বৃহস্পতিবার, ১৩ আগস্ট, ২০১৫

প্রবাসীদের স্বজন কে বলছি........

আমার এক বন্ধু দীর্ঘদিন যাবত প্রবাসে আছে । সবার মতো আমিও ভাবতাম অনেক টাকা কামিয়ে সে বেশ সুখি। প্রবাসীদের ব্যাপারে আমরা সবাই এমনটাই ভাবি।
গতকাল দীর্ঘ সময় কথা হলো ওর সাথে। ওর মনের লুক্কায়িত কষ্টের কিছুটা ফিরিস্তি তুলে ধরলো আমার সামনে। হয়তো কষ্টগুলো হজম করতে পারেনি বলেই উগড়ে দিয়েছে। ওর বিবরণ:
:
দোস্ত ! দীর্ঘ দশ বছর ধরে বিদেশে চাকরি করছি। এই দশ বছরে অনেক ঝড় মোকাবেলা করতে হয়েছে আমাকে। আকামা করতে বিলম্ব হওয়ায় কখনো জেলেও যেতে হয়েছে। কিন্তু পরিবারের মানুষগুলো পেরেশান হবে ভেবে তাদের জানাইও নি। জানালেই বা তারা কী করতে পারতো? হয়তো কিছু সমবেদনা পেতাম। শুধু সমবেদনা কি পারতো আমার কষ্টকে দূর করতে ?
:
দোস্ত! প্রবাসে আছি। বেতনও বেশ ভালোই। কিন্তু তাতে কি? মাস শেষে বেতন হাতে আসার আগেই অনেকগুলো আবদার এসে জমা হয়। তার এটা নেই। ওর ওটা লাগবে। অমুকের জামা চাই। তমুকের এতো টাকা চাই। সবার আবদার মিটাতে গিয়ে হাতে সারা মাসের খাবারের টাকা ছাড়া প্রায়সই কিছুই থাকে না। অনেক সময় অসুস্থ হলে চিকিৎসার টাকাটাও অন্যকারো কাছ থেকে ধার করতে হয়। আমাদের কি স্বাধ-আহ্লাদ বলে কিছু থাকতে নেই?
:
দোস্ত ! তোরা দশ বারো হাজার টাকা বেতন পেলেও নিজের স্বাধীন মতো খরচ করতে পারিস। কিন্তু আমরা তা পারি না। কোন মাসে টাকা কম পাঠালে জবাব দিহি করতে হয় আমাদের। তোরা মাস শেষে আপন মানুষগুলোকে কাছে পেয়ে মনে তৃপ্তি অনুভব করিস। আমরা তাও পারি না। বছরের পর বছর আপন মানুষ থেকে দূরে থাকাযে কতোটা যন্ত্রনার তা তোকে বোঝানো যাবে না।
:
এর পরও সব কিছু মেনে নিয়ে আপন মানুষগুলো ভালো থাকুক এই আশায় প্রবাসে পড়ে থাকি। কখনো যদি কারো চাওয়া পূরণ করতে বিলম্ব হয় শুরু হয় অকথ্য গালি-গালাজ আর মিথ্যা অপবাদ ও অভিমানের ফুলঝুড়ি।
:
দোস্ত ! সত্য বলতে কি জানিস? কুকুরের চেয়েও নিকৃষ্ট আমাদের জীবন। কোনো স্বাধীনতা নেই। সেই সকালে ঘুম থেকে ওঠে ছাইপাঁস কিছু একটা মুখে পুড়ে হাজিরা দিতে হয় ফার্মে। সারাদিন কাজ শেষে শ্রান্ত শরিরটা যখন একটু বিশ্রাম চায় তখন মেসে ফিরে রান্না করতে বসা। সারা বছর এক রুটিন। কোন ভিন্নতা চলবে না। যান্ত্রিক জীবন আমাদের।
সবচে‘ কষ্টের বিষয় হলো আমার দুঃখগুলো পরিবারের মানুষগুলো বুঝতে চায় না। সবার একটাই কথা আরো চাই ! আরো চাই!! কেউ বুঝতেই চায় না আমরাও মানুষ ! আমাদেরও কোন চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে। ভবিষ্যত কোন স্বপ্ন থাকতে পারে।
:
শেষের কথাগুলো বলতে গিয়ে ওর গলাটা কেমন ভিজে ওঠেছিলো। কোন রকম শান্তনার বুলি শুনিয়েই চুপ থেকেছি। আমি ওকে কোনো শান্তনার প্রলেপ দিতে পারি নি। গত মাস দু‘য়েক আগে ওর একটা ছেলে সন্তান হয়েছে। ছেলেটাকে এক নজর দেখার জন্য যন্ত্রনায় ছটপট করছে ও। কিন্তু বাবার বারণের কারনে বাড়ি আসতে পারছে না।
:
এমন হাজারো প্রবাসী তাদের প্রবাস জীবনে শুধু আপন জনের সুখের কথা ভেবে নিজেকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দিচ্ছে। আর আপন জনেরা নিজেদের স্বার্থের কারনে ছেলেকে কিংবা ভাইটিকে প্রবাসের ঘোলাপানি খাইয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। তাই প্রবাসীদের স্বজনের প্রতি আমার আবেদন একটু সদয় হোন তাদের প্রতি। তাদের কষ্টকে একটু বুঝতে শিখুন। তাহলে হয়তো প্রবাসের নিঃসঙ্গ জীবনেও তারা কিছুটা হলেও প্রশান্তি অনুভব করবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন