ইতিহাসের প্রথম বই :
গ্রিক লেখক হেরোডোটাস ইতিহাসের জনক বলে স্বীকৃত। পৃথিবীর শুরু থেকে এই গ্রহটির সর্বত্র যা কিছু ঘটেছে সেসব কি আর বর্তমান মানুষ জানে? আজ যেমন আছে, প্রাগৈহাসিককালেও তেমনি দিনরাত ছিল। সকালে সূর্য উঠলেই দিনের শুরু আর সূর্য ডুবে গিয়ে অন্ধকার নামলেই রাতের শুরু। সেই আদিকাল থেকেই এই তো চলছে। আর সেই আদিকাল থেকেই মানুষ নামের প্রাণীটি যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, কিছু ঘটনা তো ঘটিয়েছে, নাকি? তারা দৈনন্দিন কাজ করেছে। খেয়েছে, ঘুমিয়েছে, জেগে উঠেছে, শিকার করেছে, অন্যান্য কাজে থেকেছে, হেঁটে চলে বেড়িয়েছে, দুঃখ পেয়েছে, আনন্দ করেছে। বর্তমানের মানুষ যা যা করছে, তারাও তাই করেছে। কিন্তু সে সবের কোনো লিখিত দলিল নেই। তারা কী কী করেছে, আমরা সেসব হয়তো ভেবে নিতে পারি। কিন্তু নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারি না। কারণ, সেসব কেউ কোথাও লিপিবদ্ধ করে যায় নি। তার মানে, সে সবের কোনো ইতিহাস নেই। নিশ্চিত করে বলতে গেলে যে প্রমাণ লাগে তা নেই। তার মানেই সে সব প্রাগৈতিহাসিক।
ইতিহাসের আগের ঘটনা। বিক্ষিপ্ত কিছু নিদর্শন ছাড়া তাদের সম্বন্ধে আন্দাজ করারও কোনো উপায় নেই। আহা যদি আদিকাল থেকেই লেখার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে ভেবে দেখো, আমরা আরো কত কিছুই জানতে পারতাম। মানবসভ্যতার ধারাবাহিক অগ্রগতি জানতে হলে লিখিত দলিল থাকাটা খুবই জরুরি। আর এই জরুরি কাজটি হেরোডোটাস শুরু করেছিলেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের কোনো এক সময়ে তাঁর জন্ম হয়েছিল। হেরোডোটাস একটি বই লিখেছিলেন তার নাম ছিল হিস্ট্রি। এই বইয়ে তিনি গ্রিক ও পারসিয়ানদের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল সেই যুদ্ধের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করে গেছেন।
উত্তরকালে যেসব মানুষ পৃথিবীতে বসবাস করবে, তাদেরকে তাদের জন্মের পূর্বকালে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ দেয়ার ইচ্ছা নিয়েই তিনি এই কাজটি করেছিলেন। ইতিহাসের বর্তমান অর্থ মাথায় রেখেই তিনি ঐরংঃড়ৎু লিখেছিলেন বলে মনে করা হয়। চলমান ঘটনার সংরক্ষণই ইতিহাস। আর হেরোডোটাসের-ই তার প্রথম সচেতন প্রয়াস।
তাঁর বইয়ের শুরুতেই হেরোডোটাস বলেছেন, মানুষ পৃথিবীতে যা যা করছে, যা যা ঘটাচ্ছে সেসব স্মৃতি পৃথিবী থেকে যাতে মুছে না যায়, সে জন্যই আমি আমার পর্যবেক্ষণ ও অনুসন্ধান লিপিবদ্ধ করলাম। গ্রিক অথবা কোনো বিদেশীর সুকীর্তির জয়গান যেন অনাগত কালের মানুষ করতে পারে। তাদের মহৎ কর্মকে যেন কেউ ভুলে না যায় সেই জন্যই এই যুদ্ধের বিবরণ, যুদ্ধেলিপ্ত মানুষ এবং যুদ্ধের কারণ লিখে রাখলাম।
তাহলে, এখান থেকেই যে আনুষ্ঠানিকভাবে ইতিহাসের সংরক্ষণ বা দলিল রাখা শুরু একথা বলা যায়। এই বইয়ে ইতিহাসের কথা বলা হয়েছে গল্পের ঢঙে। গল্প করতে গিয়ে সংলাপ ব্যবহার করতে হয়েছে। এর মধ্যে যেমন আছে সুখের কথা, আনন্দ-ফুর্তি, হাসি-তামাশা, তেমনি আছে বিষন্ন বিষাদ, দুঃখগাথা।
পরিব্রাজক হিসাবে হেরোডোটাস বিখ্যাত ছিলেন এবং সুবিখ্যাত ছিলেন ভূগোলের পণ্ডিত হিসাবে। তাঁর দুই চোখের তীক্ষè দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়া সহজ ছিল না।
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অথবা যত অকিঞ্চিতকরই হোক ঘটনা, তাঁর চোখে ধরা পড়তোই। মানবজাতির ব্যাপারে হেরোডোটাসের আগ্রহ ছিল অসীম। সে তাঁর কাছের মানুষই হোক, আর দূরের মানুষ হোক। জাত-পাত, বড়-ছোটর ভেদাভেদ তাঁর কাছে ছিল না। আর ছিল না বলেই মানুষের গভীরে প্রবেশ করে সত্য বের করে আনতে পারতেন। সত্যনিষ্ঠ ছিলেন বলে তাঁর লেখা পড়ে যেমন আনন্দ পাওয়া যায়, তেমনি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ইউরোপীয় লেখকদের মধ্যে হেরোডাটাসই প্রথম ঝরঝরে চাঁছাছোলা গদ্য লেখেন। গদ্যের এই ধারাই ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিক।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন