বুধবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫

দাঁড়ি ইসলামের একটি অন্যতম নিদর্শন

দাঁড়ি ইসলামের একটি অন্যতম নিদর্শন ও দায়েমী ছুন্নাত, যার মাধ্যমে মুসলিম ও অমুসলিম আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়। তাই অপরিচিত মৃতদেহের জানাজা ও দাফন-কাফন হবে কিনা- তা সাধারণতঃ দাঁড়ি ও খাতনা দেখে নির্ধারণ করা হয়। ইসলামী শরীয়তে একমুষ্টি পরমান লম্বা দাঁড়ি রাখা ছুন্নাতে মুয়াক্কাদা এবং হুকুমেমর দিক থেকে ওয়াজিব পর্যায়ভূক্ত। রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন: যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে মুহাব্বত করল সে যেন আমাকেই মুহাব্বত করল। আর যে আমাকে মুহাব্বত করল সে আমার সাথে জান্নাতে বসবাস করবে। -(তিরমিযী শরীফ, মেশকাত- পৃ: ৩০)
দাঁড়ি এক মুষ্টির কম রাখা বা একেবারে তা মুন্ডিয়ে সর্বসম্মতিক্রমে হারাম এবং কবীরা গুনাহ। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) দাঁড়ি রেখেছেন এবং উম্মতের প্রতি দাঁড়ি রাখার সাধারণ নির্দেশ প্রদান করেছেন। এ সংক্রান্ত তার অসংখ্য হাদীস প্রমান করে যে, দাঁড়ি রাখা ওয়াজিব এবং না রাখা হারাম। কারন, শরীয়ত প্রবর্তক কর্তৃক কোন বিষয়ের প্রতি সাধারন নির্দেশ হলে তা পালন করা ওয়াজিব এবং বিপরীত করা হারাম হয়ে যায়। এছাড়া সাহাবা, সালফে সালেহীন এবং ফুক্বাহাগণের দাঁড়ি রাখার নিরবচ্ছিন্ন আমল এবং তাদের বিভিন্ন উক্তিসমূহের দ্বারাও এক মুষ্টি পরিমাপ লম্বা দাঁড়ি রাখা ওয়াজিব এবং এর বিপরীত করা হারাম প্রমাণিত হয়। নিম্নে দাঁড়ি সম্পর্কিত কতিপয় হাদীস, সাহাবাগণের আমল ও ফুক্বাহাগণের উক্তিসমূহ উল্লেখ করা হল:
হাদীস শরীফে দাঁড়ির বিধান:
১. হযরত আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দশটি বিষয় সকল নবী রাসূলগণের সুন্নাত। তন্মধ্যে গোঁফ ছোট করা এবং দাঁড়ি লম্বা করা অন্যতম। -(মুসলিম শরীফ : ১২৯)
২. হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ তোমরা গোঁফ কাট এবং দাঁড়ি লম্বা কর, আর অগ্নিপূজকদের বিরোধিতা কর। -(মুসলিম শরীফ : ১২৯)
৩. হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ মুশরিকদের বিরোধিতরা কর, দাঁড়ি লম্বা কর, আর গোঁফ ছোট কর। -(বুখারী শরীফ : ৮৭৫, মুসলিম)
৪. হযরত আবু হুরায়রা (রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দাড়ি বাড়াও, গোঁফ কাট এবং এ ক্ষেত্রে ইহুদী- খ্রীষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করোনা। (মাসনাদে আহমদ)
৫. রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আমলঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর আমল দ্বারাও দাড়ি রাখার বিধান প্রমানিত হয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে যে, সাহাবী হযরত খাব্বাব (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-কে কেউ জিজ্ঞেস করেন, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কি জোহর ও আছর নামাযে কেরআত পাঠ করতেন? তিনি বললেনঃ হ্যা, পাঠ করতেন। লোকটি পুনঃ প্রশ্ন করেন, আপনি কিভাবে তা বুঝতেন ? তিনি বললেনঃ হুজুর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর দাড়ি মুবারকের দোলায় আমরা বুঝতাম যে, তিনি কিরআত পাঠ করছেন। -(তাহাবী শরীফ)
দাঁড়ি লম্বা রাখার সীমাঃ
রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অনুসরণে সাহাবা (রাদিয়াল্লাহু আনহু)-গণের আমল দ্বারা সুন্নাহ মোতাবেক দাঁড়ি এক মুষ্টি পরিমান লম্বা রাখার সীমার প্রমানিত হয়। যেমনঃ
১.হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন হজ্জ্ব বা উমরা আদায় করতেন, তখন স্বীয় দাঁড়ি মুষ্টি করে ধরতেন, অতঃপর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। -(বুখারী শরীফঃ ৮৭৫)
২. হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু স্বীয় দাঁড়ি ধরতেন, অতঃপর অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলতেন। -(মুসান্নাফ লি-ইবনি আবি শাইবাঃ ১১২)
দাঁড়ির ব্যাপারে ইমাম ও ফুক্বাহাদের ফতোয়া:
মুসলিম উম্মাহর সকল ইমাম ও ফুক্বাহাগণের গবেষণালব্ধ রায় হল-দাঁড়ি এক মুষ্টি পরিমান লম্বা রাখা ওয়াজিব। এর চেয়ে ছোট করা বা মুন্ডন করা হারাম। যেমনঃ
১. হানাফীঃ হানাফী মাযহাবের কিতাব শরহে মুনহাল ও শরহে মানজুমাতুর আদবের মধ্যে লিখেছেন, নির্ভরযোগ্য ফতোয়া হল দাড়ি মুন্ডানো হারাম।
২. মালেকীঃ মালেকী মাজহাব মতেও দাড়ি মুন্ডন করা হারাম। অনুরূপভাবে ছুরত বিগড়ে যাওয়া মত ছেটে ফেলাও হারাম। -(কিতাবুল ওবদা)
৩. শাফেয়ীঃ মাওলানা আশেকে এলাহী মিরাঠী রহ. তার প্রণিত “দাড়ি কী কদর ও কীমত” কিতাবে চার মাজহাবের ফক্বীহগণের মতামত শাফেয়ী মাজাহাবের প্রামান্য গ্রন্থ “আল ওবাব” হতে উদ্বৃত করেছেন : ইমাম ইবনুর রাফ’আ বলেন, ইমাম শাফেয়ী রহ. “আলউম্ম” কিতাবে লেখেন যে, দাড়ি কাটা হারাম।
৪. হাম্বলীঃ হাম্বলী মাজহাবের কিতাব “শাহহুল মুন্তাহা” ও “শরহে মুজ্জুমাতুল আদব” এর উল্লেখ হয়েছে যে, নির্ভরযোগ্য মত হল দাড়ি মুন্ডন করা হারাম।
৫. ইজমাঃ উম্মাতের সকল ফুক্বাহাগণও দাড়ি রাখা ওয়াজিব হওয়ার ব্যাপারে মাননীয় ইমামদের ইজমা (ঐকমত) বর্ণনা করেছেন এবং তাঁরাও সবাই এর সাথে একমত হয়েছেন।
দাড়ি কর্তনকারী আল্লাহ পাকের দুশমনদের মধ্যে গণ্য হওয়ার সম্ভাবনা:
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহ. নিজ রচিত “কিতাবুজ্জুহুদে” আকীল ইবনে মোদরেক সালামী হতে উদ্ধৃতি করেন যে, আল্লাহ জাল্লা শানুহু বনী ইস্রাইলের এক নবীর নিকট এই অহী প্রেরন করেন যে, তিনি যেন নিজ কওম বনী ইস্রাইলকে এ কথা জানিয়ে দেন যে, তারা যেন আল্লাহ তা’য়ালার দুশমনদের বিশেষ খাদ্য শুকরের গোশত না খায় এবং তাদের বিশেষ পানীয় অর্থাৎ শরাব(মদ) পান না করে এবং তাদের শিক্ল ছুরত (আকৃতি) না বানায়। যদি তারা এমন করে অর্থাৎ শুকরের গোশত খায়, বা মদ পান করে, অথবা দাড়ি মুন্ডায় বা ছোট করে (ফ্রেন্সকাট করে) অথবা বড় বড় মোচ রাখে, তা’হলে তারাও আমার দুশমন হবে, যেমন তারা আমার দুশমন। -(দালায়েলুল আসর)
কওমে লূতের নিন্দনীয় বৈশিষ্ট্য ও ধ্বংসের অন্যমত কারন:
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইবনে আসাকেরসহ আরো কতিপয় মুহাদ্দিস হযরত হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর এই মুবারক হাদীস বর্ণনা করেন যে, দশ প্রকার পাপে লূত সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছিল; তন্মধ্যে দাড়ি কাটা, গোঁফ বড় রাখা অন্যমত।
আল্লাহ সুবানুহুতা’'য়ালা আমাদের সকলকে দাঁড়ি রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন! যারা দাঁড়ি কেটে ছোট ছোট দাঁড়ি রাখি তাদেরকে শরিয়াতের হুকুম মোতাবেক এক মুষ্টি পরিমান লম্বা দাঁড়ি রাখার তৌফিক দান করুন! যারা এখনও দাঁড়ি রাখিনি তাদেরকে দাঁড়ি রাখার তৌফিক দান করুন! এবং যারা দাঁড়ি সম্পর্কে আজে-বাজে মন্তব্য করেন তাদের হেদায়াত দান করুন! আ-মী-ন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন