আপনাদের বলে রাখি, আয়লানের নামের শেষে যে কুর্দি বিশেষণটি দেখছেন, সেটি একসময় তার নামের শেষে ছিলো না। যখন সে জন্ম নিয়েছিলো, তিন বছর আগে সিরিয়ার কোবানি শহরে, তখন তার নাম রাখা হয়— আয়লান শেনু। বংশীয় নাম, শেনু। কিন্তু এ নামটি সে ব্যবহারের লায়েক হয়নি কখনো। কারণ, জন্মের পরপরই তাকে মায়ের কোলে চড়ে পালাতে হয় কোবানি থেকে। শহর থেকে শহরে, দেশ থেকে দেশান্তরে। অবশেষে তুরস্কে, রিফিউজি ক্যাম্পে আকিকাহীনভাবেই আয়লানের নামের শেষে সিল মারা হয় কুর্দি! আয়লান আলকুর্দ! কুর্দি পরিচয় দিলে রিফিউজি ক্যাম্পে ধর্মীয় প্রান্তিক নৃগোষ্ঠী হিসেবে দুবেলা দুটো রুটি মেলে চারজনের পরিবারের। বেঁচে থাকতে হলে কুর্দি আর এজিদিই বা কী, সবার আগে পেটের ক্ষুধা!
ততোদিনে খেলাফতের দামামা বেজে উঠেছে সিরিয়া-ইরাকে। কুর্দি বংশোদ্ভূত আবদুল্লাহ কুর্দি, আয়লানের বাবা অপেক্ষায়— একদিন যুদ্ধ থামবে। ফিরবেন নিজ লোকালয়ে, কোবানি শহরে। কিন্তু যুদ্ধ বরং সোৎসাহে ভাঙতে থাকে যাবতীয় স্বপ্ন। তবে কি কানাডা চলে যাবেন স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে? ভ্যাঙ্কুবারে আয়লানের এক মামা থাকেন, মোহাম্মদ। চেষ্টা শুরু হলো।
আড়াই বছর পর। এ বছরের গোড়ার দিকে কোবানির যুদ্ধ কিছুটা ধীর। বুকে সাহস নিয়ে আবদুল্লাহ কুর্দি স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বহু পথ মাড়িয়ে ফিরলেন কোবানিতে। উদ্বাস্তু শিবিরের পরাধীন তাঁবুতে কি ঘুম হয় রাত হলেই? হয় না। বুকের উপর শেকল পড়ে থাকে। পরাধীন নিঃশ্বাসের জিঞ্জির।
কোবানিতে এলেন ঠিকই কিন্তু টিকতে পারলেন না। আবারও একে-47 রাইফেলের বারুদে কার্তুজ সঙ্গীন করে ফেললো তাদের জীবন। খেলাফত খেলাফত নামের মারণযুদ্ধ আবারও ঘরছাড়া করলো আয়লানদের। গন্তব্য ফের তুর্কি উদ্বাস্তু শিবির। আবার চললো কানাডা যাওয়ার চিন্তা-তদ্বির।
সেপ্টেম্বর ২। সাগরপথে যেতে হবে গ্রিসের কস দ্বীপে। গ্রিসে একবার যেতে পারলে কানাডার ভিসা পাওয়া যাবে, এ-ই ছোট্ট একটা আশা।
রাতের আঁধারে পালালেন উদ্বাস্তু শিবির থেকে। সঙ্গে স্ত্রী রেহানা, ছেলে গালিব ও আয়লান। আরও কয়েকটি পরিবার। একটুখানি বেঁচে থাকার আশায়। যুদ্ধহীন, ক্ষুধাহীন পৃথিবীতে মানুষের মতো।
তুরস্কের বদরুম উপকূল থেকে ছোট একটা প্লাস্টিকের নৌকায় চড়লো তারা। ছয়জনের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন নৌকায় গাদাগাদি করে ছাব্বিশজন! কস দ্বীপের দূরত্ব মাত্র ৪ কিলোমিটার—আড়াই মাইল!
নৌকা সাগরে ভাসলো। ঢেউ উঠছে বড় বড়। তিন বছরের ছোট্ট আয়লান মায়ের বুকে মুখ গুঁজে আছে। কালো রঙের রাত্রীকালীন ঢেউগুলো দেখে খুব ভয় লাগছে আয়লানের। ঢেউয়ের তোড়ে ভীষণ দুলছে নৌকাটি। ভয়ে শব্দ কর কেঁদে ফেললো আয়লান। মা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন তিন বছরের আয়লানকে। উপকূলে ফেলে আসা বাতিগুলো দেখে মায়ের মনটা কেমন যেন করে উঠলো।
সাগরের নোনাপানি ছিটকে এসে লাগছে আয়লানের শরীরে। ওর পরনে লাল রঙের টি-শার্ট আর গাঢ় নীল শর্টস। ছোট্ট পা দুটোতে কালো কেডস। মা রেহানা পানির ছিটা থেকে ছেলেকে বাঁচাতে গায়ের উড়না দিয়ে ঢেকে নিলেন ভালো করে। তাতেও কাজ হলো না। ঢেউ যেনো আরও উন্মত্ত হয়ে উঠেছে। আছড়ে পড়ছে নৌকার উপর। নৌকার সবাই খোদাকে ডাকছে, জোরে জোরে কালেমা পড়ছে। পানি জমে গেছে নৌকার পাটাতনে। একদিকে কাত হয়ে পড়লো। বোটম্যান শেষ চেষ্টা করলো নৌকা স্থির রাখতে। পারলো না।
দূরবর্তী সাগরের বুকে খুব জোরে জোরে চিৎকারের আওয়াজ শোনা গেলো অল্প কিছুক্ষন। ছাব্বিশজন মানুষের সম্মিলিত চিৎকার। ওর মধ্যে কয়েকটি শিশুর চিৎকারও ভেসে এলো। একটি শিশুর গলা আমাদের কানে খুব পরিচিত লাগলো। মা, বাঁচাও... মা বাঁচাও... খুব ছোট্ট একটা শিশুর আওয়াজ। কার চিৎকার? আয়লানের?
[আরও কথা রয়ে গেছে, লিখবো।]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন