‘মাদরাসা’ শব্দটির সহজ অর্থ ‘পাঠশালা’, ‘বিদ্যালয়’ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ‘জামিয়া’ শব্দের মানে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’, যা বিশেষ উপযোগী মাদরাসাগুলোর নামের সঙ্গে সংযুক্ত রাখা হয়। ‘কওম’ শব্দের মানে ‘জাতি’ আর ‘কওমি’ মানে ‘জাতীয়’। অর্থাৎ ‘কওমি মাদরাসা’ এর মানে হলো ‘জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান’ বা জাতীয় বিদ্যাপীঠ। পৃথিবীর শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার আনুষ্ঠানিক সূচনাই হয়েছে মসজিদকে কেন্দ্র করে। উন্নত চরিত্রের অধিকারী, আদর্শ মানুষ ও যোগ্য নাগরিক গড়ে তোলার জন্য পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ সা. মদিনার মসজিদে নববিতে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন যা ইতিহাসে মাদরাসা ‘আসহাবে সুফ্ফা’ পরিচয়ে প্রসিদ্ধ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে শিক্ষা ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক ও নিয়মতান্ত্রিক ধারণার শুরু এখান থেকেই। মসজিদ কেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা এভাবেই হিজরি চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত চালু থাকে এবং প্রসার লাভ করে। বর্তমান প্রচলিত মাদরাসা শিক্ষার সূচনা হয় হিজরি পঞ্চম শতাব্দীতে। মুসলিম বিশ্বে সর্বপ্রথম বাগদাদে নিজামুল মুলক তূসী ‘মাদরাসা-ই-নিজামিয়া’ নামে এ ঐতিাহাসিক মিশনের গোড়াপত্তন করেন। পরবর্তীতে এর অনুকরণে গজনিতে সুলতান মাহমুদ গজনবি একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। অতঃপর সুলতান কুতুবুদ্দিন আইবেকের শাসনামলে ভারতবর্ষে পৃথকভাবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। ভারতে তুঘলক শাসনামল শুরু হলে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা আরও অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে ফিরোজ শাহ ও সুলতান সেকান্দার শাহর হাতে অসংখ্য মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাদরাসা প্রতিষ্ঠার এই ধারাবাহিকতা মোঘল শাসকরাও ধরে রাখেন। বাদশাহ আকবরের দুধমাতা মাহাম বেগমও দিল্লির পুরান কেল্লার পাশে ‘খায়রুল মানাজিল’ নামে একটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন। এ ধারাবাহিকতায় শায়খ মোল্লা নিজামুদ্দিন স¤্রাট আওরঙ্গজেবের অর্থায়নে লক্ষেèৗর ফিরিঙ্গি মহলে ‘দারুল উলুম নিজামিয়া’ মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেন, যার সিলেবাস পরবর্তীতে ‘দরসে নেজামি’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
দারুল উলুম দেওবন্দ
মোঘল সা¤্রাজ্যের পতনের পর এ সকল দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একে একে বন্ধ হয়ে যায়। ভারতবর্ষের দখলদার ব্রিটিশ শাসনামলে বিজাতীয় সংস্কৃতি, ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও ধর্মবিমুখ চেতনা থেকে মুসলিম জাতিকে মুক্ত রেখে ধর্মানুরাগ দেশপ্রেম ও কল্যাণের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলে আদর্শ সংস্কৃতিবান ও সুশিক্ষিত জাতি গঠন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখার জন্য ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের ঐতিহাসিক আধুনিক বিদ্যাপীঠ ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’। পরবর্তীতে তারই অনুকরণে গোটা উপমহাদেশজুড়ে আরও অসংখ্য মাদরাসা গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে আমাদের বাংলাদেশেও। এ মাদরাসাগুলো ‘দরসে নেজামি মাদরাসা’ বা ‘কওমি মাদরাসা’ নামে খ্যাতি লাভ করে।
মোঘল সা¤্রাজ্যের পতনের পর এ সকল দ্বীনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একে একে বন্ধ হয়ে যায়। ভারতবর্ষের দখলদার ব্রিটিশ শাসনামলে বিজাতীয় সংস্কৃতি, ঔপনিবেশিক শিক্ষা ও ধর্মবিমুখ চেতনা থেকে মুসলিম জাতিকে মুক্ত রেখে ধর্মানুরাগ দেশপ্রেম ও কল্যাণের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে তুলে আদর্শ সংস্কৃতিবান ও সুশিক্ষিত জাতি গঠন করে স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ভূমিকা রাখার জন্য ১৮৬৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের ঐতিহাসিক আধুনিক বিদ্যাপীঠ ‘দারুল উলুম দেওবন্দ’। পরবর্তীতে তারই অনুকরণে গোটা উপমহাদেশজুড়ে আরও অসংখ্য মাদরাসা গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে আমাদের বাংলাদেশেও। এ মাদরাসাগুলো ‘দরসে নেজামি মাদরাসা’ বা ‘কওমি মাদরাসা’ নামে খ্যাতি লাভ করে।
বাংলাদেশের কওমি মাদরাসা
স্বাধীনতার আগেও বাংলাদেশে অনেক কওমি মাদরাসা ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে জনসাধারণের উদ্যোগ ও সমর্থনে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা অব্যাহত থাকে। যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অসংখ্য কওমি মাদরাসা দেশজুড়ে সাফল্যের সঙ্গে ছড়িয়ে আছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা, সুশিক্ষা, সচ্চরিত্র, নীতি-আদশ, জ্ঞান অর্জন ও প্রতিভা বিকাশের অবলম্বন। জড়িয়ে আছে কোটি মানুষের আস্থা, প্রশংসা ও ভালোবাসা। রাজধানী ঢাকার উল্লেখযোগ্য সকল এলাকায় বহু আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত বড় মাদরাসাগুলো ছাড়াও সারা ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদরাসার সংখ্যা প্রচুর। ঠিক তেমনি দেশের সব ক’টি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও থানা সদরগুলোতেও অনেক ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদরাসা সুনামের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। আর ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে গণমানুষের প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় পরিচালিত কওমি মাদরাসার সংখ্যা অগণিত। যার সঙ্গে বাংলাদেশের গণমানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আধ্যাত্মিক, মানবিক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা নিবিড়ভাবে জড়িত।
স্বাধীনতার আগেও বাংলাদেশে অনেক কওমি মাদরাসা ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের মুক্ত স্বাধীন পরিবেশে জনসাধারণের উদ্যোগ ও সমর্থনে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা অব্যাহত থাকে। যার ধারাবাহিকতায় বর্তমানে অসংখ্য কওমি মাদরাসা দেশজুড়ে সাফল্যের সঙ্গে ছড়িয়ে আছে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন-জীবিকা, সুশিক্ষা, সচ্চরিত্র, নীতি-আদশ, জ্ঞান অর্জন ও প্রতিভা বিকাশের অবলম্বন। জড়িয়ে আছে কোটি মানুষের আস্থা, প্রশংসা ও ভালোবাসা। রাজধানী ঢাকার উল্লেখযোগ্য সকল এলাকায় বহু আগে থেকে প্রতিষ্ঠিত বড় মাদরাসাগুলো ছাড়াও সারা ঢাকা ও ঢাকার আশপাশের এলাকাজুড়ে প্রতিষ্ঠিত কওমি মাদরাসার সংখ্যা প্রচুর। ঠিক তেমনি দেশের সব ক’টি বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও থানা সদরগুলোতেও অনেক ঐতিহ্যবাহী কওমি মাদরাসা সুনামের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। আর ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে গণমানুষের প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় পরিচালিত কওমি মাদরাসার সংখ্যা অগণিত। যার সঙ্গে বাংলাদেশের গণমানুষের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাগত, আধ্যাত্মিক, মানবিক ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা নিবিড়ভাবে জড়িত।
কীভাবে গড়ে ওঠে
কওমি মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে বেশকিছু অপরিহার্য কারণ ও প্রয়োজন থাকে। যেহেতু এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় নব্বই ভাগ বা এর চেয়েও বেশি মুসলমান, আর যেহেতু ইসলামের মৌলিক জ্ঞান ও দীক্ষা গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অলঙ্ঘনীয়ভাবে ফরজ অথচ এ জাতীয় শিক্ষা উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসারে প্রায় পনেরো কোটি মুসলিম নাগরিককে যথা সময়ে প্রদানের কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই এবং যে কোনো সরকার শুধু নয় বরং গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থায়ই এ বিষয়ে যথেষ্ট অনাগ্রহী ও উদাসীন। এমনকি অতীত থেকে আজ পর্যন্ত কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্মবিদ্বেষী মহল এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মীয় চিন্তা চেতনা শিক্ষা ও আদর্শের পরিপন্থি ভূমিকায় নিজেরাও সক্রিয় এবং সরকার ও রাষ্ট্রকেও এ ভূমিকায় উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট। এমতাবস্থায় জনগণের প্রয়োজনেই জনগণ আস্থাভাজন সম্মানিত আলেমদের নেতৃত্বে সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে। নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস চেতনা এবং পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় জ্ঞান ও শিক্ষাকে অখ- ও অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনে নাগরিকদের এই ভূমিকাও নাগরিক অধিকারেরই অংশ। আর রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, উপযুক্ত মূল্যায়ন ও উদার পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতিতে নাগরিকের অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক একটি প্রয়োজন পূরণে এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে আলেমদের অগ্রণী ভূমিকাও অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রশংসনীয়।
কীভাবে চলে
দেশের সব কওমি মাদরাসা প্রধানত জনসাধারণের সমর্থন ও সহযোগিতা গ্রহণ করে থাকে। এর কারণ শুধু আর্থিক নয়, সামাজিকও বটে। যাদের প্রয়োজনে মাদরাসা, যারা উপকৃত এই মাদরাসা থেকে, তাদের সঙ্গে আন্তরিক সুসম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষা করে চলাও মাদরাসার দায়িত্ব। লক্ষ হাজার বা শ’টাকা হোক অথবা দুই চার পাঁচ দশ টাকাই হোক, মাদরাসা কোনো আগ্রহী দাতাকেই ক্ষুদ্রজ্ঞান করে না। তবে মানুষের দানের টাকায় চলে বলে মাদরাসাকে খাটো জ্ঞান বা হেয় প্রতিপন্ন করার যৌক্তিকতা নেই এ জন্য যে, দেশের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি তথা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের আর্থিক তত্ত্বাবধান বা সহযোগিতায় চলে এবং সরকার তা জনগণের টাকা দিয়েই পূরণ করে। বিদেশ থেকে খয়রাতি টাকা এনেও এ কাজে ব্যয় করে। এক্ষেত্রে জনগণের টাকা সরকারের মাধ্যমে নানা হাত ঘুরে, নানা দুর্নীতির শিকার হয়ে পরিমাণে ক্ষীণ হতে হতে প্রাপকের কাছে পৌঁছায়, পক্ষান্তরে মাদরাসাগুলোতে টাকার মালিক নিজের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এবং মাদরাসাও জনগণের টাকা সরাসরি জনগণের হাত থেকেই গ্রহণ করতে পারছে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নানা ঘাট ঘুরিয়ে বস্তুত মানুষের ট্যাক্স ও দানের টাকাতেই চলে, কারণ সরকারের টাকাও মানুষেরই টাকা, হাওয়া থেকে পাওয়া নয়। তবে একটি ধারণা সবার কাছে পরিষ্কার থাকা দরকার, সাধারণ অনুদানের বাইরে মাদরাসাগুলো যে জাকাত ফিতরা মানত সদকা ও কুরবাণির চামড়া গ্রহণ করে থাকে, তা শুধুমাত্র এতিম ও দরিদ্র ছাত্রদের জন্য ব্যয় করা হয়, সবার জন্য নয়। অন্য ছাত্রদের থাকা খাওয়া বা শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতায় এসব অর্থ কোনোভাবেই ব্যবহৃত হয় না। কাজেই মাদরাসাগুলো জাকাত সদকার টাকায় চলে বা আলেমগণ জাকাতের টাকা খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকেনÑ একথা বিশ্বাস করা বা ছড়ানো জঘন্য অন্যায়। বাস্তব তো এই যে, এ ধরনের দুষ্টমানসিকতার লোকদের দু’চারবার কিনে নেয়ার মতো ধনবান আলেমও বাংলাদেশে অনেক আছেন।
জনসাধারণের আর্থিক সহযোগিতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলেও মাদরাসাগুলোর আরও বিভিন্ন আয়ের উৎস থাকে। ছাত্রদের ভর্তি ফি, মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি ছাড়াও অনেক মাদরাসার নিজস্ব ফসলের জমি, মূল্যবান গাছ, পুকুর, ফার্ম, স্থল ও জল পরিবহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেটসহ নানা আয়ের পথও রয়েছে।
কওমি মাদরাসায় কারা পড়ে
কওমি মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে অনেকের কিছু ভুল ধারণা বা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো এখানে সমাজের অসহায় দরিদ্র ঘরের সন্তানরাই শুধু পড়তে আসে অথবা পরিবারের সবচেয়ে অনুপযুক্ত অবহেলিত কিংবা প্রতিবন্ধী সন্তানকেই এখানে দেয়া হয়। কেউবা জন্মের আগেই ছেলে সন্তান হলে মাদরাসায় দেয়ার মানত করে রাখেন, তারপর সেই মানত রক্ষা করতে মাদরাসায় দিয়ে দেন, এ ছাড়াও শুধু এতিম ও আশ্রয়হীন শিশুদের দিয়ে মাদরাসার ছাত্র চাহিদা পূরণ করা হয় ইত্যাদি। অন্যদিকে সমাজের স্বাভাবিক স্বচ্ছল শিক্ষিত এবং আধুনিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘর থেকে মাদরাসায় কেউ পড়তে আসে না বলেও তাদের ধারণা। এসব ধারণা বহুলাংশেই ভুল। কওমি মাদরাসায় অনেক দরিদ্র ঘরের সন্তান পড়তে আসে বটে তবে সেটা অভাব বা গরিবিহালের কারণে নয়, বরং ইসলামের সুমহান জ্ঞান দীক্ষা ও নৈতিক চরিত্র অর্জনের জন্যই। অন্যথায় এরা অভাব মোচনে গ্রামের সেই সব স্কুলেই পড়তে যেতে পারতো যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের চাল, গম ও নগদ অর্থ দিয়ে উৎসাহিত করা হয়। কেউ যদি মানতের সন্তান মাদরাসায় দেন তবে তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। আর এতিম ও প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনা বেতনে থাকা খাওয়া ও পড়ালেখার ব্যবস্থা করে কওমি মাদরাসা মূলত রাষ্ট্রকেই সহায়তা করছে, কারণ এসব অসহায় শিশুদের সুশিক্ষা ও সুরক্ষার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের।
সারাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে যে পরিমাণ এতিম অসহায় শিশুর নিরাপদ ও সম্মানজনক আশ্রয় হয়েছে, তা সরকারি এতিমখানাগুলোর তুলনায় অনেকগুণ বেশি। বিষয়টি কওমি মাদরাসার গুণ হতে পারে, দোষ তো হওয়ার কথা নয়! বরং গরিব এতিম ও প্রতিবন্ধীদের নিচু চোখে দেখাটাইতো প্রকৃত দোষের। তবে উল্লেখ্য যে, গরিব ও অসহায়দের জন্য কওমি মাদরাসাগুলোতে বিশেষ সুবিধা সংরক্ষিত থাকলেও শুধু এদের দিয়েই যে দেশের হাজার হাজার মাদরাসা বা শুধু ঢাকারই শতাধিক মাদরাসা ভরে গেছেÑ এটা ভাবা নিতান্তই হাস্যকর। বিশেষ করে বর্তমানে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সন্তানরা পড়ছে। গরিব দিন মজুর বা গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ধনী ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, প্রতিষ্ঠিত চাকরিজীবী, অনেক প্রবাসী, এমনকি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকদের সন্তানরাও উল্লেখযোগ্য হারে মাদরাসায় পড়ছে। শহরের মাদরাসাগুলোতে জরিপ চালালে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে। বড় কথা হলো মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সমাজের যে স্তর থেকেই আসুক, যে কারণেই আসুক, এরা এ জাতিরই অংশ, এদেশেরই সন্তান। নিয়মিত শিক্ষার পাশাপাশি লক্ষাধিক মসজিদভিত্তিক মক্তব ও বয়স্ক শিক্ষার মাধ্যমে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা জাতির সুবিশাল এক অংশকে প্রাথমিক এবং ন্যূনতম শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষর করে তুলে রাষ্ট্রের নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্য বাস্তবায়নে যে অবদান রাখছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য।
কওমি মাদরাসাগুলো প্রতিষ্ঠার পেছনে বেশকিছু অপরিহার্য কারণ ও প্রয়োজন থাকে। যেহেতু এদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় নব্বই ভাগ বা এর চেয়েও বেশি মুসলমান, আর যেহেতু ইসলামের মৌলিক জ্ঞান ও দীক্ষা গ্রহণ করা প্রতিটি মুসলমানের জন্য অলঙ্ঘনীয়ভাবে ফরজ অথচ এ জাতীয় শিক্ষা উপযুক্ত পদ্ধতি অনুসারে প্রায় পনেরো কোটি মুসলিম নাগরিককে যথা সময়ে প্রদানের কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে নেই এবং যে কোনো সরকার শুধু নয় বরং গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থায়ই এ বিষয়ে যথেষ্ট অনাগ্রহী ও উদাসীন। এমনকি অতীত থেকে আজ পর্যন্ত কিছু স্বার্থান্বেষী ধর্মবিদ্বেষী মহল এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মীয় চিন্তা চেতনা শিক্ষা ও আদর্শের পরিপন্থি ভূমিকায় নিজেরাও সক্রিয় এবং সরকার ও রাষ্ট্রকেও এ ভূমিকায় উদ্বুদ্ধ করতে সচেষ্ট। এমতাবস্থায় জনগণের প্রয়োজনেই জনগণ আস্থাভাজন সম্মানিত আলেমদের নেতৃত্বে সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে। নিজেদের ধর্মীয় বিশ্বাস চেতনা এবং পূর্ণাঙ্গ ধর্মীয় জ্ঞান ও শিক্ষাকে অখ- ও অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করার প্রয়োজনে নাগরিকদের এই ভূমিকাও নাগরিক অধিকারেরই অংশ। আর রাষ্ট্রের সদিচ্ছা, উপযুক্ত মূল্যায়ন ও উদার পৃষ্ঠপোষকতার অনুপস্থিতিতে নাগরিকের অতি গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক একটি প্রয়োজন পূরণে এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনে আলেমদের অগ্রণী ভূমিকাও অত্যন্ত যৌক্তিক ও প্রশংসনীয়।
কীভাবে চলে
দেশের সব কওমি মাদরাসা প্রধানত জনসাধারণের সমর্থন ও সহযোগিতা গ্রহণ করে থাকে। এর কারণ শুধু আর্থিক নয়, সামাজিকও বটে। যাদের প্রয়োজনে মাদরাসা, যারা উপকৃত এই মাদরাসা থেকে, তাদের সঙ্গে আন্তরিক সুসম্পর্ক স্থাপন ও রক্ষা করে চলাও মাদরাসার দায়িত্ব। লক্ষ হাজার বা শ’টাকা হোক অথবা দুই চার পাঁচ দশ টাকাই হোক, মাদরাসা কোনো আগ্রহী দাতাকেই ক্ষুদ্রজ্ঞান করে না। তবে মানুষের দানের টাকায় চলে বলে মাদরাসাকে খাটো জ্ঞান বা হেয় প্রতিপন্ন করার যৌক্তিকতা নেই এ জন্য যে, দেশের স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি তথা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও সরকারের আর্থিক তত্ত্বাবধান বা সহযোগিতায় চলে এবং সরকার তা জনগণের টাকা দিয়েই পূরণ করে। বিদেশ থেকে খয়রাতি টাকা এনেও এ কাজে ব্যয় করে। এক্ষেত্রে জনগণের টাকা সরকারের মাধ্যমে নানা হাত ঘুরে, নানা দুর্নীতির শিকার হয়ে পরিমাণে ক্ষীণ হতে হতে প্রাপকের কাছে পৌঁছায়, পক্ষান্তরে মাদরাসাগুলোতে টাকার মালিক নিজের হাতে টাকা পৌঁছে দেয়ার সুযোগ পাচ্ছেন এবং মাদরাসাও জনগণের টাকা সরাসরি জনগণের হাত থেকেই গ্রহণ করতে পারছে। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও নানা ঘাট ঘুরিয়ে বস্তুত মানুষের ট্যাক্স ও দানের টাকাতেই চলে, কারণ সরকারের টাকাও মানুষেরই টাকা, হাওয়া থেকে পাওয়া নয়। তবে একটি ধারণা সবার কাছে পরিষ্কার থাকা দরকার, সাধারণ অনুদানের বাইরে মাদরাসাগুলো যে জাকাত ফিতরা মানত সদকা ও কুরবাণির চামড়া গ্রহণ করে থাকে, তা শুধুমাত্র এতিম ও দরিদ্র ছাত্রদের জন্য ব্যয় করা হয়, সবার জন্য নয়। অন্য ছাত্রদের থাকা খাওয়া বা শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতায় এসব অর্থ কোনোভাবেই ব্যবহৃত হয় না। কাজেই মাদরাসাগুলো জাকাত সদকার টাকায় চলে বা আলেমগণ জাকাতের টাকা খেয়ে বেঁচে বর্তে থাকেনÑ একথা বিশ্বাস করা বা ছড়ানো জঘন্য অন্যায়। বাস্তব তো এই যে, এ ধরনের দুষ্টমানসিকতার লোকদের দু’চারবার কিনে নেয়ার মতো ধনবান আলেমও বাংলাদেশে অনেক আছেন।
জনসাধারণের আর্থিক সহযোগিতা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হলেও মাদরাসাগুলোর আরও বিভিন্ন আয়ের উৎস থাকে। ছাত্রদের ভর্তি ফি, মাসিক বেতন, পরীক্ষার ফি ইত্যাদি ছাড়াও অনেক মাদরাসার নিজস্ব ফসলের জমি, মূল্যবান গাছ, পুকুর, ফার্ম, স্থল ও জল পরিবহন, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, মার্কেটসহ নানা আয়ের পথও রয়েছে।
কওমি মাদরাসায় কারা পড়ে
কওমি মাদরাসার ছাত্রদের নিয়ে অনেকের কিছু ভুল ধারণা বা সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি হলো এখানে সমাজের অসহায় দরিদ্র ঘরের সন্তানরাই শুধু পড়তে আসে অথবা পরিবারের সবচেয়ে অনুপযুক্ত অবহেলিত কিংবা প্রতিবন্ধী সন্তানকেই এখানে দেয়া হয়। কেউবা জন্মের আগেই ছেলে সন্তান হলে মাদরাসায় দেয়ার মানত করে রাখেন, তারপর সেই মানত রক্ষা করতে মাদরাসায় দিয়ে দেন, এ ছাড়াও শুধু এতিম ও আশ্রয়হীন শিশুদের দিয়ে মাদরাসার ছাত্র চাহিদা পূরণ করা হয় ইত্যাদি। অন্যদিকে সমাজের স্বাভাবিক স্বচ্ছল শিক্ষিত এবং আধুনিক মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ঘর থেকে মাদরাসায় কেউ পড়তে আসে না বলেও তাদের ধারণা। এসব ধারণা বহুলাংশেই ভুল। কওমি মাদরাসায় অনেক দরিদ্র ঘরের সন্তান পড়তে আসে বটে তবে সেটা অভাব বা গরিবিহালের কারণে নয়, বরং ইসলামের সুমহান জ্ঞান দীক্ষা ও নৈতিক চরিত্র অর্জনের জন্যই। অন্যথায় এরা অভাব মোচনে গ্রামের সেই সব স্কুলেই পড়তে যেতে পারতো যেখানে সরকারের পক্ষ থেকে ছাত্রছাত্রীদের চাল, গম ও নগদ অর্থ দিয়ে উৎসাহিত করা হয়। কেউ যদি মানতের সন্তান মাদরাসায় দেন তবে তাতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। আর এতিম ও প্রতিবন্ধী শিশুদের বিনা বেতনে থাকা খাওয়া ও পড়ালেখার ব্যবস্থা করে কওমি মাদরাসা মূলত রাষ্ট্রকেই সহায়তা করছে, কারণ এসব অসহায় শিশুদের সুশিক্ষা ও সুরক্ষার দায়িত্ব মূলত রাষ্ট্রের।
সারাদেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে যে পরিমাণ এতিম অসহায় শিশুর নিরাপদ ও সম্মানজনক আশ্রয় হয়েছে, তা সরকারি এতিমখানাগুলোর তুলনায় অনেকগুণ বেশি। বিষয়টি কওমি মাদরাসার গুণ হতে পারে, দোষ তো হওয়ার কথা নয়! বরং গরিব এতিম ও প্রতিবন্ধীদের নিচু চোখে দেখাটাইতো প্রকৃত দোষের। তবে উল্লেখ্য যে, গরিব ও অসহায়দের জন্য কওমি মাদরাসাগুলোতে বিশেষ সুবিধা সংরক্ষিত থাকলেও শুধু এদের দিয়েই যে দেশের হাজার হাজার মাদরাসা বা শুধু ঢাকারই শতাধিক মাদরাসা ভরে গেছেÑ এটা ভাবা নিতান্তই হাস্যকর। বিশেষ করে বর্তমানে দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সন্তানরা পড়ছে। গরিব দিন মজুর বা গ্রামের কৃষক থেকে শুরু করে শহরের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, আইনজীবী, ধনী ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি, প্রতিষ্ঠিত চাকরিজীবী, অনেক প্রবাসী, এমনকি সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষকদের সন্তানরাও উল্লেখযোগ্য হারে মাদরাসায় পড়ছে। শহরের মাদরাসাগুলোতে জরিপ চালালে এর সত্যতা প্রমাণিত হবে। বড় কথা হলো মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সমাজের যে স্তর থেকেই আসুক, যে কারণেই আসুক, এরা এ জাতিরই অংশ, এদেশেরই সন্তান। নিয়মিত শিক্ষার পাশাপাশি লক্ষাধিক মসজিদভিত্তিক মক্তব ও বয়স্ক শিক্ষার মাধ্যমে কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা জাতির সুবিশাল এক অংশকে প্রাথমিক এবং ন্যূনতম শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষর করে তুলে রাষ্ট্রের নিরক্ষরতা দূরীকরণের লক্ষ্য বাস্তবায়নে যে অবদান রাখছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য।
কওমি মাদরাসায় কী পড়ানো হয়
সাধারণ মানুষের অনেকেরই ধারণাÑ মাদরাসায় শুধু কায়দা আমপারা, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া দরূদ, আজান, নামাজ, জানাজা, খতম ও মিলাদ পড়ানোর মতো আরও কিছু জিনিস শিখানো হয়। যারা এটা ভাবেন তারা হয়তো এ পর্যন্তই জ্ঞান রাখেন, কাজেই এর বাইরে এবং এর পরে আর বুঝার বা অনুমান করার সামর্থ্য তাদের নেই। আসল ব্যাপার হলো উপরে যে বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে, এই বিষয়গুলো মাদরাসার ছাত্ররা ক্লাস ওয়ান-টুতেই শিখে ফেলে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে ছোট ছোট বাচ্চারা জনসাধারণের সামনে এর প্রদর্শনীও করে থাকে। কথা হলো ১৬/১৭ বছরের মাদরাসা সিলেবাসে বাকি ১৪/১৫ বছর তারা তাহলে কী পড়ে বা কী শেখে?
বাকি বছরগুলোতে তাদের শিক্ষার সিলেবাস যথেষ্ট দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। তারা একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আরবি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করে। বাংলাতো নিজেদের ভাষা, ইংরেজির ওপর দক্ষতার বিষয়টি না হয় বাদ দিলাম, আরবি উর্দু ও ফারসি ভাষায়ও যদি কেউ দক্ষতা অর্জন করে সেটা প্রশংসনীয় ও মেধার পরিচয় নয় কি? এ বিশ্বায়নের যুগে কতোজনের এ বাড়তি যোগ্যতাটি থাকে? এগুলোও তো ভাষা হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পৃথিবীতে ভাষা বলতে শুধু ইংরেজিকেই মনে করা প্রকৃত জ্ঞানী মানুষের কাজ নয়। এরপর আরও পড়া হয় বাংলাদেশ, উপমহাদেশ, বিশ্ব ও ইসলামের ইতিহাস। ভূগোল, সমাজ বিজ্ঞান, গণিত। একই সঙ্গে বাংলা ফার্সী ও আরবি সাহিত্য। যুক্তিবিদ্যা, কৌশল বিদ্যা, দর্শন বাংলা ও আরবি ভাষার সম্পূর্ণ ব্যাকরণ। পড়ানো হয় ইসলামি অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ইসলামি আইন ও বিচার বিধান। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নৈমিত্তিক বিষয়ের ইসলামি বিধান, যথা ব্যবসা-বাণিজ্য, বিয়ে-দাম্পত্য জীবন, লেনদেন, উত্তরাধিকার আইন, ভ্রমণ, যুদ্ধ, পরিবার, আত্মীয়তা, প্রতিবেশী, ঘুম, পানাহার, ওজু-গোসল, জন্ম-মৃত্যু, জীবন-জীবিকা, ফসল, গবাদি পশু, ভূমি, সমুদ্র, রোগ, চিকিৎসা, শ্রম-শ্রমিক, ইত্যাদি। পাশাপাশি পড়ানো হয় ইবাদাত ও আধ্যাত্মিকতার সঠিক নিয়ম কানুন ও তাৎপর্য। সেসব বিধি বিধান কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনার ভিত্তিতে গবেষণা করে বের করার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা, সেটাও পড়তে হয়। বিধি বিধানকে বলা হয় ‘ফিকহ’ আর এর নীতিমালাকে বলা হয় ‘উসুলে ফিকহ’। শুধু ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলোর ব্যাপারেই সবিস্তারে দীর্ঘ প্রামাণ্য গবেষণা করতে হয়, একে বলা হয় ‘আকাইদ’।
গভীর শ্রদ্ধা ও সতর্কতার সঙ্গে ইসলামের প্রবর্তক, শুধু মুসলমানদের নয়, বিশ্বমানবতার পথ প্রদর্শক মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনী, জীবনাদর্শ ও জীবনদর্শনের পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে আত্মস্থ করা হয়। মানুষের জীবনের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংসারিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং পারিবারিক সকল ছোট বড় বিষয়ের ইসলামি সমাধান খুঁজে নিতে মহানবীর সা. অসংখ্য হাদিস সরাসরি রাসুল সা. থেকে নিয়ে নিজ পর্যন্ত দেড় হাজার বছরের সুদীর্ঘ শিক্ষাপরম্পরার সনদসহ শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ এবং ব্যাখ্যাসহকারে পড়ে আত্মস্থ করতে হয়। হাদিসের এই উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠ ৬টি গ্রন্থকেই ‘সিহাহ সিত্তাহ’ বলা হয়। সর্বোপরি রাসুলের নির্দেশনার আলোকে মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াতের নিঃসৃত বার্তা ও বিধান প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহকারে আত্মস্থ করতে হয়।
এ ছাড়াও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, কম্পিউটার শিক্ষা, বক্তৃতা, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, পত্রিকা, খেলাধুলা, শরীরচর্চা, শিক্ষাসফরসহ আরও অনেক মৌলিক ও আনুষঙ্গিক বিষয় ও বিভাগ এখন মাদরাসায় রয়েছে যা সংক্ষেপে তুলে ধরা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ত্রিশ পারা কুরআনের আরবি আয়াতের পূর্ণাঙ্গ ভলিউম হুবহু মুখস্থ করার মতো অসম্ভবকেও যে শিশুরা সম্ভব করে দেখায় তাদের দরিদ্র-এতিম বলে তুচ্ছজ্ঞান না করে তাদের কাছে বিনয়াবনত হওয়া উচিত। এ অবদানটি শুধুই মাদরাসার, অন্য কারও নয়। মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা ও মন্তব্যকারীদের পক্ষে হয়তো কয়েক পৃষ্ঠার বাংলা চটি বইও দাঁড়ি, কমা, কোলন, প্যারাসহ মুখস্ত করা সারাজীবনেও সম্ভব নয়। কাজেই কওমি মাদরাসার সিলেবাস সম্বন্ধে ভালোভাবে না জেনে সমালোচনা করা মোটেও সমীচীন নয়। আর হ্যাঁ, মাদরাসা ছাত্রদের কিছু বিশেষ রীতি ও বৈশিষ্ট্য আছে, তারা পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি অথবা লম্বা কুর্তা পড়ে, ইসলামের পোশাকবিধান ও রাসুলের সুন্নত অনুসারেই তারা নিজেদের জীবন সাজায়, এটি তাদের ব্যক্তিগত অধিকার। এ ছাড়া কওমি মাদরাসায় মেঝেতে বসে পড়ালেখা ও খাওয়া দাওয়া চলে। এক্ষেত্রে চাদর, ফরাশ বা কার্পেট ব্যবহার করা হয়, মেঝে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। এটাও রাসুলের সুন্নত ও ইলমে দ্বীনের ঐতিহ্য অনুসারেই হয়। পয়সা বা চেয়ার টেবিলের অভাবে নয়, এ ধরনের আরও অনেক বিষয়কেই নিন্দনীয়রূপে প্রচার করা হয় যা সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপ্রসূত ও অমূলক।
কওমি শিক্ষার্থীদের উপার্জন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অবদান
প্রথমত শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি ‘নীতিবান আদর্শ মানুষরূপে নিজেকে গড়া’ হয় তবে মাদরাসায় সেটা ভালোভাবেই হয়। পাশাপাশি ব্যক্তির সচ্ছল জীবন, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা ও সম্মানজনক উপার্জনও যদি উদ্দেশ্য হয় তবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সেটাও হয়ে যায়। যদিও আর্থিক সমৃদ্ধি আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাকে প্রধান অবলম্বন মনে করা উচিত নয়, ততোটা বাস্তবও নয়। সমাজের বিশেষ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত বেশি হওয়াই এর প্রমাণ। দেশের বেকার সমস্যা যখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে থাকে। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা যখন সামান্য বেতনের একটি চাকরি পেতে হন্যে হয়ে ঘুরে জুতো ক্ষয় করে। পরিবার ও সমাজ থেকে উপেক্ষা অবমাননা পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। রাষ্ট্র যখন শিক্ষিত বেকারের চাপ নিতে হিমশিম খায় তখনও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মাদরাসা শিক্ষিত কোনো আলেম শহর বা গ্রামের কোথাও সম্পূর্ণ বেকার নেই। কিছু না কিছু উপার্জন করে অল্পে তুষ্ট সুখি জীবনযাপন করছে। নিজের কর্মক্ষেত্র নিজেই খুঁজে নিচ্ছে। রাষ্ট্রের ওপর বেকারত্বের চাপ বাড়াচ্ছে না। এটা সাধারণ সমীকরণ।
এর ব্যতিক্রম অনেক অনেক কওমি আলেম যথেষ্ট সচ্ছলতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। শিক্ষা সাহিত্য সাংবাদিকতা সংস্কৃতি গণমাধ্যম ব্যবসা ও রাজনীতিতে নিজ প্রতিভার যথার্থ স্বাক্ষর রাখছেন এমন আলেমের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একটি বাস্তব সত্য হলো কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যে অভ্যস্ত ও প্রশিক্ষিত হয়ে নিজেদের মেধাকে এমনভাবে শাণিত করতে পারে, তারা ব্যক্তিগতভাবে সরকারি আলিয়া মাদরাসা বা স্কুল-কলেজের মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিলে যথেষ্ট ভালো ফলাফল করতে সক্ষম হয়। এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর অনেকেই এখন কলেজ ভার্সিটির অধ্যাপনা, বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পদনা, পরিচালনা ও নির্বাহী দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। আছেন আইনশৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনীতেও। কওমি আলেমদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে বিপুল ভূমিকা রাখছেন। এটি যেকোনো নিরপেক্ষ জরিপে প্রমাণ হতে পারে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত বেশ কজন স্বনামধন্য কওমি আলেম দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গণমানুষের রায়ে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদেও এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছেন। গণমুখী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলে আরও অনেক সৎ ও যোগ্য আলেমকে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করবে।
এসব অন্য পেশা বাদ রেখে আলেমরা যদি শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব পালনেও সীমাবদ্ধ থাকেন তবুও পনেরো কোটি মুসলিম নাগরিকের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এবং ৬৮ হাজারেরও বেশি গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ও রাজধানীসহ সকল শহরের মহল্লায় মহল্লায় প্রতিষ্ঠিত কয়েক লক্ষ মসজিদের খতিব ইমাম ও মুয়াজ্জিনের পদ পূরণের জন্যও আরও অনেক পূর্ণাঙ্গ আলেমের প্রয়োজন। রাষ্ট্রের জনগণের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন সরবরাহের ব্যবস্থাতো মাদরাসা ছাড়া অন্যত্র নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও মসজিদ মাদরাসা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বৈ কমছে না। তাই আরও বেশি দ্বীনের আলেম তৈরি হওয়ার জন্য আরও বেশি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হওয়া প্রয়োজন। সমাজে একটি ধারণা এমনও আছে, মাদরাসায় পড়ে তো শুধু মাওলানাই হয়, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিল্পী, আইনজীবী, গণিতবিদ, আইটিবিশেষজ্ঞ, সংস্কৃতিকর্মী ইত্যাদি কিছুই তো হয় না। এটিও একটি চরম মূর্খতাপ্রসূত কথা। মাদরাসা তো আলেম বানানোর জন্যই প্রতিষ্ঠিত। অন্য কিছু এখানে হওয়ার তো কথা না। মেডিকেল কলেজ থেকে কেন ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে না বা বুয়েট থেকে কেন ডাক্তার হতে পারছে না এ প্রশ্ন যেমন অবান্তর, আগের প্রশ্নটিও তাই। মাদরাসা থেকে প্রকৃত ইলমে দ্বীন সম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ আলেম পাওয়া যাচ্ছে কিনা সেটাই আসল বিষয়। বাড়তি যোগ্যতা প্রশংসনীয়, তবে মুখ্য নয়।
কওমি শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
কোনো মানুষই দোষ গুণ থেকে মুক্ত নয়। তবে কওমি শিক্ষার্থীদের চরিত্র বিশ্লেষণে এমন অনেক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যা দেশের সাধারণ ও আধুনিক শিক্ষার্থীদের বেলায় নগণ্য। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, হল দখলের মতো কোনো ঘটনা দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে নেই। নেই শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘৃণ্য অধ্যায়। নেই নকল প্রবণতা। এমনকি এ মাদরাসাগুলো ভর্তিবাণিজ্য থেকেও মুক্ত। এ ছাড়া দেশ ও সমাজের যাবতীয় প্রধান সমস্যা ও সঙ্কটগুলোর সঙ্গে কওমি ছাত্রদের কোনোরকম সম্পর্ক নেই বলা যায়। যেমন সন্ত্রাস, মাদক, হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং, চোরাচালান, সুদ, ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হুমকি, অপহরণ, নগ্নতা, অশ্লীলতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, কালোবাজারী, প্রতারণা, যৌতুক, নারী নির্যাতন, অপরাজনীতি ইত্যাদি। তবে ছিদ্রান্বেষণকারীদের কাছে বিচ্ছিন্ন কোনো তথ্য থাকলেও তা সাধারণ শিক্ষাঙ্গনের তুলনায় শতকরা ১ ভাগেরও কম। ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়াই যদি প্রথম লাভ হয়ে থাকে, অপকার না পাওয়াই যদি উপকার হয়ে থাকে তবে বর্তমান সামাজিক নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়কালে কওমি শিক্ষার্থী ও আলেমদের দ্বারা দেশ ও জাতি যথেষ্ট লাভবান ও উপকৃত। দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে জরিপ করে দেখলে কোনো কওমি আলেমের পিতা-মাতার সন্ধান পাওয়া কঠিন হবে। তদ্রƒপ দেশের সকল অপরাধ ও অপরাধীদের ওপর গবেষণা করলে এমনকি পুলিশের কালো তালিকা ও জেলখানাগুলো খোঁজ করলে কওমি শিক্ষিতদের নৈতিক উজ্জ্বলতা প্রমাণিত হবে। এসবই কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সুফল।
কওমি মাদরাসার অগ্রসর চিন্তা
উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এমন কিছু আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত ধারণার উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করে আসছে যার প্রচলন সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্র অনেক পরে করেছে। যেমন জাতীয়ভাবে সাক্ষরতা অর্জনের জন্য শহর ও গ্রামের অসহায় দরিদ্র শিশুদের বিনা বেতনে থাকা খাওয়াসহ পড়াশোনার সুবিধা প্রদান। প্রাতঃ ও নৈশকালীন বয়স্কশিক্ষা, গণশিক্ষার এই প্রজেক্টটি অনেক মাদরাসায় আগে থেকেই বিদ্যামান। দূরের শিক্ষার্থীদের জন্য অথবা বাড়িতে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ নেই এমন শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ সুবিধাজনক আবাসিক ব্যবস্থা গ্রহণ। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার সঠিক নিরীক্ষণের জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের প্রচলনসহ অনেক আধুনিক চিন্তা ও ব্যবস্থা শত বছর আগে থেকেই কওমি মাদরাসায় প্রচলিত রয়েছে আর রাষ্ট্র এসব অতি সাম্প্রতিক সময়ে শুরু করছে মাত্র। এ ছাড়াও আরেকটি বিশেষ দিক হলোÑ মাধ্যমিক থেকে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক, ¯œাতক, ¯œাতোকোত্তর, ও উচ্চতর শিক্ষার সকল শ্রেণীর বহুমূল্যের মৌলিক পাঠ্যপুস্তক মাদরাসার গ্রন্থাগার থেকে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে সারা বছরের জন্য ধার প্রদান করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার টাকা খরচ থেকে বেঁচে যায়। এই আধুনিক ও উচ্চশিক্ষাবান্ধব ব্যবস্থাটি সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এখনও গ্রহণ করতে পারেনি। এমন আরও অনেক দিক থেকে কওমি মাদরাসা যথেষ্ট অগ্রসরতার প্রমাণ রেখেছে।
স্বতন্ত্র কওমি মহিলা মাদরাসা
দেশের অসংখ্য ছেলেদের মাদরাসার পাশাপাশি সম্পূর্ণ পৃথক নিরাপদ ও স্বাধীন ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কওমি মহিলা মাদরাসার সংখ্যাও এখন কম নয়। শুধু ঢাকাতেই এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। রয়েছে সারা দেশ জুড়েই। পরীক্ষায় তারা ফলাফলও ভালো করছে। আবাসিক অনাবাসিক দুরকম ব্যবস্থাই আছে। শহরের মহিলা মাদরাসাগুলো সমাজের অভিজাত ধনাঢ্য শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষার্থীদের দ্বারাই বহুলাংশে পরিপূর্ণ। সাধারণত এসব মাদরাসার প্রিন্সিপাল থেকে পিয়ন পদ পর্যন্ত নারীদের অবস্থান। তবে প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাসহ বিশেষ অনিবার্য কিছু দায়িত্বে যোগ্য পুরুষ আলেমও থাকেন। কঠোর নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার জন্য সমাজে মহিলা মাদরাসাগুলো গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। নারী নিরাপত্তাহীনতার এই যুগে আদরের মেয়েকে মহিলা মাদরাসায় পড়তে পাঠিয়ে তুলনামূলক নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন অভিভাবকরাও। মেয়েরা দক্ষতার সঙ্গে আলেম ও হাফেজ হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিভার সাক্ষর রাখছে। পড়া শেষ হওয়ার আগেই কর্মসংস্থানও হয়ে যাচ্ছে। সঠিক বয়সে সুপাত্র খুঁজে পেতেও অভিভাবকদের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। মেয়েদের আইবুড়ো করে ঘরে বসিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হচ্ছে না। সুশিক্ষায় আলোকিত এই মেয়েরা সংসার ও কর্মজীবনে কোনো রকম নির্যাতন বা কুসংস্কারের শিকারও হচ্ছে না। আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক করে গড়ে তুলতে পারছে নিজের সন্তানকেও। ভবিষ্যত জাতির জন্য তারা হয়ে উঠছে একেকজন আদর্শ মা।
কওমি মাদরাসার সমাজ সংশ্লিষ্টতা
বাংলাদেশ যেহেতু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ তাই এই বৃহত্তর মুসলিম সমাজে ইসলামি শিক্ষাগার কওমি মাদরাসার সামাজিক সংশ্লিষ্টতাও অনেক গাঢ় ও অনিবার্য। সমাজ জীবনের যেকোনো পর্যায়ের ধর্মীয় নির্দেশনার কাজটি মাদরাসা করে থাকে। সাধারণভাবে নামাজ, দোয়া, খতম, জানাজা, মাসলা-মাসায়েল, দ্বীনি ফতোয়া, কুরআন শিক্ষা, ইত্যাদি উপলক্ষে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মাদরাসা ও আলেমদের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। যেমনটি ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর, আইনজীবীর সঙ্গে মক্কেলের, প্রকৌশলীর সঙ্গে নির্মাতার থাকে। কাজেই অন্যান্য পেশাজীবী আধুনিক শিক্ষিতরাও যে তাদের পেশাগত সম্পর্কের বাইরে সমাজের সঙ্গে আরও খুব বেশি সম্পৃক্ত থাকেন, তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে মাদরাসাকে সমাজ বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, গ্রামবাংলায় মাদরাসা কেন্দ্রিক বার্ষিক মাহফিল বা লোকশিক্ষার আয়োজন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উৎসব বিনোদনের সংস্কৃতি হয়ে আছে। এমনকি গ্রামের ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে বিশেষ মেলা ও বাজার বসে থাকে, যা নাগরিকদের নানা প্রয়োজন মেটায়। এ উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে নাইওরি ও মেহমান আসে। পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিও এই সুযোগে পালিত হয়। অনেক জনপদের মানুষ মাদরাসা থেকে বিভিন্ন সামাজিক সেবা নিরাপত্তা ও কল্যাণমূলক ভূমিকা পেয়ে সন্তুষ্ট। এসব সরাসরি সম্পর্ক ছাড়াও মাদরাসা শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও নিজ নিজ অঙ্গন থেকে সমাজের সঙ্গে সাধ্যমত সম্পৃক্ত আছেন।
কওমি মাদরাসার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
রাজনৈতিক সচেতনতা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য প্রয়োজন, কওমি মাদরাসায় সেটি রয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশ নাগরিকের একান্ত অধিকার। কওমি মাদরাসা জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি সে সুযোগটিও রেখেছে। ব্যক্তিগত বোধ ও উৎসাহ থেকে কোনো শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করাও নাগরিকের দায়িত্ব ও অধিকারের মধ্যে পড়ে। কওমি মাদরাসায় সেই স্বাধীনতাও রয়েছে।
তবে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বা বিশৃঙ্খলার কোনো সুযোগ ও প্রচলন কওমি মাদরাসায় নেই। আর কওমি মাদরাসার সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার সব অভিযোগ অতিরঞ্জিত ও ভিত্তিহীন। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নানা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর গ্রেফতারকৃত ও দ-প্রাপ্তদের ওপর নিরপেক্ষ জরিপে এটি পরিষ্কারভাবেই প্রমাণিত। এরপরও অভিযোগ আরোপ নিতান্ত বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যমূলক। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি ইসলামি রাজনীতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অংশ। মাদরাসার ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতরা স্বাভাবিকভাবেই এই ইসলামি রাজনীতির পক্ষালম্বন করে থাকে। এ থেকে মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষী হওয়ার কোনো অধিকার কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সরকার বা রাষ্ট্রের নেই।
কওমি শিক্ষাই শিক্ষার মূলধারা
একথা সর্বজন বিদিত ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় প্রমাণিত, উপমহাদেশে বহু শতাব্দী আগে থেকে মাদরাসা শিক্ষাই ছিল জাতীয় ও প্রধান শিক্ষাব্যবস্থা। ব্রিটিশ আগ্রাসনের ফলে গোটা ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষায় সাময়িক বিপর্যয় দেখা দিলেও ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর পুনরুত্থান ও বিকাশ ঘটে। স্বাধীনতাকামী মূলধারার এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ কেটে ব্রিটিশরা এদেশে ধর্মবিমুখ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার প্রচলন করে। যা নৈতিক আদর্শের চেয়ে জীবিকা ও উপার্জনকেই অধিক প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত হয়। যার কুফল সমাজ ও রাষ্ট্র আজ হারে হারে টের পাচ্ছে। এদেশের উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও জাতীয় সমস্যাগুলোর পেছনে রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় পরিচালিত প্রচলিত সাধারণ শিক্ষিতরাই সর্বাত্মকভাবে জড়িত। এমতাবস্থায় এও লক্ষণীয় যে, আধুনিক শিক্ষিতদের মাঝে মাদরাসা শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় প্রতীয়মান করার প্রবণতা থাকলেও আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে মাদরাসা শিক্ষিতদের এরকম কোনো বিদ্বেষমূলক প্রচার প্রবণতা নেই। এরপরও যদি একটি দেশে একটিই মূল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন হয় তবে তা অবশ্যই মাদরাসাশিক্ষা হওয়া উচিত, কেননা এটিই এ অঞ্চলের পূর্ব থেকে চলে আসা শিক্ষার মূলধারা ছিল আর প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাটি ছিল দখলদার ব্রিটিশ প্রবর্তিত পরাধীন ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক শিক্ষা। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর স্বাধীন জাতির কাছে যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকার কথা ছিল না। আর যদি দু’টিকেই এক সঙ্গে করে সবার জন্য অপরিহার্য একটি গ্রহণযোগ্য মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষা সৃষ্টি করা যায় তবে সেটাও বিবেচ্য। এক্ষেত্রে এই মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের পর সবাই যার যার মতো ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার বিষয় বেছে নিতে পারবে তবে এ মৌলিক স্তরে ধর্মীয় শিক্ষার অবহেলা ও অপর্যাপ্ততা গ্রহণযোগ্য হবে না।
কওমি শিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও করণীয়
যদিও কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা তার ধর্মীয় আধ্যাত্মিক নৈতিক ও মানবিক মৌল উদ্দেশ্যের ওপর পূর্ণাঙ্গভাবেই প্রতিষ্ঠিতÑ এরপরও যুগের চাহিদা ও বাস্তবতার আলোকে শিক্ষার পূর্ণতার স্বার্থে আরও বেশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এর সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। জাগতিক, সামাজিক, কল্যাণমুখী আরও বিষয়াদি নিয়ে সমৃদ্ধ একটি সিলেবাস ঢেলে সাজালে কওমি শিক্ষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও কার্যকারিতা আরও অনেক বেড়ে যাবে, গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় বিধি বিধান ও নির্দেশনার ক্ষেত্রেও মৌলিক ও সময়োপযোগী বিশ্লেষণ কওমি মাদরাসায় হওয়া দরকার। গৎবাঁধা মুখস্ত বিদ্যার গ-ি ছেড়ে আরও গবেষণাধর্মী চর্চা প্রয়োজন। জ্ঞান-গবেষণার পাশাপাশি কওমি মাদরাসাগুলোকে নিজস্ব জনবল নিয়ে আরও অনেক বেশি সমাজসেবা ও কল্যাণমূলক তৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের নাগরিক যেন মাদরাসাগুলোকে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় ও আস্থার কেন্দ্র ভাবতে পারে। এ ছাড়াও এর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, সতর্ক নিরাপত্তা ও সুনাম সংরক্ষণের প্রতি আরও যতœবান হলে কওমি মাদরাসার শ্রেষ্ঠত্ব সহজেই প্রমাণিত হবে। আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, জনগণের সহযোগিতার পাশাপাশি নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতার জন্য স্থায়ী সম্পদ ও আয়ের উৎস সৃষ্টি করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে হবে। যা আত্মমর্যাদাকে আরও উজ্জ্বল ও বলিষ্ঠ করে তুলবে।
রাষ্ট্রের করণীয়
কওমি মাদরাসার ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রথম করণীয় হবে এর বিপক্ষে উদ্দেশ্যমূলক কোনো অপপ্রচারে কান না দিয়ে এতে কোনো অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা। সম্পূর্ণ আন্তরিক ও ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এই শিক্ষা ব্যবস্থার অবদান ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে গুরুত্ব দেয়া। সাক্ষরতা ও গণশিক্ষায় কওমি মাদরাসাকে নিঃশর্ত সহযোগিতা করা। যেসব মাদরাসা এতিম ও দরিদ্র শিশুদের থাকা খাওয়া ও শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে সেসব মাদরাসায় উন্নত আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া। প্রকৃত আলেমে দ্বীন তৈরির জন্য আরও অনেক বেশি দ্বীনি মাদরাসা বিস্তারে প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রদান করা। কওমি শিক্ষার্থী ও শিক্ষিতদের নাগরিক সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার বাধাগ্রস্ত না করা। সমাজ ও দেশের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই বিপুল জনশক্তিকে অবমূল্যায়ন বা উত্ত্যক্ত না করে সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশ ও জাতির ধর্মীয় সামাজিক নৈতিক সেবায় ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেয়া। বিশেষত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মানচিত্রের তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এই সৎ সভ্য ও বিশ্বস্ত শ্রেণীকে সব ধরনের গঠনমূলক ও উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে উদারভাবে সম্পৃক্ত করে দেশ ও জাতিকে উপকৃত করা।
জনসাধারণের করণীয়
জনসাধারণের করণীয় হলো কোনো রাজনৈতিক অপপ্রচার বা হুজুগে প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের বুদ্ধি বিবেক ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কওমি মাদরাসাকে মূল্যায়ন করা। প্রতিটি নাগরিক যদি একান্তে ভেবে দেখেন তার বাসস্থানে চুরি-ডাকাতি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, চলার পথে ছিনতাই, অফিস আদালতে ঘুষ দুর্নীতি, সন্তানের মাদকাসক্তি, মেয়ের ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়া বা আশপাশে ঘটে যাওয়া খুন খারাবি বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসের সঙ্গে কোন শিক্ষা ব্যবস্থার লোকেরা জড়িত, তবে কওমি শিক্ষিতদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অবশ্যই বাড়বে। স্বাধীন চিন্তা ও বিবেচনাশক্তিকে বাদ দিয়ে কোনো অমূলক আত্মঘাতি প্রোপাগান্ডায় তাল মেলানো কিছুতেই সৎ ও সচেতন নাগরিকের কাজ হতে পারে না। মাদরাসার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ও অবদানগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সবার উচিত এর পাশে দাঁড়ানো, পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং এর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা।
নিজ এলাকার শিক্ষার্থীরা নিজেদেরই সন্তান আর দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞান অর্জন করতে আসা শিক্ষার্থীরা এলাকাবাসীর মেহমান। তাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধা দেখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও এলাকার জনসাধারণেরই নৈতিক দায়িত্ব। ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ উপদেশ ও গঠনমূলক শাসনের দায়িত্বও এলাকাবাসীর রয়েছে। কওমি মাদরাসা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বানে ভেসে আসা কোনো সম্প্রদায় নয়। এরা এদেশেরই স্বাধীন নাগরিক, এ মাটিরই উজ্জ্বল সন্তান। এ জনপদেরই শহর নগর গ্রামগঞ্জের একেকটি সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবার থেকে তাদের এই আলোর পথের যাত্রা। ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের উচিত এই সভ্য ও আদর্শ মানুষগুলোর সহযাত্রী হওয়া।
সাধারণ মানুষের অনেকেরই ধারণাÑ মাদরাসায় শুধু কায়দা আমপারা, কুরআন তিলাওয়াত, দোয়া দরূদ, আজান, নামাজ, জানাজা, খতম ও মিলাদ পড়ানোর মতো আরও কিছু জিনিস শিখানো হয়। যারা এটা ভাবেন তারা হয়তো এ পর্যন্তই জ্ঞান রাখেন, কাজেই এর বাইরে এবং এর পরে আর বুঝার বা অনুমান করার সামর্থ্য তাদের নেই। আসল ব্যাপার হলো উপরে যে বিষয়গুলোর কথা বলা হয়েছে, এই বিষয়গুলো মাদরাসার ছাত্ররা ক্লাস ওয়ান-টুতেই শিখে ফেলে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় মাহফিলে ছোট ছোট বাচ্চারা জনসাধারণের সামনে এর প্রদর্শনীও করে থাকে। কথা হলো ১৬/১৭ বছরের মাদরাসা সিলেবাসে বাকি ১৪/১৫ বছর তারা তাহলে কী পড়ে বা কী শেখে?
বাকি বছরগুলোতে তাদের শিক্ষার সিলেবাস যথেষ্ট দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। তারা একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় আরবি বাংলা, ইংরেজি, উর্দু ও ফারসি ভাষা আয়ত্ত করে। বাংলাতো নিজেদের ভাষা, ইংরেজির ওপর দক্ষতার বিষয়টি না হয় বাদ দিলাম, আরবি উর্দু ও ফারসি ভাষায়ও যদি কেউ দক্ষতা অর্জন করে সেটা প্রশংসনীয় ও মেধার পরিচয় নয় কি? এ বিশ্বায়নের যুগে কতোজনের এ বাড়তি যোগ্যতাটি থাকে? এগুলোও তো ভাষা হিসেবে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পৃথিবীতে ভাষা বলতে শুধু ইংরেজিকেই মনে করা প্রকৃত জ্ঞানী মানুষের কাজ নয়। এরপর আরও পড়া হয় বাংলাদেশ, উপমহাদেশ, বিশ্ব ও ইসলামের ইতিহাস। ভূগোল, সমাজ বিজ্ঞান, গণিত। একই সঙ্গে বাংলা ফার্সী ও আরবি সাহিত্য। যুক্তিবিদ্যা, কৌশল বিদ্যা, দর্শন বাংলা ও আরবি ভাষার সম্পূর্ণ ব্যাকরণ। পড়ানো হয় ইসলামি অর্থনীতি ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান। ইসলামি আইন ও বিচার বিধান। মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নৈমিত্তিক বিষয়ের ইসলামি বিধান, যথা ব্যবসা-বাণিজ্য, বিয়ে-দাম্পত্য জীবন, লেনদেন, উত্তরাধিকার আইন, ভ্রমণ, যুদ্ধ, পরিবার, আত্মীয়তা, প্রতিবেশী, ঘুম, পানাহার, ওজু-গোসল, জন্ম-মৃত্যু, জীবন-জীবিকা, ফসল, গবাদি পশু, ভূমি, সমুদ্র, রোগ, চিকিৎসা, শ্রম-শ্রমিক, ইত্যাদি। পাশাপাশি পড়ানো হয় ইবাদাত ও আধ্যাত্মিকতার সঠিক নিয়ম কানুন ও তাৎপর্য। সেসব বিধি বিধান কুরআন ও হাদিসের নির্দেশনার ভিত্তিতে গবেষণা করে বের করার জন্য রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা, সেটাও পড়তে হয়। বিধি বিধানকে বলা হয় ‘ফিকহ’ আর এর নীতিমালাকে বলা হয় ‘উসুলে ফিকহ’। শুধু ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসগুলোর ব্যাপারেই সবিস্তারে দীর্ঘ প্রামাণ্য গবেষণা করতে হয়, একে বলা হয় ‘আকাইদ’।
গভীর শ্রদ্ধা ও সতর্কতার সঙ্গে ইসলামের প্রবর্তক, শুধু মুসলমানদের নয়, বিশ্বমানবতার পথ প্রদর্শক মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা.-এর জীবনী, জীবনাদর্শ ও জীবনদর্শনের পুঙ্খানুপুঙ্খ গবেষণা ও বিশ্লেষণ করে আত্মস্থ করা হয়। মানুষের জীবনের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংসারিক, অর্থনৈতিক, বিচারিক, আধ্যাত্মিক, নৈতিক এবং পারিবারিক সকল ছোট বড় বিষয়ের ইসলামি সমাধান খুঁজে নিতে মহানবীর সা. অসংখ্য হাদিস সরাসরি রাসুল সা. থেকে নিয়ে নিজ পর্যন্ত দেড় হাজার বছরের সুদীর্ঘ শিক্ষাপরম্পরার সনদসহ শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ এবং ব্যাখ্যাসহকারে পড়ে আত্মস্থ করতে হয়। হাদিসের এই উল্লেখযোগ্য শ্রেষ্ঠ ৬টি গ্রন্থকেই ‘সিহাহ সিত্তাহ’ বলা হয়। সর্বোপরি রাসুলের নির্দেশনার আলোকে মহাগ্রন্থ পবিত্র কুরআনের প্রতিটি আয়াতের নিঃসৃত বার্তা ও বিধান প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যাসহকারে আত্মস্থ করতে হয়।
এ ছাড়াও সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, কম্পিউটার শিক্ষা, বক্তৃতা, বিতর্ক, সংগীত, সাহিত্য, পত্রিকা, খেলাধুলা, শরীরচর্চা, শিক্ষাসফরসহ আরও অনেক মৌলিক ও আনুষঙ্গিক বিষয় ও বিভাগ এখন মাদরাসায় রয়েছে যা সংক্ষেপে তুলে ধরা সম্ভব নয়। বিশেষ করে ত্রিশ পারা কুরআনের আরবি আয়াতের পূর্ণাঙ্গ ভলিউম হুবহু মুখস্থ করার মতো অসম্ভবকেও যে শিশুরা সম্ভব করে দেখায় তাদের দরিদ্র-এতিম বলে তুচ্ছজ্ঞান না করে তাদের কাছে বিনয়াবনত হওয়া উচিত। এ অবদানটি শুধুই মাদরাসার, অন্য কারও নয়। মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে নেতিবাচক চিন্তা ও মন্তব্যকারীদের পক্ষে হয়তো কয়েক পৃষ্ঠার বাংলা চটি বইও দাঁড়ি, কমা, কোলন, প্যারাসহ মুখস্ত করা সারাজীবনেও সম্ভব নয়। কাজেই কওমি মাদরাসার সিলেবাস সম্বন্ধে ভালোভাবে না জেনে সমালোচনা করা মোটেও সমীচীন নয়। আর হ্যাঁ, মাদরাসা ছাত্রদের কিছু বিশেষ রীতি ও বৈশিষ্ট্য আছে, তারা পাঞ্জাবি, পায়জামা, টুপি অথবা লম্বা কুর্তা পড়ে, ইসলামের পোশাকবিধান ও রাসুলের সুন্নত অনুসারেই তারা নিজেদের জীবন সাজায়, এটি তাদের ব্যক্তিগত অধিকার। এ ছাড়া কওমি মাদরাসায় মেঝেতে বসে পড়ালেখা ও খাওয়া দাওয়া চলে। এক্ষেত্রে চাদর, ফরাশ বা কার্পেট ব্যবহার করা হয়, মেঝে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন রাখা হয়। এটাও রাসুলের সুন্নত ও ইলমে দ্বীনের ঐতিহ্য অনুসারেই হয়। পয়সা বা চেয়ার টেবিলের অভাবে নয়, এ ধরনের আরও অনেক বিষয়কেই নিন্দনীয়রূপে প্রচার করা হয় যা সম্পূর্ণ অজ্ঞতাপ্রসূত ও অমূলক।
কওমি শিক্ষার্থীদের উপার্জন, কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক অবদান
প্রথমত শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য যদি ‘নীতিবান আদর্শ মানুষরূপে নিজেকে গড়া’ হয় তবে মাদরাসায় সেটা ভালোভাবেই হয়। পাশাপাশি ব্যক্তির সচ্ছল জীবন, অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা ও সম্মানজনক উপার্জনও যদি উদ্দেশ্য হয় তবে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে সেটাও হয়ে যায়। যদিও আর্থিক সমৃদ্ধি আর সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য শিক্ষাকে প্রধান অবলম্বন মনে করা উচিত নয়, ততোটা বাস্তবও নয়। সমাজের বিশেষ ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মধ্যে অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত বেশি হওয়াই এর প্রমাণ। দেশের বেকার সমস্যা যখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে থাকে। সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা যখন সামান্য বেতনের একটি চাকরি পেতে হন্যে হয়ে ঘুরে জুতো ক্ষয় করে। পরিবার ও সমাজ থেকে উপেক্ষা অবমাননা পেয়ে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। রাষ্ট্র যখন শিক্ষিত বেকারের চাপ নিতে হিমশিম খায় তখনও লক্ষ্য করলে দেখা যাবে মাদরাসা শিক্ষিত কোনো আলেম শহর বা গ্রামের কোথাও সম্পূর্ণ বেকার নেই। কিছু না কিছু উপার্জন করে অল্পে তুষ্ট সুখি জীবনযাপন করছে। নিজের কর্মক্ষেত্র নিজেই খুঁজে নিচ্ছে। রাষ্ট্রের ওপর বেকারত্বের চাপ বাড়াচ্ছে না। এটা সাধারণ সমীকরণ।
এর ব্যতিক্রম অনেক অনেক কওমি আলেম যথেষ্ট সচ্ছলতার সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য ও উৎপাদনে সাফল্যের স্বাক্ষর রাখছেন। শিক্ষা সাহিত্য সাংবাদিকতা সংস্কৃতি গণমাধ্যম ব্যবসা ও রাজনীতিতে নিজ প্রতিভার যথার্থ স্বাক্ষর রাখছেন এমন আলেমের সংখ্যা নেহাত কম নয়। একটি বাস্তব সত্য হলো কওমি মাদরাসার শিক্ষার্থীরা এই শিক্ষা ব্যবস্থার বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যে অভ্যস্ত ও প্রশিক্ষিত হয়ে নিজেদের মেধাকে এমনভাবে শাণিত করতে পারে, তারা ব্যক্তিগতভাবে সরকারি আলিয়া মাদরাসা বা স্কুল-কলেজের মাধ্যমিক/উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিলে যথেষ্ট ভালো ফলাফল করতে সক্ষম হয়। এ প্রক্রিয়ায় অগ্রসর অনেকেই এখন কলেজ ভার্সিটির অধ্যাপনা, বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদ এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পদনা, পরিচালনা ও নির্বাহী দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন। আছেন আইনশৃঙ্খলা ও সামরিক বাহিনীতেও। কওমি আলেমদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ প্রবাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিতে বিপুল ভূমিকা রাখছেন। এটি যেকোনো নিরপেক্ষ জরিপে প্রমাণ হতে পারে। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত বেশ কজন স্বনামধন্য কওমি আলেম দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে গণমানুষের রায়ে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদেও এসেছেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পালন করেছেন। গণমুখী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত থাকলে আরও অনেক সৎ ও যোগ্য আলেমকে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণ করবে।
এসব অন্য পেশা বাদ রেখে আলেমরা যদি শুধু ধর্মীয় দায়িত্ব পালনেও সীমাবদ্ধ থাকেন তবুও পনেরো কোটি মুসলিম নাগরিকের ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এবং ৬৮ হাজারেরও বেশি গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় ও রাজধানীসহ সকল শহরের মহল্লায় মহল্লায় প্রতিষ্ঠিত কয়েক লক্ষ মসজিদের খতিব ইমাম ও মুয়াজ্জিনের পদ পূরণের জন্যও আরও অনেক পূর্ণাঙ্গ আলেমের প্রয়োজন। রাষ্ট্রের জনগণের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন সরবরাহের ব্যবস্থাতো মাদরাসা ছাড়া অন্যত্র নেই। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ও মসজিদ মাদরাসা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে বৈ কমছে না। তাই আরও বেশি দ্বীনের আলেম তৈরি হওয়ার জন্য আরও বেশি মাদরাসা প্রতিষ্ঠা হওয়া প্রয়োজন। সমাজে একটি ধারণা এমনও আছে, মাদরাসায় পড়ে তো শুধু মাওলানাই হয়, ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, শিল্পী, আইনজীবী, গণিতবিদ, আইটিবিশেষজ্ঞ, সংস্কৃতিকর্মী ইত্যাদি কিছুই তো হয় না। এটিও একটি চরম মূর্খতাপ্রসূত কথা। মাদরাসা তো আলেম বানানোর জন্যই প্রতিষ্ঠিত। অন্য কিছু এখানে হওয়ার তো কথা না। মেডিকেল কলেজ থেকে কেন ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে না বা বুয়েট থেকে কেন ডাক্তার হতে পারছে না এ প্রশ্ন যেমন অবান্তর, আগের প্রশ্নটিও তাই। মাদরাসা থেকে প্রকৃত ইলমে দ্বীন সম্পন্ন পূর্ণাঙ্গ আলেম পাওয়া যাচ্ছে কিনা সেটাই আসল বিষয়। বাড়তি যোগ্যতা প্রশংসনীয়, তবে মুখ্য নয়।
কওমি শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য
কোনো মানুষই দোষ গুণ থেকে মুক্ত নয়। তবে কওমি শিক্ষার্থীদের চরিত্র বিশ্লেষণে এমন অনেক বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় যা দেশের সাধারণ ও আধুনিক শিক্ষার্থীদের বেলায় নগণ্য। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস, অস্ত্রবাজি, হল দখলের মতো কোনো ঘটনা দেশের কওমি মাদরাসাগুলোতে নেই। নেই শিক্ষক লাঞ্ছনার মতো ঘৃণ্য অধ্যায়। নেই নকল প্রবণতা। এমনকি এ মাদরাসাগুলো ভর্তিবাণিজ্য থেকেও মুক্ত। এ ছাড়া দেশ ও সমাজের যাবতীয় প্রধান সমস্যা ও সঙ্কটগুলোর সঙ্গে কওমি ছাত্রদের কোনোরকম সম্পর্ক নেই বলা যায়। যেমন সন্ত্রাস, মাদক, হত্যা, ধর্ষণ, ইভটিজিং, চোরাচালান, সুদ, ঘুষ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, হুমকি, অপহরণ, নগ্নতা, অশ্লীলতা, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, কালোবাজারী, প্রতারণা, যৌতুক, নারী নির্যাতন, অপরাজনীতি ইত্যাদি। তবে ছিদ্রান্বেষণকারীদের কাছে বিচ্ছিন্ন কোনো তথ্য থাকলেও তা সাধারণ শিক্ষাঙ্গনের তুলনায় শতকরা ১ ভাগেরও কম। ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়াই যদি প্রথম লাভ হয়ে থাকে, অপকার না পাওয়াই যদি উপকার হয়ে থাকে তবে বর্তমান সামাজিক নৈতিক ও চারিত্রিক অবক্ষয়কালে কওমি শিক্ষার্থী ও আলেমদের দ্বারা দেশ ও জাতি যথেষ্ট লাভবান ও উপকৃত। দেশের বৃদ্ধাশ্রমগুলোতে জরিপ করে দেখলে কোনো কওমি আলেমের পিতা-মাতার সন্ধান পাওয়া কঠিন হবে। তদ্রƒপ দেশের সকল অপরাধ ও অপরাধীদের ওপর গবেষণা করলে এমনকি পুলিশের কালো তালিকা ও জেলখানাগুলো খোঁজ করলে কওমি শিক্ষিতদের নৈতিক উজ্জ্বলতা প্রমাণিত হবে। এসবই কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সুফল।
কওমি মাদরাসার অগ্রসর চিন্তা
উপমহাদেশে বিশেষ করে বাংলাদেশে কওমি মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থা এমন কিছু আধুনিক ও বিজ্ঞান সম্মত ধারণার উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করে আসছে যার প্রচলন সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্র অনেক পরে করেছে। যেমন জাতীয়ভাবে সাক্ষরতা অর্জনের জন্য শহর ও গ্রামের অসহায় দরিদ্র শিশুদের বিনা বেতনে থাকা খাওয়াসহ পড়াশোনার সুবিধা প্রদান। প্রাতঃ ও নৈশকালীন বয়স্কশিক্ষা, গণশিক্ষার এই প্রজেক্টটি অনেক মাদরাসায় আগে থেকেই বিদ্যামান। দূরের শিক্ষার্থীদের জন্য অথবা বাড়িতে পড়াশোনার উপযুক্ত পরিবেশ নেই এমন শিক্ষার্থীদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নিরাপদ সুবিধাজনক আবাসিক ব্যবস্থা গ্রহণ। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতার সঠিক নিরীক্ষণের জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপত্রের প্রচলনসহ অনেক আধুনিক চিন্তা ও ব্যবস্থা শত বছর আগে থেকেই কওমি মাদরাসায় প্রচলিত রয়েছে আর রাষ্ট্র এসব অতি সাম্প্রতিক সময়ে শুরু করছে মাত্র। এ ছাড়াও আরেকটি বিশেষ দিক হলোÑ মাধ্যমিক থেকে নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক, ¯œাতক, ¯œাতোকোত্তর, ও উচ্চতর শিক্ষার সকল শ্রেণীর বহুমূল্যের মৌলিক পাঠ্যপুস্তক মাদরাসার গ্রন্থাগার থেকে বিনামূল্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে সারা বছরের জন্য ধার প্রদান করা হয়। এতে শিক্ষার্থীরা হাজার হাজার টাকা খরচ থেকে বেঁচে যায়। এই আধুনিক ও উচ্চশিক্ষাবান্ধব ব্যবস্থাটি সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় রাষ্ট্র এখনও গ্রহণ করতে পারেনি। এমন আরও অনেক দিক থেকে কওমি মাদরাসা যথেষ্ট অগ্রসরতার প্রমাণ রেখেছে।
স্বতন্ত্র কওমি মহিলা মাদরাসা
দেশের অসংখ্য ছেলেদের মাদরাসার পাশাপাশি সম্পূর্ণ পৃথক নিরাপদ ও স্বাধীন ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কওমি মহিলা মাদরাসার সংখ্যাও এখন কম নয়। শুধু ঢাকাতেই এর পরিমাণ উল্লেখযোগ্য। রয়েছে সারা দেশ জুড়েই। পরীক্ষায় তারা ফলাফলও ভালো করছে। আবাসিক অনাবাসিক দুরকম ব্যবস্থাই আছে। শহরের মহিলা মাদরাসাগুলো সমাজের অভিজাত ধনাঢ্য শিক্ষিত পরিবারের শিক্ষার্থীদের দ্বারাই বহুলাংশে পরিপূর্ণ। সাধারণত এসব মাদরাসার প্রিন্সিপাল থেকে পিয়ন পদ পর্যন্ত নারীদের অবস্থান। তবে প্রশাসন, ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তাসহ বিশেষ অনিবার্য কিছু দায়িত্বে যোগ্য পুরুষ আলেমও থাকেন। কঠোর নিরাপত্তা ও সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার জন্য সমাজে মহিলা মাদরাসাগুলো গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। নারী নিরাপত্তাহীনতার এই যুগে আদরের মেয়েকে মহিলা মাদরাসায় পড়তে পাঠিয়ে তুলনামূলক নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন অভিভাবকরাও। মেয়েরা দক্ষতার সঙ্গে আলেম ও হাফেজ হয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিভার সাক্ষর রাখছে। পড়া শেষ হওয়ার আগেই কর্মসংস্থানও হয়ে যাচ্ছে। সঠিক বয়সে সুপাত্র খুঁজে পেতেও অভিভাবকদের তেমন বেগ পেতে হচ্ছে না। মেয়েদের আইবুড়ো করে ঘরে বসিয়ে দুশ্চিন্তায় ভুগতে হচ্ছে না। সুশিক্ষায় আলোকিত এই মেয়েরা সংসার ও কর্মজীবনে কোনো রকম নির্যাতন বা কুসংস্কারের শিকারও হচ্ছে না। আদর্শ মানুষ ও সুনাগরিক করে গড়ে তুলতে পারছে নিজের সন্তানকেও। ভবিষ্যত জাতির জন্য তারা হয়ে উঠছে একেকজন আদর্শ মা।
কওমি মাদরাসার সমাজ সংশ্লিষ্টতা
বাংলাদেশ যেহেতু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশ তাই এই বৃহত্তর মুসলিম সমাজে ইসলামি শিক্ষাগার কওমি মাদরাসার সামাজিক সংশ্লিষ্টতাও অনেক গাঢ় ও অনিবার্য। সমাজ জীবনের যেকোনো পর্যায়ের ধর্মীয় নির্দেশনার কাজটি মাদরাসা করে থাকে। সাধারণভাবে নামাজ, দোয়া, খতম, জানাজা, মাসলা-মাসায়েল, দ্বীনি ফতোয়া, কুরআন শিক্ষা, ইত্যাদি উপলক্ষে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মাদরাসা ও আলেমদের ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে। যেমনটি ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর, আইনজীবীর সঙ্গে মক্কেলের, প্রকৌশলীর সঙ্গে নির্মাতার থাকে। কাজেই অন্যান্য পেশাজীবী আধুনিক শিক্ষিতরাও যে তাদের পেশাগত সম্পর্কের বাইরে সমাজের সঙ্গে আরও খুব বেশি সম্পৃক্ত থাকেন, তা কিন্তু নয়। এক্ষেত্রে মাদরাসাকে সমাজ বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, গ্রামবাংলায় মাদরাসা কেন্দ্রিক বার্ষিক মাহফিল বা লোকশিক্ষার আয়োজন সমাজের সর্বস্তরের মানুষের উৎসব বিনোদনের সংস্কৃতি হয়ে আছে। এমনকি গ্রামের ওয়াজ মাহফিলকে কেন্দ্র করে বিশেষ মেলা ও বাজার বসে থাকে, যা নাগরিকদের নানা প্রয়োজন মেটায়। এ উপলক্ষে বাড়িতে বাড়িতে নাইওরি ও মেহমান আসে। পারিবারিক অনুষ্ঠানাদিও এই সুযোগে পালিত হয়। অনেক জনপদের মানুষ মাদরাসা থেকে বিভিন্ন সামাজিক সেবা নিরাপত্তা ও কল্যাণমূলক ভূমিকা পেয়ে সন্তুষ্ট। এসব সরাসরি সম্পর্ক ছাড়াও মাদরাসা শিক্ষিত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও নিজ নিজ অঙ্গন থেকে সমাজের সঙ্গে সাধ্যমত সম্পৃক্ত আছেন।
কওমি মাদরাসার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা
রাজনৈতিক সচেতনতা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য প্রয়োজন, কওমি মাদরাসায় সেটি রয়েছে। রাজনৈতিক চিন্তা ও স্বাধীন মত প্রকাশ নাগরিকের একান্ত অধিকার। কওমি মাদরাসা জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি সে সুযোগটিও রেখেছে। ব্যক্তিগত বোধ ও উৎসাহ থেকে কোনো শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণ করাও নাগরিকের দায়িত্ব ও অধিকারের মধ্যে পড়ে। কওমি মাদরাসায় সেই স্বাধীনতাও রয়েছে।
তবে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস বা বিশৃঙ্খলার কোনো সুযোগ ও প্রচলন কওমি মাদরাসায় নেই। আর কওমি মাদরাসার সঙ্গে জঙ্গি সম্পৃক্ততার সব অভিযোগ অতিরঞ্জিত ও ভিত্তিহীন। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নানা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত নিষিদ্ধ সংগঠনগুলোর গ্রেফতারকৃত ও দ-প্রাপ্তদের ওপর নিরপেক্ষ জরিপে এটি পরিষ্কারভাবেই প্রমাণিত। এরপরও অভিযোগ আরোপ নিতান্ত বিদ্বেষপ্রসূত ও উদ্দেশ্যমূলক। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে পুঁজিবাদ ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির পাশাপাশি ইসলামি রাজনীতিও একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী অংশ। মাদরাসার ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিতরা স্বাভাবিকভাবেই এই ইসলামি রাজনীতির পক্ষালম্বন করে থাকে। এ থেকে মাদরাসার প্রতি বিদ্বেষী হওয়ার কোনো অধিকার কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠী, সরকার বা রাষ্ট্রের নেই।
কওমি শিক্ষাই শিক্ষার মূলধারা
একথা সর্বজন বিদিত ও ঐতিহাসিক বাস্তবতায় প্রমাণিত, উপমহাদেশে বহু শতাব্দী আগে থেকে মাদরাসা শিক্ষাই ছিল জাতীয় ও প্রধান শিক্ষাব্যবস্থা। ব্রিটিশ আগ্রাসনের ফলে গোটা ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষায় সাময়িক বিপর্যয় দেখা দিলেও ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর পুনরুত্থান ও বিকাশ ঘটে। স্বাধীনতাকামী মূলধারার এ শিক্ষা ব্যবস্থাকে পাশ কেটে ব্রিটিশরা এদেশে ধর্মবিমুখ স্কুল ও কলেজ শিক্ষার প্রচলন করে। যা নৈতিক আদর্শের চেয়ে জীবিকা ও উপার্জনকেই অধিক প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত হয়। যার কুফল সমাজ ও রাষ্ট্র আজ হারে হারে টের পাচ্ছে। এদেশের উল্লেখযোগ্য সামাজিক ও জাতীয় সমস্যাগুলোর পেছনে রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতায় পরিচালিত প্রচলিত সাধারণ শিক্ষিতরাই সর্বাত্মকভাবে জড়িত। এমতাবস্থায় এও লক্ষণীয় যে, আধুনিক শিক্ষিতদের মাঝে মাদরাসা শিক্ষাকে অপ্রয়োজনীয় প্রতীয়মান করার প্রবণতা থাকলেও আধুনিক শিক্ষার বিরুদ্ধে মাদরাসা শিক্ষিতদের এরকম কোনো বিদ্বেষমূলক প্রচার প্রবণতা নেই। এরপরও যদি একটি দেশে একটিই মূল শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন হয় তবে তা অবশ্যই মাদরাসাশিক্ষা হওয়া উচিত, কেননা এটিই এ অঞ্চলের পূর্ব থেকে চলে আসা শিক্ষার মূলধারা ছিল আর প্রচলিত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাটি ছিল দখলদার ব্রিটিশ প্রবর্তিত পরাধীন ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক শিক্ষা। ব্রিটিশ চলে যাওয়ার পর স্বাধীন জাতির কাছে যার কোনো গ্রহণযোগ্যতা থাকার কথা ছিল না। আর যদি দু’টিকেই এক সঙ্গে করে সবার জন্য অপরিহার্য একটি গ্রহণযোগ্য মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষা সৃষ্টি করা যায় তবে সেটাও বিবেচ্য। এক্ষেত্রে এই মৌলিক প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের পর সবাই যার যার মতো ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষার বিষয় বেছে নিতে পারবে তবে এ মৌলিক স্তরে ধর্মীয় শিক্ষার অবহেলা ও অপর্যাপ্ততা গ্রহণযোগ্য হবে না।
কওমি শিক্ষার সীমাবদ্ধতা ও করণীয়
যদিও কওমি শিক্ষা ব্যবস্থা তার ধর্মীয় আধ্যাত্মিক নৈতিক ও মানবিক মৌল উদ্দেশ্যের ওপর পূর্ণাঙ্গভাবেই প্রতিষ্ঠিতÑ এরপরও যুগের চাহিদা ও বাস্তবতার আলোকে শিক্ষার পূর্ণতার স্বার্থে আরও বেশি আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এর সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। জাগতিক, সামাজিক, কল্যাণমুখী আরও বিষয়াদি নিয়ে সমৃদ্ধ একটি সিলেবাস ঢেলে সাজালে কওমি শিক্ষার গুরুত্ব, তাৎপর্য ও কার্যকারিতা আরও অনেক বেড়ে যাবে, গ্রহণযোগ্যতাও বাড়বে। সেই সঙ্গে ধর্মীয় বিধি বিধান ও নির্দেশনার ক্ষেত্রেও মৌলিক ও সময়োপযোগী বিশ্লেষণ কওমি মাদরাসায় হওয়া দরকার। গৎবাঁধা মুখস্ত বিদ্যার গ-ি ছেড়ে আরও গবেষণাধর্মী চর্চা প্রয়োজন। জ্ঞান-গবেষণার পাশাপাশি কওমি মাদরাসাগুলোকে নিজস্ব জনবল নিয়ে আরও অনেক বেশি সমাজসেবা ও কল্যাণমূলক তৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সমাজের সর্বস্তরের নাগরিক যেন মাদরাসাগুলোকে নিজেদের নিরাপদ আশ্রয় ও আস্থার কেন্দ্র ভাবতে পারে। এ ছাড়াও এর স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা, সতর্ক নিরাপত্তা ও সুনাম সংরক্ষণের প্রতি আরও যতœবান হলে কওমি মাদরাসার শ্রেষ্ঠত্ব সহজেই প্রমাণিত হবে। আরেকটি জরুরি বিষয় হলো, জনগণের সহযোগিতার পাশাপাশি নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতার জন্য স্থায়ী সম্পদ ও আয়ের উৎস সৃষ্টি করে আত্মনির্ভরশীল হয়ে উঠতে হবে। যা আত্মমর্যাদাকে আরও উজ্জ্বল ও বলিষ্ঠ করে তুলবে।
রাষ্ট্রের করণীয়
কওমি মাদরাসার ব্যাপারে রাষ্ট্রের প্রথম করণীয় হবে এর বিপক্ষে উদ্দেশ্যমূলক কোনো অপপ্রচারে কান না দিয়ে এতে কোনো অযাচিত হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকা। সম্পূর্ণ আন্তরিক ও ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে এই শিক্ষা ব্যবস্থার অবদান ও বৈশিষ্ট্যগুলোকে গুরুত্ব দেয়া। সাক্ষরতা ও গণশিক্ষায় কওমি মাদরাসাকে নিঃশর্ত সহযোগিতা করা। যেসব মাদরাসা এতিম ও দরিদ্র শিশুদের থাকা খাওয়া ও শিক্ষার সুযোগ দিচ্ছে সেসব মাদরাসায় উন্নত আবাসনের ব্যবস্থা করে দেয়া। প্রকৃত আলেমে দ্বীন তৈরির জন্য আরও অনেক বেশি দ্বীনি মাদরাসা বিস্তারে প্রশাসনিক সহযোগিতা প্রদান করা। কওমি শিক্ষার্থী ও শিক্ষিতদের নাগরিক সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার বাধাগ্রস্ত না করা। সমাজ ও দেশের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই বিপুল জনশক্তিকে অবমূল্যায়ন বা উত্ত্যক্ত না করে সঠিক মূল্যায়নের মাধ্যমে দেশ ও জাতির ধর্মীয় সামাজিক নৈতিক সেবায় ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেয়া। বিশেষত দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মানচিত্রের তৃণমূল পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা এই সৎ সভ্য ও বিশ্বস্ত শ্রেণীকে সব ধরনের গঠনমূলক ও উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে উদারভাবে সম্পৃক্ত করে দেশ ও জাতিকে উপকৃত করা।
জনসাধারণের করণীয়
জনসাধারণের করণীয় হলো কোনো রাজনৈতিক অপপ্রচার বা হুজুগে প্রভাবিত না হয়ে নিজেদের বুদ্ধি বিবেক ও বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে কওমি মাদরাসাকে মূল্যায়ন করা। প্রতিটি নাগরিক যদি একান্তে ভেবে দেখেন তার বাসস্থানে চুরি-ডাকাতি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, চলার পথে ছিনতাই, অফিস আদালতে ঘুষ দুর্নীতি, সন্তানের মাদকাসক্তি, মেয়ের ইভটিজিংয়ের শিকার হওয়া বা আশপাশে ঘটে যাওয়া খুন খারাবি বিশৃঙ্খলা ও সন্ত্রাসের সঙ্গে কোন শিক্ষা ব্যবস্থার লোকেরা জড়িত, তবে কওমি শিক্ষিতদের প্রতি তার শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা অবশ্যই বাড়বে। স্বাধীন চিন্তা ও বিবেচনাশক্তিকে বাদ দিয়ে কোনো অমূলক আত্মঘাতি প্রোপাগান্ডায় তাল মেলানো কিছুতেই সৎ ও সচেতন নাগরিকের কাজ হতে পারে না। মাদরাসার ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য ও অবদানগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে সবার উচিত এর পাশে দাঁড়ানো, পৃষ্ঠপোষকতা করা এবং এর সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করা।
নিজ এলাকার শিক্ষার্থীরা নিজেদেরই সন্তান আর দূর-দূরান্ত থেকে জ্ঞান অর্জন করতে আসা শিক্ষার্থীরা এলাকাবাসীর মেহমান। তাদের সুখ-দুঃখ, সুবিধা-অসুবিধা দেখার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও এলাকার জনসাধারণেরই নৈতিক দায়িত্ব। ক্ষেত্রবিশেষে প্রয়োজনীয় পরামর্শ উপদেশ ও গঠনমূলক শাসনের দায়িত্বও এলাকাবাসীর রয়েছে। কওমি মাদরাসা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা বানে ভেসে আসা কোনো সম্প্রদায় নয়। এরা এদেশেরই স্বাধীন নাগরিক, এ মাটিরই উজ্জ্বল সন্তান। এ জনপদেরই শহর নগর গ্রামগঞ্জের একেকটি সম্ভ্রান্ত বনেদি পরিবার থেকে তাদের এই আলোর পথের যাত্রা। ধর্মপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক সকল নাগরিকের উচিত এই সভ্য ও আদর্শ মানুষগুলোর সহযাত্রী হওয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন