাতৈব বীরপ্রসুর
নীচেনাপি ভবদবিধেন বসুধা সুক্ষত্রিয়া বর্ততে।“
এর অর্থ হচ্ছে
“সাধু ম্লেচ্ছরাজ সাধু! আপনার মাতাই যথার্থ বীর প্রসবিনী। পতিত হলেও আপনার মতো লোকের জন্য পৃথিবী সুক্ষত্রিয়া রয়েছে।“
উমাপতিধর রাজকবি ছিলেন না যে কিছু নগদ নারায়ণের জন্য এই কবিতা লিখেছেন। লৌকিক ধর্মানুষ্ঠানে বখতিয়ারকে মুসলমানের বেশে পরমেশ্বর বলায় ইতিহাসের সব গোমর খুলে যায়। বখতিয়ারের বিজয় বাঙলার মানুষের কাম্য ছিল। এই বিজয় অভিনন্দিত হয়েছিল। লক্ষণ সেনের রাজত্বের অনাচার থেকে রক্ষা পেতে বঙ্গ উন্মুখ ছিল। তাই বখতিয়ারের বিজয় হিন্দু শক্তির পরাজয়ের প্রতীক নয়। বরং মানুষের মুক্তির প্রতীক। হিন্দুদের পূর্বপুরুষরা যাকে বন্দনা করে গেছেন তাঁকে কলঙ্কিত করলে অপমান কার হয়?
(আমার উপরোক্ত বয়ান কারো অবিশ্বাস উৎপাদন করলে। পশ্চিমবঙ্গ বাঙলা আকাদেমী প্রকাশিত সুকুমার সেনের বঙ্গ ভুমিকা বইটির ৯৩,৯৪, ৯৯, ১৪০ ও ১৪১ নম্বর পৃষ্ঠা পড়ে দেখতে পারেন)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন