শুক্রবার, ১০ জুলাই, ২০১৫

বিশ্বসেরা আদর্শ বালক

মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
নিত্য দিনরাতের হয় আনাগোনা। বনের সুরভি ফুলে মুখরিত হয় চিত্ত আল্পনা। আঁধার লুকোয়, আলোর আগমন ঘটে। ফুল ফোটে। নদী উদ্বেলিত হয় প্রবহমান স্রোতে; হৃদয় আকৃষ্ট হয় তার মনোমুগ্ধকর কলকল প্রতিধ্বনিতে। পাখি গান করে। পর্বত চিরে ঝরনা ঝরে। চিত্রক প্রকৃতির চিত্র আঁকে। কবি রচনা করে কবিতাÑএ সবই হলো পৃথিবীর নিয়মিত বিধান। আর এ বিধান থেকেই আমরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে শিখছি। তাইতো অবলীলায় কবির ভাষায় বলতে পারি, ‘পৃথিবীটা হলো শিক্ষাঙ্গন’। শিক্ষার এ ধারায়ই কোনো মহামনীষীর উত্তম আদর্শ অনুসরণ করে মানুষ হতে পারে আদর্শবান, আপন জীবন গড়তে পারে উজ্জ্বলময় এক অতুলনীয় জীবনে, বাল্যে হতে পারে একজন সেরাদশ আদর্শ বালক, আর নৈতিকতায় এক গরিষ্ঠ নৈতিক, কর্মজীবনে পদার্পণ করে হতে পারে সমাজের যোগ্যনেতা এবং শিষ্টাচারে আদর্শ শিষ্টাচারক।
শৈশবকাল থেকেই শিষ্টাচারিত্ব, নৈতিকত্ব, আদর্শতা, ও ভদ্রতাসহ নানাবিধ গুণাবলিতে কারও শেখানো বৈ স্বয়ংসম্পন্নরূপে গুণান্বিত হয়ে যৌবনে পদার্পণ করেছেÑপৃথিবীতে এমন শিশুর জন্ম যেহেতু খুবই কম, সেহেতু যে শিশুর চরিত্র মাধুর্য তদুপরি শিক্ষা ছাড়াই যার জগদ্বাসীর কাছে রয়েছে বেনজীর উপমা, যার নজীর ইতিহাসের পাতা পল্ল¬বিত, এসব গুণাবলীয়মান ব্যক্তিবর্গের ব্যানারে অন্যতম ছিলেন আমাদের প্রিয়নবী বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত হজরত মুহাম্মদ সা.। যার শুভাগমনে এ পৃথিবী হয়েছে গর্বিত, যার পদধূলিতে ধন্য হয়েছে গোটা আরব, মুক্তি পেয়েছে গোলামেরা আপন পশুতুল্য মনিবের গোলামিত্ব হতে, ভূলুণ্ঠিত হয়েছে আঁধার যুগের পূণ্যকে কলুষতুল্য সব আঁধার কালিমা। যার সংস্পর্শে কাফেররা পরশ পাথরের মতো গড়ে উঠেছে মহামানবে, ভূ-খণ্ড ভরে গেছে দীনে-ইসলামের সুশীতল ছায়াতুল্য আদর্শ জীবনবিধানে। শুধু কী তাই! বরং যার বাল্যেই প্রকাশ পেয়েছিলো অসংখ্য অলৌকিক মুজেজা। ১৯৮৯ সালের ২২ আগস্ট অক্সফোর্ড ইসলামিক সেন্টারের আহ্বানে সেন্টার পার্ক রোড হলে এক সুনির্বাচিত নাগরিক সমাবেশে আরব, আফ্রিকা ও পাশ্চাত্যের প্রতিনিধিত্বপূর্ণ অসাধারণ উপস্থিতিতে সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. ‘ইনসানিয়াত কে মুহসিনে আজম সা. আওর শরীফ ও মুতামাদ্দিন দুনইয়া কা আখলাকি ফরজ’ শিরোনামে রাসুল সা.-এর আদর্শের ওপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ দেন; যা আজও বিশ্বময় ঐতিহাসিক ভাষণ হিসেবে স্বীকৃত। সে ভাষণের মূল বক্তব্য ছিলো, ‘রাসুল সা. মানবজাতিকে মানবতার প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা শিখিয়েছেন। ভবিষ্যতের পথকে এ শিক্ষা এতোই উজ্জ্বল করেছে, যার প্রভা বহুশতাব্দি পর আজও মানব হৃদয়কে স্পর্শ করছে। মানব সভ্যতা বহুবার পাশ ফিরলেও তাঁর পয়গামের উপকারিতা অপরিবর্তিতই রয়েছে; বরং দিন দিন এর প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ইউরোপের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও সভ্যতা-বিশারদগণ ইসলামের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাবের স্বীকৃতি দিয়ে বলেন, সভ্য ও উন্নত বিশ্ব কোনোক্রমেই ইসলামের মহান পয়গম্বর সা.-এর অবদান ও অনুগ্রহের ব্যাপারে পরাক্সমুখ হতে পারে না।’
রাসুল সা. তারুণ্যে যেমন ছিলেন একজন দর্পণ রাষ্ট্রনায়ক, তেমনি বাল্যে ছিলেন অতুলনীয় এক শিষ্টাচারক। তাঁর শৈশব-কৈশোরের উপমা, আমাদের চূড়ায় অবস্থিত তারকারাজি। শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী লেখেন, ‘যদি তুমি আদর্শ বালক হতে চাও, তাহলে মহানবী সা.-এর বাল্যজীবনের প্রতি দৃষ্টি রাখো।’ এমনকি তিনি নিজেও বলে গেছেন, ‘চারিত্রিক উৎকর্ষের পূর্ণতা বিধানের লক্ষ্যেই আমি প্রেরিত হয়েছি।’ এ কারণেই কবি আল্লামা ইকবাল তাঁর শানে বন্দনা গেয়েছেনÑ‘উম্মি উপাধিপ্রাপ্ত নবীর সজীব শ্বাসের ছোঁয়ায় মরু আরবের তপ্ত বালুকণায় সৃষ্টি হয় গোলাপ ও লালা ফুলের অপরূপ কানন। তাঁরই পবিত্র ক্রোড়ে লালিত হয় আজাদির চিন্তাচেতনা। বলতে গেলে আজকের পৃথিবীর সকল উন্নতি-অগ্রগতির পেছনে রয়েছে তাঁর মহান অতীতের অবদান। মানব জাতির মৃতবৎ দেহে সৃষ্টি করলেন তিনি প্রাণস্পন্দন, উন্মোচন করলেন তার সুপ্ত প্রতিভার অবগুণ্ঠন, আর আবিষ্কার করলেন তার প্রকৃতিগত নৈপুণ্য। তাঁর হাতে সকল বানোয়াট খোদার পতন ঘটে। তাঁর বদান্যতায় শুকিয়ে যাওয়া বৃক্ষশাখা সুশোভিত হয় পত্র-পল্লব ও ফল-ফুলের সমারোহে।’
তাঁর বাল্যজীবনের অনুপম আদর্শ বর্ণনা করতে গিয়ে সিরাতে মোগলতাই গ্রন্থকার লেখেন, ‘তিনি যখন দুধমা হজরত হালিমাতুস সাদিয়া রা.-এর দুধ পান করতেন, তখন ডান স্তন গ্রহণ করতেন। কারণ বাম স্তন গ্রহণ করতেন তাঁর দুধভাই আবদুল্ল¬¬াহ।’ সমবেদনার ক্ষেত্রেও তাঁর কোনো জুড়ি ছিলো না। তিনি যেকালে হজরত হালিমা রা.-এর তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন, সেকালের একদিনের কথা। দুধভাই প্রতিদিনের মতো সেদিনও গিয়েছিলেন মাঠে বকরি চরাতে। ঘরে দুধ ভাইকে দেখতে না পেয়ে তিনি এর কারণ জিজ্ঞেস করলেন। হজরত হালিমা রা.-বললেন, ‘সে বকরি চরাতে গেছে’। তিনি বললেন, ‘পরবর্তীতে আমাকেও তাঁর সঙ্গে পাঠাবেন।’
বাল্যজীবনে তাঁর একাগ্রচিত্তেরও উপমা মেলে ‘খাসাইসুল কুবরা’ গ্রন্থের উদ্ধৃতি থেকেÑ‘সেকালে আরবের বালকেরা মূর্তিপূজা ও জুয়াখেলা ইত্যাদি খেল-তামাশায় সদা লিপ্ত থাকতো। অপরদিকে তাদের সঙ্গে খেল-তামাশায় লিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, কখনও তিনি মিশতেনও না। অধিকাংশ সময় নিজ গৃহে একাকীবস্থায় কাটাতেন। খাবার মজলিসেও বাল্যবয়সে তাঁর শিষ্টাচারিত্ব ছিলো লক্ষণীয়। স্বগোত্রীয় বালকেরা যখন খেলাধূলা শেষে পানাহারের জন্য নিজ নিজ গৃহে আসতো, তখন তারা উচ্চৈস্বরে হৈ চৈ করাকে পছন্দ করতো। তাদের নিত্যদিনের অভ্যাস ছিলো, তারা খাবার মজলিসে আপন পূর্বপুরুষদের মূর্খ বর্বরতাময় প্রথার অনুকরণ করতো। কিন্তু তিনি ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীতমুখি বালক।
ছেলেবেলা থেকেই তিনি মহিলাদের সঙ্গে পর্দা রক্ষা করে চলতেন। নিজের ওপর দেখা দেয়া শরিয়তে নিষিদ্ধ, এমন কারও সঙ্গে কথা বলা তো দূরের কথা, সাক্ষাতও করতেন না। এমনকি যখন বাল্যে স্বীয় চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে লালিত ছিলেন, তখন আবু তালিবের স্ত্রী (চাচির) সঙ্গে একই ঘরে বসবাস করা সত্ত্বেও কখনও তিনি তাঁর মুখোমুখি হতেন না। বড়ো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তিনি যখন প্রবীণ, তখন সেসব সাহাবায়েকেরাম তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও একান্ত সহচর ছিলেন; যারা তাঁরই সঙ্গে বাল্যজীবন কাটিয়েছেন। এর দ্বারা স্পষ্টত প্রতীয়মান হয়, বাল্যবয়স থেকেই তারা তাঁর অনুপম চরিত্র ভালোভাবে অবলোকন করে পৌঢ়ে তাঁরাই তাঁর একান্ত সহচর হয়েছিলেন।
জন উইলিয়াম ড্রেপার ইউরোপের মানসিক ও জ্ঞানগত ইতিহাসের আনুষঙ্গিক আলোচনায় বলেন, ‘৫৬৯ খৃস্টাব্দে ঔঁংঃরহরধহ-এর মৃত্যু ঘটে। এর চার বছর পর আরবের মক্কা নগরীতে সে ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটলো, যিনি মানবজাতির ওপর সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।’ তিনি লেখেন, ‘মুহাম্মদের মাঝে সেসব গুণাবলির সমাবেশ ঘটেছিলো, যেগুলো একাধিকবার দুনিয়ার রাজত্বসমূহের ভাগ্যনির্ধারণী ভূমিকা পালন করেছে।’ এ কারণেই দুশো বছর পূর্বে টমাস কার্লাইল সকল নবীর মধ্য থেকে হজরত মুহাম্মদ সা.-কে নিজের আদর্শ নির্বাচন করেছিলেন। সর্বোপরি বিংশ শতাব্দির শেষভাগে এসে মাইকেল এইচ হার্ট পৃথিবীর ইতিহাসে মানব সভ্যতার ওপর সর্বাধিক কৃতিত্বের স্বাক্ষর স্থাপনকারী অনন্য ব্যক্তিদের তালিকায় বালক মুহাম্মদ সা.-কেই সর্বশীর্ষে স্থান দিয়েছেন।’
পৃথিবীর বুকে বিরল ও অতুলনীয় এই বিশ্বসেরা বালক সা.Ñএর চরিত্র ঘিরে হজরত দাউদ বিন হুসাইন রা.-এর একটি প্রসিদ্ধ বর্ণনা রয়েছেÑ‘আরবেরা বলেছে, ‘রাসুল সা. বিশেষ এক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বাল্যজীবন থেকে যৌবনে পদার্পণ করেছেন। তিনি নিজ গোত্রের মাঝে সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। প্রতিবেশীর সবচে বেশি খোঁজখবর রাখতেন। ধৈর্যশীলতা, সহনশীলতা, সত্যবাদিতা এবং আমানতদারিতায় তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সবধরনের অপকৃষ্টতা থেকে অনেক দূরে ছিলো তাঁর অবস্থান।’
মালিবাগ জামিয়া, ঢাকা

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন