বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৫

আমার জীবনে হযরত শাইখুল হাদীস রহঃ

মাওলানা মামুনুল হক সাহেব
আব্বাজান রহঃ ও রমযানে তারাবীহর স্মৃতি
( আমার জীবনে হযরত শাইখুল হাদীস রহঃ শিরোনামে একটা ধারাবাহিক লেখা শুরু করেছিলাম গত… …… ৷ ছয়টি পর্ব লেখার পর আর লেখা হয় নি ৷ দীর্ঘ বিরতির পর আবার লেখায় হাত দিলাম)
…………………………
হিফজুল কুরআনের প্রতি আব্বাজান হযরত শাইখুল হাদীস রহঃএর অনেক বেশি দুর্বলতা ছিল ৷ শিশুকালে বাড়ীর কাছে ব্যবস্থা না থাকায় তিনি নিজে হাফেজ হতে পারেন নি ৷ হাফেজ না হলেও পবিত্র কুরআনের অনেক অংশ তাঁর মুখস্ত ছিল ৷ দীর্ঘ কেরাতে ক্বিয়ামুল্লাইল পড়ার মা'মূল ছিল জীবনভর ৷ নিজে হাফেজ হতে না পারার আক্ষেপটা পুরন করেছেন সন্তানদেরকে হাফেজ বানিয়ে ৷ বিশেষ করে মেয়েদের হেফজ পড়ানোকে তিনি একটা আন্দোলনরূপে গ্রহন করেছিলেন ৷
বর্তমানে তো মেয়েদের হেফজের অনেক ব্যবস্থা হয়েছে ৷ কিন্তু আব্বাজান রহঃ যে সময়ে আমাদের বোনদেরকে হাফেজা বানিয়েছেন এবং অন্যদেরকেও উদ্বুদ্ধ করেছেন, সেই সময়ে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না ৷ তিনি বলতেন, মেয়েদেরকে হিফজুল কুরআন শিখিয়ে দেয়া তাদের জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার ৷ মেয়েরা হাফেজা হলে ঘর কুরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে যায় ৷ ঘরে কুরআন তেলাওয়াতের পরিবেশ কায়েম হয়ে যায় ৷
সাধারণ মানুষের মধ্যে এমনকি অনেক আলেমদের মধ্যেও এমন ধারনা বদ্ধমূল দেখা যায় যে, মেয়েদেরকে হাফেজা বানালে সাংসারিক কাজের ঝামেলায় তারা হেফজ ধরে রাখতে পারবে না ৷ আব্বাজান মরহুম রহঃ এই ধারনারও খুব কঠোরভাবে বিরোধিতা করতেন ৷ তিনি তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্ত দিয়ে বলতেন যে, আমার মেয়েদের কুরআন ইয়াদ ছেলেদের চেয়ে বেশি ৷ কারণ, নেককার মেয়েরা সাধারণত অনেক ইবাদতগুজার হয় ৷ তাদের কুরআন হেফজ থাকলে নামাযে খুব বেশি তেলাওয়াতের সুযোগ হয় ৷
আব্বাজান রহঃ হিফজুল কুরআনের প্রতি এই বিশেষ আগ্রহের কারণে খতমে তারাবীহকে খুব গুরুত্ব দিতেন ৷ আর তাই স্বাভাবিকতার বিপরিতে মেয়েদের এবং নাবালেগ ছেলেদের ইমামতিতে খতমে তারাবীহের ব্যবস্থার প্রচলন রয়েছে আমাদের পরিবারে ৷হেফজ শেষ হওয়ার পর ছেলে মেয়ে সকলের জন্য তারাবীহতে খতম শোনানোকে বাধ্যতামূলক করে দিতেন ৷
ফিকহে হানাফীর বেশ কিছু মাসআলায় হযরত শায়খ রহঃএর ভিন্ন রায় ছিল ৷ তার মধ্যে একটি হল মহিলা মানুষের ইমামতিতে মহিলাদের জামাতে নামায ৷ শাফেয়ী মাযহাবে মেয়েদের জন্য মেয়দের ইমামতি ফরজ ও নফল উভয় ক্ষেত্রেই বৈধ ৷ পক্ষান্তরে হানাফী ও মালেকী মাযহাবমতে তা মাকরূহ, তবে নামায হয়ে যাবে ৷ মেয়েরা নামায পড়ালে পুরুষদের মতো কাতারের সামনে নয়, বরং কাতারের মধ্যখানে দাড়াবে ৷ হানাফী মাযহাবেও মাসআলা একই রকম ৷
হযরত আয়শা রাঃ ও উম্মে সালামা রাঃ মেয়েদের নামাযে ইমামতি করেছেন ৷ ইমাম শাফেয়ী রহঃ ও বায়হাকী রহঃ হাসান সনদে বিষয়টি বর্ণনা করেছেন ৷
আব্বাজান রহঃ কুরআন হেফজের প্রয়োজনে বাসায় মেয়েদের ইমামতিতে শুধু তারাবীহর জামাতের এন্তেজাম করতেন ৷ এখনো আমাদের বাসায় সেই ধারা অব্যাহত আছে ৷
তারাবীহর ক্ষেত্রে নাবালেগ ছেলেদের দিয়ে ইমামতিকেও তিনি জায়েয মনে করতেন ৷ ফিকহে হানাফীর ফাতাওয়ার কিতাবে তার অনুমতি না থাকলেও আকাবিরদের আমল দিয়েই তিনি দলীল দিতেন ৷ আকাবিরদের আমলকে তিনি অনেক শক্তিশালী ও অনুসরণীয় বিষয় বলে মনে করতেন ৷ দেওবন্দের ছাত্তা মসজিদে হযরত হুসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ কাসেমী খান্দানের কোনো এক নাবালেগ বাচ্চার ইমামতিতে তারাবীহ পড়তেন ৷
কুরআন হেফজ করিয়েই দায়িত্ব ক্ষান্ত করেন নি আমাদের আব্বা হযরত শায়খ রহঃ ৷ বরং সেই হেফজ ইয়াদ রাখার জন্য সব রকম চেষ্টা ও পদক্ষেপও গ্রহন করেছেন ৷ আমাদের ভাইবোনদের হেফজের জন্য একজন অন্ধ হুজুর ঠিক করেছিলেন ৷ মাহবুব ভাই, মাহফুজ ভাই, আমি ও তিনবোন আমরা এই "না বীনা " হুজুরের কাছে পড়েছি ৷ আমাদের বড়বোন দিলরুবা আপার বিয়ের পরও আব্বা তার হেফজ ইয়াদের ব্যাপারে বে-খবর হন নি ৷ বরং ঐ অন্ধ হুজুরকে ঠিক করেছিলেন নিয়মিত বাসায় এসে পড়া শুনে যাওয়ার জন্য ৷ আমাদের সবার বড়ভাই মাহমুদ ভাইকেও ওনার বিয়ের পর ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ততার মধ্য দিয়ে হুজুরকে পড়া শোনানোর নিয়ম করে দিয়েছিলেন ৷ ভাবলে আবেগে আপ্লুত হই, কেমন দায়িত্বশীল পিতা ছিলেন তিনি আর হিফজুল কুরআনের প্রতি কেমন দরদই না তাঁর ছিল!
আমার নিজের তারাবীহ নিয়েও রয়েছে অনেক সুখের স্মৃতি ৷ আমি আমাদের বাসার পাশের চাঁদতারা মসজিদে তারাবীহ পড়িয়েছি দীর্ঘদিন ৷ প্রায় ষোল সতের বছর ৷
আমাদের বাসার দুদিকের দুই মসজিদে তারাবীহ ছিল আমাদের দুই ভাইয়ের ৷ আমি ছিলাম চাঁদতারায় ৷ আর মাহবুব ভাই ফেরদৌসে ৷ গত তিন বছর হল, আমি দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি ৷ মাহবুব ভাই আছেন এখনও ৷
গোড়ার দিকে বেশ অনেক বছর আমি একাই বিশ রাকাত পড়াতাম ৷ ঐ সময় আব্বাজান রহঃ কয়েক বছর আমার পিছনে তারাবীহ পড়েছেন ৷ পরে অবশ্য ফেরদৌস মসজিদে পড়তেন ৷ ফেরদৌসের কমিটি আব্বাকে খুব মূল্যায়ন করতেন আর সকল বিষয়ে আব্বার নির্দেশনা নিতেন ৷ তারা আব্বাকে তারাবীহতে তাদের মসজিদে খুব করে চাইতেন ৷ আব্বাজান রহঃ মানুষের মহব্বতকে খুব কদর করতেন ৷ আব্বাকে নিয়ে চাঁদতারা মসজিদে তারবীহ সময়কার কিছু স্মৃতি অমর হয়ে আছে ৷ মনে দাগ কেটে আছে তাঁর কিছু শিক্ষাও ……………

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন